(আগের পর্বের পর…)

৮.০ : লোকায়ত ও আন্বীক্ষিকী

ইতঃপূর্বেই আমরা দেখেছি যে, লোকায়তকে কৌটিল্য তাঁর অর্থশাস্ত্রে’র অনুমোদিত বিদ্যাচতুষ্টয়ের অন্যতম আন্বীক্ষিকী’র অন্তর্গত শাস্ত্র হিসেবে বর্ণনা করেছেন-

‘সাংখ্যং যোগো লোকায়তং চেত্যান্বীক্ষিকী’। (অর্থশাস্ত্র: ১/২/২)।
অর্থাৎ : সাংখ্য, যোগ ও লোকায়ত- এই তিনটি শাস্ত্র উক্ত আন্বীক্ষিকী-বিদ্যার অন্তর্ভুক্ত।

.
কৌটিল্যের এই বিদ্যাচতুষ্টয় হলো-

‘আন্বীক্ষিকী ত্রয়ী বার্তা দণ্ডনীতিশ্চেতি বিদ্যাঃ’। (অর্থশাস্ত্র: ১/২/১)।
অর্থাৎ : আন্বীক্ষিকী (হেতুবিদ্যা বা তর্কবিদ্যা বা মোক্ষদায়ক আত্মতত্ত্ব), ত্রয়ী (ঋক্-যজুঃ-সামবেদাত্মক বেদ-বিদ্যাসমুদায়), বার্তা (কৃষি, পশুপালন ও বাণিজ্য বিষয়ক বিদ্যা) এবং দণ্ডনীতি (অর্থাৎ রাজনীতি বা নীতিশাস্ত্র ও অর্থশাস্ত্র)।

.
‘অর্থশাস্ত্রে’র বর্ণনা অনুসারে আন্বীক্ষিকী যে বিদ্যাগুলির মধ্যে শ্রেষ্ঠত্বের দাবী রাখে তাও বোঝা যায় কৌটিল্যের উদ্ধৃতিতে-

ধর্মাধর্মৌ ত্রয্যাম্ । অর্থানর্থৌ বার্তায়াম্ । নয়াপনয়ৌ দণ্ডনীত্যাম্ । বলাবলে চৈতাসাং হেতুভিরন্বীক্ষমাণান্বীক্ষিকী লোকস্যোপকরোতি, ব্যসনেহভ্যুদয়ে চ বুদ্ধিমবস্থাপয়তি, প্রজ্ঞাবাব্যক্রিয়াবৈশারদ্যং চ করোতি। (অর্থশাস্ত্র: ১/২/২)।
অর্থাৎ : এই আন্বীক্ষিকীর দ্বারা এবং সূক্ষ্ম অন্বীক্ষার সাহায্যে ধর্ম এবং অধর্মের বিষয় ত্রয়ীতে প্রতিপাদিত হয় ; অর্থ এবং অনর্থ প্রতিপাদিত হয় বার্তা-নামক বিদ্যায় ; এবং দণ্ডনীতিতে নয় ও অপনয় (good policy and bad policy) প্রতিপাদিত হয়। এই তিন বিদ্যার বল ও অবল (সামর্থ্য ও অসামর্থ্য) বা প্রাধান্য ও অপ্রাধান্য যুক্তির দ্বারা নির্ধারণ করা হয় বলে আন্বীক্ষিকী লোকসমাজের উপকার করে থাকে, বিপৎকালে এবং অভ্যুদয়ের সময় মানুষের বুদ্ধি অবিচলিত রাখে এবং মানুষের প্রজ্ঞা, বাক্য-ব্যবহার ও কর্মশক্তির নৈপুণ্য সম্পাদন করে।

.
সহজ কথায় একমাত্র এই আন্বীক্ষিকী বিদ্যার সহায়তার ভিত্তিতেই অপর বিদ্যাগুলি সাধারণের কাছে গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত। এই অপর বিদ্যাগুলির মধ্যে বেদও অন্তর্ভুক্ত। তাই কৌটিল্যের মতে আন্বীক্ষিকী সকল বিদ্যার প্রদীপস্বরূপ-

প্রদীপঃ সর্ববিদ্যানামুপায়ঃ সর্বকর্মণাম্ ।
আশ্রয়ঃ সর্বধর্মাণাং শশ্বদান্বীক্ষিকী মতা।। (অর্থশাস্ত্র: ১/২/২)।
অর্থাৎ : আন্বীক্ষিকীবিদ্যা (অপর-) সকল বিদ্যার প্রদীপস্বরূপ (মার্গদর্শক), সকল কর্মের (অর্থাৎ কর্মসাধনের পক্ষে) উপায়তুল্য, সকল (লৌকিক ও বৈদিক-) ধর্মের আশ্রয়স্বরূপ বলে সর্বদা পরিগণিত হয়ে থাকে।

.
অন্যদিকে জড়বাদী বার্হস্পত্যরা তাঁদের মতাদর্শে এই আন্বীক্ষিকীকে যে বিদ্যারই অন্তর্ভুক্ত করেননি তাও কৌটিল্যর উদ্ধৃতি থেকেই জানা যায়-

বার্তা দণ্ডনীতিশ্চেতি বার্হস্পত্যাঃ। সংবরণমাত্রং হি ত্রয়ী লোকযাত্রাবিদ ইতি। (অর্থশাস্ত্র: ১/২/১)।
অর্থাৎ : বৃহস্পতির শিষ্যগণের (বার্হস্পত্যগণের) মতে, বার্তা ও দণ্ডনীতি- এই দুই প্রকারের বিদ্যা ; কারণ, ত্রয়ী লোকযাত্রাবিদের অর্থাৎ বার্তা ও দণ্ডনীতির অনুষ্ঠান বিষয়ে অভিজ্ঞ মানুষের পক্ষে সংবরণের অর্থাৎ আচ্ছাদনের কাজ করে মাত্র (লোকতন্ত্রজ্ঞ হলেও ত্রয়ীজ্ঞান না থাকলে নাস্তিক বলে লোকসমাজে যে নিন্দিত হতে হয়, তার থেকে রক্ষার উপায়মাত্র হওয়ায় ত্রয়ীর স্বতন্ত্র বিদ্যাত্ব স্বীকারের কোনো প্রয়োজন নেই)।

