১. মাঝে মাঝে এমন মূর্তির মত স্থিরতায় কেটে যায় আমার দিন… মনে হয়, আমি বুঝি এই পৃথিবীর হিসেবের খাতায় আর নেই। একদিন এক প্রচন্ড ব্যস্ত সময়ে মনের কোণে কবিতার একটি লাইন গুনগুনিয়ে উঠল…

“জীবনের সাথে সম্পর্কহীন
একটি জীবন করে যাচ্ছে জীবনযাপন!”

চমকে উঠলাম… একি! মনটা তেতো হয়ে গেলো। কবিতার পরের লাইনগুলো আর বের হয়নি। দেশ ছেড়ে বিদেশের মাটিতে নিঃশ্বাস নেবার যে যন্ত্রণা, যে একাকীত্ব – তা বলে বোঝাবার নয়। একটা যান্ত্রিক মানুষের বেঁচে থাকা- বুকভরা নিঃসঙ্গতা।

২. বেঁচে ছিলাম কি আমি আমার দেশের মাটিতেও? পালিয়েই তো এসেছি আমি জীবন বাঁচাতে… বাংলাদেশের সমাজ এখনও আমার মত স্বাধীনচেতা, স্বপ্নবাজ তরুণ হৃদয়কে ধারণ করার যোগ্য হয়নি। সেখানে মেয়েরা জন্মে হাঁটতে শুরু করে যখন, তখনই মেয়েদের মায়েরা লাল টুকুটুকে শাড়ি পড়িয়ে দেখে মেয়েটা বড় হয়ে বৌ সাজলে কেমন দেখাবে? কন্যাশিশুটিও তার পুতুলের গায়ে লাল কাপড় জড়িয়ে পুতুলের বিয়ে দিয়ে দেয়। পুতুল খেলার বয়স পেরুলে সত্যি সত্যি মেয়েটিকে পুতুলের মত করে লাল শাড়িতে পেঁচিয়ে গা ভর্তি সোনাদানায় জড়িয়ে পাঠিয়ে দেয় আরেক ঘরে… নারীপাঁচার।

৩. বাংলার সমাজে আজকাল শারিরীক নিযার্তনটা বোধ করি কমেছে। কিন্তু কমেনি মানসিক নির্যাতনটা। কিশোরী বা তরুণী যাই বলিনা কেন, বিবাহিত অবিবাহিত নির্বিশেষে মানসিক নির্যাতনের শিকার। সমাজের চোখে সেটা মোটেও কোন অপরাধ নয়, আইনের চোখে তো প্রশ্নই ওঠে না। মানসিক যন্ত্রণাটা যে চোখে দেখা যায় না।

৪. আমার মা বলেছিল, বিএসসির পরে আর কি পড়ালেখা বাকি থাকে? আস্ত একটা অশিক্ষিত সমাজের চিন্তার দৌড়, মানসিক দৈন্যতা পরিষ্কার হয়ে যায় এই একটি কথায়। ছেলেকে বিএসসি অব্দি পড়ানোর উদ্দেশ্য চাকরী করার যোগ্য করে তোলা, আর মেয়েকে বিয়ের বাজারে মূল্যবান করে তোলা। অশিক্ষিত সমাজটার কাছে শিক্ষা মানে বিক্রয় হবার সার্টিফিকেট অর্জন। হয় পূঁজিপতির কাছে নয় পু্রুষের কাছে।

৫. কোরিয়ার মানুষগুলো জীবন যাপন করে, জীবন নামের বোঝা বহন করে না। খালি চোখে প্রত্যেকটা মানুষকে দেখলে এটাই মনে হয়। তবুও কর্মক্ষেত্রে উচ্চপদে এইখানে নারীদের দেখিনি আমি। কেন? গোটা মানব সমাজই কি একটি নষ্ট এক্স ক্রোমোজম বহন করছে?

৬. আমার বাবার মত মানুষেরা তবে এলো কি করে? যারা স্বপ্ন দেখেতে শেখায়, যারা ভালোবেসে ভালোবাসতে শেখায়, যারা কন্যাকে বিপ্লবী হতে শেখায়, এরা এলো কি করে নষ্ট সমাজে? আমার বাবার মত মানুষেরা কি তবে মানবসমাজের ঘুনে ধরা এক্স ক্রোমজোমে রেয়ার মিউটেশনের ফলাফল?

৭. এখন আমি স্বাধীন। এখন আমি মামদো ভূতের মত কাঁধে চেপে বসে থাকা সমাজটাকে ছুড়ে ফেলতে শিখেছি। এখন আমি মানুষের জীবন যাপন করি।

৮. এখানে আসার পর কদিনের জন্য জীবনের স্বাদ পেয়েছিলাম। কোরিয়াতে তখন আমার অনেকবন্ধু ছিল। একটি সেমিস্টার শেষ হতে না হতেই… মানুষগুলো হারিয়ে গেলো, চলে গেলো অন্য ভূ-খন্ডে, থেমে গেলো আমার জীবনের উৎসবটাও। এ ভূ-খন্ড আমার নয়।

৯. এখন আমি একটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপ।