আমরা যে সময়ে বাস করি সেটা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সময়। সকালে ঘুম থেকে উঠে রাতে শুতে যাবার আগ পর্যন্ত আমরা হামেশা বিজ্ঞানের উপকরণ ব্যবহার করি। বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানির সরবরাহ, টোস্টার-মাইক্রোওয়েভ, ইন্টারনেট-ল্যাপটপ-আইফোন, বাতি-পাখা-লিফট, গাড়ি-বাস-বাইক, টিভি-ডিভিডি-হোমথিয়েটার ইত্যাদি সবই আধুনিক প্রযুক্তির অবদান। প্রাযুক্তিক উৎকর্ষের কল্যাণে নিত্যনতুন ঔষধ আবিষ্কৃত হয়েছে, আমাদের গড় আয়ুষ্কাল বেড়েছে। বাতাসের মধ্যে থেকেও যেমন বাতাসের অস্তিত্ব আমরা সচেতনভাবে টের পাইনা, ঠিক তেমনি বিজ্ঞানের মধ্যে থেকেও আমরা বিজ্ঞানকে ভুলে থাকি। শুধু ভুলে থাকি না, ভুলে থাকার জন্য সক্রিয়ভাবে চেষ্টা করি। বাইরের জগৎ সম্পর্কে জানতে না চাওয়ার এই মজ্জাগত সমস্যা বিশেষ করে আমাদের দেশে বেশী প্রকট। বাঙালি মুসলমানের বুদ্ধিবৃত্তিক এই কূপমণ্ডুকতা দীর্ঘস্থায়ী ঔপনিবেশিক সংস্কৃতির ফল বলেই মনে হয়। আমরা ভোগ করি ঠিকই, কিন্তু কী ভোগ করছি তার সম্পর্কে বিন্দুমাত্র কৌতুহলী আমরা নই। এই ভোক্তা-সংস্কৃতির খিদে মিটিয়ে বিদেশী কোম্পানি প্রচুর মুনাফা দেশের বাইরে নিয়ে যাচ্ছে সেটা আমরা দেখতে-বুঝতে-শুনতে চাইনা। চোখ-বন্ধ ‘কলুর বলদে’র মতো ব্যাপারটা আরকি! অন্যদিকে, শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির ব্যাপারে আমরা অতিমাত্রায় উৎসাহী। নাচ-গান-কবিতা-গল্প-উপন্যাসে আমরা সবসময়েই অত্যুৎসাহী। একজন নাচিয়ে কিংবা গাইয়ে কিংবা কবি-ঔপন্যাসিকের জন্মদিন-মৃত্যুদিন আমরা যত জাঁকজমক সহকারে পালন করি, একজন বৈজ্ঞানিকের জন্য তা আমরা করি না। এক/দুইজন বিজ্ঞানী ছাড়া আর কোনো বিজ্ঞানীর নামেই আমাদের রাস্তা-ভবন-ইনস্টিটিউটের নামকরণ করা হয় না।
বিজ্ঞান তাই আজ আমাদের ঘরের পেছনের ব্যাকইয়ার্ডে জায়গা পেয়েছে। আমাদের সদর-অলিন্দে গান-বাজনা ও কবিতা-উপন্যাসের একচ্ছত্র আধিপত্য। এই কারণেই আজ আমাদের সমাজে বিজ্ঞানমনস্কতার অভাব, আর তাই আমাদের স্কুল-কলেজগুলোতে বিজ্ঞান-শিক্ষার্থীর সংখ্যাও কমতির দিকে। আমার বক্তব্য এই নয় যে, শিল্প-সংস্কৃতির চর্চা খুব খারাপ এবং সেহেতু তা পরিত্যাজ্য। অবশ্যই তা নয়। শিল্পচর্চা মননকে কোমল ও পরিশীলিত রাখে। সেইজন্যেই পশ্চিমে প্রকৌশলবিদ্যার কারিকুলামে প্রচুর মানবিকবিদ্যার সমাহার রাখা হয়। কিন্তু যেহেতু আমরা পিছিয়ে পড়া দেশের নাগরিক, সেহেতু উন্নয়নের রেলগাড়িটা ক্রমশই আমাদের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। যেহেতু বিজ্ঞান শিক্ষায় ক্রমশ আমরা লক্ষ্যহীন হয়ে পড়ছি, তাই আমাদের উচিত হবে মানব সংস্কৃতির এক অচ্ছেদ্য উপাদান এই বিজ্ঞানচর্চাকে আর অবহেলা না করা।
মানুষ যা কিছু করে তার পূর্ণাঙ্গ সমাহারই তার সংস্কৃতি। তাই শুধু শিল্প-চর্চা ও সুকুমার কর্মকাণ্ডই আমাদের সংস্কৃতি নয়। আমরা ফেসবুক করি, ইন্টারনেটে উইকিপিডিয়া পড়ি, ব্লগ লিখি – এসবও আমাদের সংস্কৃতি। আর তাই বিজ্ঞানও আমাদের সংস্কৃতির অচ্ছেদ্য অঙ্গ। এজন্যই আমরা ‘বিজ্ঞান-সংস্কৃতি’ শব্দবন্ধটি উচ্চারণ করি এটা মনে করিয়ে দেবার জন্য যে, আমাদের সংস্কৃতিতে সুকুমার চর্চা-কবিতা-উপন্যাস-নাটক-সিনেমা যেমন, তেমনি বিজ্ঞানও ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
আমাদের দেশে বিজ্ঞান-সংস্কৃতির ব্যাপারটা জনপ্রিয় করার উপায় কী? সমাজের বিভিন্ন স্তরে বিজ্ঞান সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানো। তার জন্য প্রয়োজন প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে বিজ্ঞান শিক্ষার বিশেষ মানোন্নয়ন। এই মুহূর্তে স্কুলে যেভাবে বিজ্ঞান পড়ানো হয়, বিজ্ঞানের যেসব পাঠ্যবই পড়ানো হয় তা একদমই যুগোপযোগী নয়। এমনকি যারা বিজ্ঞানের ছাত্র নয়, অর্থাৎ মানবিক ও বাণিজ্যশাখার ছাত্র-ছাত্রীদের জন্যেও বিজ্ঞানের বইকে আকর্ষণীয় করে তুলতে হবে। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, বিজ্ঞানের ভাণ্ডারের খবর বিজ্ঞানের ছাত্রের জন্য তোলা থাকুক, কিন্তু বিজ্ঞানের অলিন্দের খবরটুকু সবার জানা উচিত। এতে করে শিক্ষার বুনিয়াদী ভিত্তিতে বৈজ্ঞানিক কাণ্ডজ্ঞান ব্যাপ্ত করা সম্ভব হবে। আর তা হলে আমরা একটা সুন্দর সমাজ পাবো। এটি একদিনে সম্ভব নয়, কিন্তু এই প্রচেষ্টা শুরু না হলে তা কখনোই আয়ত্তও হবে না। সে বড় দুঃখের ব্যাপার হবে।
আমাদের সংস্কৃতি কতটা বিজ্ঞান-বিমুখ হয়ে গেছে তার একটা ছোট্ট উদাহরণ দেই। জনপ্রিয় টিভি অনুষ্ঠান ‘কে হতে চায় কোটিপতি’তে এক ভদ্রমহিলার কাছে প্রশ্ন রাখা হয়েছিল : দূরের তারা দেখার যন্ত্রের নাম কী? অপশন-১ : স্পেকট্রোস্কোপ; অপশন-২: মাইক্রোস্কোপ; অপশন-৩ : বায়োস্কোপ; অপশন-৪: টেলিস্কোপ। ভদ্রমহিলা নাকি