(আগের পর্বের পর…)

৬.০ : চার্বাক ও লোকায়ত

অষ্টম শতকের বৌদ্ধ আচার্য শান্তরক্ষিত তাঁর ‘তত্ত্বসংগ্রহ’ গ্রন্থে স্বমত-সমর্থনে তথা বিপক্ষমত খণ্ডনে যে বিস্তৃত আয়োজন করেছিলেন, সেখানে তৎকালীন প্রচলিত বস্তুবাদী মতবাদকে তাঁর খণ্ডনের প্রয়োজন ছিলো এবং সে ব্যবস্থাও তিনি করেছিলেন। এই খণ্ডনের প্রয়োজনে পূর্ব-পক্ষ হিসেবে স্থাপিত বস্তুবাদী মতকে তিনি ‘লোকায়াত’ নামে আখ্যায়িত করেছেন। আবার একই শতকের বৌদ্ধ দার্শনিক কমলশীল তাঁর গুরু শান্তরক্ষিতের ‘তত্ত্বসংগ্রহ’ গ্রন্থের ব্যাখ্যায় ‘তত্ত্বসংগ্রহপঞ্জিকা’ নামের যে বিশাল ভাষ্যগ্রন্থ রচনা করেন, সেখানেও বস্তুবাদী মত খণ্ডনে ব্যাপক আয়োজন করা হয়েছে। কিন্তু কমলশীল এখানে গুরু শান্তরক্ষিতের আখ্যায়িত ‘লোকায়ত’ মতকে ‘চার্বাক’ মত হিসেবে উল্লেখ করেন। অর্থাৎ এই দুই বৌদ্ধ আচার্যের দার্শনিক সিদ্ধান্তে লোকায়ত ও চার্বাক ভিন্ন ভিন্ন নামে আসলে একই অভিন্ন মতবাদ ও সম্প্রদায় হিসেবেই চিহ্নিত হয়েছে।
.
একইভাবে অষ্টম শতকের আরেক জৈন দার্শনিক হরিভদ্র সূরী তাঁর স্বমত জৈনমতের শ্রেষ্ঠত্ব নিরূপণে রচিত ‘ষড়দর্শনসমুচ্চয়’ গ্রন্থে সেকালের যে ছটি প্রখ্যাত দার্শনিক মতের বিচারমূলক পর্যালোচনা করেছেন, সেখানে বস্তুবাদী মতটিকে ‘লোকায়ত’ মত হিসেবেই উপস্থাপন করেন। অথচ এই ‘ষড়দর্শনসমুচ্চয়’ গ্রন্থের বিশদ ব্যাখ্যা হিসেবে আনুমানিক চতুর্দশ-পঞ্চদশ শতকের প্রখ্যাত জৈন দার্শনিক গুণরত্নের রচিত ‘তর্করহস্যদীপিকা’ নামের টীকাগ্রন্থে ওই একই বস্তুবাদী মত চার্বাক নামে অভিহিত হয়েছে। অবশ্য চার্বাক ও লোকায়ত যে একই মতের ভিন্ন ভিন্ন নাম, গুণরত্ন তা বলতেও দ্বিধা করেননি-

‘তৎ নামানি চার্বাক লোকায়ত ইতি-আদীনি’।- (তর্করহস্যদীপিকা)।
অর্থাৎ : তার নাম চার্বাক, লোকায়ত ইত্যাদি।

.
এখানেই শেষ নয়, বেদান্ত দর্শনের মূল গ্রন্থ মহর্ষি বেদব্যাস বা বাদরায়ন রচিত ‘ব্রহ্মসূত্রে’র প্রখ্যাত ভাষ্যকার বিশিষ্টাদ্বৈতবাদী বেদান্ত দার্শনিক রামানুজ একাদশ শতকে রচিত তাঁর ভাষ্যগ্রন্থে বস্তুবাদী দর্শনকে ‘চার্বাক’ নামে অভিহিত করলেও এর বহু আগেই সপ্তম শতকের আরেক প্রখ্যাত ভাষ্যকার অদ্বৈত-বেদান্তবাদী দার্শনিক শঙ্করাচার্যের প্রসিদ্ধতম গ্রন্থ ‘বেদান্তভাষ্য’র কোথাও চার্বাক শব্দটি চোখে পড়ে না। বস্তুবাদী মতটিকে শঙ্করাচার্য একাধিকবার ‘লোকায়ত’ নামেই উল্লেখ করেছেন।
.
আসলে চার্বাকমতেরই পূর্বকৃত নামান্তর যে লোকায়ত, এটারই উল্লেখ পাওয়া যায় চতুর্দশ শতকের আরেক বেদান্ত দার্শনিক মাধবাচার্যের ‘সর্বদর্শনসংগ্রহ’ গ্রন্থে-

তস্য চার্বাকমতস্য লোকায়তম্ ইতি অণ্বর্থম্ অপরং নামধেয়ম।- (সর্বদর্শনসংগ্রহ)।
অর্থাৎ : ওই চার্বাকদর্শনেরই অপর এক জুৎসই বা সার্থক নাম হলো লোকায়ত।

.
লোকায়ত নামটিকে মাধবাচার্য কথিত অপর এক ‘অণ্বর্থম্’ বা জুৎসই উল্লেখের মধ্যে চার্বাকদর্শনের প্রতি তাঁর অপছন্দ-প্রসূত কটাক্ষের আভাস রয়েছে বলে মনে হয়। এরই প্রতিধ্বনি শোনা যায় লোকায়ত নামের ব্যাখ্যায় জৈন দার্শনিক গুণরত্নের উক্তিতেও-

‘লোকো নির্বিচারাঃ সামান্য লোকাঃ তৎবদ্ আচরন্তি স্ম ইতি লোকায়ত, লোকায়তিকা ইতি অপি।’- (তর্করহস্যদীপিকা)।
অর্থাৎ : সহজ কথায় বিচারবিহীন সাধারণ মানুষ এই মত অনুসারে আচরণ করে বলেই লোকায়ত বা লোকায়তিক শব্দের ব্যবহার।

.
গুণরত্নের এই ব্যাখ্যা থেকে প্রতীয়মান হয়, এই বস্তুবাদী মতানুযায়ী কোন বাছবিচার ছাড়া সাধারণ মানুষের আচরণ অনুচর্চিত হয় বলে এটা লোকায়ত অর্থাৎ জনসাধারণের দর্শন। আর সাধারণ মানুষের বস্তুবাদী আচরণ নিশ্চয়ই আধ্যাত্মবাদী দার্শনিকদের কাছে সম্মানজনক বিবেচিত হয়নি। ফলে এসব দার্শনিকের পক্ষ থেকে এরকম কম-বেশি কটাক্ষ বর্ষণ ভারতীয় দার্শনিক আচার হিসেবেই প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেছে হয়তো। এবং লোকায়তবাদীদের পক্ষ থেকেও যখন ফের পাল্টা কটাক্ষ বর্ষিত হতে শুরু করে, তখনই শুরু হয় যুক্তিতর্কের এক অন্যরকম দার্শনিক বিতর্ক। তাই চার্বাক মতের উৎসগ্রন্থের অনুপস্থিতিতে বিষয়ানুগ আলোচনায় এসব উষ্ণতা এড়িয়ে চার্বাক মত পুনর্গঠনের সুযোগ আপাতদৃষ্টিতে নেই বলেই মনে হয়।
.
এই দার্শনিক কটাক্ষের মধ্য দিয়েই যে লোকায়ত মতগুলি ভারতীয় আধ্যাত্ম দর্শনের বিপরীতে দাঁড়িয়ে চার্বাক মতের প্রতিনিধি হয়ে নিজের সদম্ভ অস্তিত্ব ঘোষণা করে নিরন্তর যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছে, সেগুলি আসলে প্রাচীনকাল থেকে আমাদের সমাজে একরকম দার্শনিক ছড়া হিসেবে চালু ছিলো। এগুলি কার রচনা তা জানা নেই কিংবা বিদগ্ধ কোন গ্রন্থের অংশও নয় এগুলি। তবুও লোকমুখে মুখে চলে এসেছে বলে একে বলা হয় লোকগাথা। এই লোকগাথার পেছনে দীর্ঘকালের রেশ থাকলে অনেক সময় তা প্রামাণিক লোকগাথা হিসেবে প্রসিদ্ধি পেয়ে যায়। চার্বাকের নামে প্রচলিত এরকম কিছু প্রামাণিক লোকগাথার উপস্থিতি দেখা যায় প্রাচীন ভারতীয় দার্শনিক সাহিত্য গ্রন্থগুলিতে, তাও আবার প্রতিপক্ষ দার্শনিকদের দর্শনযুক্তির পূর্বপক্ষ হয়ে। এরকম একটি লোকগাথা হলো-

যাবদ্ জীবেৎ সুখং জীবেদ্ নাস্তি মৃত্যোরগোচরঃ।
ভস্মীভূতস্য দেহস্য পুনরাগমনং কুতঃ ।। -(সর্বদর্শনসংগ্রহ : চার্বাক-দর্শনম্)।
অর্থাৎ : যতদিন বেঁচে আছ ততদিন সুখভোগ করে নাও। মরণ থেকে কারুরই রেহাই নেই। লাশ পুড়ে যাবার পর আবার কেমন করে ফিরে আসবে?

.
মাধবাচার্য তাঁর ‘সর্বদর্শনসংগ্রহ’ গ্রন্থে এই লোকগাথাটি উদ্ধৃত করে এরপর মন্তব্য করেছেন-

-ইতি লোকগাথামনুরুন্ধানা নীতিকামশাস্ত্রানুসারেণার্থ-কামৌ এব পুরুষার্থৌ মন্যমানাঃ পারলৌকিকম্ অর্থম্ অপহ্নুবানাঃ চার্বাকমতম্ অনুবর্ত্তমানা এবানুভূয়ন্তে। অতএব তস্য চার্বাক-মতস্য লোকায়তম্ ইতি অন্বর্থম্ অপরং নামধেয়ম্ । -(সর্বদর্শনসংগ্রহ : চার্বাক-দর্শনম্)।
অর্থাৎ : এই লোকগাথার অনুবর্তন করে, নীতিশাস্ত্র ও কামশাস্ত্র অনুসারে অর্থ ও কামকে পুরুষার্থ মনে করে, পারলৌকিক স্বর্গ, দেবতা, পাপ ও পুণ্য প্রভৃতি অপ্রত্যক্ষ পদার্থ অগ্রাহ্য করে চার্বাকমতের অনুবর্তন করতে দেখা যায়। এজন্যে চার্বাক মতের অপর একটি সার্থক নাম লোকায়ত। প্রায় সমস্ত লোকে এই মতটি পরিব্যাপ্ত বলে তা লোকায়ত মত নামে প্রসিদ্ধ।

