সেই অনেকদিন আগের কথা। আমি তখন ১০ বছরের বালিকা। প্রাইমারি ইস্কুল শেষ করে গিয়েছি হাই ইস্কুলে ভর্তি হতে। ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তির দিনের স্মৃতি আমার মনে আজো অম্লান। আমার পরনে ছিল একটি স্কার্ট।হাঁটু থেকে চরণ অবধি ছিল অনাবৃত। বাবরিকাটা কুন্তলরাশি ঘাড় এবং কাঁধের উপর ঝুলছিল। কপালের উপরও ছিল কাটা চুলের রাশি। শখ করে কপালে একটি লাল টিপও পরেছিলাম। আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে বিস্ময়, পুলক ও ভয় মিশ্রিত মনে চারিদিকে চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছিলাম। ইস্কুলের বিশাল বিশাল ঘর, সামনে বিরাট খেলার মাঠ, মাঠের ওপারে পুকুর, তার পাশে বাজার, অনেক দোকানপাট ও একটি মসজিদ। মনে মনে ভাবছিলাম এই ইস্কুলে আমি পড়ব! এত ছেলেমেয়ে এত শিক্ষক, কাউকেই তো চিনি না। আমি এই পুচকে মেয়ে কোন রুমে গিয়ে বসব, কী পড়ব, কী ক’রে কী হবে? ইত্যাদি। এমন হতবিহবল, ভাবনাচিন্তাময় অবস্থার আকস্মিক পরিসমাপ্তি ঘটল একটি বিকট শব্দ ও রুদ্রমূর্তির আবির্ভাবে। দেখলাম শ্মশ্রুমণ্ডিত, মাথায় গোলটুপিযুক্ত, কপালে এবাদতের আঘাতে সৃষ্ট স্থায়ী কালোটিপ অঙ্কিত, গোল পাঞ্জাবি ও গিরার বেশ উপরে লুঙ্গি পরিহিত এক জলজ্যান্ত বাহ্যিক-ভয়াবহ মানুষ সশরীরে আমার সামনে আবির্ভূত।

আমার তো ভূত দেখার মত অবস্থা! কে এই দেবদূত? তিনি চোখমুখ সম্ভবের অতিরিক্ত কঠিন করে আমার উদ্দেশ্যে দেববাণী নিঃসৃত করতে লাগলেন। জিজ্ঞেস করতে লাগলেন, এই মেয়ে তুই কি হিন্দু? আমি কাঁদো কাঁদো হয়ে বললাম –না। তোর বাবা-মা কি হিন্দু? না। তাহলে কপালে এটা কি লাগিয়েছিস? জানিস না তিলককাটা হারাম! এক্ষুনি এটা ফেলে দে। আমি অশ্রু বিসর্জন দিতে দিতে আমার অতি সাধের টিপখানাও বিসর্জন দিয়ে দিলাম। তোর ঠ্যাং দেখা যাচ্ছে কেন? তুই কি কাক, নাকি বক? তোর পায়জামা কই? চুলের এই দুরবস্থা কেন? চুল কেটে ফেলে দিয়েছিস কেন? উড়না কই? মাথায় কাপড় কই? আমি প্রশ্নে প্রশ্নে জর্জরিত ও নাস্তানাবুদ। আমার হাই ইস্কুলগামী প্রতিবেশী ও কাজিনদের কাছে শুনতাম ইস্কুলের অনেক গল্প। ওদের কাছে আমি আগেই শুনেছিলাম এই ডাকসাইটে মুছলমান খালেদ স্যারের গল্পও। তিনি পৌত্তলিক ছিলেন। কোনো শুভমুহূর্তে, কোনো এক নিবেদিতপ্রাণ ও ইছলামের সম্প্রসার এবং সম্প্রচারে উৎসর্গীকৃতদিল মুছলমানের সহচার্যে এসে তিনি একমাত্র সত্য-শান্তির ধর্ম ইছলাম সম্পর্কে অবহিত হন। এবং শান্তিসাগরে ঝাঁপিয়ে পড়ে দীক্ষিত হন। উনার নাম ছিল সন্তোষ। মুছলিম হওয়ার পর নাম বদলে রাখেন সাইফুল্লাহ খালেদ। তিনি স্ত্রী-পুত্র-কন্যা সমভিব্যাহারে সপরিবারে ঈমান এনেছেন। তার পর থেকে শুরু হয়েছে বিরামহীনভাবে যে কাউকে দেখামাত্রই শান্তিময় উৎপীড়ন।