লাইফ-লাইন ব্যবহার করেও এ প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেনি। এই হলো অবস্থা! বিজ্ঞানের সাধারণ বিষয়ের প্রতি জ্ঞানের অভাব কী পর্যায়ে গেলে নক্ষত্র দেখতে যে টেলিস্কোপ লাগে সেটাও জানা থাকে না – তা ভাবা যেতে পারে। অথচ একটি উন্নত দেশে আপনি দেখবেন সেখানকার সাধারণ মানুষের বুনিয়াদী শিক্ষার স্তরটি অনেক উঁচুতে। সেখানে সাধারণভাবে একটা বৈজ্ঞানিক কাণ্ডজ্ঞান কাজ করে। যে সমাজের জীবন ও সংস্কৃতি যতো বেশী বিজ্ঞানঘনিষ্ঠ, সে সমাজ ততো বেশী শ্রম ও সময়ের মর্যাদা দিতে জানে। জার্মানিতে ঘন্টায় ঘন্টায় ইন্টারকণ্টিনেন্টাল ট্রেন আসা-যাওয়া করে কাঁটায় কাঁটায় নিয়ম মেনে। অথচ আমাদের দেখুন, সময় যে কী মূল্যবান বস্তু তা আমরা পাত্তাই দেই না। আর তাই এখানে ন’টার গড়ি ক’টায় যায় অবস্থা। ঘন্টার পর ঘন্টা আমরা যানজটে বসে থাকি। বিজ্ঞান-সংস্কৃতি যে সমাজের রন্ধ্রে প্রবেশ করেছে, তাদের পিছে তাকানোর জো নেই, শুধুই সমুখপানে ছুটে চলা। অথচ আমাদের এখনো শায়েস্তা খাঁর আমল নিয়ে হা হতোস্মি! অবাক!
বিজ্ঞান যখন সংস্কৃতির সাথে মিশে যায়, তখন কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দৃশ্যতই দেখা যাবে। রাস্তাঘাটে পথে-বাজারে সর্বত্রই মানুষের আচরণের একটি গুণগত পার্থক্য দৃশ্যমান হবে, আশা করা যায়। মানুষের গড়-আচরণে একটা যুক্তিনিষ্ঠতা দেখা যাবে। অবশ্য এটা রাতারাতি কখনোই হবে না। এটি একটি দীর্ঘপ্রক্রিয়ার ফল। বিজ্ঞান-শিক্ষিত মানুষেরা বেশী বেশী শৃঙ্খলা মেনে চলেন। শিক্ষার হার বাড়ালেও এটা আসবে, কিন্তু বুনিয়াদি শিক্ষায় যদি বিজ্ঞানের অংশটা বেশী থাকে তবেই এটা আরো প্রকট হবে। মানুষকে এটা আরো সচেতন করবে, প্রতিবাদীও করবে। কিন্তু সেসব প্রতিবাদ শুধু অন্ধ-প্রতিবাদ নয়, যুক্তিনির্ভর প্রতিবাদ হবে। বিজ্ঞান-সংস্কৃতি মানুষকে সাধারণভাবে কিছুটা হলেও দ্রষ্টা বা ভিশনারি করে তুলবে। মানুষ যখন দীর্ঘমেয়াদী লাভ-ক্ষতি বিবেচনা করতে শিখবে, তখন সে স্বল্পমেয়াদে আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত কখনোই নেবে না। এটা বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা করতে আমাদেরকে আরো উপযোগী করে তুলবে। বিজ্ঞান-সংস্কৃতি সাধারণ মানুষের সামনে একটি ভবিষ্যৎ পৃথিবীর ছবি তুলে ধরে। ফলে মানুষের একটা ভবিষ্যৎ-পরিকল্পনা থাকে, একটা স্বপ্ন থাকে। স্বপ্নহীন ভবিষ্যৎহীন শূন্যমানবের কবল থেকে এটি সমাজকে রক্ষা করে।