.
মাধবাচার্যের এই মন্তব্য থেকে আমাদের অনুমান করতে কষ্ট হয় না যে, চার্বাক মত আর লোকায়ত মত একই, যা সাধারণ জনমনে খুবই জনপ্রিয়। এবং তার চেয়েও বড় কথা হলো, দর্শনটি ঐকান্তিক অর্থেই ইহলোকসর্বস্ব। এই মতে পরকাল পরলোক প্রভৃতির কোন স্থান নেই। দৃশ্যমান এ পৃথিবী বাস্তব সত্য। মূলত এটিই এ দর্শনের প্রাণকথা। প্রত্যক্ষসিদ্ধ এই বাস্তবতাকে কোন ইন্দ্রিয়াতীত কল্পনার আধ্যাত্মিক যুক্তি দিয়ে খণ্ডন করা যে দুরুহ তা চার্বাকমতের ঘোর বিরোধী হয়েও মাধবাচার্য হয়তো অনুধাবন করেছিলেন ঠিকই। তাই শুরুতেই বলে রেখেছেন-

‘দুরুচ্ছেদং হি চার্বাকস্য চেষ্টিতম্ ।’- (সর্বদর্শনসংগ্রহ)।
অর্থাৎ : চার্বাকের চেষ্টিত বা প্রচারিত এই মতবাদ দুশ্ছেদ্য।

.
উপরিউক্ত লোকগাথাটি ছাড়াও মাধবাচার্য তাঁর ‘সর্বদর্শনসংগ্রহ’ গ্রন্থে চার্বাক বা লোকায়তিকদের নামের সঙ্গে সম্পর্কিত এরকম বেশ কিছু প্রামাণিক বা প্রসিদ্ধ লোকগাথা উদ্ধৃত করেছেন। অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক এই লোকগাথাগুলির অন্তর্গত দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি চার্বাক মতেরই প্রতিধ্বনি। তবে এগুলোর লোকায়তিক কটাক্ষপূর্ণ বক্তব্যের মূল কথাটা হচ্ছে- কিছু ধূর্ত মানুষ লোক-ঠকিয়ে উপার্জন করবার উদ্দেশ্যে রকমারি ধর্মকর্ম ও ক্রিয়াকাণ্ডের বিধান দিয়ে থাকেন এবং এসব যে নেহায়েতই লোক-ঠকানো ব্যাপার, প্রত্যক্ষ-প্রমাণ থেকেই তা সহজে বোঝা যায়। প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় ‘সর্বদর্শনসংগ্রহে’ উদ্ধৃত লোকগাথাগুলি বাংলা তর্জমাসহ বিবৃত করা হলো-

সর্বদর্শনসংগ্রহে লোকায়তিক চার্বাকপক্ষ প্রকরণ

অত্র চত্বারি ভূতানি ভূমি-বারি-অনল-অনিলাঃ ।
চতুর্ভ্যঃ খলু ভূতেভ্যঃ চৈতন্যম্ উপজায়তে ।।
[ (লোকায়ত মতে) মাটি, জল, আগুন, বাতাস- শুধুমাত্র এই চার রকম ভূতবস্তুই বর্তমান। এই চার রকম ভূতবস্তু থেকেই চৈতন্য উৎপন্ন হয়। ]
.
কিণ্ব-আদিভ্যঃ সমেতেভ্যঃ দ্রব্যেভ্যঃ মদশক্তিবৎ।
অহং স্থূলঃ কৃশঃ অস্মি ইতি সামানাধিকরণ্যতঃ।।
[ যেমন কিণ্ব প্রভৃতি বস্তুগুলি থেকেই উৎপন্ন হয় মদশক্তি। ‘আমি মোটা’, ‘আমি রোগা’- এ জাতীয় শব্দ ব্যবহারের ক্ষেত্রে আসলে বিশেষ্য-বিশেষণ সম্পর্কই বর্তমান। ]
.
দেহঃ স্থৌল্য-আদি-যোগাৎ চ স এব আত্মা ন চ অপরঃ ।
মম দেহঃ অয়ম্ ইতি উক্তিঃ সম্ভবেৎ ঔপচারিকী ।।
[ ‘মোটা’ প্রভৃতি শব্দ দেহেরই বিশেষণ বলে স্বতন্ত্র কোনো আত্মার কথা অবান্তর। ‘আমার দেহ’ জাতীয় কথা নেহাতই কথার কথা- যাকে বলে উপচার। ]
.
ন স্বর্গো নাপবর্গো বা নৈবাত্মা পারলৌকিকঃ।
নৈব বর্ণাশ্রমাদীনাং ক্রিয়াশ্চ ফলদায়িকাঃ ।।
[ স্বর্গ বলে কিছু নেই, অপবর্গ বা মুক্তি বলেও নয়, পরলোকগামী আত্মা বলেও নয়। বর্ণাশ্রম-বিহিত ক্রিয়াকর্মও নেহাতই নিষ্ফল। ]
.
অগ্নিহোত্রং ত্রয়ো বেদাস্ত্রিদণ্ডং ভস্মগুণ্ঠনম্।
বুদ্ধিপৌরুষহীনানাং জীবিকা ধাতৃনির্মিতা ।।
[ যাদের না-আছে বুদ্ধি, না খেটে খাবার মুরোদ তাদের জীবিকা হিসাবেই বিধাতা যেন সৃষ্টি করেছেন অগ্নিহোত্র যজ্ঞ, তিন বেদ, সন্ন্যাসীদের ত্রিদণ্ড, গায়ে ভস্মলেপন প্রভৃতি ব্যবস্থা। ]
.
পশুশ্চেন্নিহতঃ স্বর্গং জ্যোতিষ্টোমে গমিষ্যতি।
স্থাপিতা যজমানেন তত্র কস্মান্ন হিংস্যতে।।
[ জ্যোতিষ্টোম যজ্ঞে নিহত পশু যদি সরাসরি স্বর্গেই যায়, তাহলে যজমান কেন নিজের পিতাকে হত্যা করে না? (অর্থাৎ, স্বর্গে যাবার অমন সোজা সড়ক থাকতেও যজমান কেন নিজের পিতাকে তা থেকে বঞ্চিত করে? ]
.
মৃতানামপি জন্তূনাং শ্রাদ্ধং চেৎ তৃপ্তিকারণম্।
নির্বাণস্য প্রদীপস্য স্নেহঃ সংবর্ধয়েৎ শিখাম্।।
[ কেউ মারা যাবার পর শ্রাদ্ধকর্ম যদি তার তৃপ্তির কারণ হয়, তাহলে তো প্রদীপ নিভে যাবার পরেও তেল ঢেলে তার শিখা প্রদীপ্ত করা যেত। ]
.
গচ্ছতামিহ জন্তূনাং ব্যর্থং পাথেয়কল্পনম্।
গেহস্থকৃতশ্রাদ্ধেন পথি তৃপ্তিরবারিতা।।
[ যে পৃথিবী ছেড়ে গেছে তার পাথেয় (পিণ্ড) কল্পনা করা বৃথা, কেননা তাহলে ঘর ছেড়ে কেউ গ্রামান্তর গমন করলে ঘরে বসে তার উদ্দেশ্যে পিণ্ড দিলেই তো তার পাথেয়-ব্যবস্থা সম্পন্ন হতো। (অর্থাৎ গ্রামান্তরগামীর পক্ষে তো তাহলে পাথেয় হিসেবে চাল-চিঁড়ে বয়ে নিয়ে যাবার দরকার হতো না।) ]
.
স্বর্গস্থিতা যদা তৃপ্তিং গচ্ছেয়ুস্তত্র দানতঃ।
প্রাসাদস্যোপরিস্থানামত্র কস্মান্ন দীয়তে ।।
[ যিনি স্বর্গে গেছেন তাঁর উদ্দেশ্যে দান নেহাতই বৃথা, কেননা তাহলে যিনি প্রাসাদের উপরে উঠে গেছেন তাঁর উদ্দেশ্যে (মাটিতে বসে) দান করলেও তো তাঁর তৃপ্তি হবার কথা। ]
.
যাবজ্জীবেৎ সুখং জীবেৎ ঋণং কৃত্বা ঘৃতং পিবেৎ।
ভস্মীভূতস্য দেহস্য পুনরাগমনং কুতঃ ।।
[ যতদিন বেঁচে আছ সুখে বাঁচার চেষ্টা কর, ধার করেও ঘি খাবার ব্যবস্থা কর। লাশ পুড়ে যাবার পর আবার কেমন করে ফিরে আসবে? ]
.
যদি গচ্ছেৎ পরং লোকং দেহাদেষ বিনির্গতঃ।
কস্মাদ্ ভূয়ো ন চায়াতি বন্ধুস্নেহসমাকুলঃ।।
[ জীব যদি এই দেহ ছেড়ে পরলোকে যায়, তাহলে বন্ধুবান্ধবদের টানে সে আবার ফিরে আসে না কেন? ]
.
ততশ্চ জীবনোপায়ো ব্রাহ্মণৈর্বিহিতস্ত্বিহ।
মৃতানাং প্রেতাকার্যাণি ন ত্বন্যৎ বিদ্যতে ক্কচিৎ ।।
[ ব্রাহ্মণদের জীবিকা হিসেবেই মৃত ব্যক্তির উদ্দেশ্যে (শ্রাদ্ধাদি) প্রেতকার্য বিহিত হয়েছে। তাছাড়া এসবের আর কোনো উপযোগিতা নেই। ]
.
ত্রয়ো বেদস্য কর্ত্তারো ভণ্ডধূর্তনিশাচরাঃ ।
জর্ফরীতুর্ফরীত্যাদি পণ্ডিতানাং বচঃ স্মৃতম্।।
[ যারা তিন বেদ রচনা করেছেন তাঁরা নেহাতই ভণ্ড, ধূর্ত ও চোর (নিশাচর)। জর্ফরীতুর্ফরী (প্রভৃতি অর্থহীন বেদমন্ত্র) ধূর্ত পণ্ডিতদের বাক্যমাত্র। ]
.
অশ্বস্যাত্র হি শিশ্নং তু পত্নীগ্রাহ্যং প্রকীর্তিতম্ ।
ভণ্ডৈস্তদ্বৎ পরং চৈব গ্রাহ্যজাতং প্রকীর্তিতম্।
মাংসানাং খাদনং তদ্বন্নিশাচর-সমীরিতম্।।
[ আর তাঁরাই বিধান দিয়েছেন, অশ্বমেধ-যজ্ঞে যজমান-পত্নী অশ্বের শিশ্ন গ্রহণ করবে। তেমনি চোরেরাই (নিশাচর) মাংস খাবার মতলবে (যজ্ঞে পশুবলির) বিধান দিয়েছেন। ]

