(এই লেখাটা চার বছর আগে সামুতে দিয়েছিলাম। আমার ক্ষুদ্র ব্লগ জীবনের প্রথম দিকের লেখা। বাস্তব জীবনের যে সব ঘটনা ধর্মের স্বপ্নালু জগৎ থেকে একটু অন্যকিছু ভাবতে শিখিয়েছিল, তেমনি একটা ঘটনা নিয়ে লেখা। )

খান জানান আলীর মাজারের বর্হিভাগের ছবি। ছবিটি উইকিমিডিয়া কমন্স থেকে সংগৃহীত।


তখন ক্লাস এইটে পড়ি। আমার ছোট চাচার চিকিৎসার জন্য খুলনা যেতে হয়েছে। চাচাকে নিয়ে আমার বাবা, ছোটবোন আর আমি গিয়েছি।এক দিনেই কাজ শেষ হল। কাজ শেষে সিদ্ধান্ত নেওয়া হল পরদিন ষাট গম্বুজ মসজিদ দেখতে যাওয়া হবে। যেই কথা সেই কাজ।পরদিন সকালে রওনা হয়ে দুপুরের মধ্যেই আমরা বাগেরহাট পৌঁছে গেলাম। গিয়ে প্রথমেই ষাট গম্বুজ মসজিদে নামাজ পড়ে এর বিভিন্ন জায়গা ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলাম তারপর রওনা হলাম খানজাহান আলীর মাজারের উদ্দেশ্যে।সেটা মসজিদ থেকে বেশ খানিকটা দূরে, রিকশায় যেতে হয়। মাজারের কিছুটা আগে থেকেই রাস্তা লোকে লোকারণ্য। অথচ মসজিদে নামাজের সময় তেমন লোক ছিলনা। মাজারের বেশ খানিকটা দূরে রিকশা থেকে নামতে হল। মাজারের এলাকাতে ঢুকতেই অনেকগুলো লোক ছেঁকে ধরল, শুধু তাই না রীতিমত টানাটানি শুরু করে দিল। কিসের জন্য এই টানাটানি জানেন? মাজার এলাকাতে শুধু খানজাহান আলীরই কবর নেই, আরও দুইটি বা তিনটি পীরেরও কবর আছে (একটার নাম খুব সম্ভবত ছিল, “ঠান্ডা বাবা” অথবা “ঠান্ডা পীর”!!)। বিভিন্ন পীরের খাদেমরা এসেছে তাদের পীরের কবরের কাছে আমাদের নিয়ে যেতে । তাদের মধ্যে খানজাহান আলীর খাদেমরা বেশ তাগড়াই হওয়ার কারনে তারই জিত হল। সে আমাদের কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়েই হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে গেল সেই মহান আউলিয়ার কবরের কাছে! একটা ঘরের মধ্যে নকশা করা কাপড় দিয়ে ঢাকা কবর। সেখানে নিয়ে গিয়েই কবর ঢাকার কাপড়ের এক কোনা একে একে আমাদের মাথার উপর চড়িয়ে দোয়া পড়ে দিল (আল্লায় জানে কি পড়ল!)। ঘটনার আকষ্মিকতায় আমরা হকচকিয়ে গিয়েছি। এর পর ১১১ টাকা ( আচ্ছা, এই ১১১ ফিগারটার মাহাত্ন কি?) দান বাক্সে রাখতে রীতিমত বাধ্য করল(ওরা সম্ভবত বলেছিল এটা সাপ্তাহিক মিলাদের চাঁদা)।
এর মধ্যেই একটা জিনিস অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম খাদেমরা “বাবার” কবরের পাশে জ্বালানো আগর বাতির ছাই যত্নের সাথে সংগ্রহ করে নিয়ে গেল। তারপর ইনিয়ে বিনিয়ে শুরু করল “বাবার মাজারে” টাকা দান করলে ইহকাল পরকালে কত ফায়দা হবে তার হিসেব। জানতে পারলাম “বাবার” কবর ঢাকা কাপড় পুরানো হয়ে গেছে(!!!) , সেটা কিনার টাকা দিলেও অনেক ফায়দা হবে। তারপর গছিয়ে দিল কিছু তাবিজ (অবশ্যই টাকার বিনিময়ে)। কবরের ঘর থেকে বাইরে এসে দেখি সেই আগর বাতির ছাই একজন লোক যত্নের সাথে তাবিজের খোলসে ভরছে !!!