.
কৌটিল্য বর্ণিত এসব উদ্ধৃতি থেকেই স্পষ্টত বোঝা যায় যে, আন্বীক্ষিকী বৈদিক সংস্কৃতির পরিপন্থী ছিলো না কখনোই, বরং বেদের পরিপূরক শাস্ত্র হিসেবেই তা পরিগণিত হতো। ফলে জড়বাদী বার্হস্পত্যরা এটাকে বিদ্যা হিসেবে স্বীকৃতি দেননি। তবে তৎকালীন চিন্তাজগতে আন্বীক্ষিকীর যে যথেষ্ট সম্মান ছিলো, কৌটিল্যের বর্ণনাভঙ্গিতে তার সুস্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যায়।
.
অর্থশাস্ত্রে সাংখ্য, (ন্যায়-বৈশেষিক অর্থে) যোগ এবং লোকায়ত এই তিনটি শাস্ত্রকে আন্বীক্ষিকীর মর্যাদা দেয়া হয়েছে। ভারতীয় চিন্তাজগতে উপনিষদীয় চিন্তাধারা-প্রভাবিত সাংখ্য ও যোগ নামের এই সুপরিচিত দর্শন দুটি যে ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির সমর্থনপুষ্ট, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু দর্শন জগতে এ দুটি শাস্ত্র মতের উৎস ও বিকাশের ধারাবাহিক ইতিহাস জানা থাকলেও লোকায়তের সেরকম কোন পরিচিতি সূত্র, ভাষ্য বা ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। তবু শাস্ত্র হিসেবে লোকায়তও যে সমসাময়িক সাংখ্য ও যোগের সমান সমানই ছিলো, ‘অর্থশাস্ত্রে’র বিবরণী থেকে তা ধারণা করা যায়। আর কৌটিল্য বর্ণিত বার্হস্পত্য মতে বিদ্যার ক্ষেত্রে আন্বীক্ষিকীকে প্রবেশাধিকার না দেয়ায় অর্থশান্ত্রোক্ত লোকায়ত যে তৎকালীন বার্হস্পত্য থেকে পৃথক ছিলো তাও স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়। ফলে এটা সহজেই অনুমেয়, পরবর্তী যুগের জড়বাদী নাস্তিকধর্মী চার্বাক দর্শনের সঙ্গে প্রাচীন এই লোকায়ত শাস্ত্র অভিন্ন ছিলো না। বরং ‘লোকায়ত’ সংজ্ঞার দ্বারা বিশেষিত হওয়া সত্ত্বেও পরবর্তী চার্বাক মতবাদ দৃষ্টিভঙ্গির বিচারে প্রাচীন লোকায়ত শাস্ত্রের বিপরীত। তাহলে বিভিন্ন যুগের বিপরীতমুখি এই শাস্ত্র দুটির সাধারণ একটি সংজ্ঞায় অভিহিত হওয়ার মূলে কী কারণ থাকতে পারে ? এর কারণ হিসেবে পণ্ডিতেরা উভয়ের অন্তনির্হিত সাদৃশ্য বা বৈশিষ্ট্য হিসেবে যে প্রভাবটিকে কার্যকর যোগসূত্র হিসেবে ধারণা করেন, তা হলো হেতুবিদ্যা। তাই বিষয়টি কিঞ্চিৎ পর্যালোচনার দাবি রাখে।
.
লোকায়ত শাস্ত্র নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে বিভিন্ন মত দেখা যায়। পালি সাহিত্য বিষয়ে সুপণ্ডিত রিস ডেভিডস (Rhys Davids) এ ব্যাপারে ‘লোকায়ত’ শব্দটির ব্যুৎপত্তিগত অর্থের উপরই নির্ভর করতে চেয়েছেন। এই ব্যুৎপত্তিগত অর্থটি হচ্ছে- ‘লোকেষু আয়তো লোকায়তঃ’। অর্থাৎ জনসাধারণের মধ্যে পরিব্যাপ্ত বলেই নাম লোকায়ত। পণ্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতেও- ‘লোকায়ত মত লোকে আয়ত অর্থাৎ ছড়াইয়া পড়িয়াছে বলিয়াই ওই নাম পাইয়াছে।’ এ ব্যাপারে সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্তের মন্তব্য হলো- ‘জনসাধারণের মধ্যে যার পরিচয় পাওয়া যায়’। এ প্রসঙ্গে তিনি বৌদ্ধ গ্রন্থ ‘দিব্যাবদান’-এর নজির দেখিয়েছেন, যেখানে লোকায়ত শব্দ এই ব্যুৎপত্তিগত অর্থেই ব্যবহৃত। তাছাড়া-
.

‘লোকায়ত’ শব্দের এই অর্থের অনুসরণে রিস ডেভিডস লোকায়তকে সাধারণ লোকের মধ্যে প্রচলিত বিভিন্ন বিষয়ের অবলম্বনে রূপায়িত শাস্ত্র হিসেবে নির্দেশ করেন এবং এই বিশেষ শাস্ত্রটি তাঁর মতে ব্রাহ্মণ্য বিদ্যারই একটি শাখা। …এ ব্যাপারে সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত মনে করেন, ‘লোকায়ত’ সংজ্ঞায় তর্ক বা যুক্তিভিত্তিক এক বিশেষ শাস্ত্রকে বোঝায়, যার উল্লেখ বৌদ্ধ সাহিত্যের বহু স্থানে আছে। পালি গ্রন্থের বিভিন্ন অংশে প্রাপ্ত লোকায়তসম্বন্ধীয় মন্তব্য থেকে দাশগুপ্ত মহাশয় সিদ্ধান্ত করেন যে ‘লোকায়ত’ শাস্ত্রের আশ্রয় এক বিশেষ ধরনের তর্ক, যে তর্কের উদ্দেশ্য প্রতিপক্ষকে যে-কোন উপায়ে নিরস্ত করা, আত্মপক্ষ উপস্থাপনা নয়। এই জাতীয় তর্কের পারিভাষিক নাম ‘বিতণ্ডা’ এবং পালি লেখক বুদ্ধ ঘোষ লোকায়তকে বিতণ্ডাত্মক শাস্ত্র হিসাবে বর্ণনা করেছেন। (চার্বাক দর্শন, পৃষ্ঠা-২৪ /লতিকা চট্টোপাধ্যায়)।

.
উল্লেখ্য, ‘বিতণ্ডা’ শব্দটির পারিভাষিক অর্থ যে খুব ভালো কিছু নয় তা উপরের উদ্ধৃতি থেকেই প্রতীয়মান হয়। ন্যায়সূত্রে বিতণ্ডা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে-

স (জল্পঃ) প্রতিপক্ষস্থাপনাহীনো বিতণ্ডা। (ন্যায়সূত্র: ১/২/৪৪)।
অর্থাৎ : প্রতিপক্ষস্থাপনাহীন জল্পকে বিতণ্ডা বলে।