তস্মাদ্ বহূনাং প্রাণিনামনুগ্রহার্থং চার্বাকমতমাশ্রয়ণীয়মিতি রমণীয়ম্।
ইতি সায়ণমাধবীয়ে সর্বদর্শন-সংগ্রহে চার্বাকদর্শনম্ সমাপ্তম্ ।
[ এরকম আরো বহু রমণীয় চার্বাক লোকগাথা রয়েছে। সায়ণ মাধবাচার্য বিরচিত সর্বদর্শনসংগ্রহ নামক গ্রন্থের চার্বাকদর্শন নামক প্রকরণ সমাপ্ত হলো। ]

.
লোকমুখে প্রচারিত এই লোকগাথাগুলিতে দর্শনের জটিল বিভ্রম নেই ঠিকই, কিন্তু তাদের নিজস্ব বাস্তবসম্মত দর্শনের ঔজ্জ্বল্যটুকু বিকিরিত হয়েছে ঠিকই। আর তা হলো ইন্দ্রিয়গোচর ইহলৌকিক দর্শন। যাকে আমরা বস্তুবাদী চার্বাক দর্শন বলি। এটাই প্রাকৃতজনের বা জনগণের দর্শন অর্থাৎ লোকায়ত দর্শন। এই ইন্দ্রিয়গোচরতাই যে লোকায়ত, তা নিরূপন করতে গিয়ে জৈন দার্শনিক হরিভদ্র সূরী তাঁর ‘ষড়দর্শনসমুচ্চয়’-এ বলেন-

‘এতাবানেব লোকোইয়ং যাবানিন্দ্রিয়গোচরঃ’। (ষড়দর্শনসমুচ্চয়)।
অর্থাৎ : যতটুকু নিছক ইন্দ্রিয়গোচর সেটুকুকেই বলে ‘লোক’।

.
আর এই ‘লোক’ই যাদের কাছে একমাত্র সত্য তারাই লোকায়তিক। ফলে লোকায়তিক মতে প্রত্যক্ষগোচর পদার্থই একমাত্র সত্য। কিন্তু লোকায়তিকদের মধ্যে শুধুমাত্র প্রত্যক্ষ-গোচর পদার্থকে সত্য বলে স্বীকার করার কারণ কী ? এর সুস্পষ্ট উত্তর পাওয়া যায় ভাষ্যকার মণিভদ্র’র উক্তিতে –

‘এবম্ অমী অপি ধর্মছদ্মধূর্তাঃ পরবঞ্চনপ্রবণাঃ যৎকিংচিৎ অনুমানাদিদার্ঢ্যম্ আদর্শ্য ব্যর্থং মুগ্ধজনান্ স্বর্গাদিপ্রাপ্তিলভ্য ভোগাভোগপ্রলোভনয়া ভক্ষ্যাভক্ষ্যগম্যাগম্যহেয়োপাদেয়াদি সংকটে পাতয়ন্তি, মুগ্ধধার্মিককান্ধ্যম্ চ উৎপাদয়ন্তি।’
অর্থাৎ : লোকায়তিকদের মতে প্রত্যক্ষ-পরায়ণতা ধর্মপ্রবঞ্চনার প্রতিষেধক, কেননা অনুমান, আগম (শাস্ত্র) প্রভৃতির নজির দেখিয়ে পরবঞ্চনপ্রবণ ধর্মছদ্মধূর্তেরা সাধারণ মানুষের মনে স্বর্গাদিপ্রাপ্তি সংক্রান্ত অন্ধ মোহের সঞ্চার করে, এই কারণেই প্রত্যক্ষ ছাড়া অন্য প্রমাণ স্বীকার করা সাধারণ মানুষের পক্ষে নিরাপদ নয়।
(সূত্র: ভারতে বস্তুবাদ প্রসঙ্গে, পৃষ্ঠা-১৬/ দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়)