এতক্ষণ কিন্তু অন্যান্য পীরের খাদেমরা আমাদের পিছু ছাড়েনি। এবার ওরা এল ওদের “বাবার” কাছে আমাদের নিয়ে যেতে। গেলাম তাদের সাথে। সেখানেও একই কাহিনী। দোয়া>লেকচার>চাঁদা…। এসব শেষ করে মাজারের পাশে সেই বিখ্যাত দিঘী দেখতে গেলাম। কিন্তু কোন কুমির দেখলাম না। সেখানে হঠাৎ আমার আব্বার মাথায় উদয় হল চাচার জন্য মুরগী সদকা দিবে (মানে কুমির কে মুরগী খাওয়াবে, এতে নাকি মনোবাসনা পূর্ণ হয়! )। একথা জানানোর পর আবার খাদেমদের মধ্যে হুড়োহুড়ি পড়ে গেল। সবাই কে পেছনে ফেলে এগিয়ে এল সেই খানজাহান আলীর তেজী খাদেম। ওরাই মুরগি নিয়ে এল। দর কষাকষির পর স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি দামে একটা বড়সড় মুরগি কেনা হল। এবার কুমির কে মুরগি খাওয়ানোর পালা। নেতা খাদেম মাজার থেকে বের হয়ে আব্বাকে নিয়ে হুড়মুড় করে এগুতে লাগল। আমি আর আমার বোন পেছনে পড়ে গেলাম। এরই মধ্যে দেখলাম পেছনে চলা শিষ্য খাদেমরা আমাদের কেনা বড় মুরগির সাথে অপেক্ষাকৃত ছোট একটা মুরগি বদলে ফেলল! এরপর অনেক ঘুরপথে বিভিন্ন অলি গলি, বাড়ি ঘর পেরিয়ে খাদেম সাহেব আমাদের একটা ডোবার পাশে নিয়ে এল। এখানে দেখলাম কুমির বাবাজী কে এক মহিলা গরুর ভুঁড়ি কেটে কেটে খাওয়চ্ছে! নেতা খাদেম এসেই সেই কাটা ভুঁড়ির কিছু অংশ কুমিরের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে বলল “বাবা” সদকা কবুল করেছেন সুতরাং এখন আমরা যেতে পারি ! আমরা তো অবাক। কারন মুরগিটি এখনও শিষ্য খাদেমদের হাতে ধরা। আব্বা তো ভীষণ ক্ষেপে বললেন নিজে হাতে মুরগিটি খাইয়ে তবেই যাবেন। সাহস করে আমাদের পক্ষ নিয়ে স্থানীয় আর দর্শনাথীদের বেশ কয়েকজন কথা বললে খাদেমরা তাদেরও হুমকি-ধামকি দেয়। এ নিয়ে অনেক তর্কের পর খাদেমরা ক্ষান্ত দিল। আব্বা নিজে হাতে মুরগিটি কুমিরকে খাওয়ালেন(জানিনা কত পূণ্য অর্জন করলেন!)।

আউলিয়ার মাজারে গিয়ে এরকম অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হল। আমরা বেশ কঠোর ছিলাম বলে ওরা বিশেষ সুবিধা করতে পারেনি। আমি ভাবছি সেই ধর্মভীরু লোকদের কথা যারা শুধু বিশ্বাসের বশে আউলিয়ার আশীর্বাদ পেতে সেখানে যায়, আর বর্তমান যুগের এই মজিদরা (লালশালু) তাদের কি ভাবে শোষণ করে। হাজার হাজার মানুষ এভাবে প্রতারিত হচ্ছে প্রতিদিন। এখানে তো অনুমদিত প্রতারনা হচ্ছে।