.
একটি বিষয় বুঝতে গিয়ে এখানে ফের নতুন একটি পারিভাষিক শব্দ ‘জল্প’-এর উপস্থিতির কারণে আরেকটু ব্যাখ্যার প্রয়োজন রয়েছে হয়তো। ন্যায়শাস্ত্রে দার্শনিক বিতর্ক সংশ্লিষ্ট কয়েকটি সমধর্মী কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন পারিভাষিক শব্দ ব্যবহৃত হয়ে থাকে, যেমন- বাদ, জল্প, বিতণ্ডা ইত্যাদি। উল্লেখিত এই তিনটি পদ বা শব্দই সমধর্মী অর্থাৎ তর্কসংশ্লিষ্ট। আর ভিন্নতা হচ্ছে যুক্তির উপস্থিতি-অনুপস্থিতি এবং বিপক্ষমত খণ্ডন ও স্বমত প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হওয়া-না-হওয়ার তারতম্যের মধ্যে। বিষয়টি স্পষ্ট হওয়া জরুরি।
.
ন্যায়শাস্ত্রে কোন বিষয় নিয়ে সাধারণভাবে কিছু বলার নাম ‘বাদ’। এই বলার ব্যাপারে বক্তব্যটির বিষয়বস্তুতে বিভিন্ন ধর্মের আলোচনার প্রয়োজন হতে পারে এবং ধর্মগুলি পরস্পরবিরুদ্ধ হলে বাদী (বক্তা) স্বভাবতঃই একটিকে সমর্থন এবং অপরটিকে প্রত্যাখ্যান করেন। ন্যায়ের ভাষায় একই বিষয়ে পরস্পর বিপরীত ধর্মের একটিকে পক্ষ এবং অপরটিকে প্রতিপক্ষ বলে। এই পক্ষ এবং প্রতিপক্ষের মধ্যে একটির সাধন বা স্থাপনা এবং অপরটির উপালম্ভ বা প্রত্যাখ্যান বাদের আবশ্যিক অঙ্গ। সহজ কথায় প্রমাণ ও তর্কের দ্বারা তত্ত্বনির্ণয়ের উদ্দেশ্যে আলোচনাকেই বাদ বলে।
.
এই পক্ষ এবং প্রতিপক্ষযুক্ত বিষয় জল্পেরও অঙ্গ, তবে কেবল সাধারণ আলোচনা জল্পের প্রতিপাদ্য নয়। জল্প প্রসঙ্গে ন্যায়সূত্রে বলা হয়েছে-

যথোক্তপপন্নছলজাতিনিগ্রহস্থানসাধনো পালম্ভো জল্পঃ। (ন্যায়সূত্র: ১/২/৪৩)।
অর্থাৎ : জল্পের প্রধান উদ্দেশ্য অপরের প্রতিষিদ্ধ স্বপক্ষের স্থাপনা।

.
সহজ কথায়, কোন তত্ত্বনির্ণয়ের প্রতি লক্ষ্য না রেখে কেবলমাত্র প্রতিপক্ষকে পরাস্ত করার জন্য যে নিছক বাক্যুদ্ধ চলে, তাকেই বলা হয় জল্প। জল্পের প্রধান উদ্দেশ্য হলো আত্মপক্ষ সমর্থন। জল্পে প্রবৃত্ত ব্যক্তির মধ্যে বিজিগীষা বা প্রতিপক্ষকে পরাস্ত করার এক মনোভাব থাকে, যে মনোভাব বাদে অদৃশ্য। যে বিজিগীষু মনোভাব জল্পের পটভূমি রচনা করে, জল্পের বিশেষ রূপ বিতণ্ডাতে তারই চরম প্রকাশ ঘটে কেবল অপরপক্ষের দূষণকে কেন্দ্র করে। বৈতণ্ডিকের কাজ শুধুই অপরপক্ষের সমালোচনা। এই সমালোচনাতেই বৈতণ্ডিক তাঁর সমগ্র প্রয়াস কেন্দ্রীভূত করেন এবং পক্ষদ্বয়ের মধ্যে অপরপক্ষের প্রতিপক্ষ যে স্বপক্ষ, সেই স্বপক্ষের মতামত সম্বন্ধে সম্পূর্ণ নীরব থাকেন। সোজা কথায়, বিতণ্ডা হলো একপ্রকার যুক্তিহীন তর্ক, যেখানে কোন পক্ষই নিজের মত প্রতিষ্ঠা না করে কেবল অপরের মত খণ্ডন চেষ্টায় লিপ্ত থাকে।
.
অতএব পালি লেখক বুদ্ধ ঘোষ লোকায়তকে যে বিতণ্ডাত্মক শাস্ত্র হিসেবে বর্ণনা করেছেন, সেটুকু বিবেচনায় নিলে অনুমিত হয়, বিতণ্ডাত্মক শাস্ত্র হিসেবে বর্ণিত প্রাচীন লোকায়তের মধ্যে অপরের সমালোচনার প্রবণতাই মূখ্য ভূমিকা গ্রহণ করেছিলো। বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের বিরাগভাজন এই লোকায়ত শাস্ত্রে কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে বর্ণিত ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির সম্মতি বা অনুমোদনের নিদর্শন দেখে ধারণা করা বিচিত্র নয় যে বৌদ্ধরাই এক্ষেত্রে লোকায়তের প্রতিদ্বন্দ্বী এবং বৌদ্ধদের সমালোচনার মাধ্যমেই এই লোকায়ত শাস্ত্র বিতণ্ডাত্মক রূপে আত্মপ্রকাশ করেছিলো। কেননা, কৌটিল্যের সমকালীন ব্রাহ্মণ্যবাদীদের মুখে প্রকাশিত বৌদ্ধবিদ্বেষ নিশ্চয়ই কোন গোপন বিষয় ছিলো না। প্রাচীন রামায়ণেও এ নজির বিরল নয়। এ প্রসঙ্গে বুদ্ধদেব সম্বন্ধে কিছু বক্রোক্তি রামায়ণে দেখা যায়-

‘যথা হি চোরঃ স তথা হি বুদ্ধস্তথাগতং নাস্তিকমত্র বিদ্ধি’। (রামায়ণ: ২/১০৯/৩৪)।

.
তাছাড়া রামায়ণের অযোধ্যাকাণ্ডে (রামায়ণ: ২/১০৮) বনবাসী রামকে অযোধ্যায় প্রত্যাবর্তনের অনুরোধ জানিয়ে কৃচ্ছ্রসাধনের দৃঢ় সংকল্প থেকে প্রতিনিবৃত্ত করার প্রচেষ্টায় ব্রাহ্মণ জাবালি যে উপদেশাত্মক বিবৃতি দিয়েছিলেন, তা ছিলো বৌদ্ধ নাস্তিকবাদের সমগোত্রীয়। জাবালির উপদেশকে রাম প্রতিপালনের অযোগ্য বলে বর্ণনা করেছেন।
.
মূলত যে ধরনের তর্ককে কেন্দ্র করে বিতণ্ডার প্রচলন, সে ধরনের তর্কের নিদর্শন প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যে প্রচুর দেখা যায়। এ প্রসঙ্গে-

‘হেতুবিদ্যা’ নামে প্রাচীন ভারতে প্রচলিত যে বিশেষ বিদ্যার উল্লেখ পাওয়া যায়, তা সাধারণত তর্ককেন্দ্রিক এবং প্রতিপক্ষকে নিরস্ত করার প্রয়াসেই এর ব্যবহার দেখা যেতো।
প্রাচীন লোকায়ত শাস্ত্রের উপর এই হেতুবাদের প্রভাব খুব বেশি। সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্তের মতে বৌদ্ধদের সমালোচনায় তৎপর হেতুবাদমূলক লোকায়ত প্রাচীন যুগে কেবলমাত্র বৌদ্ধ সম্প্রদায়েরই বিরাগের পাত্র ছিল ; অপরপক্ষে ব্রাহ্মণরা বিদ্যার এক বিশেষ শাখা হিসাবে এই শাস্ত্রের অনুশীলনে রত ছিলেন। (চার্বাক দর্শন, পৃষ্ঠা-২৫/ লতিকা চট্টোপাধ্যায়)।

.
এই হেতুবিদ্যা বা তর্কশাস্ত্রের উল্লেখ ‘অর্থশাস্ত্রে’র অন্তর্গত আন্বীক্ষিকীর আলোচনায়ও দেখতে পাই আমরা। কৌটিল্য যখন বলেন-