৬ষ্ঠ শ্রেণী থেকে ১০ম শ্রেণী পর্যন্ত প্রতিটি শ্রেণীতেই খালেদ স্যারের কোনো না কোনো ক্লাস ছিল। ক্লাসে ঢুকেই তিনি তারস্বরে মিলাদ পড়াতে শুরু করতেন। ‘ইয়া নবী সালাম আলাইকা, ইয়া রাসুল সালাম আলাইকা।‘ অথবা গাইতে থাকতেন, দীনের নবী মোস্তফায় রাস্তা দিয়া হাঁইটা যায়। আর অশ্রুসজল চোখে, আবেগবিজড়িত ভারীকণ্ঠে আফসোস করে বলতেন, বনের পশুও নবী চিনে। আর আমরা চিনলাম না! আহা, নবীরে চিনলাম না; নবীরে দেখলাম না ( সুরে সুরে)। ইস্কুলের পড়া নিয়ে উনার তেমন মাথাব্যথা ছিলনা। তিনি ছেলেমেয়েদেরকে সূরা জিজ্ঞেস করতেন। সবার দীনীজ্ঞান পরীক্ষা করতেন নিষ্ঠার সাথে। আমাকে সূরা জিজ্ঞেস করলে আমি প্রায়ই মার খেতাম। কারণ আমি সূরা পারতাম ৪-৫টা। তাও শুদ্ধভাবে না। দীনীজ্ঞান ত ছিলই না। আমাকে একবার জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, মাগরিবের নামাজ কয় রাকাত। আমি বলেছিলাম দশ রাকাত। খেয়েছিলাম অধম মার। দীনে জ্ঞানহীনতার জন্য জনসমক্ষে মার খেতে ও হেনস্তা হতে ভীষণ লজ্জা লাগত। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করতাম, আজই বাড়ি গিয়ে সব শিখে পাক্কা মমিন হয়ে যাবো ইনশাল্লাহ। কিন্তু প্রতিজ্ঞা পর্যন্তই। এর বেশি এগুনো হয়নি। ধর্মকর্মে উদাসীনতার জন্য নিয়মিত বাড়িতেও মার খেতাম, খালেদ স্যারের হাতেও খেতাম। তবুও আমি উদাসীনই রয়ে গিয়েছিলাম। অবশেষে সেই উদাসীনতার মেঘও কেটে গেল।
ছিলাম ধর্মকর্মে উদাসীন।
তার পরে হয়ে গেলাম পুরোপুরি ধর্মহীন।
স্যার প্রায়ই বলতেন, কে কে বাড়িতে নিয়মিত নামাজ পড়িস দাঁড়া তো দেখি। সবাই দাঁড়িয়ে যেত। সত্যি সত্যিই তোরা সবাই নামাজ পড়িস? নামাজ নিয়ে মিছে কথা বললে কিন্তু আল্লার গজব পড়বে। তার পর দুই একজন ছাড়া বাকি সবাই বসে যেত। তাদের উপর আল্লার তরফ থেকে স্যার নিজের হাতেই গজব ফেলতেন। মিথ্যে বলা ও নামাজ না পড়ার জন্য দ্বিগুণ শাস্তি।

আমাদের ইস্কুলে ছেলেরা বসত একপাশের বেঞ্চিতে আর মেয়েরা বসতো অন্যপাশের বেঞ্চিতে। খালেদ স্যার ভুলেও কভু মেয়েদের দিকে তাকাতেন না। মেয়েদের উদ্দেশ্যে কিছু বলার সময় তিনি হয়ত ছেলেদের দিকে তাকাতেন, অথবা বাইরের দিকে উদাসদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতেন, নয়ত চোখ বন্ধ করে রাখতেন। না তাকিয়েই বলতেন, চার নম্বর বেঞ্চের তিন নম্বর মেয়ে, তোর নখে রঙ কেন? এদিকে আয়। মেয়েটি যমদূত দেখার মত ভয়ে নীল হয়ে দুরুদুরু বক্ষে এগিয়ে যেত স্যারের কাছে। স্যার চোখ বন্ধ অবস্থায়ই বলতেন, হাত মুষ্টিবদ্ধ কর। মেয়েটি হাত মুঠো করে রাখত। স্যার চোখ বুজেই মেয়েটির মুষ্টিবদ্ধ হাতের নেলপালিশমাখা রাঙানখে বেরহমভাবে বেত্রাঘাত করতে থাকতেন আর অভিসম্পাত বর্ষণ করতে থাকতেন নেলপালিশ আবিষ্কর্তা ও এর ব্যবসায়ের সাথে সংশ্লিষ্ট সবাইকে। ব্যবহারকারীকে তো অবশ্যই। ফিনকি দিয়ে তাজারক্ত বের হয়ে মেয়েটির