“ম্যায় ইস হারামজাদী কওম কি নাসল বদল দুঙ্গা ( আমি এই জারজ জাতির বংশগতি বদলে দেব )…………….। ”
– লেঃ জেনারেল আমির আব্দুল্লাহ খান নিয়াজী ( পরিচয় নিষ্প্রয়োজন), ১৯৭১

বিদেশে ফর্সা চেহারার বাংলাদেশী দেখলে কিছু ঠোঁটকাটা পাকিস্তানী প্রায়ই জিজ্ঞাসা করে , ” কি ব্যপার ? তোকে (আপনাকে !) তো বাংলাদেশী মনে হয় না ? ” । আমি ১৯৯০-২০০০ সালের দিকে যখন জার্মানীতে থাকতাম , তখন এই প্রশ্নটা নিয়ে তেমন মাথা ঘামাইনি। পাকিস্তানে এক পাঠান জাত ছাড়া বেলুচিস্তান, পান্জাবে এবং সিন্ধে শ্যামলা রঙ্গের (পড়ুন কালো) লোকের সংখ্যা অগনিত। তাদের গাত্রবর্ণ বাংলাদেশ এবং ভারতের আর দশজন মানুষের থেকে আলাদা করা কঠিন।

১৯৯৫ সালে জার্মানীর ড্রেজডেনে পাকিস্তানের ফয়সালাবাদ থেকে আসা দুই পাকিস্তানী সহোদরের সাথে আমার পরিচয় হয় যারা তাদের স্ত্রী সন্তানসহ একই ভবনে আমার পাশের ফ্লাটে থাকতেন। ছোটটার নাম জাহাঙ্গীর এবং বড়টার নাম তানভীর যে আবার ইউরোপের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে প্রয়াত মোহাম্মাদ রফির গান গাইতেন। সিড়ি দিয়ে উঠা নামা করার সূত্রে তারা জানতেন যে, আমি বাংলাদেশী এবং তিন তলার অন্য ফ্লাটটায় থাকি। তারা প্রায় বিশ বছর যাবৎ জার্মানীতে থাকলেও জার্মান বলতে পারতেন না। জাহাঙ্গীর পাকিস্তানে এফ, এ পাস করেছে এবং তার বড় ভাইয়ের দৌড় অষ্টম শ্রেনী পর্যন্ত। তবে তাদের স্ত্রীদের কখনও সামনা সামনি দেখি নি। এক শনিবার সকালে কলিং বেল শুনে দরজা খুলতেই দেখি বেনজীর ভুট্টোর মত দেখতে সালোয়ার কামিস পড়া সুদর্শনা এক ভদ্রমহিলা সামনে দাড়িয়ে , উচ্চতায় প্রায় পাঁচ ফিট আটের মত হবেন। আমি মুখ খুলে কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই ভদ্রমহিলা পান্জাবী উচ্চারণে সালাম দিয়ে উর্দুতে জানালেন যে, তার স্বামী জাহাঙ্গীর পুলিশ হেফাজতে আছেন এবং বড়ভাই তানভীর স্ত্রীসহ লন্ডনে গেছেন কনসার্টে। আমি কি করতে পারি এটা জিজ্ঞাসা করার আগেই বললেন যে , তার সোশ্যাল ওয়েলফেয়ারের কিছু ফর্ম পূরণ করে দিতে হবে যা না করলে আগামী মাসের সোশ্যালের টাকা পাওয়া যাবে না এবং তিনি নিজে পড়তে লিখতে পারেন না। এটা বলেই তিনি আমাকে তার সঙ্গে তার ফ্লাটে যেতে বললেন। ফর্ম পূরন করার সময় বলে দিলেন যে, বৈবাহিক অবস্থা যেন ‘তালাকপ্রাপ্তা’ লিখি। আমি অবাক হয়ে এর কারণ জিজ্ঞাসা করতে গিয়েও করলাম না কারণ আমি জানতাম যে , জার্মানীতে প্রচুর পাকিস্তানী কাগজে কলমে নিজেদের তালাকপ্রাপ্ত দেখায় দ্বিগুন সোশ্যাল ওয়েলফেয়ারের টাকা পাওয়ার আশায়। যাহোক ফর্ম পূরণ করে দিয়েই দেখি ভদ্রমহিলা খাবার টেবিলে খাবারের জন্য ডাকছেন । বড় বড় তিনটা চাপাতি রুটি ভুনা মাংস দিয়ে খেয়ে বিদায় নেয়ার সময় ভদ্রমহিলা অনেক ধন্যবাদ জানালেন এবং মুচকি হেসে বললেন, ” আপকো দেখনেমে বাঙাল কা নেহি লাগতি !” এর বেশ কিছুদিন পর জাহাঙ্গীর প্রায়ই প্রায় জোর করে তার ফ্লাটে আমাকে নিয়ে যেতেন খাওয়ানোর জন্য। নিজে ভোজন রসিক হওয়ায় আমিও আপত্তি করতাম না। একদিন তার বড়ভাই কথা প্রসঙ্গে জানালেন যে, ১৯৭১ এ পাকিস্তানী সেনারা বাংলাদেশে ভালই আমোদ ফূর্তি করেছে এবং সেটা যে কি রকম তা হাতের অশ্লীল ইঙ্গিতপূর্ণ অঙ্গভঙ্গি দিয়ে দেখালেন। এটা শোনামাত্র আমি রাগে দুঃখে অপমানে সেই যে , তাদের সামনে থেকে বিদায় নিলাম , আর কোনদিন তাদের সামনে আসিনি। পরের সপ্তাহে এমনিতেই আমাকে চলে যেতে হয়েছিল অন্য জার্মান শহরে ।

