Dear Gita Das,
আপনি তো সাংঘাতিক, মুখের ওপর বলে দিলেন, অনেক বই ভাল লাগেনি।:)
ঠিক আছে, তাতে আমি মোটেও অখুশি হচ্ছি না, একটা তো ভালো লাগলো। ‘না মানুষি জমিন’ আমার প্রিয় উপন্যাসগুলোর একটা।এটা পাঠকদের অনেকের দৃষ্টি আকর্ষন করেছে।কিন্তু আরেকটু বেশি হয় তো করা উচিত ছিল। একই কথা ‘এতদিন কোথায় ছিলেন’ প্রসঙ্গেও বলতে চাই। ওটাই ভালো বই বলে আমি মনে করি।
আপনার সমালোচনা খুব ডিটেইল হয়েছে, আপনি কৌশলগুলো ধরতে পেরেছেন। আপনার মত সমালোচক আমাদের সাহিত্যে খুব বেশি নাই। ধন্যবাদ, ভালো থাকবেন।

(এটি কথাশিল্পী আনিসুল হকের ইমেইল এর ইংরেজি হরপের বাংলা রুপান্তর। উনি আমার ইমেইলের উত্তরে একথাগুলো লিখেছেন। পরে আমি প্রিয় কথাশিল্পী মহোদয় সম্বোধন করে তার সম্মতি নিয়ে তা প্রকাশ করছি। আর আমার যে মেইলের তিনি উত্তর দিয়েছেন তা নীচে দেওয়া হলো।তবে হ্যাঁ, আমি ইচ্ছে করেই Dear Gita Das, বদলাইনি, কারণ ডিয়ারের এর বাংলা যা হয় সে অর্থে তিনি ডিয়ার বলেননি বলেই আমার মনে হয়েছে।)