‘বলাবলে চৈতাসাং হেতুভিরন্বীক্ষমাণান্বীক্ষিকী লোকস্যোপকরোতি’- (অর্থশাস্ত্র: ১/২/২)।
অর্থাৎ : এই তিন (ত্রয়ী, বার্তা, দণ্ডনীতি) বিদ্যার বল ও অবল (সামর্থ্য ও অসামর্থ্য) বা প্রাধান্য ও অপ্রাধান্য হেতু বা যুক্তির দ্বারা নির্ধারণ করা হয় বলে আন্বীক্ষিকী লোকসমাজের উপকার করে থাকে।

.
এখানে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, কৌটিল্য তাঁর আলোচনায় অপর বিদ্যাগুলির গুণাগুণ, বলাবল ইত্যাদি বিচারের ব্যাপারে এই হেতুকেই প্রধান অবলম্বন হিসেবে বর্ণনা করেছেন (হেতুভিরন্বীক্ষমাণাঃ)। প্রাচীন ভারতে ‘হেতু’ শব্দ সাধারণত তর্ক অর্থে ব্যবহৃত হতো এবং তর্ককেন্দ্রিক বিদ্যাবিশেষকে ‘হেতুবিদ্যা’ নামে সংজ্ঞায়িত করা হয়। প্রতিদ্বন্দ্বীর আক্রমণ প্রতিহত করে নিজ মতকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য সুনির্দিষ্ট উপায়ে তর্ক প্রয়োগের প্রয়োজনীয়তা প্রাচীন ভারতে ভালোভাবেই অনুভূত হয়েছিলো, যার ফলে একটি বিশেষ শাস্ত্র হিসেবে ভারতের চিন্তাজগতে হেতুবিদ্যার আত্মপ্রকাশ। এর নজির হিসেবে মহাভারতের শান্তিপর্বে হেতুবাদের উল্লেখ দেখা যায় (মহাভারত : ১২/১৯/২৩-২৪, ১২/১৮০/৪৮) । যেমন-

ভবন্তি সুদুরাবর্ত্তা হেতুমন্তোহপি পন্ডিতাঃ।
দৃঢ়পূর্ব্বে স্মৃতা মূঢ়া নৈতদস্তীতি বাদিনঃ।। (মহাভারত : ১২/১৯/২৩)
অনৃতস্যাবমন্তারো বক্তারো জনসংসদি।
চরন্তি বসুধাং কৃৎস্নাং বাবদূকা বহুশ্রুতাঃ।। (মহাভারত : ১২/১৯/২৪)।
অর্থাৎ :
‘মৃত্যুর পরে আর জীব থাকে না’ এইরূপ মতবাদী, যুক্তিতর্কাবলম্বী হেতুবাদী, উক্ত মতে দৃঢ়বিশ্বাসী, প্রাচীন কতকগুলি পণ্ডিত লোকও উক্ত সিদ্ধান্তের বহুদূরে অবস্থান করিয়া গিয়াছেন। ২৩।
তা’র পর, উক্ত নাস্তিকমত মিথ্যা বলিয়া তাহার অবজ্ঞাকারী, বহুশাস্ত্রজ্ঞ এবং গার্হস্থ্যের প্রাধান্যবাদী অনেক লোকই জনসভায় বক্তৃতা দিতে থাকিয়া সমগ্র পৃথিবী বিচরণ করেন। ২৪।

.
মহাভারতের বর্ণনা থেকে বোঝা যায় যে,

হেতুবাদী পণ্ডিতেরা দেশের বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণ করে জনসভায় নিজেদের মতামত ব্যক্ত করতেন। আবার মহাভারতের অশ্বমেধপর্বে (মহাভারত: ১৪/৮৫/২৭) তর্কযুদ্ধে পরস্পর প্রতিদ্বন্দ্বী কিছু হেতুবাদীর উল্লেখ থেকে হেতু বা তর্কের সাহায্যে প্রতিদ্বন্দ্বীর মতকে খণ্ডন করে স্বমতের প্রতিষ্ঠাই যে হেতুবাদী এই বাগ্মীদের উপজীব্য তা বোঝা যায়। ‘অর্থশাস্ত্রে’ কৌটিল্যের বর্ণনায় এই হেতু বা তর্কবিদ্যারই অঙ্গ হিসেবে আন্বীক্ষিকীর পরিচিতির প্রকাশ। কৌটিল্যের সমকালীন হেতুবিদ্যা আন্বীক্ষিকী ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির অবিরোধী ছিলো এবং আন্বীক্ষিকীর অন্যতম লোকায়ত শাস্ত্র ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির দ্বারা অনুমোদিত বিদ্যার এক শাখা হিসেবেই পরিগণিত হতো। (চার্বাক দর্শন, পৃষ্ঠা-২৬/ লতিকা চট্টোপাধ্যায়)।

.
প্রাথমিক পর্যায়ে বেদের অবিরোধী হিসেবে আবির্ভূত হলেও এই হেতুশাস্ত্র ক্রমে বৈদিক প্রামাণ্যের বিচারকেও তার অস্ত্রপরীক্ষার ক্ষেত্রে পরিণত করে বসলো। ফলে-

বৈদিক প্রভাবের অপপ্রয়োগের প্রতিক্রিয়া হিসাবে বৈদিক যাগযজ্ঞ এবং ক্রিয়াকলাপে ক্রমশঃ বহু লোকের বিশ্বাসের মূলে আঘাত করে। ফলে যুক্তির মাধ্যমে বৈদিক সব ধারণাকে যাচাই করে দেখার প্রচেষ্টার সূচনা হয়। এর অবশ্যম্ভাবী ফল হেতুবাদই হল এই প্রচেষ্টার মাধ্যম। এই বেদবিরোধী নাস্তিকদের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার ফলে কালক্রমে হেতুবাদের প্রতি সনাতনপন্থীদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন স্বাভাবিকভাবেই লক্ষ্যণীয়। হেতুবাদের সংজ্ঞাতেও এর পরিণামে সাহচর্যজনিত কিছু পরিবর্তন হওয়া বিচিত্র নয়, ফলে পরবর্তী যুগের ‘আন্বীক্ষিকী’ শব্দও ভিন্ন সংজ্ঞার দ্বারা চিহ্নিত। (চার্বাক দর্শন, পৃষ্ঠা-২৬/ লতিকা চট্টোপাধ্যায়)।

.
এই ভিন্ন সংজ্ঞাটা কী ?