২০০০ সালে চাকুরী সূত্রে আমার প্রথমবারের মত পাকিস্তানে যাওয়ার সূযোগ হয়। সেখানে গিয়ে লাহোরে এক উচ্চপদস্থ পাঞ্জাবী কর্মকর্তার বাসায় গিয়ে দেখি আরেক কান্ড ! চা নিয়ে তার কাজের লোক বৈঠক খানায় প্রবেশ করতেই কর্মকর্তা আমাকে দেখিয়ে তার গৃহভৃত্যকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলেন, ” ইয়ে ভাইসাব তেরা বাঙালকা হ্যায়, আপনা জবানমে ইনকো সালাম দুয়া কার….।” আমি জানলাম যে তার গৃহভৃত্য একজন বাঙালী অবৈধ অধিবাসী, দেশের বাড়ী নোয়াখালী । পাকিস্তানে এরকম অবৈধ বাঙালীর সংখ্যা কয়েক লক্ষ হবে। পাকিস্তানে বাঙালীদের সম্পর্কে যে প্রচলিত ধারণা অত্যন্ত নিচু সেটা এসময় জানতে পারি।‌‌ ভারতীয়দের সম্পর্কে তারা শত্রুভাবাপন্ন হলেও এতটা নিচু ধারনা পোষন করে না।

প্রয়াত জেনারেল খাদিম হুসাইন রাজার লেখা একটা স্মৃতিচারণমূলক বই সম্প্রতি মরনোত্তর প্রকাশ করেছে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস। বইটির নাম A stranger in my own country EAST PAKISTAN, 1969–1971 । মেজর জেনারেল খাদিম হুসাইন রাজা ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থিত ১৪শ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি ছিলেন এবং অপারেশন সার্চলাইট সরাসরি তত্ত্বাবধান করেছেন। তিনি এই বইয়ে এক জায়গায় লিখেছেন :

We come to the climax: “[Enter] Commander East Pakistan General Niazi, wearing a pistol holster on his web belt. Niazi became abusive and started raving. Breaking into Urdu, he said: Main iss haramzadi qaum ki nasal badal doon ga. Yeh mujhe kiya samajhtey hain. He threatened that he would let his soldiers loose on their womenfolk. There was pin drop silence at these remarks. The next morning, we were given the sad news. A Bengali officer Major Mushtaq went into a bathroom at the Command Headquarters and shot himself in the head” (p.98).

অর্থাৎ , জেনারেল নিয়াজী প্রচুর পরিমান পাকিস্তানী Y ক্রোমোজোম জনপুঞ্জে প্রবেশ করিয়ে বাঙালী জাতির বংশগতি বদলে দেবেন এবং এটা করা হবে তার সেনাদের দিয়ে বাঙালী নারীদের উপর ‘অপারেশন গণধর্ষণ’ চালিয়ে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, সেটা করার মত যথেষ্ট সময় তিনি পান নি, তবে করার যথাসাধ্য চেষ্টা তিনি করেছেন। আমি জানি না , কোনদিন পাকিস্তানী ধর্ষকামী যুদ্ধপরাধীদের নুর্নবার্গের মত সামরিক বিচারালয়ে বিচারের সম্মুখীন করা যাবে কি না। সে সময় পর্যন্ত বিচারের বানী নিভৃতেই কাঁদবে।


আলোকচিত্র : কিশোর পারেখ