এইমাত্র পড়ে শেষ করলাম ডঃ মুহাম্মদ জাফর ইকবালের লেখা বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী “কেপলার টুটুবি”। আমি যে জাফর ইকবাল স্যারের অনেক লেখা পড়েছি, বা সব বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী পড়েছি সে দাবী করিনা, তবে উনার লেখার সাধারণ প্যাটার্ণ ধরার মত বেশ খানেক বই পড়েছি বটে। আমার কখনও বইয়ের নাম মনে থাকে না, বিখ্যাত লেখকের কোন বিখ্যাত সাহিত্য খন্ড না হলে। জাফর ইকবাল স্যার বিখ্যাত বটে, তবে উনার লেখা একেকটা কল্পকাহিনী অতটা বিখ্যাত না, যতটা বিখ্যাত “জাফর ইকবাল স্যারের লেখা বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী।” এই মানুষটার লেখা আমি পড়ি মনের মধ্যে একধরণের শ্রদ্ধাবোধ নিয়ে… ছোট বেলায় “বাচ্চা ভয়ঙ্কর কাচ্চা ভয়ঙ্কর” পড়ার সময় মনের মধ্যে যেমন একটা উত্তেজনা কাজ করত, ঠিক তেমনি, এখনো যেন শিশুদের মতই তার লেখা কল্পকাহিনী পড়তে গেলে সেই উচ্ছ্বাস মনে জাগে। তিনি আমার মত আমাদের প্রজন্মের তরুণদের শৈশব কৈশোর গড়েছেন একটা ফ্যান্টাসি দিয়ে। সেই ফ্যান্টাসির জগতটা অনেকটা রূপকথার মত, সেখানে কোন অশুভ শক্তি শেষ অব্দি বিজয়ী হতে পারে না। ছোট্ট ছোট্ট ছেলেমেয়েরা দুরন্ত চঞ্চল, তাদের চাঞ্চল্য দিয়ে সম্ভব করে ফেলছে অসাধ্যকে, মানুষ মানেই মায়া মমতা ভালোবাসার আঁধার। চরম বিপদের মুখে মানবজাতি শেষ অব্দি টিকে যায় তাদের হৃদয়ের ভালোবাসার জন্যেই, রোবটেরা বারবার মানব জাতিকে পদানত করে ফেলার চেষ্টা করে, কিন্তু বুদ্ধিমত্তা, গণিতে রোবট প্রজাতি মানুষের চেয়ে তুখোড় হলেও মানুষ ঠিকই তাদের বুদ্ধিমত্তাকে অতিক্রম করে যায়। জাফর ইকবাল স্যারের গল্পে কোয়ান্টাম কম্পিউটার আর ক্রিস্টালে রেকর্ডকৃত তথ্য থাকে। প্রাচীন পৃথিবী সম্পর্কে ভবিষ্যতের মানুষ গুলো জানতে পারে দৈবাৎ পেয়ে যাওয়া ক্রিস্টাল থেকে। সেখানে সবকিছুর শেষে মানুষের জয় হয়, ভালোবাসার জয় হয়। একটা গল্পের সামগ্রিক চিত্রটা যখন এভাবে দেখা হয়, তখন সেটাকে রূপকথা বলেই মনে হয়। আসলে তো বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী আর রূপকথার মধ্যে পার্থক্য শুধু একটাই, আগডুম বাগডুম দৈত্য দানো ভূত প্রেতকে স্থলাভিষিক্ত করে বৈজ্ঞানিকের কল্পনায় গড়া যন্ত্র দানবেরা, পাতাল পুরী, আকাশ পুরীর জায়গায়, ভিনগ্রহ, নক্ষত্র, মহাকাশ যান আর রাজকন্যা রাজপুত্রকে স্থলাভিষিক্ত করে মহাকাশযানের অভিযাত্রী, সাধারণ কোন মানুষ বা তারছেড়া কোন পাগলা বিজ্ঞানী। মন্দ নয়।

এগুলো উচ্চদরের সাহিত্য না হলেও ভালো মানের শিশু-খাদ্য বটে। প্রশ্ন হল ফ্যান্টাসীর জগতে ঘুরতে থাকা শিশুমন যখন জাফর ইকবাল স্যারের বইয়ের জগত থেকে বেরিয়ে অমানবিক জগতের দিকে তাকায়, বুঝতে পারে ক্রমাগত মানুষের মাঝে মানবতা বোধ কমছে, তখন একধাক্কায় মানবতা, মায়া মমতা ভালোবাসার গল্প কি শুধুই গল্প হয়ে যায় না?

