প্রিয় হুমায়ুন আহমেদ স্যার,

আপনি এ চিঠি পড়বেন না, জানি। তারপরও আপনার রেখে যাওয়া অগুনতি ভক্ত আর পাঠকের কথা ভেবে এবং আপনার দেয়া জাতীয় দৈনিকে সাক্ষাৎকার (গত শুক্রবার,২৭ তারিখে ছাপানো,এখানে) পড়ে, এ চিঠি আর না লিখে থাকতে পারলাম না। প্রথমেই, আমার অযাচিত ভুলের জন্য ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি,স্যার।

বালিশের তলায় গুঁজে রেখে রাত জেগে আমাদের বেড়ে উঠা শশধর দত্ত, ডাঃ নীহার রঞ্জন গুপ্ত আর কাজী আনোয়ার হোসেন এর বই পড়ে। রহস্য আর রোমাঞ্চ দু’টোই- তখন আমাদের তারুণ্যের সাথী। একদিন “নন্দিত নরকে” গিয়ে আপনাকে যখন পেলাম, অদ্ভূত এক ভালোলাগায় ভরে গেল মন। বাবা মার ভয়ে বালিশের তলায় গুঁজে রাখা বই, আপনার নান্দনিক ছোঁয়ায় এক ঝটকায় বালিশের তলা থেকে বেরিয়ে পড়ল পড়ার টেবিলে, ঘুরতে থাকে আমাদের হাতে হাতে,এক বন্ধু থেকে আরেক বন্ধুর বাসায়,আমাদের আড্ডায়। ভাললাগার তর্কে ঝড় উঠে বন্ধুত্বে। কখনো কখনো,বইয়ের দোকানে ভিড়-বাট্টায় উঁকি মেরে খুঁজি ফিরি আপনাকে। হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখি, মলাটে প্রেমের সুগন্ধ পাই। খুশিতে ভরে উঠত আমাদের তারুণ্য। এভাবে,বেশ কিছু সময় কেটে গেল । তারপর, এক সময় এল ”মোহ আর মাদকতার সমাপ্তি”। কিছু পরে, আরো বড় হয়ে অনুসন্ধিৎসু মনে নতুন কিছু খুঁজে পেতে চেষ্টা করে, বুঝতে চাইছে অন্য ধরণের কিছু, গৎবাঁধার বাইরে। আস্তে আস্তে একদিন জানলাম, প্রেম আর ভালবাসা এসবের ভাবালুতা কোনটাই আর নেই মনের কোণে জমা। কঠিন বাস্তবতা তখন কড়া নাড়ছে মনের উঠানে। বুঝতে পারি, ভাবাবেগে টেনে নিয়ে যাচ্ছে না হিমুর হলদে পান্জাবী। চোখে মুখে লালের প্রতি মুগ্ধতা ছিলো একদল লোক দেয়াল ভাংগার পরেও। লাল ছেড়ে হলুদে ভালোবাসা – সেটা কেন জানি সেদিন সায় দেয়নি মন। সে বিশ্বাস এখনো টিকে আছে স্যার, ”একদিন ঝড় থেমে যাবে, পৃথিবী আবার শান্ত হবে”।

স্যার,আমাদের মত ছোটদের কথা, জানি আপনি পড়বেন না। কিন্তু, তারপরেও কিছু না লিখে পারি না। কারণ একটাই। দায়টা নিজের,একজন মানুষের। মনে পড়ছে না কোথায় যেন বলেছেন, “কোন উদ্দেশ্য নিয়ে আপনি লেখেন না,লেখেন আপনার নিজের আনন্দের জন্য। আপনার কোন দায়িত্ব নেই”। স্যার, এটাও কি সম্ভব? মানুষ হিসেবে আমাদের কি কোন সামাজিক দায়-দায়িত্ব নেই? আর বিশেষ করে, আপনি যখন বলেন তখন তো সেটা স্রেফ একটা ঘরোয়া কথা নয়, সেটা মুহুর্তে ছড়িয়ে পড়ে সমষ্টিতে। আপনার কথার হাজারো দাম অন্যের কাছে। তাহলে, কেন লিখতে গিয়ে হাজার হাজার তরুণদের হলুদ পান্জাবীর আবিলতায় ভাসালেন? কেন হাজার হাজার দর্শকের চোখ সিনেমা আর টিভির পর্দায় সাঁটালেন? কেন, মানুষকে হাসালেন,কাঁদালেন? স্যার, আপনি আমাদের ছেড়ে চলে যাবার পরেও আজো ঘুরে ফিরে এসব প্রশ্ন আসে,আসে আপনার দেয়া ইন্টারভিউ পড়ে। স্যার, আপনি প্রেমের সংজ্ঞা দিলেন। কথার বাহুল্যে, কি বুঝাতে চাইলেন- বুঝতে পারলাম না। একজন মানুষ প্রেমে কিভাবে পড়বে – সেটা সে মানুষের ব্যক্তিগত অনুভূতির ব্যাপার। কার কাকে ভালো লাগছে, সেটা প্রত্যেকের একান্ত ভাবনা। সুন্দর ও অসুন্দর – এ বিষয়টা প্রত্যেকের ব্যক্তিগত অনভূতির অনুরণন। কোন মেয়ে যদি রুচি আর ব্যক্তিগত সৌন্দর্যে আকর্ষনীয় হয়ে উঠে- কি এসে যায় খাটো আর বাইরের কুৎসিতায়? আপনি বলেছেন, ”অত্যন্ত রূপবতী কাউকে দেখলেই প্রেমে পড়ার সম্ভাবনা তোমার বেশি”। স্যার, আপনার এ অদ্ভূত যুক্তির রহস্য ধরতে পারিনি। অত্যন্ত রূপবতী কাউকে দেখলেই কি প্রেমে পড়তে হবে? আসলে কি সব মানুষের তাই হয়? নিজেকে অনেক প্রশ্ন করে কোন সদুত্তর খুঁজে পাইনি, নিজেকে মেলাতে পারিনি আপনার বক্তব্যে। কি জানি,আপনার কাছে প্রেমের সংজ্ঞা হয়তঃ অন্যরকম!