অন্বীক্ষা শব্দের অর্থ ‘পরবর্তী জ্ঞান’। অনু (অর্থাৎ পরবর্তী) + ঈক্ষা (বা জ্ঞান)। অনুমান শব্দটির অর্থও হুবহু একই : অনু (পরবর্তী) + মান (জ্ঞান)। অতএব ‘অন্বীক্ষা’ ও ‘অনুমান’ একই কথা, ভারতীয় পরিভাষায় যাকে বলে পর্যায়শব্দ। কিন্তু ‘পরবর্তী জ্ঞান’ বললে… প্রশ্ন… কিসের পরবর্তী ? ভারতীয় ঐহিত্য অনুসারে ‘প্রত্যক্ষর পরবর্তী’। …ঐতিহ্য অনুসারে ‘অনুমান’ জ্ঞান প্রত্যক্ষজ্ঞানের অনুগামী- পূর্ববর্তী প্রত্যক্ষজ্ঞানের উপর নির্ভরশীল। প্রথমে কোনো প্রত্যক্ষ-জ্ঞান এবং তারই অনুসরণ করে অনুমান-জ্ঞান।…
তাহলে, ‘আন্বীক্ষিকী’র শব্দার্থ হলো ‘অনুমানবিদ্যা’- আজকাল চলতি কথায় আমরা যাকে বলি ‘লজিক’। অবশ্য, কৌটিল্য এখানে বিশুদ্ধ অনুমানবিদ্যা অর্থে শব্দটি ব্যবহার করেননি ; তাঁর মতে ‘আন্বীক্ষিকী’ শুধু অনুমানবিদ্যা ছাড়াও অনুমান-মূলক দার্শনিক মতও। (ভারতে বস্তুবাদ প্রসঙ্গে, পৃষ্ঠা-৫৯/ দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়)।

.
অর্থাৎ ব্রাহ্মণ্য সমাজে স্বীয় স্থান অক্ষুণ্ন রাখার জন্য উত্তর যুগের আন্বীক্ষিকী তর্ক বা অনুমান শব্দকে নিজস্ব সংজ্ঞায় ‘হেতু’ শব্দের স্থলাভিষিক্ত করেছে। তাই হয়তো অমরকোষে আন্বীক্ষিকীকে তর্কশাস্ত্র বলে অভিহিত করা হয়েছে- ‘আন্বীক্ষিকী দণ্ডনীতিস্তর্কবিদ্যার্থশাস্ত্রয়োঃ (অমরকোষ, পৃষ্ঠা-১৩)। আর ন্যায়ভাষ্যকার বাৎসায়নের মতে, শ্রুতি বা বেদের অবিরোধী অন্বীক্ষা বা অনুমান আন্বীক্ষিকীর প্রধান কাজ- ‘প্রত্যাগমাশ্রিতমনুমানং সা অন্বীক্ষা…’। (ন্যায়ভাষ্য: ১/১/১)। অপরপক্ষে হেতুবাদকে যাঁরা অবলম্বন করে থাকেন সেই হৈতুকরা সনাতনপন্থীদের নিন্দার পাত্র হলেন। যেমন মনুসংহিতায় এই হেতুবাদে অনুরক্ত নাস্তিক ব্রাহ্মণদের নিন্দা করে বলা হয়েছে-

যোহবমন্যেত তে মূলে হেতুশাস্ত্রাশ্রয়াদ্ দ্বিজঃ।
স সাধুভি র্বহিষ্কার্যো নাস্তিকো বেদনিন্দকঃ।। (মনুসংহিতা: ২/১১)।।
অর্থাৎ : যে দ্বিজ হেতুশাস্ত্র অর্থাৎ অসৎ-তর্ককে অবলম্বন করে ধর্মের মূলস্বরূপ এই শাস্ত্রদ্বয়ের (শ্রুতি ও স্মৃতির) প্রাধান্য অস্বীকার করে (বা অনাদর করে), সাধু ব্যক্তিদের কর্তব্য হবে- তাকে সকল কর্তব্য কর্ম এবং সমাজ থেকে বহিষ্কৃত করা (অর্থাৎ অপাংক্তেয় করে রাখা)। কারণ, সেই ব্যক্তি বেদের নিন্দাকারী, অতএব নাস্তিক।

.
আবার মনুশাস্ত্রের অন্যত্র এই হৈতুকরা বাক্যালাপেরও অযোগ্য বলে বর্ণিত হয়েছে-

পাষণ্ডিনো বিকর্মস্থান্ বৈড়ালব্রতিকান্ শঠান্ ।
হৈতুকান্ বকবৃত্তীংশ্চ বাঙ্মাত্রেণাপি নার্চয়েৎ।। (মনুসংহিতা: ৪/৩০)।।
অর্থাৎ : পাষণ্ডী অর্থাৎ বেদপথবিরুদ্ধব্রতধারী (যথা, বৌদ্ধভিক্ষু-ক্ষপণকাদি), বিকর্মস্থ (অর্থাৎ প্রতিষিদ্ধবৃত্তিজীবী, যারা আপৎকাল ছাড়াও অন্য বর্ণের জীবিকা গ্রহণ করে, যথা, ব্রাহ্মণ হয়ে ক্ষত্রিয়ের বৃত্তি বা ক্ষত্রিয় হয়ে ব্রাহ্মণের বৃত্তি অবলম্বন করে যারা জীবিকার্জন করে), বৈড়ালব্রতিক (বিড়ালতপস্বী, অথবা দাম্ভিক, যারা কেবল লোককে আকৃষ্ট করার জন্যই অগ্নিহোত্রাদি যজ্ঞ করে, কিন্তু ধর্মবুদ্ধিতে এই সব যজ্ঞ করে না), শঠ (বেদে শ্রদ্ধারহিত), হৈতুক (বেদবিরুদ্ধ তর্কপরায়ণ) এবং বকবৃত্তিধারী (প্রবঞ্চক ও কপটবিনয়ী-দ্বিজ)- এই সব ব্যক্তি যদি অতিথি-যোগ্য কালেও উপস্থিত হয়, তাহলে বাক্যের দ্বারাও তাদের সম্ভাষণ করবে না।

.
উল্লেখ্য, মনুসংহিতার ভাষ্যকার মেধাতিথির মতে হৈতুক অর্থ হচ্ছে-

হৈতুকা নাস্তিকা নাস্তি পরলোকো, নাস্তি দত্তম্, নাস্তি হুতমিত্যেবং স্থিতপ্রজ্ঞাঃ।
অর্থাৎ : নাস্তিক অর্থাৎ যারা এই রকম দৃঢ়নিশ্চয় করে যে, পরলোক নেই, দানেরও কোনও ফল নেই, হোম করারও কোনও ফল নেই, তারাই হৈতুক।