কথাশিল্পী আনিসুল হক,
“মানষে করে বান্দরের কাম, আর বান্দর করে মানষের কাম”।
বিশেষ করে সেইসব মানুষেরাই বেশি বান্দরের মতো কাজ করে, যারা আইন কানুন নিয়ে বেশি ঘাটাঘাটি করে, আইন বানানোর দায়িত্ব পাওয়ার জন্য এহেন বাঁনরামি নেই যা তারা করতে পারে না। তারা সীমান্তে সীমান্তে সীমারগিরি করে, পাড়ায় পাড়ায় ফতোয়াবাজি করে। এমন মানুষেরাই বেশি বান্দরের মতো কাজ করে।যেমন, ফুলবানু সীমাকে বুকের দুধ দিয়েছিল বলে তার সংসারে আগুন লাগায়।
আপনার লেখা ‘না মানুষি জমিন’ পড়ে আমার এ মেইল লেখা। দেরিতে লেখার কারণ, ঈদসংখ্যা প্রায় সবগুলো কিনি, বইমেলা থেকে সাধ্যমত ও সাধমত বই কিনি আর সারা বছর ধীরে ধীরে পড়ি। কাজেই পালাক্রমে পড়তে পড়তে ‘না মানুষি জমিন’ এ সপ্তাহে পড়া শেষ হল।আপনি উপন্যাসটির নীচে ই মেইল ঠিকানা দিয়ে মতামত জানাতে বলেছেন। আর আমিও এ সুযোগে আমার কিছু বলার লোভ সামলাতে পারিনি।
আপনার লেখা গদ্য কার্টুন ও কথা কার্টুন পড়ে ভাল লাগায় আমি আপনার লেখা পড়া শুরু করি। প্রথমে তো গদ্য কার্টুন বইটি কিনে সেলফে অন্য বইয়ের সাথে রাখতে বেসাইজ বলে সমস্যায়ই পড়েছিলাম। তবুও আজও সযত্নে রেখে দিয়েছি।
আপনার লেখা বেশ কিছু উপন্যাস আমি আগে পড়েছি, বলা বাহুল্য সবগুলো আমার ভাল লাগেনি। আপনার মা উপন্যাস ভাল লাগলেও কোন কোন জায়গায় অহেতুক বড় করেছেন বলে মনে হয়েছে। কবি জীবনানন্দ (এতদিন কোথায় ছিলেন) ও আলতাফ মাহমুদকে নিয়ে লেখা উপন্যাসদ্বয় ভালই লেগেছে। সবচেয়ে ভাল লাগল ‘না মানুষি জমিন’।
উপন্যাসটিতে আপনি অত্যন্ত সার্থকভাবে সরকারদের পুশব্যাক আর পুশইনের খেলাকে তুলে ধরেছেন। এ খেলা যে কত অমানবিক, হাস্যস্পদ ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রনীত তা বর্ডারের জনগণের মত দায়িত্বপ্রাপ্ত ও দায়িত্ব পালনকারী ব্যক্তিরাও বুঝে কিন্তু তারা নিরুপায় যা আপনার উপন্যাসের কাহিনীতে বিবৃত করেছেন। পাঠককে নাড়া দিয়েছেন।নিজেরা বেশ মিলে মিশেই আছে। সীমানার অন্নপ্রাসন করে। মানবতাবোধে সমুজ্জ্বল সংলাপ,
“হাবিলদার নির্দেশ দেয়, কাদের ময়া, বাবুর্চিকে অর্ডার দেয়, এদের লাইগা খানা পাকাও, এদের তো আমর আমগো মাটিতে ঢুকতে দিমু না, কিন্তু দুইটা ভাত দিলে তো আমাগো কিছু কমব না।বরং আল্লায় সোয়াব দিব”।
ভবেশ পাগলা আর মজনু পাগলা, দুই পারে এ দুই পাগলকে কি রুপকভাবে এনেছেন? যারা সীমান্তে এমন কাজ করে যা সাধারণ নাগরিকরা করবে না। সাধারণ নাগরিকদের তো আইনের ভয়, সামাজিক মর্যাদা, মানসিক দ্বন্দ্ব কাজ করে। ভবেশ পাগলা আর মজনু পাগলা এ সব থেকে মুক্ত ও শুদ্ধ মানুষ। তারা দুই পারের মানুষের মধ্যে লেনদেনের সহায়ক। সীমান্ত আইনকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে ভবেশ পাগলা স্বর্গের লোভে জল নিয়ে না মানুষি জমুনে যায়। হাবিলদারের আল্লার সোয়াব আর ভবেশ পাগলার স্বর্গের প্রত্যাশা কি একই সুরে বাঁধা! সব মানুষ যদি পরক্লাএর লোভেও, আল্লার সোয়াবের আশায়ও একটু ভাল কাজ করত তবে তো আমারা মানুষের মাঝেই স্বর্গ পেতাম!
ভবেশ পাগলার স্বর্গ লাভের আকাংঙ্ক্ষায় আর আর মর্ত্যের মোয়া খাওয়ার লোভে যে পূণ্যটুকু করেছে তা যদি আমাদের মুসুল্লিরা করত তবে আমাদের চারদিকে মানবপ্রেমের বন্যা বয়ে যেত।
মানবতাবোধকে অবজ্ঞা করা রাষ্ট্রীয়নীতিকে এ বইয়ে আঘাত করেছেন। পল্টুর মা তো শুধু হলদে বাড়ি আর নলচেপাড়া সীমান্তের না মানুষি জমিনে আটকে পড়ে একটি শিশু জন্ম দিয়ে মৃত প্রসুতি নয়। সে তো আছে রোহিঙ্গাদের নৌকায়, আফগান সীমান্তে, ইরাকের কুর্দিদের মধ্যে, ভূটানের যারা নেপালে আশ্রয় নিয়েছে তাদের মধ্যেও।
সীমানার বড় হওয়ায় রানি নামক বানরের ভূমিকাকে বেশ কৌশলে বাস্তবসম্মত বানিয়েছেন। কাঞ্জিলালের বানর খেলার বানর যে এমন মূখ্য চরিত্র হয়ে উঠবে তা অবশ্য বইয়ের প্রথমেই ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। একজন মানব শিশু বানরের তত্ত্বাবধানে খাওয়া শিখলে তার কোন কোন আঙ্গুলের ব্যবহার করবে তা বলতেও ভুলে যাননি।
“এবং উভয় পারে সীমুর শুভানুধযায়ীরা উদ্বিগ্ন বোধ করে যে সীমু যে একটা বরবটি ধরেছে এবং সেটা মুখে দেওয়ার চেষ্টা করছে, তার কায়দাটা, অনেকটা বাঁদরেরই মতো”।
তবে আমাদের পূর্ব পুরুষ যে বানর, আর অন্য সব শিশুরাও যে বানরের মতোই পেন্সিল আর কলম ধরে তাও মন করিয়ে দিয়েছেন।
“হামার ছাওয়ালকে দেখেন, অরাও পেন্সিলটা, কলমটা বান্দরের নাকানই ধরিয়া থাকে”।
তাছাড়া টেলিভিশনের সমসাময়িক অনুষ্ঠানমালাকে ব্যবহার করে কৌশলে ক্ষুদে গানের শিল্পীদের অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এবং একই সাংস্কৃতিক বলয়ের কথা মনে করিয়ে দিয়ে সীমানাকে বাংলাদেশে ঢুকিয়েছেন। জানান দিয়েছেন সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড শুধু বাংলাদেশ ও ভারত নয়, প্রতিবেশি দেশমমূহের মধ্যে মিলনের সেতু বাঁধতে পারে।এক্ষেত্রে আপনার সৃজনশীলতার চেয়ে বুদ্ধিমত্তার প্রশংসা করতে হয় বৈকি!
আপনি ব্যক্তিজীবনে একজন সাংবাদিক বলে সাংবাদিক পরিমল মজুমদারের চরিত্রটিকে এতটা দরদ দিয়ে ও বাস্তব তুলির ছোঁয়ায় আঁকতে পেরেছেন।যে নিজের পেশার বাইরে ভবেশ পাগলাকে মোবিলাইজ করে না মানুষি জমিনে মোয়া আর জল পাঠায়। তার জীবনের পরিণতিতে পাঠক কষ্ট পায় বৈ কি।
হরিহর মাষ্টারের উপস্থিতি এ উপন্যাসে সীমানার লেখাপড়াকে নিশ্চিত করতে প্রাসঙ্গিকভাবেই উপস্থাপিত।
আর একটা কথা না বলে পারছি না, আপনি অত্যন্ত সার্থকভাবে ও যত্নের সাথে আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার করেছেন।
চমৎকার কিছু শব্দও সৃষ্টি করেছেন, যেমন, নড়ন্ত।।
রসিকলাল আর মর্জিনা তো মানবিকবোধের এক সমুজ্জ্বল উদাহরণ। রসিকলালের স্ত্রী কৃষ্ণাও মনে করে এবং অভিযোগ করে, “রসিকলাল নিজের দুই ছেলে মাখনলাল ও মাধবলালের চেয়ে ওই বান্দরের বাচ্চা সীমুকেই বেশি আদর করে থাকে”।