স্যার, আপনি আপনার মামার গল্প বললেন,বললেন আপনার মুহসীন হলের কথা, শহীদ মিনারে পাশে দেখা লোকটার কথা। বিনীত প্রশ্নে জানাই, এসবে কি রহ্স্য লুকিয়ে আছে? কি জানাতে চান আপনি- পাঠকদের? অলৌকিক ঘটনার বয়ান দিয়ে কি বুঝাতে চাইছেন আপনি? দু’হাত জোড়ে বলছি, আধুনিক মানুষের কাছে এসব বলে নিজেকে আর হাস্যকর করে তুলবেন না, স্যার। আজ আমাদের ছেড়ে অনেক দুরে চলে গেছেন আপনি। তবুও, আপনাকে একটা কথা সবিনয়ে জানিয়ে রাখি স্যার,আজকালকার এই আমরা সব কিছুই যুক্তির আলোয় দেখতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। শুধু কি তাই স্যার, প্রবীর ঘোষের লেখা পড়ে সব অলৌকিক বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছি বহু আগেই। সে কারণেই বোধহয়, পেসাবে কোন মেয়ের কথা শুনতে পাই না, ভয়ংকর সাপের সামনে পড়লে আল্লাহ ভুলে ভয়ে পালাই বা লাঠি নিয়ে তাড়া করি, কিংবা শহীদ মিনারের পাশে দাড়িওয়ালা লোক দেখি ঠিকই ..কিন্তু কোন মহাপুরুষ ভেবে ভয় পেয়ে কাউকে জড়িয়ে ধরি না।

চিঠি বেশি দীর্ঘ করব না,স্যার। আর একটা কথা না বলে শেষ করতে পারছি না। আপনি নাইকন ক্যামেরার কথা বলেছেন..ঈশ্বর বিশ্বাসের কথা বলেছেন। প্যালের ঘড়ির কথা আগেই পড়েছিলাম। আপনি ঘড়িকে শুধু ক্যামেরা বানালেন,পুরানো বোতলে নতুন মদ ভরলেন। আপনি এভাবেই পরিবেশন করতে চান – যা আপনার ভক্তকূলে বিশ্বাস জাগিয়ে তোলে। বিনীতভাবে বলি, প্যালের ঘড়ি বহু আগে মরে ভূত হয়ে গেছে। একবিংশ শতাব্দীতে নতুন করে আপনার নতুন ভূতের আমদানি- কোন সুস্হ মানুষ মেনে নেবে না। যুক্তিবাদীরা তো নয়ই। আপনার কাছে এমবিএস পাস করা ডাক্তার থেকে হাতুড়ে বড় হয়ে উঠে, বিবর্তনের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাকে অস্বীকার করে ভাবালুতায় ভাসাতে চান, জিকির রত আপনার মামা নিজেকে দেখতে পান – এসব আজগুবি কথায় বিশ্বাস করতে বলেন আমাদের,পাঠকদের? আপনি খালি গায়ে লুঙি পরা লোককে যত খুশি খুঁজুন, কিন্তু একটা কথা স্যার, আমরা সে সব গল্পে বিমোহিত হতে পারিনি,বিশ্বাসে নিজেদের ভাসাতে পারিনি- ”কিছু অলৌকিক ঘটনার বয়ানে”। পারিনি আমাদের যুক্তিতে, পারিনি আমাদের বিজ্ঞান চেতনায়,পারিনি আমাদের সুস্হ মস্তিষ্কে। কারণ, আমরা ”অবিশ্বাসের দর্শন” এ পাঠ নিয়েছি। ছুঁড়ে ফেলেছি বহুকালের যত্তোসব পৌরাণিক ধ্যাণ ধারণা,হারিয়েছি বিশ্বাস- বাস্তবতা বিবর্জিত অলৌকিক রূপকথায়। কারণ, আমরাই তো বড় হয়ে পড়েছি আরজ আলী মাতুব্বর,আবিষ্কার করেছি একজন হুমায়ুন আজাদ কিংবা শুনেছি আহমদ শরীফ স্যারের কথা। আর ক্রমাগতঃ অবিশ্বাসী হয়ে উঠেছি – যুক্তির বিন্যাসে আর ধারালো সমালোচনায়।

আমাদের, আপনার রেখে যাওয়া এসব অবিশ্বাসীদের ক্ষমা করবেন স্যার ! ক্ষমা করবেন তো!

ইতি,
অবিশ্বাসী এক পাঠক।