.
এর মানে দাঁড়ালো, আধ্যাত্মবাদী দর্শনের পেছনে লোকবঞ্চনার এক আয়োজন সক্রিয়। চার্বাক বিরোধী হয়েও মণিভদ্রের এই চমৎকার ব্যাখ্যাটি পর্যালোচনার ক্ষেত্রে আমাদের বিবেচনায় রাখতে হবে যে, তিনি একাধারে একজন ব্রাহ্মণ্যবাদ বিরোধী দার্শনিকও। ফলে ব্রাহ্মণ্যবাদের স্বরূপটিও তাঁর উক্তি থেকে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এবং মণিভদ্রের এই ব্যাখ্যা স্বীকার্য হলে এটাও মানতে হবে যে, সেকালের লোকায়তিকেরাও দার্শনিক মতকে একেবারে নির্ভেজাল তত্ত্বজিজ্ঞাসার পরিচায়ক বলে মেনে নেননি। দার্শনিক মতের সঙ্গে ধর্মীয় রাজনীতির এরকম যোগাযোগ তাঁদের চেতনারও অগোচর ছিলো না। উপরে উদ্ধৃত লোকাগাথাগুলিই এর প্রকৃষ্ট প্রমাণ।
.
দেহাতিরিক্ত আত্মা অস্বীকার করাটাই চরম জড়বাদের প্রধান বৈশিষ্ট্য। আর পরলোকগামী আত্মা বলে যদি কিছু না-থাকে তাহলে পরলোকের কল্পনাও অবান্তর। এ অর্থে জড়বাদ বা বস্তুবাদ মানেই ইহলোক-সর্বস্ব দর্শন। ফলে আত্মবাদী বা আধ্যাত্মবাদীদের পক্ষে অবশ্যই এই দর্শনকে অপছন্দ করার পাশাপাশি এরকম দর্শনের প্রতি সহজাতভাবে আকৃষ্ট জনসাধারণকেও ভালো চোখে দেখার কথা নয়। কেননা, দেহাতিরিক্ত আত্মাকেই চৈতন্যের মূল বা উৎস হিসেবে প্রচার করে আধ্যাত্মবাদীরা যে ইন্দ্রিয়াতীত সত্তা ও পারলৌকিক জগতের কল্পনা বিস্তার করেছেন, তা দিয়ে মূলত পূর্বজন্মের কর্মফল হিসেবে প্রাকৃত জনগোষ্ঠির বর্তমান জন্ম ও ক্রিয়াকাণ্ডকে বেঁধে ফেলে নিজেদের মতো করে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হয়েছে। এটা যে চতুর লোকবঞ্চনা তা লোকায়তিকদের সাধারণ দৃষ্টিতেই ধরা পড়েছে এবং ইন্দ্রিয়াতীত কোন অস্তিত্বে সরাসরি অস্বীকারের মধ্য দিয়েই তা প্রতিরোধের চেষ্টা করা হয়েছে। তাই লোকায়তিকদের মতে চৈতন্য যে আসলে দেহেরই গুণ বা দেহধর্ম, তা কট্টর ব্রহ্মবাদী বৈদান্তিক দার্শনিক শঙ্করাচার্য’র কটাক্ষপূর্ণ উক্তি থেকেও বোঝা যায়-

‘ইতর জনগণ বা প্রাকৃতজন এবং লোকায়তিকেরা চৈতন্যবিশিষ্ট দেহমাত্রকে আত্মা বলে মনে করে।’

.
জনসাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে থাকা লোকায়তিকদের প্রত্যক্ষ যুক্তি সংবলিত প্রচলিত লোকগাথাগুলিকে বস্তুবাদী দর্শনের অন্যতম প্রতিভূ হিসেবে পূর্বপক্ষ বিবেচনায় নিয়ে বিভিন্ন দার্শনিক সাহিত্যে আধ্যাত্মবাদী দার্শনিকদের পক্ষ থেকে যুক্তি খণ্ডনের প্রয়াস প্রত্যক্ষ করলেই এ ধারণা জোরালো হয়ে ওঠে যে, লোকায়ত ও চার্বাক আসলে একই মতের একাধিক নাম ছাড়া কিছু নয়। সপ্তম-অষ্টম শতকের শঙ্করাচার্যও তাঁর ‘সর্বসিদ্ধান্তসংগ্রহ’ গ্রন্থে লোকায়ত মতের প্রতিভূ হিসেবে বেশ কিছু লোকগাথা উদ্ধৃত করেছেন। প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় সেগুলিও তর্জমাসহ উদ্ধৃত করা হলো-

সর্বদর্শন-সিদ্ধান্ত-সংগ্রহোক্ত লোকায়তিক-মতম্

[ সংগ্রহ সূত্র: সায়ন মাধবীয় সর্বদর্শনসংগ্রহ (প্রথম খণ্ড)- চার্বাকদর্শন / অমিত ভট্টাচার্য / সংস্কৃত পুস্তক ভাণ্ডার, কলকাতা। ]