রাঙানখ এবং পুরো হাত আরো আরো রাঙা হয়ে উঠত। সে চিৎকার করতে থাকতো, স্যার গো আর কোনোদিন দেবনা। অথবা অমুক বেঞ্চের তমুক, তোর গায়ে পাতলা উড়না কেন? মশারি পরে ইস্কুলে আসিস কেন, তোকে কি মশা কামড়ায়? অমুকের ঠোঁটে রঙ কেন, ঠোঁট কেটে দেব? তমুকের চোখে কালি কেন, চোখ গেলে দেব? ওর চুল দেখা যায় কেন? এর হাত দেখা যায় কেন? এই মেয়েটা ছেলেদের দিকে তাকায় কেন? বাড়িতে তোদেরকে কোনো শিক্ষা দেয়না? তোরা কি কেবল ছেলে ভোলাতে ইস্কুলে আসিস? প্রভৃতি। মেয়েদের দিকে না তাকিয়েও তিনি তৃতীয় নয়নে সবই পরিষ্কার দেখতে পেতেন! স্যার লেইজারের সময় মসজিদে নামাজ পড়তে যেতেন। যে সকল ছেলেদের তিনি নামাজে দেখতে পেতেন না তাদেরকে বেদম মার দিতেন। অনেক সময় মারতে মারতে অজ্ঞান করে ফেলতেন। অন্যান্য স্যাররাও কারণে-অকারণে ছেলেমেয়েদের মেরে অজ্ঞান করতেন। দৈনিক কয়েকটি ছেলেমেয়ের অজ্ঞান হওয়া ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। আমি অবশ্য কোনোদিন বেহুশ হয়নি। বাড়িতে ও ইস্কুলে মার খেতে খেতে হাড়গোড় শক্ত হয়ে গিয়েছিল। যে স্যার যত বেশি সংখ্যক ছেলেমেয়ে অজ্ঞান করতে পারতেন তিনি তত বেশি উত্তম শিক্ষক বলে বিবেচিত হতেন। জ্ঞান ফিরে এলে স্যাররা বেত ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আরো অভিসম্পাত দিয়ে জিজ্ঞেস করতেন, কেমন লাগল? আর করবি? অজ্ঞান-থ্যারাপির ব্যাপারে অভিভাবকরাও কখনো অভিযোগ করতেন না। ভর্তির সময় আদর্শ বাবার মত বলতেন, স্যার আপনাদের হাতে তুলে দিয়ে গেলাম। একটু এদিক-ওদিক হলেই মেরে লাশ ফেলে দেবেন; কোনোই আপত্তি নেই।

স্যার কাউকে নাম জিজ্ঞেস করলে, সে যদি নামের আগে মোহাম্মদ বা মোছাম্মৎ না বলত তবে তিনি ভয়ানক রাগ করতেন। শাস্তিও দিতেন। একদিন এক ছেলেকে জিজ্ঞেস করলেন, এই ছেলে তোর নাম কি। ছেলেটি বলল আলাউদ্দীন। কী! মোহাম্মদ নেই? আছে স্যার, মোহাম্মদ আলাউদ্দীন। আরেকটি ছেলেকেও একই প্রশ্ন করলেন। উত্তর এলো ইব্রাহিম। কী! না- না স্যার, ভুল হয়ে গেছে। মোহাম্মদ ইব্রাহিম। প্রথমবারে মোহাম্মদ কোথায় গিয়েছিল? মুছলমানের ছেলে হয়ে মোহাম্মদ বলতে ভুলে যাস! ছি ছি! এবার তোরা পরস্পরের কানে ধরাধরি করে উঠবস কর। আমাদেরকে উঠবস করতে লাগিয়ে দিয়ে বা গালি দিতে দিতে বা ওয়াজ করতে করতে বা নাতে রাসুল ও হামদে বারি গাইতে গাইতে তিনি টেবিলের উপর মাথা রেখে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়তেন। দুইটা ছেলেকে ডেকে বলতেন উনার গা টিপে দিতে। তিনি নাক ডেকে আরামে ঘুমোতেন। ঘুম থেকে উঠেই মিলাদ পড়তে শুরু করতেন। অথবা আমাদের দীনীজ্ঞান পরীক্ষা করে হতাশ হয়ে মার দিতেন। তবে উনার অনেক রসবোধও ছিল। শাস্তির কথাগুলোও তিনি অনেক রসিয়ে বলতেন। আমরা মার খেয়েও উনার কথা শুনে হেসে গড়িয়ে পড়তাম। অনেক আদিরসাত্মক