.
আবার মনুসংহিতার অপর ভাষ্যকার কুল্লুক ভট্টের মতে হৈতুক হলো-

হৈতুকা বেদবিরোধিতর্ক ব্যবহারিণঃ।
অর্থাৎ : হৈতুক হচ্ছে বেদবিরুদ্ধ তর্কপরায়ণ।

.
মহাভারতেরও বিভিন্ন স্থানে হেতুবাদরত পণ্ডিতদের নিন্দা দেখা যায় (মহাভারত: ১২/১৯/২৩-২৪)।
.
তাই অনুমান করা হয়তো অসঙ্গত হবে না যে, কালের অগ্রগতির সঙ্গে হেতুবাদের একটি শাখা আন্বীক্ষিকীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বেদবিরোধী নাস্তিকদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে বৌদ্ধদের সমালোচনায় সীমাবদ্ধ না রেখে তর্কের অস্ত্রকে বেদের বিরোধিতার ক্ষেত্রেও প্রসারিত করে স্বতন্ত্রভাবেই হেতুবাদী তর্কশাস্ত্রে রূপান্তরিত হলো। অন্যদিকে কৌটিল্যের ‘অর্থশাস্ত্রে’ এবং পরবর্তীযুগের ন্যায়ভাষ্যে বর্ণিত বিশ্লেষণমূলক শাস্ত্র হিসেবে আন্বীক্ষিকীর মূল শাখাটি বৈদিক বচনকে যুক্তির সমর্থন দিয়ে বেদসমর্থকদের শাস্ত্র হিসেবেই পরিগণিত হয়েছে।
ওই হেতুবাদী তর্কশাস্ত্রই পরবর্তীকালের লোকায়ত হিসেবে আখ্যায়িত, যা বেদসমর্থকদের কাছে নিন্দাযোগ্য হিসেবে প্রচার পেয়েছে। যেমন, এরই সমসাময়িক নমুনা হিসেবে রামায়ণের অযোধ্যাকাণ্ডে (রামায়ণ: ২/১০৮) দেখা যায়, রামের ভাই ভরত রামচন্দ্র সকাশে এলে তাঁকে রাজ্য-পরিচালন বিষয়ে উপদেশ দিতে গিয়ে রাম বললেন-

ক্কচিন্ন লোকায়তিকান্ ব্রাহ্মণাংস্তাত সেবসে।
অনর্থকুশলা হ্যেতে বালাঃ পণ্ডিতমানিনঃ।। (রামায়ণ: ২/১০৮)।
অর্থাৎ : আশা করি তুমি লোকায়তিক ব্রাহ্মণদের সেবা করছো না। ওরা অনর্থ ঘটাতে খুবই পটু।

.
অপরপক্ষে মনুসংহিতায় নৃপতিদের আন্বীক্ষিকী চর্চার বৈদিক সমর্থন হিসেবে মনু বলছেন-

ত্রৈবিদ্যেভ্যস্ত্রয়ীং বিদ্যাদ্ দণ্ডনীতিঞ্চ শাশ্বতীম্।
আন্বীক্ষিকীঞ্চাত্ববিদ্যাং বার্তারম্ভাংশ্চ লোকতঃ।। (মনুসংহিতা: ৭/৪৩)।
অর্থাৎ : রাজা ত্রিবেদবেত্তা দ্বিজাতিদের কাছ থেকে ঋগ্-যজুঃ-সাম এই বেদত্রয় আয়ত্ত করবেন। পরম্পরাগত দণ্ডনীতি অর্থাৎ অর্থশাস্ত্র- যা চিরকাল বিদ্যমান আছে এমন রাজনীতিশাস্ত্র- রাজনীতিবিদ ব্যক্তিদের কাছে অধ্যয়ন করবেন। আন্বীক্ষিকী বা তর্কশাস্ত্র এবং আত্মবিদ্যা বা ব্রহ্মবিদ্যা এবং বার্তা অর্থাৎ কৃষিবাণিজ্যপশুপালনাদি জ্ঞান সেই সেই বিষয়ে অভিজ্ঞ ব্যক্তিগণের কাছে শিক্ষা করবেন।

.
তবে আন্বীক্ষিকীর সঙ্গে হেতুবাদের সম্পূর্ন বিচ্ছেদের কাল সময়ের কোন নির্দিষ্ট গণ্ডিতে চিহ্নিত করা সম্ভব নয়। কেননা হেতুবাদ যখন ব্রাহ্মণ্যবাদীদের বিরাগভাজন, তখনও কোন কোন ক্ষেত্রে হেতুবাদের সঙ্গে আন্বীক্ষিকীর ঘনিষ্টতার ছাপ সাধারণের চিত্তে অবিচল। যার ফলে আন্বীক্ষিকীও ব্রাহ্মণ্য সমাজে কোন কোন ক্ষেত্রে সমালোচিত হয়েছে। যেমন রামায়ণের (রামায়ণ: ২/১০০/৩৬-৩৯) এই বর্ণনায় দেখা যায়, হেতুবাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েও লোকায়ত আন্বীক্ষিকী সংজ্ঞার সঙ্গে পূর্ব সম্পর্ক অক্ষুণ্ন রেখেছে। আবার মহাভারতে ব্রাহ্মণ্যবাদীদের দ্বারা নিন্দিত হচ্ছে।

এ প্রেক্ষিতে মহাভারতের শান্তিপর্বে (মহাভারত: ১২/১৭৪/৫-৫৪) ব্রাহ্মণ্যবাদ কর্তৃক হেতুবাদী আন্বীক্ষিকীর নিন্দামূলক ‘ইন্দ্র ও কাশ্যপ সংবাদ’ উপাখ্যানটি সংক্ষেপে এরকম-

