[ প্রাক কথনঃ মুক্তগদ্যের ধারণাটা বাংলা ভাষায় খুব একটা সমাদৃত নয়। কিন্তু জীবন থেকে উঠে আসা সঞ্চিত ভান্ডারকে পদ্যের আঙ্গিকে গদ্যপ্রথায় সাজিয়ে তোলা কিংবা খন্ডচিত্রে ভাষা নির্মাণ একটা প্যাশন মনে হয় আমার কাছে। সেই প্রয়াস থেকেই এই লেখার শুরু… ]

একটা কিছু কি লিখতে হবে! লিখতে হবে এটা বোঝানোর জন্য যে স্বপ্নগুলি আঁতলামির বেনোজলে ভাসছে। লিখতে হবে? … তাই এটাই লিখে দিলাম…
অলসতার দিনগুলিকে ঝেরে ফেলি কাকের মত। দেখি মহাপ্রয়াণ হবার আরও অনেক দেরি আছে। তারচেয়ে বরং আরেকটু সময় নষ্টের দিকে মনযোগ দেই। এটাই হবে সঠিক উত্তরণ। আমি একা হতে চাইনি। একাকীত্ব আমাকে কামড়ায়, ফালাফালা করে দেয়, ফিনকের পিরিচের ঢালে ঢালে রক্ত বেড়িয়ে আসে। …

সেই দগদগে ক্ষত নিয়ে, দুই চোখে ক্লান্তি নিয়ে আমি কুকুরের সাথে ভাতের জন্য লড়াই করি। বর্ণবাদে, জাতিবাদে আমি প্রেমিকার মুখি দেখি… সব কিছু নষ্ট বিশ্বাস হয়ে ফুটে বারবার, প্রতিবারই আমি বুঝাই নিজেকে – সবাই একা, সবাই নিঃস্ব! তারপরও আমাকে রক্তাক্ত হতে হয়… সেই কামড় নিয়ে আমি মৃত্যুর দিকে জীবনের প্রথম পদক্ষেপ নেই…কারন বাবা বলেছেন – তোদের জন্য খাটতে খাটতে বালের জীবনটা শেষ করে দিলাম। আর আমি শালা অম্লান বদলে তা হজম করে নেই।

ছেলেবেলায় বেশ নাদুস-নুদুস ছিলাম। গালটা টোবলা-চুবলা, বড় বড় চুল, চোখগুলিও সেই রকম। আমার প্রথম ভালোলাগার মানুষটি আমাকে বলেছিল – তোর চোখগুলি না… সেই চোখ ধীরে ধীরে শরীরের সামান্য ডালাপালা মেলতেই আংশিক নিমজ্জিত হয়ে গেল। এরপর অনেক ইতিহাস লেখা হয়ে গেছে পৃথিবীর দরবারে, যদিও সেই ইতিহাসে আমার ঠাই নাই। হতেও চাইনা। তবে একে একে ফুরিয়ে গেছে অনেক কিছুই। বন্ধুত্ব, ভালোবাসা, সেই স্পর্শ সবকিছু। আমি কি সুন্দর ছিলাম? সুন্দরের সংজ্ঞাটা আমার কাছে গরুর রচনা লেখার মতো! …এত কিছুর জন্যে হয়তো চোখ মেলেই তাকাতে পারতাম না যদি না সে বলত, সত্যিই তুই সুন্দর! তাই…! আমি সেদিন ওকে উরু দেখিয়ে বলেছিলাম – দ্যাখ আমার চেহারা থেকেও সুন্দর। সে একটু হেসে নির্দ্বিধায় বলেছিল – আমারও! আজ সেই মেয়েটির বর, যাকে ছেড়ে ও পালিয়েছে আরেকজনকে ভালোবেসে, সেই লোকটি ওকে বেশ্যা বলে গালি দিল আমার সামনে। যাক সুন্দরের সংজ্ঞাটা শিখে গেছি মনে হয়…