আর নিঃসন্তান মর্জিনার তো সীমানার খাবারের যোগান দেওয়া একদিনের জন্যও ভুল হয়নি। প্রথমেই ফুলবানুর বুকের দুধ নিয়ে এসেছে। এভাবেই মর্জিনার সুপ্ত মাতৃ হৃদয়ের উষ্ণ পদক্ষেপেই সীমু মানুষের দুধ খেতে পায়।
ফুলবানুকে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়ে ফতোয়ার অস্তিত্ব যে এখনও সরব তা মনে করিয়ে দিয়েছেন, উপরন্তু ফুলবানুর স্বামীর লোভী চরিত্রটির খোঁজ দিতেও ভুলেননি। “বিয়ে মানেই নতুন আরেকটা মেয়েমানুষের ওপরে অধিকার লাভ,সেই বিষয়টাও তার কাছে বেশ একটা আকর্ষণীয় ব্যাপার বলে প্রতীয়মান হয়।”
রানির মৃত দেহ আমাকে বর্ডারে গুলিতে নিহত কাঁটা তারে ঝুলে থাকা ফালানির কথা মনে করিয়ে দিয়েছে।কারণ রানির পরনে ছিল

সীমানাকে রানি মাতৃস্নেহে বড় করেছে বলেই রানির মৃত্যু সীমানাকে উতলা করে। “আমার জানি কেমতু কেমতন লাগে”।

আমি ব্যক্তিগতভাব্র বইয়ের সমালোচনা বা পর্যালোচনা পড়ে অনেক বই কিনি। সে আলোচনা বা সমালোচনা কিংবা পর্যালোচনা কাগজের পাতায় হোক, ইন্টারনেট থেকে হোক অথবা কারও মুখ থেকে শুনে হোক। এবং গ্রন্থ সমালোচনা করতে কিছু অবশ্যই পালনীয় বিষয় উল্লেখ করতে হয় বলে আমার ধারণা, যেমন বইটির নাম সঠিকভাবে লেখা, প্রকাশক। প্রচ্ছদ শিল্পী, পৃষ্ঠা সংখ্যা। দাম।কাজেই আপনার বইয়ের বেলায় লিখতে ‘না মানুষি জমিন’ একটি উপন্যাস। প্রকাশিত হয়েছে প্রথম আলো ঈদ সংখ্যা ২০১১। ২৫৬ পৃষ্ঠা থেকে ২৮৫ পৃষ্ঠা। সচিত্রকরণঃ আফজাল হোসেন।ঈদ সংখ্যাটির দাম ১৫০ টাকা। এতে না মানুষি জমিন সহ সাতটি উপন্যাস ও অনেকগুলো ছোটগল্পসহ আরও অনেক লেখা আছে। কাজেই বইটির আর্থিক দাম যা পড়েছে তা পাঠককে ক্যালকুলেটর দিয়েই হিসাব করতে হবে। আর সাহিত্যিক মূল্য, মানবিকবোধ জাগানোর উদ্যোগ, রাষ্ট্রীয় নীতি ও আইনের ফানুসের অন্তসারশূন্যতার বিশ্লেষণ ও বিবেচনা করতে আমাকে আবার কলম ধরতে হবে।