একবার এক ব্রতচারী তপস্বী দরিদ্র ব্রাহ্মণ কাশ্যপ কোন এক ধনসম্পদশালী বৈশ্যের রথের আঘাতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে রাগে দুঃখে অপমানে আত্মহত্যায় উদ্যোগী হলে তাঁকে নিবারণ করতে এসময় শৃগালরূপী ইন্দ্র সামনে এলেন এবং বলতে লাগলেন-
.
মনুষ্যযোনিমিচ্ছন্তি সর্ব্বভূতানি সর্ব্বশঃ।
মনুষ্যত্বে চ বিপ্রত্বং সর্ব্ব এবাভিনন্দতি।। (মহাভারত : ১২/১৭৪/৮)
মনুষ্য ব্রাহ্মণশ্চাসি শ্রোত্রিয়শ্চাসি কাশ্যপ !।
সুদুর্লভমবাপ্যৈতন্ন দোষান্মর্ত্তু মর্হসি।। (মহাভারত : ১২/১৭৪/৯)
…পাণিমদ্ভ্যঃ স্পৃহাস্মাকং যথা তব ধনস্য বৈ।
ন পাণিলাভাদধিকো লাভঃ কশ্চন বিদ্যতে।। (মহাভারত : ১২/১৭৪/১২)।
অর্থাৎ :
‘জগতে অন্যান্য সকল প্রাণীই মনুষ্যযোনি কামনা করে, আবার মনুষ্যমধ্যেও ব্রাহ্মণত্বেরই সকলে প্রশংসা করিয়া থাকে। ৮।
কাশ্যপ ! তুমি সেই মনুষ্য ও ব্রাহ্মণ এবং তাহাতে আবার বেদবিৎ হইয়াছ। অতএব অতিদুর্লভ এই সকল পাইয়া কেবল দারিদ্র্যদোষে মরিবার ইচ্ছা করিতে পার না। ৯।
…তোমার যেমন ধনের স্পৃহা চলিতেছে, আমাদেরও তেমন হস্তশালী প্রাণিগণের স্পৃহা আছে। এই জগতে হস্তলাভ অপেক্ষা অধিক কোন লাভ নাই। ১২।
.
এরপর শৃগালরূপী ইন্দ্র হস্তহীন প্রাণীদের কষ্টকর দুঃসহ অবস্থার বর্ণনা দিয়ে বলছেন যে, আরো নিকৃষ্ট যোনিতে জন্মাবার ভয়ে এই শৃগাল-জীবন থেকে আত্মহত্যার মতো ঘোরতর পাপও করা যাচ্ছে না। সেইসব নিকৃষ্ট যোনিতে জন্মাবার কষ্ট আরো বহু ব্যাপক। হস্তযুক্ত আর হস্তহীন প্রাণীর সুবিধা-অসুবিধা এবং বিভিন্ন জন্মে কে কী পাপে কোন যোনিতে কিভাবে জন্ম নেয় ইত্যাদি সম্পর্কে বিস্তৃত বর্ণনার পর তিনি তাঁর বর্তমান শৃগালযোনিতে জন্ম নেবার কারণস্বরূপ পূর্বজন্মের কৃত পাপের উল্লেখ করতে গিয়ে বলছেন-
.
‘অহর্মাসং পণ্ডিতকো হৈতুকো বেদনিন্দকঃ।
আন্বীক্ষিকীং তর্কবিদ্যামনুরক্তো নিরর্থিকাম্’।। (মহাভারত : ১২/১৭৪/৪৭)
হেতুবাদান্ প্রবদিতা বক্তা সংসৎসু হেতুমৎ।
আক্রোষ্টা চাতিবক্তা চ ব্রহ্মবাক্যেষু বৈ দ্বিজান্ ।। (মহাভারত : ১২/১৭৪/৪৮)
নাস্তিকঃ সর্বশঙ্কী চ মূর্খঃ পণ্ডিতমানিকঃ।
তস্যেয়ং ফলবির্বৃত্তিঃ শৃগালত্বং মম দ্বিজ !।। (মহাভারত : ১২/১৭৪/৪৯)
অপি জাতু তথা তস্মাদহোরাত্রশতৈরপি।
যদহং মানুষীং যোনিং শৃগালঃ প্রাপ্নুয়াং পুনঃ।। (মহাভারত : ১২/১৭৪/৫০)
সন্তুষ্টশ্চাপ্রমত্তশ্চ যজ্ঞদানতপোরতঃ।
জ্ঞেয়জ্ঞাতা ভবেয়ং বৈ বর্জ্যবর্জয়িতা তথা।। (মহাভারত : ১২/১৭৪/৫১)।
অর্থাৎ :
আমি পূর্বজন্মে হেতুবাদী, বেদনিন্দক ও নিরর্থক তর্কবিদ্যায় অনুরক্ত একটা কুৎসিত পণ্ডিত ছিলাম। ৪৭।
তৎকালে আমি কেবল যে এক এক জনের নিকট সেই হেতুযুক্ত বাক্য বলিতাম তাহা নহে, বহু সভাতেও তাহাই বলিতাম এবং বেদের উপরে গালি দিতাম ও বেদ-বাক্যসম্বন্ধে বিচারে পণ্ডিতগণকে পরাজয় করিতাম। ৪৮।
তারপর আমি সেই জন্মে নাস্তিক ছিলাম, বেদ ও স্মৃতিপ্রভৃতির সিদ্ধান্তের উপরে আশঙ্কা করিতাম; সুতরাং তখন আমি পণ্ডিতাভিমানী একটা মূর্খই ছিলাম। ব্রাহ্মণ ! তাহারই এই ফল হইয়াছে যে, আমি এই জন্মে শৃগাল হইয়াছি। ৪৯।
হায় ! এই শৃগালরূপী আমি আর কি বহুকাল পরে কখনও মানুষ হইতে পারিব ?। ৫০।
এবং সেই জন্মে সর্ব্বদা সন্তুষ্ট, কর্ত্তব্য কার্য্যে মনোযোগী, যজ্ঞ, দান ও তপস্যায় ব্যাপৃত, জ্ঞেয়, জ্ঞাতা ও বর্জনীয়ের বর্জ্জয়িতা হইতে পারিব কি ?। ৫১।

.
মহাভারতের এই উপাখ্যানের মধ্য দিয়ে হেতুবাদী ব্রাহ্মণদেরকে বেদনিন্দুক ও তর্কবিদ্যায় অনুরক্ত নাস্তিক হিসেবে অবজ্ঞার পাশাপাশি এই মতাদর্শে কেউ অনুরক্ত হলে মহাপাপের ফল হিসেবে পরবর্তী জন্মের ভয়ঙ্করতা তুলে ধরে বেদপরিপন্থি না হবার উপদেশ প্রচার করার ব্রাহ্মণ্যবাদী মনোভাব স্পষ্ট। আর ব্রহ্মবাদীদের এই বিরোধিতা থেকে আরেকটি বিষয়ও হয়তো স্পষ্ট হয়ে যায় যে, সেই মহাভারতের যুগে বা তারও আগে থেকেই এই যুক্তিপ্রবণ হেতুবাদী নাস্তিক মতটি তথাকথিত ব্রাহ্মণ্যবাদীদের প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী ও প্রতিষ্ঠিত মতবাদ হিসেবে তৎকালীন লোকসমাজে যথেষ্ট জনপ্রিয়ও ছিলো।
.
অন্যদিকে আবার ব্রাহ্মণ্য সমাজে সাধারণভাবে নিন্দনীয় হৈতুকদেরও স্থানবিশেষে সম্মানের স্বীকৃতি দেখা যায় মনুসংহিতায়, যেখানে অনাম্নাত বিষয়ের মীমাংসার জন্য দশাবরা পরিষৎ গঠনের বিধানে সেই পরিষদের দশ জনের মিলিত সদস্যগোষ্ঠিতে হৈতুকও অন্তর্ভুক্ত হয়েছে-

ত্রৈবিদ্যো হৈতুকস্তর্কী নৈরুক্তো ধর্মপাঠকঃ।
ত্রয়শ্চাশ্রমিণঃ পূর্বে পরিষৎ স্যাদ্দশাবরা।। (মনুসংহিতা: ১২/১১১)।।
অর্থাৎ : ঋগ্বেদ প্রভৃতি তিন বেদে অভিজ্ঞ তিনজন, হেতুক অর্থাৎ অনুমানাদি-নিপুণ একজন, তর্কী অর্থাৎ ঊহ-অপোহকুশল একজন (মীমাংসক), বেদাঙ্গ-নিরুক্তশাস্ত্র-জ্ঞাতা একজন, মানবাদিধর্মশাস্ত্রজ্ঞ একজন এবং প্রথম তিনটি আশ্রমের তিন ব্যক্তি (অর্থাৎ ব্রহ্মচারী, গৃহস্থ এবং বানপ্রস্থ) এইরকম অন্যূন দশজনকে নিয়ে দশাবরা পরিষৎ গঠিত হবে।

.
তবে সম্মানের স্বীকৃতি পাওয়া এ হৈতুক যে বেদ-সমালোচক নয় বরং বেদ বা শ্রুতিকে প্রমাণ গণ্য করা হেতুবিদ, তা বোঝা যায় মনুর অন্য শ্লোকে-