কথাও তিনি অবলীলায় বলে যেতেন। ছেলেদের জিজ্ঞেস করতেন, ছেলেরা তোরা যদি দোকানে কলা কিনতে যাস তাহলে কি খোসাযুক্ত কলা কিনবি নাকি খোসামুক্ত কলা কিনবি? ছেলেরা তাৎক্ষণিক জবাব দিত অবশ্যই খোসাযুক্ত কিনব স্যার! কেন কিনবি খোসাযুক্ত? কারণ খোসা-ছাড়া কলায় ময়লা পড়তে পারে বা মাছি বসতে পারে স্যার। তোরা উদলা খাবার কিনবি নাকি ঢাকা-খাবার কিনবি? অবশ্যই ঢাকা-খাবার স্যার। কারণ খোলা খাবারে মাছি বসে। শুনেছিস মেয়েরা-যেসব মেয়েরা পর্দা করেনা ওরাও খোলা খাবার বা খোসাছাড়া কলার মত। ওদের গায়েও মাছি বসে। আর মাছিবসা খাবার কেউ কিনেনা। তখন এসব কথার অর্থ বুঝতাম না। সবাই হাসত উনার কথা শুনে, আমিও হাসতাম। এখন ভাবলে মনে হয় স্যার উনার সন্তানতুল্য ছাত্রছাত্রীদের সাথে এসব কুরুচিপূর্ণ কথাবার্তা কেমন করে বলতেন! ইস্কুলের মোট ছাত্রছাত্রী সংখ্যার অর্ধেক ছাত্রীদের দিকে ফিরে তাকানোও তিনি জঘন্যপাপ মনে করতেন। এত অবজ্ঞা, এত তাচ্ছিল্য করতেন! অনেক সময় বলতেন, তিনি এই পাপ-চাকরি ছেড়ে দিয়ে মাটি কাটার কাজ করবেন; তাও ভাল। কারণ ইস্কুলে মেয়েরাও আসে। তিনি এই অচ্ছুৎ বস্তুদের পানে না তাকালেও তাদের সাথে একই রুমে অন্তত বসতে তো হয়!এতেই নাকি উনার অমার্জনীয় গুনাহ হয়ে যায় প্রতিনিয়ত! তিনি অবশ্য কোনোদিন চাকরি ছাড়েননি।

স্যার লেখাপড়ার কথাও মাঝে মাঝে দু’একটা বলতেন। আমাদেরকে হুট করে কিছু জিজ্ঞেস করতেন। না পারলে মার দিতেন। বেত দিতে দিতে বলতেন, লেখাপড়া করে যে; গাড়িঘোড়া চড়ে সে। লেখাপড়া না করিলে হাতের উপর বেত পড়ে। বেত খেতে কেমন লাগে রে? তিনি ছিলেন রঙ্গরসে ভরপুর একজন মানুষ। তার কঠোরতার মাঝেও ছিল রসিকতা। শুনেছি তিনি এককালে গানবাদ্য বেশ ভালবাসতেন। সেই পাপকর্মের জন্য তিনি সর্বদা অনুতাপও করতেন। তিনি নিজেই বলতেন মুসলিম হবার পূর্বে তিনি নাকি সাক্ষাত শয়তানের অনুচর ছিলেন! একজন সংস্কৃতিবান, রসিক মানুষকে এমন কঠোরে পরিণত করল কী-সে?
ইস্কুলে কোনো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান থাকলে তিনি সেদিন অনুপস্থিত থাকতেন। কখনো উপস্থিত থাকলেও নাক মুখ সিঁটকাতেন। জাতীয় সংগীত শুরু হলে সবাই দাঁড়িয়ে যায় সম্মান প্রদর্শন করতে। গাইতে পারুক বা না পারুক সবার ঠোঁট কাঁপে। আর খালেদ স্যার মুখ বিকৃত করে বিড়বিড় করতে করতে সেখান হতে উঠে চলে যেতেন। এসব নাকি বেধাতি! তিনি যথেষ্ট পড়াশোনা জানতেন। কিন্তু আমাদেরকে সেসব শিক্ষা না দিয়ে কেবল গোঁড়ামি শেখাতেন। তবুও স্যারের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধাবোধ ছিল। আজও আছে অটুট। তিনি যা বিশ্বাস ও অনুসরণ করতেন তা-ই প্রতিটি পদক্ষেপে প্রয়োগ এবং প্রতিফলিত করতে চাইতেন। তাঁর এই আচরণের জন্য কি তিনি আদৌ দায়ী, নাকি এই ভয়াবহ বিশ্বাসটি যে সৃষ্টি করেছে সে দায়ী?