লোকায়তিকপক্ষে তু তত্ত্বং ভূতচতুষ্টয়ম্ ।
পৃথিব্যাপস্তথা তেজো বায়ুরিত্যেব নাপরম্ ।। ১।।
[ লোকায়ত মতে চারটি ভূতকেই তত্ত্ব বলা হয়। উক্ত চারটি ভূত হলো যথাক্রমে পৃথিবী, জল, তেজ এবং বায়ু। অপর কোন ভূত এই মতে স্বীকৃত নয়। ]
.
প্রত্যক্ষগম্যমেবাস্তি নাস্ত্যদৃষ্টমদৃষ্টতঃ।
অদৃষ্টবাদিভিশ্চাপি নাদৃষ্টং দৃষ্টমুচ্যতে।। ২।।
[ যা কিছু প্রত্যক্ষসিদ্ধ তা-ই আছে। অদৃষ্ট যেহেতু দেখা যায় না সেহেতু অদৃষ্ট বলে কিছু নেই। অদৃষ্ট দৃষ্ট হয়ে থাকে- এমন কথা অদৃষ্টবাদিগণও বলেন না। ]
.
ক্বাপি দৃষ্টমদৃষ্টঞ্চেদদৃষ্টং ব্র“বতে কথম্ ।
নিত্যাদৃষ্টং কথং সৎ স্যাৎ শশশৃঙ্গাদিভিঃ সমম্ ।। ৩।।
[ লোকায়তিকেরা বলেন, যদি অদৃষ্ট কোথাও দেখে থাকো, তবে সেই দৃষ্ট বস্তুকে অদৃষ্ট কেন বলো? আবার শশশৃঙ্গাদির ন্যায় নিত্যই যা অদৃষ্ট, তা কিভাবে সৎ হতে পারে? ]
.
ন কল্প্যৌ সুখদুঃখাভ্যাং ধর্মাধর্মৌ পরৈরিহ।
স্বভাবেন সুখী দুঃখী জনোহন্যন্নৈব কারণম্ ।। ৪।।
[ অপরবাদিগণ কর্তৃক সুখদুঃখরূপ হেতুর দ্বারা ধর্ম ও অধর্মের অনুমান করা অযৌক্তিক। স্বভাববশতই মানুষ সুখ এবং দুঃখ পেয়ে থাকে। এই বিষয়ে ধর্ম ও অধর্ম নামক কারণান্তরের অপেক্ষা নেই। ]
.
শিখিনশ্চিত্রয়েৎ কো বা কোকিলান্ কঃ প্রকূজয়েৎ।
স্বভাবব্যতিরেকেণ বিদ্যতে নাত্র কারণম্ ।। ৫।।
[ ময়ূরদের কে বিচিত্র বর্ণে রঞ্জিত করে দেয়? কোকিলদেরই বা কে কূজন করায়? বস্তুত স্বভাব ব্যতীত এক্ষেত্রে অন্য কোন কারণ নেই। ]
.
স্থূলোহহং তরুণো বৃদ্ধো যুবেত্যাদিবিশেষণৈঃ।
বিশিষ্টো দেহ এবাত্মা ন ততোহন্যো বিলক্ষণঃ।। ৬।।
[ আমি স্থূল, তরুণ, যুবা, বৃদ্ধ ইত্যাদি বাক্যে স্থূল প্রভৃতি বিশেষণের দ্বারা দেহই বিশেষিত হয়ে থাকে। দেহ থেকে ভিন্ন অন্য কোন আত্মা নামক পদার্থ ঐ বিশেষণের বিশেষ্য হয় না। ]
.
জড়ভূতবিকারেষু চৈতন্যং যত্তু দৃশ্যতে।
তাম্বুলপূগচূর্ণানাং যোগাদ্রাগ ইবোত্থিতম্ ।। ৭।।
[ জড় ভূতের বিকাররূপ শরীরাদিতে যে চৈতন্য দৃষ্ট হয়, তা পান, সুপারি এবং চূণ সংযোগে রক্তিমার ন্যায়- সংযোগজন্য। ]
.
ইহলোকাৎ পরো নান্যঃ স্বর্গোহস্তি নরকা ন চ।
শিবলোকাদয়ো মূঢ়ৈঃ কল্প্যন্তেহন্যৈঃ প্রতারকৈঃ।। ৮।।
[ ইহলোক থেকে পৃথক স্বর্গ অথবা নরক নামক কোন স্থান নেই। মূর্খ এবং প্রতারকেরাই শিবলোকাদির কল্পনা করে থাকে। ]
.
স্বর্গানুভূতির্মৃষ্টাষ্টির্দ্ব্যষ্টবর্ষবধূগমঃ।
সূক্ষ্মবস্ত্রসুগন্ধস্রক্চন্দনাদিনিষেবণম্ ।। ৯।।
[ শোভন অন্নভোজন, ষোড়শী যুবতীর সঙ্গ, সূক্ষ্ম বস্ত্র এবং সুগন্ধ মাল্য চন্দনাদির উপভোগই স্বর্গানুভব। ]
.
নরকানুভবো বৈরিশস্ত্রব্যাধ্যাদ্যুপদ্রবঃ।
মোক্ষস্তু মরনং তচ্চ প্রাণবায়ুনিবর্তনম্ ।। ১০।।
[ শত্রুর অস্ত্র অথবা ব্যাধি প্রভৃতির উপদ্রবই নরকানুভব। মরণই মুক্তি এবং সেই মরণ হলো প্রাণবায়ুর চিরতরে বহির্গমন। ]
.
অতস্তদর্থং নায়াসং কর্ত্তুমর্হতি পণ্ডিতঃ।
তপোভিরুপবাসাদ্যৈর্মূঢ় এব প্রশুষ্যতি।। ১১।।
[ সুতরাং সেই মুক্তির জন্য বিদ্বানদের কৃচ্ছ্রসাধন করা উচিত নয়। মূর্খ লোকেরাই উপবাসাদি তপস্যার দ্বারা শুষ্ক হয়। ]
.
পাতিব্যত্যাদিসঙ্কেতো বুদ্ধিমদ্দুর্ব্বলৈঃ কৃতঃ।
সুবর্ণভূমিদানাদি মৃষ্টামন্ত্রণভোজনম্ ।
ক্ষুৎক্ষামকুক্ষিভির্লোকৈর্দরিদ্রৈরুপকল্পিতম্ ।। ১২।।
[ যারা বুদ্ধিমান অথচ স্বয়ং দুর্বল (নিজেদের স্ত্রী রক্ষায় অক্ষম) তারাই পাতিব্রত্য প্রভৃতির নিয়ম করেছে। ক্ষুধায় জর্জরিত দরিদ্র লোকেরাই সুবর্ণদান, ভূমিদান এবং শোভন নিমন্ত্রণ ভোজনের ব্যবস্থা কল্পনা করছে। ]
.
দেবালয়প্রপাসত্রকূপারামাদিকর্মণাম্ ।
প্রশংসাং কুর্বতে নিত্যং পান্থা এব ন চাপরে।। ১৩।।
[ পথিকেরাই কেবল দেবালয়, জলসত্র, কূপ, পান্থনিবাসের প্রশংসা করে থাকে, অন্যেরা নয়।]
.
অগ্নিহোত্রং ত্রয়ো বেদাস্ত্রিদণ্ডং ভস্মগুণ্ঠনম্ ।
বুদ্ধিপৌরুষহীনানাং জীবিকেতি বৃহস্পতিঃ।। ১৪।।
[ অগ্নিহোত্র, তিন বেদ, ত্রিদণ্ডধারণ (সন্ন্যাস), ভস্মানুলেপন প্রভৃতি বুদ্ধি ও পৌরুষহীন মানুষের জীবিকার্জনের উপায় বলে বৃহস্পতি মনে করেন। ]
.
কৃষিগোরক্ষবাণিজ্যদণ্ডনীত্যাদিভির্বুধঃ।
দৃষ্টৈরেব সদোপায়ৈর্ভোগাননুভবেদ্ভুবি।। ১৫।।
[ অতএব বুদ্ধিমান সর্বদা কৃষিকর্ম, গোপালন, বাণিজ্য এবং দণ্ডনীতি প্রভৃতি দৃষ্ট উপায় দ্বারা এই পৃথিবীতেই ভোগ অনুভব করেন। ]