ধর্মেণাধিগতো যৈস্তু বেদঃ সপরিবৃংহণঃ।
তে শিষ্টা ব্রাহ্মণা জ্ঞেয়াঃ শ্র“তিপ্রত্যক্ষহেতবঃ।। (মনুসংহিতা: ১২/১০৯)।।
অর্থাৎ : ব্রহ্মচর্যাদি ধর্মযুক্ত হয়ে যাঁরা ‘সপরিবৃংহণ বেদ’ অর্থাৎ বেদাঙ্গ, মীমাংসা, ইতিহাস ও পুরাণাদির দ্বারা পরিপুষ্ট বেদশাস্ত্র বিধিপূর্বক আয়ত্ত করেছেন সেই ব্রাহ্মণকে শিষ্ট বলে বুঝতে হবে; শ্রুতিই তাঁদের নিকট প্রত্যক্ষস্বরূপ এবং হেতুস্বরূপ অর্থাৎ অনুমানাদি অন্যান্য প্রমাণস্বরূপ।

.
ধারণা করা হয়, প্রাচীন লোকায়ত এবং চার্বাক দর্শনের মধ্যে মিলনের সেতু রচিত হয়েছে এই হেতু বা তর্কাশ্রয়ী যুক্তির সাহায্যে। নাস্তিক যে গোষ্ঠি হেতুবাদের আশ্রয় নিয়ে বেদের প্রামাণ্য প্রতি পদে যাচাই করতে আগ্রহী ছিলো, লোকায়ত ক্রমে তার সঙ্গে যুক্ত হলো। তাই প্রাচীন লোকায়তের হেতু বা যুক্তিভিত্তিক তর্কের উত্তরাধিকারই সঞ্চারিত হতে দেখা যায় পরবর্তী লোকায়ত বা চার্বাক সিদ্ধান্তে। প্রাচীন লোকায়তের অনুসরণে যুক্তিতর্কের জাল বিস্তার করে বিপক্ষের ত্রুটির অনুসন্ধানে নিজেকে ব্যাপৃত রেখেছে। এই বিপক্ষ এখানে শুধু বৌদ্ধ নয়, জৈন এবং আধ্যাত্ম দর্শনের প্রতিটি শাখা। সম্মতিতর্কপ্রকরণের ব্যাখ্যাকার অভয়দেব সূরী তাই উদ্ধৃত করেন- ‘চার্বাক শাস্ত্রকার বৃহস্পতির সকল উক্তিই পর্যনুযোগপর অর্থাৎ পরমত দূষণের জন্য প্রশ্নাত্মক।’ মূলত এই তর্কে অনুরক্তির পরিচয় পরবর্তী লোকায়ত বা চার্বাক দর্শনের মধ্যে ভালোভাবেই পাওয়া যায়। এ কারণে মনুশান্ত্রেও এই বেদবিরোধী তর্কমূলক শাস্ত্রের বিরুদ্ধে তীব্র নিন্দা উচ্চারিত হয়-

যা বেদবাহ্যাঃ স্মৃতয়ো যাশ্চ কাশ্চ কুদৃষ্টয়ঃ।
সর্বাস্তা নিষ্ফলাঃ প্রেত্য তমোনিষ্ঠা হি তাঃ স্মৃতাঃ।। (মনুসংহিতা: ১২/৯৫)।।
অর্থাৎ : বেদবাহ্য অর্থাৎ বেদবিরুদ্ধ যে সব স্মৃতি আছে এবং যে সব শাস্ত্র কুদৃষ্টিমূলক অর্থাৎ অসৎ-তর্কযুক্ত মতবাদসমূহ যে শাস্ত্রে আছে, সেগুলি শেষ পর্যন্ত একেবারে প্রেত্য বা নিষ্ফল অর্থাৎ বৃথা বা অকিঞ্চিৎকর বলে প্রতিভাত হয় এবং সেগুলি তমোনিষ্ঠ বলে স্মৃত হয়ে থাকে।
.
আর্ষং ধর্মোপদেশঞ্চ বেদশাস্ত্রাহবিরোধিনা।
যস্তর্কেণানুসন্ধত্তে স ধর্মং বেদ নেতরঃ।। (মনুসংহিতা: ১২/১০৬)।।
অর্থাৎ : যে ব্যক্তি বেদোক্ত-ধর্মোপদেশসমূহ বেদশাস্ত্রের অবিরোধী অর্থাৎ অনুকূল তর্কের সাহায্যে অনুসন্ধান করেন অর্থাৎ নিরূপণ করতে চেষ্টা করেন, তিনিই বেদের ধর্ম অর্থাৎ বেদের অর্থ অবগত হন; এর বিপরীত স্বভাব ব্যক্তি বেদার্থধর্ম বোঝে না।

.
তবে যে কৌতুহলোদ্দীপক বিষয়টি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ না-করে থাকে না তা হলো, বৈদিক সংস্কৃতির সমুদ্রমন্থনে যে দ্বিজ বা ব্রাহ্মণ ব্যক্তিসম্প্রদায় অমৃতের অধিকারী হয়েছেন, নাস্তিকতা বন্টনেও তারাই হয়তো অগ্রণীর ভূমিকা গ্রহণ করেছেন। এক্ষেত্রে-

মনুকথিত নাস্তিক দ্বিজ, রামায়ণের ব্রাহ্মণ জাবালি অথবা মহাভারতের ব্রাহ্মণবেশি চার্বাকের উপাখ্যানের মাধ্যমে তার আভাস পাওয়া যায়। আর দেবগুরু বৃহস্পতিকে নাস্তিকবাদের গুরু বলে বর্ণনা করার মধ্যেও এর কিছু ইঙ্গিত মেলে। ব্রাহ্মণ্যধর্মী লোকায়তের নাস্তিক মতের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার সমর্থনেও হয়ত এই সব কাহিনী কোন তথ্য সরবরাহ করতে পারে। (চার্বাক দর্শন, পৃষ্ঠা-৩০/ লতিকা চট্টোপাধ্যায়)।

.
অতএব, বার্হস্পত্য, লোকায়ত ও চার্বাক এই জড়বাদী তিনটি মতাদর্শের পরবর্তী রূপ অভিন্নাকার হলেও পণ্ডিতদের ধারণায় প্রাচীনকালের ধারাবাহিক ঐতিহাসিক পরিক্রমায় প্রতিটা মতেরই কোন অন্তর্গত ভিন্নতাকে সময়ের প্রেক্ষাপটে আদিরূপের সাপেক্ষে অস্বীকার করা যাবে না। তাই কেউ কেউ এই প্রাচীন দর্শনকে চার্বাকপন্থী, লোকায়ত এবং বার্হস্পত্য বা বৃহস্পতিশিষ্য হিসেবে তিনটি শ্রেণীতে ভাগও করেছেন। তবে সেরকমের সুনির্দিষ্ট কোন তথ্য প্রমাণ না থাকায় ‘নাস্তিক’ সংজ্ঞার বৃহৎ পরিধিতে এগুলোকে আর পৃথক গোষ্ঠি ভাবা সমীচীন হবে না বলেই মনে হয়। তবে প্রাচীন সাহিত্যে চার্বাক দর্শনের মূলগত দৃষ্টিতে কিছু শ্রেণীগত ভেদ চোখে পড়ে ঠিকই, যা নিয়ে কিছুটা হলেও আলোচনার অবকাশ থেকে যায়।

(চলবে…)

[আগের পর্ব: চার্বাক-ষষ্ঠি] [*] [পরের পর্ব: চার্বাক-দর্শনের শ্রেণীগত ভেদ]