বিজ্ঞান-সংস্কৃতি মানুষকে একটি উচ্চতম রুচিশীলতা দান করে। স্বভাবতই এটা সামাজিক কদর্যতার বিপরীতে এক সুস্থ পরিশীলিত জীবনের কথা বলে। অবশ্যই এটা শুধু ব্যক্তি-জীবনেই সীমাবদ্ধ নয়, এতে সামাজিক জীবনের একটা গড় হিসাবের কথা বোঝানো হয়েছে। বিজ্ঞান-সংস্কৃতি আয়ত্তে এলেই সব রাহাজানি ও রক্তপাত, লোভ ও পঞ্চ ম-কার লোপ পাবে, তা নয়। আশা করা যায়, পুরো সমাজ জীবনে একটি স্থিতিশীলতা আসবে। এখন যেমন আমরা এক অস্থির সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। আমাদের এই সামাজিক অস্থিরতার পেছনে এটা বড় কারণ কিন্তু নেপথ্যের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি। এই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি অবশ্যই এসেছে পশ্চিম থেকে, কিংবা বলা যায় উন্নত দেশ থেকে। কিন্তু আমাদের শাপলা-শালুক আর হিজল-তমাল এবং বিল-হাওর আর জলাশয়ের দেশের স্বাভাবিক বিজ্ঞান-বিমুখতার কারণে আমরা প্রযুক্তিটা ব্যবহার করছি মাত্র। এর পেছনে যে বিজ্ঞান থাকে, সেটা আমরা জানিই না। যে সমাজ একটি মুঠোফোন তৈরি করে রপ্তানি করে আর যে সমাজ শুধু মুঠোফোনটি আমদানী করে ব্যবহার করে, এ দুইয়ের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য থাকে। এই পার্থক্যটাই বিজ্ঞান-সংস্কৃতি।

বিজ্ঞান-বিমুখ মানুষ ভবিষ্যৎহীন এবং আত্মপ্রবঞ্চক। এই মৌলিক অনুমানটি আমাদের কবি-সার্বভৌম রবীন্দ্রনাথের ছিল। রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তি-মানুষের মধ্যে কবিতা-গান এবং বিজ্ঞান-বিষয়ক মৌলিক অনুভব ছিল। তিনি একটি বিজ্ঞান-বিষয়ক বই লিখেছিলেন, যার নাম ‘বিশ্বপরিচয়’; এই বইটি বিজ্ঞান-সাহিত্যের এক উজ্জ্বলতম উদাহরণ। এই বইটির সূচনায় সত্যেন্দ্রনাথ বসুকে উদ্দেশ্য করে রবীন্দ্রনাথ যে ভূমিকাটি লিখেছিলেন সেখানে তিনি বলেছেন,

“শিক্ষা যারা আরম্ভ করেছে, গোড়া থেকেই বিজ্ঞানের ভাণ্ডারে না হোক, বিজ্ঞানের আঙিনায় তাদের প্রকাশ করা অত্যাবশ্যক। এই জায়গায় বিজ্ঞানের সেই প্রথম পরিচয় ঘটিয়ে দেবার কাজে সাহিত্যের সহায়তা স্বীকার করলে তাতে অগৌরব নেই। সেই দায়িত্ব নিয়েই আমি [বই লেখার] কাজ শুরু করেছি। কিন্তু এর জবাবদিহি একা কেবল সাহিত্যের কাছেই নয়, বিজ্ঞানের কাছেও বটে। তথ্যের যাথার্থ্যে এবং সেটাকে