বর্তমান কালের মানুষগুলো মানুষের মৃত্যুর খবরে নির্বিকার হয়ে থাকে, মুখ দিয়ে হয়তো, ছোট্ট করে বের হয়, “আহা!” আমাদের সংবাদপত্রগুলো আমাদের কাছে প্রতিদিন যে বাস্তব সংবাদ প্রচার করে, তাতে কি মনে হয় না, প্রাচীনকালের রূপকথার দৈত্যদানব, জাফর ইকবাল স্যারের কল্পকাহিনীর মায়া মমতাহীন রোবট প্রজাতিকে স্থলাভিষিক্ত করে ফেলেছে আমাদেরই মানব সম্প্রদায়। রূপকথা গুলো বা বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীগুলো ক্রমেই গল্প হয়ে যাচ্ছে, কল্পনার জোরে নয়, মানবতার অবলুপ্তির ফলশ্রুতিতে!

নতুন করে আজ জীবনের অর্থ খুঁজতে বসেছি, কি চাই জীবনে, জ্ঞান, ধন, যশ? কোন পথে গেলে মনে হবে জীবনটা সার্থক? মানব সেবার কথা ভেবেছি এতোটা দিন। এখন ভাবছি, সামগ্রিক অর্থে যে মানব জাতির সেবার কথা ভেবেছি, সেই মানব জাতি আসলে কি চায়?

জীবনের অর্থই যদি হয় অমুক খ্রিষ্টাব্দ থেকে অমুক খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত বেঁচে থাকা স্রেফ, তাহলে জীবনের আসলেই কোন আল্টিমেট গোল আছে? জাফর ইকবাল স্যার যেই মানবতা বোধকে উচ্চে তুলে ধরার জন্য গল্প লিখেন, এটাই কি শেখাবো আমার সন্তানকে? সেই সাথে তো তাহলে আমাকে এটাও শেখাতে হবে, এই পৃথিবীতে রোজ চলবে হানাহানি, তার মধ্যেই বেঁচে থাকতে হবে, সয়ে যেতে হবে মানুষের অমানবিক আচরণ। এইভাবে নীতিগতভাবে দ্বিচারী হতে শেখানোই কি বাঁচতে শেখানো? আপাত দৃষ্টিতে সত্য এবং মিথ্যার এমন একটা সংকটে “মানবতা” শব্দটার ভাবার্থ দাঁড়িয়ে রয়েছে, দ্বিচারীতা ছাড়া আর কি শেখাতে পারবো? সেই বা কি শেখাবে তার সন্তানকে? “বাঁচতে শেখা” মানেটা কি?

বিবর্তনীয় প্রয়োজনে একদিন সৃষ্টি হয়েছিল প্রাণী জগতের সহমর্মী সহযোগী আচরণ। আমি যে গবেষণার সাথে জড়িত, সেই গবেষণায় সফল হলে একদিন মানুষ জৈবিক অঙ্গ হারিয়ে কৃত্রিম অঙ্গকেই নিজের দেহের অংশ ভাবতে শুরু করবে, বুঝতে পারবে না, জৈবিক অঙ্গের সাথে কৃত্রিম অঙ্গের পার্থক্য কোথায়। হয়ত এটা রোবটিক্সের জগতেও এনে দেবে বিপ্লব। কি হবে আসলে সেটা ভবিষ্যতের ব্যাপার, কিন্তু আমি বা আমার মত অনেক বাচ্চা গবেষক যে এইভাবে ব্যয় করছে তার জীবনী শক্তি, কি তার উদ্দেশ্য? প্রয়াত বিজ্ঞানী ফ্রান্সিস ক্রিক, যিনি একাধারে মলিকুলার বায়োলজি এবং নিউরোসায়েন্স নিয়ে কাজ করে গেছেন, শেষ অব্দি তো তিনি একটি নাম ছাড়া কিছু নন। সময়ের হিসেবে তার কর্মময় সময়ের অস্তিত্ব ছাড়া আর কিছু নেই। আজ যেমন লুইগি গ্যালভানীর দৈহিক অস্তিত্ব আমি অনুভব করিনা, কিছুদিন পরে, ফ্রান্সিস ক্রিকের দৈহিক অস্তিত্ব ছিল, তাও কেউ অনুভব করবে না। তাও তো তারা নামে বেঁচে আছেন, কিভাবে বেঁচে থাকবো আমরা? মানবসেবা এবং মানবতা-বোধও জীবনের লক্ষ্য যদি না হয়ে থাকে, তবে কেন খুঁজে চলেছি জীবন বোধ? রোজ রাতে ঘুমোবার সময় এটুকু ভাবার জন্য আজকের জীবনটা সুন্দর কেটেছে, আজকের দিনটা সার্থক, আজ আমি এই কাজটি করে তৃপ্তি অনুভব করেছি?

এই আমি, মহাজাগতিক ধূলিকণা, আদি এবং অন্তহীন। আমার মস্তিষ্ক আমাকে দিচ্ছে জীবনের একধরণের অনুভূতি, যার আসলে কোন উদ্দেশ্য নেই। বাঁচো, খাও এবং মর। ছোটবেলায় যেমন বাংলা পরীক্ষায় “জীবনের লক্ষ্য” রচনা লিখতে বলা হত, আজ কেউ লিখতে বললে, দু-শব্দে লিখে দিতাম, “ইট এন্ড ডাই”।