চলে গেছেন হুমায়ুন, শেষ হয়ে গেছে সমকালীন বাংলা সাহিত্যের এক যুগ, যে যুগ আর কোনদিন হয়ত ফিরে আসবে না। রবীন্দ্রনাথের পাশে সাহিত্য সমালোচনার মারপ্যাঁচে তার হয়ত ঠাই হবে না, তবে পাঠকের হৃদয়ে তাঁর চিরস্থায়ী আসন নেবার মত তূল্য আর কেউ সহসা আসবেন এমন ভরসা পাই না। আমার এই লেখার উদ্দেশ্যে আসলে ভক্ত পাঠকের শোক প্রকাশ বা স্মৃতিচারন গোছের কিছু নয়, এক অপ্রিয় দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করছি বলাটাই ভাল। এই দায়িত্ব পালনের এটা উপযুক্ত সময় নয় জানি, তবে করতে বাধ্য হচ্ছি।

এই বিপুল জনপ্রিয় লেখক যে শুধু পাঠক/দর্শক বন্দনাই পেয়েছেন তা নয়, সাথে সাথে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য বিতর্কে জড়িয়েছেন, কিছু লেখালেখি সম্পর্কিত, কিছু তার ব্যাক্তিগত জীবন সম্পর্কিতও বটে। লেখালেখির ব্যাপারে সম্প্রতি তার অপ্রকাশিত ‘দেওয়াল’ উপন্যাসের প্রথম আলোয় দু’ অধ্যায় ছাপা হবার পর মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী অনেকেই তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন (আমিও তাতে স্বাভাবিক ভাবেই ছিলাম নিজস্ব তথ্য যুক্তির ভিত্তিতে), ব্যাপারটি এমনকি উচ্চ আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে। মুশকিল হল এর জের ধরে কেউ কেউ তার ওপর অন্যায্য ভাবে অন্য দায়ও চাপিয়ে দেবার চেষ্টা করছেন তিনি কত ভয়াবহ বংগবন্ধু বিদ্বেষী কিংবা রাজাকারি চেতনায় বিশ্বাসী তা প্রমান করতে। তার বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ আনা হচ্ছে যে তিনি তাঁর ‘জোছনা ওঁ জননীর গল্প’ বইতে নাকি বংগবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষন নিয়ে ইচ্ছেকৃত ভাবে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছেন। গুরুতর অভিযোগের তীর হল তিনি নাকি সে বইতে প্রমান করার চেষ্টা করেছেন যে বংগবন্ধু সেদিন ভাষন শেষ করার সময় জয় বাংলার সাথে সাথে ‘জিয়ে পাকিস্তান’ বলেছিলেন।

এই অভিযোগ প্রথম শোনার পর আমি যারপর নাই বিস্মিত হই। বিস্ময়ের কারন বংগবন্ধু যে ‘৭ই মার্চের সেই কালজয়ী ভাষনের শেষে জিয়ে পাকিস্তান আসলেই বলেননি এটা আমি নিশ্চিত ভাবে প্রথম বুঝতে পারি হুমায়ুন আহমদের এই বই পড়েই। এই একই বই পড়ে কারো পক্ষে বিভ্রান্ত হওয়া কিংবা উলটো ধারনা পাওয়া কিভাবে সম্ভব সেটা আমার মোটা মাথায় ঢোকে না। ধরে নিচ্ছি যে সমালোচনাকারীরা আসলেই বইটি পড়েছেন।

এই ‘জিয়ে পাকিস্তান’ বিষয়টি হুমায়ুন বই এর শুরুতে ভূমিকা (পূর্ব কথা) আকারে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক কিছু ঐতিহাসিক বিভ্রান্তি বর্ননা করার সময় ব্যাখ্যা করেছেন। তার জবানীতেই শোনা যাক ‘জিয়ে পাকিস্তান’ বিষয়ে আসলেই তিনি ‘জোছনা ওঁ জননীর গল্প’ বইতে কি লিখেছিলেন।

জাতির জনক বংগবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চের বিখ্যাত ভাষন প্রসংগেও একই ব্যাপার। জাষ্টিস মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান সাহেবের বিখ্যাত গ্রন্থ বাংলাদেশের তারিখ প্রথম সংস্করনে তিনি উল্লেখ করেছেন ভাষনের শেষে শেখ মুজিবুর রহমান বললেন ‘জয় বাংলা। জিয়ে পাকিস্তান’। দ্বিতীয় সংস্করনে তিনি ‘জিয়ে পাকিস্তান’ অংশটি বাদ দিলেন। কবি শামসুর রহমানের লেখা আত্মজীবনী যা দৈনিক জনকন্ঠে ‘কালের ধূলোয় লেখা’ শিরোনামে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছে সেখানেও তিনি বলেছেন শেখ মুজিবুর রহমানের শেষ কথা ছিল ‘জিয়ে পাকিস্তান’। আরো অনেকের কাছে আমি এ ধরনের কথা শুনেছি, যারা আওয়ামী ভাবধারার মানুষ। সমস্যা হল আমি নিজে ৮ এবং ৯ই মার্চের সমস্ত পত্রিকা খুঁজে এরকম কোন তথ্য পাই নি। তাহলে একটি ভুল ধারনা কেন প্রবাহিত হচ্ছে?