প্রকাশ করবার যথাযথ্যে বিজ্ঞান স্বল্পমাত্র স্খলনও ক্ষমা করে না। স্বল্পসাধ্যসত্ত্বেও যথাসম্ভব সতর্ক হয়েছি। বস্তুত, আমি কর্তব্য থেকে লিখেছি, কিন্তু কর্তব্য কেবল ছাত্রের প্রতি নয়, আমার নিজের প্রতিও। এই লেখার ভেতর দিয়ে আমার নিজেকেও শিক্ষা দিয়ে চলতে হয়েছে। এই ছাত্রমনোভাবের সাধনা হয়তো ছাত্রদের শিক্ষা-সাধনার পক্ষে উপযোগী হতেও পারে।”

এই হলো বিজ্ঞান-সংস্কৃতির অচ্ছেদ্য অঙ্গ, বিজ্ঞান-সাহিত্যের সর্বোৎকৃষ্ট উদাহরণ। ব্রিটেনের লেখক-বিজ্ঞানী সি. পি. স্নো তাঁর ‘দ্য টু কালচারস্’ বইয়ে এই বিজ্ঞান-সংস্কৃতির মেলবন্ধনের কথা বলতে গিয়ে বলেছেন, কলাবিদ্যার মানুষেরা বিজ্ঞান জানার তোয়াক্কা করেন না, আর বিজ্ঞানীরা কাব্যিকতা দেখলেই ছোঃ ছোঃ করে ওঠেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন, বিজ্ঞানীর পক্ষে শেক্সপিয়ার না-জানা যেমন অপরাধ, কলাবিদ্যার মানুষের পক্ষে তাপগতিবিদ্যার দ্বিতীয় সূত্র না জানা তেমনই সমান অপরাধ। এখানে তিনি বুঝিয়েছেন যে, কোনো বৈজ্ঞানিক সূত্রের গাণিতিক প্রমাণ জানতে হবে এমন নয়, কিন্তু বৈজ্ঞানিক সিদ্ধান্তটি জানা থাকলেই হলো। কিন্তু চেতনার এই বিনিময়টা প্রায়শই একমুখী হয়। এটি কাম্য নয়। ইদানিং কিছুটা দেখা যায়, কবিরাও বিজ্ঞানের বই-টই পড়ছেন। কবি শামসুর রহমানের খাস কামরায় আমি স্টিফেন হকিংয়ের বই দেখেছি। এই বিনিময়টা যত বেশী হয় ততোই সমাজের জন্য মঙ্গল, ব্যক্তির জন্য মঙ্গল তো বটেই। এভাবেই বিজ্ঞান-সংস্কৃতি ক্রমে ঋদ্ধ হবে। একজন সাম্প্রতিক কবির লেখা দেখুন, কত বিজ্ঞান-ঋদ্ধ তাঁর উচ্চারণ:
“দশ কোটি বছর একটানা রাজত্ব করেছিল ডাইনোসর
গ্রহাণুর ধাক্কায় পৃথিবী জোড়া প্রলয়ের জলে
সাড়ে ছ’কোটি বছর আগে লুপ্ত হয়ে গেল
জুরাসিক যুগ
কেন ‘স্তন্যপায়ী’ বলে পিন ফোটাচ্ছ আমাকে
ডাইনোসর বেঁচে থাকলে কে-টি-বাউন্ডারির
সন্ধিক্ষণে
আসতেই পারত না স্তন্যপায়ীরা, বাঁচতে পারত না!
আশ্চর্য, আমি যে-কামরায় উঠি সেখানেই
টাইম-স্পেসের রাস্তা দিয়ে ঢুকে পড়ে একটা গান
আশ্চর্য, আমাদের গ্যালাক্সির প্রায় পঞ্চাশ কোটি গ্রহে
প্রাণ থাকবার সম্ভাবনা
কিন্তু এখনও যোগাযোগ করছে না কোনও এলিয়েন,
সায়েন্স ফিকশন থেকে আমরাও ধরতে পারছি না তাদের!
প্রাণ শুধু জন্মালো পৃথিবীতে, আমরা এই যে
কথা বলছি
সুর বসাচ্ছি লিরিকের শরীরে
আশ্চর্য! কী আশ্চার্য এই জন্ম! এই বৈশাখ!”