ইতি শ্রীমচ্ছঙ্করাচার্যবিরচিতসর্বসিদ্ধান্তসংগ্রহে লোকায়তিকপক্ষো নাম দ্বিতীয়ং প্রকরণম্ ।
[আচার্য শঙ্কর বিরচিত সর্বসিদ্ধান্তসংগ্রহনামক গ্রন্থের লোকায়তিকপক্ষ নামক দ্বিতীয় প্রকরণ সমাপ্ত হলো।]

.
মাধবাচার্যের ‘সর্বদর্শনসংগ্রহ’ ও শঙ্করাচার্যের ‘সর্বসিদ্ধান্তসংগ্রহ’-এ উদ্ধৃত লোকগাথাগুলিতে কিছু বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। যেমন, লোকগাথাগুলিকে প্রতিপক্ষ আধ্যাত্মবাদী দার্শনিক কর্তৃক যুক্তি খণ্ডনের নিমিত্তে পূর্বপক্ষ হিসেবে তাদের সাহিত্যে স্থাপন করা হয়েছে। এই লোকগাথাগুলির মূল কথা প্রধানতই নেতিবাচক এবং প্রধান ঝোঁক পরমত খণ্ডন। অর্থাৎ আধ্যাত্মবাদী দার্শনিকেরা তাঁদের দার্শনিক সিদ্ধান্তে যা প্রমাণ করতে চেয়েছেন তার অনেক কথাই এসব লোকগাথায় নস্যাৎ করার আয়োজন করা হয়েছে বলে মনে হয়। এতে স্বমত প্রতিষ্ঠায় যুক্তিজাল বিস্তারের কোন আয়োজন চোখে পড়ে না। এবং এগুলোর প্রধান হাতিয়ার হলো কটাক্ষপূর্ণ বক্তব্য অর্থাৎ বাস্তব জীবনের প্রায়োগিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে ব্যঙ্গবিদ্রূপ ও হাসি-তামাশার ব্যবহার।
.
কিন্তু যুক্তিজাল বিস্তারের আয়োজন নেই বলেই এজাতীয় খণ্ডনপদ্ধতি যুক্তিহীন বা দার্শনিক মর্যাদার দিক থেকে অবান্তর ভাবারও কারণ নেই। কেননা প্রচলিত অর্থে বিচার-বিশ্লেষণের আয়োজন না থাকলেও এই প্রাণশক্তিপূর্ণ লোকগাথাগুলি কোনভাবেই যুক্তিশূন্য নয়। আর ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ হিসেবে প্রকাশিত হলেও এগুলির ভিত্তি-ভূমিতে কোন যুক্তির পরিচয় না-থাকলে প্রতিটা বিপক্ষ দর্শন-সাহিত্যে এদের খণ্ডনে ব্যাপক প্রস্তুতিরও প্রয়োজন হতো না। অতএব কেবলই পরমত খণ্ডন-লিপ্ত লোকগাথা হলেও দার্শনিক বিচার-পদ্ধতিতে এর অন্তর্নিহিত যুক্তির মধ্যেই স্বীয় মতের পরিচয় নিহিত রয়েছে। সেগুলি সংশ্লেষণের মধ্য দিয়েই লোকায়ত চার্বাক দর্শনের মূল সিদ্ধান্ত এবং এর রূপরেখা তৈরি ও পুনর্গঠন করাও অসম্ভব নয় বলেই বিদ্বানেরা মনে করেন।
.
কিন্তু এই লোকগাথাপ্রসূত লোকায়ত মতের সাথে খ্রীস্টপূর্ব চতুর্থ শতকের প্রাচীন গ্রন্থ ‘অর্থশাস্ত্রে’ কৌটিল্য বর্ণিত আদি লোকায়ত ধারণার যে দ্বন্দ্বমূলক ভিন্নতা সূচিত হয়ে আছে, তার ব্যাপারে কোন যুক্তিসঙ্গত সিদ্ধান্ত না-আসা পর্যন্ত বিষয়টা রহস্যময় প্রশ্ন হয়েই থেকে যায়।

(চলবে…)

[আগের পর্ব: বার্হস্পত্য-সূত্র] [*] [পরের পর্ব: চার্বাক-ষষ্ঠি]