ও ভালো কবিতা লিখত, কবিতা শোনাত আমাকে স্কুল ছুটির পর, কিংবা বিরতির সময়। আমি অবাক হয়ে শুনতাম আর ভাবতাম কি অদ্ভুত সব লাইন, কি অদ্ভুত সব শব্দ। আসলে আমি শব্দকে নয়, ওকেই দেখতাম। আর মনে মনে সংকল্প করতাম একদিন আমিও ওকে কবিতা লিখে এনে তাক লাগিয়ে দেব।

এরপর থেকেই আমার শব্দ খোজা শুরু। শব্দ? মা বলতেন – খুঁজলে নাকি ‘ঈশ্বর’ পাওয়া যায়। অন্য সব কিছুই তুচ্ছ! তাই শব্দ নিয়ে আমার দৌড় শুরু হয়ে যায় এক অজানা ঈশ্বরের সন্ধানে! তখনই মিথ্যে কথা বলা শিখে গেছি আমার দ্বৈত সত্তার সাথে। কিছু একটা করে দেখানোর তাগিদা। দৈনিক খবরের কাজগ থেকে টুকে নিয়ে সাজিয়ে দিলাম একের পর এক কবিতার পঙতি। সবই ভাসাভাসা প্রেমের আকুলতা! আর আমার ভেজাভেজা সুখ ও স্বপ্ন। ওর চোখে দেখলাম কি অপার বিস্ময়। সেই বিস্ময় এখনো আমাকে কবিতার দেয়ালে ঠেলে দেয়, বারবার।

তুমি শালা কবিতা লেখ? হুম! লিখি তো! বেশ, ভালো কথা, তা কবিতা বোঝ? আধুনিক কবিতার যন্ত্রণা বুঝ? … প্রশ্ন অনেক উত্তর দিতে গেলে মনে হয় ভেতরের ইয়েটা কেঁপে উঠে। তবুও আমি কবিতা লিখতে চাই, যেমন করেই হোক দুই লাইন অন্ততঃ লেখা চাই ‘ফকিন্নির পুত’, তোকে লিখতেই হবে। এই একমাত্র কবিতা আমাকে ঠকায় না। শালা যা বলি সব বিশ্বাস করে, যা করতে বলি তাই করে। গ্রীক পুরান এর দেবতাকে কিংবা মহাভারতের পরাক্রমী যোদ্ধাদেরও আমার পায়ের কাছে এনে ফেলে দেয়। দ্যাখ শালা, আমি ‘ফকিন্নির পুত’ কত বড় কবি। আমার এলেম আছে। কি করে অস্বীকার করবি আমায়?

পনেরো-ষোল বছর অবধি আমি বেশ ওজনদার মানুষ ছিলাম, গতরে। বাড়ি থেকে হাওয়া হতেই যখন বাইরের হাওয়া লাগল, গতর বেইমানী করতে শুরু করল। তখন থেকেই শিখে গেছিলাম আর যাই হোক একটা হ্যান্ডুপনা আমার দ্বারা হবেনা। তার সাথে যুক্ত হয়েছিল একটা শারীরিক ত্রুটি যা আমাকে মরণের আগের কয়েক সেকেন্ডেও বলে যাবে – তুই শালা একটা চিজ, মাইরি! … হতে হতে একটা ঝাঁকুনি হয়, সয়ে সয়ে গড়ে উঠে সহানুভূতি। সেই সহানুভূতিই আমার দুই চোখের বিষ, পটাশিয়াম সায়ানেড।

এখন রাত, আজ সন্ধ্যাতারা দেখা যায়নি আকাশে। তবুও শুভ্রতা টেনে ধরেছে মেঘের আঁচল, চাঁদ মোহনার তীরে। হাসি তাতাই এর সাথে খেলছে। আজ তাদের ছুটি। বুড়ো দাড়িওলা ঠাকুর মুকুট পড়ে বসে আছেন। তাই আঁধারটা বড্ড সুন্দর ভাবে সেজেছে আজ। তুমি তো জানোই, আলোকে আমার বড্ড ভয়। আজই সময়, চলো হাতে হাত রাখি। চলো একটু ঘুরে আসি… কিন্তু হয়না। আমার দেখা হয়না। ভালোবাসা যখন ধুসর স্মৃতি হয়ে যায়, কিংবা হয়ে যায় একটা নারকীয় উপসংহার তখন? তখন মনে হয় কি ভালোবাসাটাই একটা ভ্রান্ত ধারণা? কিন্তু বিশ্বাস কর, আমি এরকম হতে দিতে চাইনি। বিশ্বাস কর, মনে মনে আমি অনেক দূরে চলে যেতে চেয়েছিলাম। বিশ্বাস করঃ কোন দুরভিসন্ধি ছিলনা মনে। বিশ্বাস করঃ একবার অন্তত উত্তরণ চেয়েছিলাম। বিশ্বাস কর, ভরা শ্রাবণে আমি শুধু তোকে নিয়ে একবার ভিজতে চেয়েছিলাম। বিশ্বাস কর, আমি তোকে ভালোবেসেছিলাম।

বিশ্বাস কর, আমি ছন্নছাড়া, অথর্ব, বর্বর যাযাবর, পঙ্গু, অমানুষ হতে চাইনি……

আমি হয়তো একদিন ছায়া হয়ে যাবো স্বপ্ন দেখতে দেখতে। রোজ স্বপ্নের খাম তৈরি করি আমি। কিন্তু চিঠি লেখার সাহস হয়না! পোস্ট অফিসটা অনেক দূরে। তবুও আমি যাই, দেখি, কত মানুষ ডাকঘরে আসে যায়। আমি দেখি। বারবার দেখি। মনে করার চেষ্টা করি – সেই চিঠিগুলিতেই বোঝাই হয় স্বপ্ন। যদিও দাঁড়ি পাল্লায় মাপতে গিয়ে আমার দিকের বাটখারা স্বপ্নের চেয়ে ভারী হয়ে গেছে। অতঃপর, নির্জনে স্বপ্নের টুকলি তৈরি করি চুরি করে। হয়তো কোন একজামিনেশনে চোথা মারার কাজে লাগতেও পারে।

এটা প্রাপ্য। কেউ ছিনিয়ে নিতে পারবে না। তাই অবশেষে স্বপ্ন বেচাটাকেই পেশা হিসেবে বেছে নিলাম। আমি শালা পয়সার অভাবে বিপ্লবী, মননের অভাবে চিন্তাশীল, ভয়ের অভাবে নির্ভীক, কথার অভাবে বাচাল, শান্তির অভাবে সন্ত্রাসী, ভাগ্যের অভাবে জাঁদরেল, তুলতুলে চেহারার অভাবে বিকৃতবেশী, চুকানির জন্য আঁতেল, ভাবের অভাবে কবি, রোমান্সের অভাবে অপ্রেমিক, অস্ত্রের অভাবে শিকারী, সুরের অভাবে কাককন্ঠী, নিন্দার অভাবে বিশ্বপটু, ভাতের অভাবে বাটপার, স্কিল এর অভাবে খেলোয়ার, নিষ্ঠার অভাবে জানোয়ার। কলমের অভাবে শব্দ গুতাই, অভ্যাসের দোষে রাষ্ট্রকে কটাক্ষ করি, বাঁচার জন্য তেল দেই, ইঞ্জিনকে চালু রাখার জন্য ঘড়ি ঘুরাই, চরিত্রের দোষে বাউন্ডাল ও চোর। আমি বাই ডিফল্ট সৎ, কারণ আমি অসৎ হতে পারিনা!

—————-
জুন। ১০। ২০১২।