পিনাকী ঠাকুরের এই কবিতায় (‘টাইম-স্পেসের রাস্তা’, দেশ, ২রা মে ২০১২) বিজ্ঞান-বোধ গভীর ও নান্দনিকভাবে এসেছে। ‘কে-টি-বাউন্ডারি,’ স্তন্যপায়ীর বিবর্তন, ভিনগ্রহে প্রাণের কথার এই বিষয়গুলো কবির গভীর বিজ্ঞান-পাঠের স্বাক্ষর।
বিজ্ঞান-দার্শনিক লিয়াকত আলী বলেন,

“বিগত কয়েক শতাব্দীতে বিজ্ঞানের অভাবনীয় বিকাশ ‘মানব সংস্কৃতি’ নামক মুদ্রাটির দুটি পরিপূরক কিন্তু ভিন্ন পিঠকে স্পষ্ট করে দিয়েছে। আগের শতাব্দীগুলোতে শিল্প-সাহিত্য ও দর্শনের প্রায় একপেশে বিকাশের কারণে literarary mind-ই সমাজে অধিক প্রভাব ফেলেছে। বিশ্ববীক্ষায় এই মনই অধিক প্রাধান্য পেয়েছে। আর তাই, ওই সময়ের অধিকাংশ উন্নত সংস্কৃতিই মুখ্যত literarary ছিল। পরে বিজ্ঞানের বিকাশ জন্ম দিতে শুরু করে বৈজ্ঞানিক সংস্কৃতির। এই দুই সংস্কৃতির প্রত্যেকটিরই রয়েছে নিজস্ব mode of intellect; প্রত্যেকেরই রয়েছে নিজস্ব বৈশিষ্ট্যসূচক বিষয়বস্তু, প্রকাশভঙ্গি, যুক্তি, পদ্ধতি, মূল্যবোধ, আগ্রহ, অনাগ্রহ এবং সমস্যা। তবে শুধু যে পার্থক্য আছে তাই নয়, একই মানব-বৃক্ষের দুটি শাখা হিসেবে তাদের শিকড় প্রোথিত রয়েছে একই ভূমিতে – কল্পনার ব্যাপ্তি, সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ, সত্যনিষ্ঠা, আকর্ষনীয় প্রকাশ-ক্ষমতা – এ দুই সংস্কৃতিরই সাধারণ বৈশিষ্ট্য। বর্তমান কালে আমরা এই দুই সংস্কৃতির পার্থক্যগুলোকেই বেশী করে দেখছি; তাদের মৌলিক অখণ্ডতাকে ভুলে যেতে বসেছি। … আর এজন্যেই আধুনিক কবিতা কিংবা চিত্রকলা বোঝেন এমন বিজ্ঞানীর সংখ্যা হাতে গোণা যাবে; অন্যদিকে কারিগরী শব্দের কথা বাদ দিয়েও, শুধুমাত্র বৈজ্ঞানিক সংস্কৃতির মর্ম অনুধাবনে সক্ষম এমন সাহিত্য-প্রেমিকও বিরল। … মানুষের ব্যক্তিত্বের ভারসাম্যের জন্য এই দুই সংস্কৃতির সম্মিলন প্রয়োজন; এর অভাবে ব্যক্তিত্বের বিকাশ একপেশে হতে বাধ্য। জন্মগতভাবে প্রাপ্ত শক্তিশালী প্রবৃত্তিসমূহ এবং সেই সঙ্গে সভ্যতার শৈশব থেকে নিরবচ্ছিন্নভাবে বিকশিত literarary mind-এর প্রভাবে আমরা এখন পর্যন্ত বলতে গেলে উত্তরাধিকাসূত্রে literarary সংস্কৃতির মধ্যে জন্মাই। বাংলাদেশে এ অবস্থা আরও প্রকট, কারণ সামাজিক-রাজনৈতিক বিভিন্ন কারণে বিজ্ঞানের চর্চা এদেশে বিলম্বিত। তাই আজ পর্যন্ত আমরা মধ্যযুগীয় বৈষ্ণব পদাবলীর সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল ছেড়ে পুরোপুরি বেরুতে পারিনি। এদেশের শিল্পী, রাষ্ট্রনায়ক, সমাজচিন্তক, আইনজ্ঞ এমনকি অধিকাংশ বিজ্ঞানী পর্যন্ত যুক্তির আবর্তে বর্ধিঞ্চু মানুষ নন, মুখ্যত ভাবাবেগে আপ্লুত মানুষ। তাই এদেশের সাংস্কৃতিতে যদি ভারসাম্য আনতে হয় তাহলে বিজ্ঞানকেও সংস্কৃতির অংশ করে তুলতে হবে।” [সংকলিত, ‘বিজ্ঞান লেখক সম্মেলন’, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ১৯৮৬, পৃ. ৫০-৫১।]

[বিডি আর্টস-এ ৭ই জুলাই ২০১২ তে প্রকাশিত]