বংগবন্ধু যদি ‘জিয়ে পাকিস্তান’ বলে থাকেন তাহলে তাতে দোষের কিছু নেই। তিনি যা বলেছেন অবশ্যই ভেবে চিন্তেই বলেছেন। পাকিস্তানের সংগে তার আলোচনার পথ খোলা রাখতে হবে। তাকে সময় নিতে হবে। ৭ই মার্চে যুদ্ধ ঘোষনার মত অবস্থা তার ছিল না। বংগবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষন গেটেসবার্গ এড্রেসের চেয়েও গুরুত্বপূর্ন বলে আমি মনে করি। এখানে কোন অষ্পষ্টতা থাকা বাঞ্জনীয় না।

ওপরের অংশ পড়ে আপনাদের কি মনে হয়? হুমায়ুন কি এ বইতে বংগবন্ধু ‘জিয়ে পাকিস্তান’ বলেছিলেন এটা সরসারি বা কৌশলে প্রমানের চেষ্টা করেছেন, নাকি উল্টোটাই করেছেন? আমার তো পরিষ্কারই মনে হয়েছে যে উল্টোটাই তিনি প্রমানের চেষ্টা করেছেন। তিনি অবশ্যই সংশয়ে ভুগেছেন, যার মূল কারন আওয়ামীপন্থী লোকদের জবানীতেই ‘জিয়ে পাকিস্তান’ এর সন্ধান পাবার পর। তবে সে সংশয় নিরসনে নিজেই কিছু গবেষনা করে নিশ্চিত হয়েছেন যে আসলে বংগবন্ধু সেদিন জয় বাংলার সাথে জিয়ে পাকিস্তান বলেননি, কারন ততকালীন কোন পত্রিকায় এর কোন রেফারেন্স নেই। অর্থাৎ যারা সেদিন ‘জিয়ে পাকিস্তান’ শুনেছেন বলে দাবী করেছেন তাদের দাবী যে কোন কারনেই হোক সঠিক নয়। নিজেই তাই সত্য আবিষ্কার করে প্রশ্ন করেছেন যে ‘তাহলে একটি ভুল ধারনা কেন প্রবাহিত হচ্ছে?

এরপর সত্য প্রকাশের সাথে কিছু বাস্তব বিশ্লেষনও দ্বিতীয় প্যারায় করেছেন যা খুবই বাস্তব সম্মত। বংগবন্ধু সহ সাড়ে সাত কোটি বাংগালী ৭ই মার্চ, ’৭১ তারিখে পাকিস্তানেরই নাগরিক ছিল, বংগবন্ধু বাংলার লোক হলেও পাকিস্তানের জাতীয় নেতা হিসেবে জিয়ে পাকিস্তান বলাটা তার পক্ষে মোটেই অস্বাভাবিক কিছু ছিল না। অর্থাৎ এ নগন্য বিষয় নিয়ে ঘোঁট পাকানোও আসলে অসত উদ্দেশ্যেই করা হয়। এ নিয়ে বহুদা কমপ্লেক্সে ভোগারও আসলে কোন প্রয়োযন নেই। আর যেখানে আদৌ ‘জিয়ে পাকিস্তান’ বলাই হয়নি সেখানে তো আর কোন কথাই আসে না।

আমি বুঝতে পুরোই অক্ষম যে বিভ্রান্তিটি এমন চমতকার তথ্য যুক্তি সমেত ব্যাখ্যা করার পরেও কিভাবে তার লেখা পড়ে কারো বিভ্রান্তির অবকাশ থাকে? আমার কাছে অবশ্য ২০০৪ সালে প্রকাশিত বইটির প্রথম সংস্করনই আছে, সেখান থেকেই কথাগুলি কোট করেছি, অন্য কোন সংস্করনে কি হুমায়ুন ভিন্ন কিছু বলেছেন? কেউ জানালে বাধিত হব। আমার ভুল হচ্ছে কিনা যাচাই করতে বইটির ভেতরেও ‘৭ই মার্চের ভাষন ঘটিত বর্ননা পড়েছি যা অবশ্যই ইতিহাসের দলিল নয়। কিন্তু সেখানেও (১০৪/১০৫ নং পাতায়) জিয়ে পাকিস্তান ঘটিত আর কোন কথা নেই।

আমার লেখার উদ্দেশ্য এখানে ‘জিয়ে পাকিস্তান’ ক্যাঁচাল নিয়ে আলোচনা নয়, হুমায়ুন সাহিত্যের সামগ্রিক আলোচনা সমালোচনাও নয়। আমি নিজে হুমায়ুন ভক্ত হলেও অন্ধ ভক্ত নই। তীব্র ভাবে হুমায়ুন সমালোচনা করেছি, এমনকি তার মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক লেখারও কিছু মৌলিক দূর্বলতা যা আমার চোখে খুব তীব্রভাবে লাগে তার সমালোচনা করেছি। সাথে সাথে এটাও স্বীকার করি যে এখনো তার বই হাতে পেলে সেটাই আগে পড়ি, তাঁর সাহিত্য মান কত নীচু তা বুঝি না বলে নিজেকে সৌভাগ্যবানই মনে হয়। এখানে আমার শুধু বক্তব্য তিনি যা বলেননি তার দায় তাঁর ওপর চাপানোর চেষ্টা করা যে কোন আদর্শবাদের দোহাই দিয়েই হোক না কেন ঠিক নয়। আর যে কোন লেখাই পড়ে বোঝার চেষ্টা ছাড়া আলোচনা সমালোচনায় নামা কোন কাজের কথা নয়। তার লেখার সমালোচনা করার আরো বহু ভাল পয়েন্ট আছে। অবশ্য কেউ ‘জোছনা ও জননীর গল্প’ বইতে ‘জিয়ে পাকিস্তান’ বিষয়ে ভিন্ন কিছু লেখা আছে রেফারেন্স সহ দেখালে আলোচনা স্বাপেক্ষে কথাগুলি প্রত্যাহার করে নিতে পারি।