এখানে একজন বড় আউলিয়াকে কেন্দ্র করেই এসব হচ্ছে। আর সারাদেশের আনাচে কানাচে কত শত মাজার যে পীরের মাজার আছে তার কোন হিসেব নেই। প্রতিটি স্থানেই হচ্ছে অন্ধ বিশ্বাসের চর্চা। বাধা দেবার উপায় নেই। কারন ধর্মইতো আউলিয়াদের সন্মান করতে বলেছে। ধর্মের আফিমই আমাদের এসবের দিকে ধাবিত করছে। এক সময় এই ধর্মই নাকি মানুষকে অন্ধকারের যুগ থেকে বের করে এনেছে, সেটিই এখন মানুষকে আবার অন্ধকারের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। যে লোক জীবনেও কোরান পড়েনি বা অর্থ না জেনে পড়েছে তাকেও নাকি বিশ্বাস করতে হবে কোরান সত্য, কোরান মহান, এতে পৃথিবীর আবিষ্কৃত অনাবিষ্কৃত সব তথ্য লিখা আছে! কিছু কিছু ওস্তাদরাতো আরও এক কাঠি সরেস,তারা বিশ্বাস করে ইহুদী নাসারা রা নাকি কোরান অ্যানালাইসিস করেই সব আবিষ্কার করছে (আর কোরান যাদের ধর্মগ্রন্থ তারা পানিপড়া, ডিমপড়া খাওয়ার যুগেই পড়ে আছে (মারহাবা! মারহাবা!))।

সামুতে এই লেখাটা লেখার কিছু দিন আগে একুশে টিভিতে একটি অনুষ্ঠান দেখছিলাম( খুব সম্ভবত অনুষ্ঠানটির নাম ছিল “একুশে চোখ”)। সেখানে দেখাল ঢাকার মিরপুরে এক মহিলা ফকির(!) দাবি করছেন তার বাড়ির ভেতর এক আউলিয়ার কবর আছে। আর তিনি সেই আউলিয়ার কবরকে কেন্দ্র করে ঝাড়ফুঁকের আর জড়িবুটির ব্যবসা বেশ ভালই জমিয়েছেন। তাকে অনুষ্ঠানটির তদন্ত টিম জিজ্ঞস করল তিনি রোগীদের অষুধ দেন কেমন করে। তিনি বললেন বাবা তাকে স্বপ্নে বলে দেন কোন রোগের ঔষধ কোনটি, আর বাবার কবর নাকি তিনি স্বপ্নেই খুঁজে পেয়েছেন। এই এক কথায় তদন্ত টিম একদম কোনঠাসা! কারন ধর্মে তো স্বপ্নে পাওয়া বিষয় অনুমোদিত। স্বয়ং মুহাম্মদ (সাঃ) ই তো স্বপ্নে আল্লাহর অনেক নির্দেশ পেয়েছেন। তদন্ত টিমের লোক গুলোতো আর ধর্মের উপর কথা বলে ধর্মপ্রাণ (নির্বোধ এবং অন্ধ) মুসলমানদের রোষানলে পড়তে চায়না । এবার তারা অন্য পথে এগুলেন, কয়েকজন মাওলানা কে সেটে হাজির করলেন এবং তারা বললেন আউলিয়ার কবরকে কেন্দ্র করে মহিলা ফকিরের ঝাড়ফুঁকের কাজটি ঠিক নয় (মানে ঝাড়ফুঁকের কাজটি দোষের না, কিন্ত মাজার কে এর সাথে জড়িত করাটাই ভুল হয়েছে!!!) আর সেই আউলিয়ার নামও তারা শোনেনি। কিন্তু তারা একবারও বললেন না ঝাড়ফুঁকের চিকিৎসার কোন ভিত্তি নেই, তারা বললেন না অনেক অসুখ এমনিতেই সেরে যায় এতে ঝাড়ফুঁকের চিকিৎসার কোন অবদান নেই(ঝড়ে বক মরে ,আর ফকিরের কেরামতি বাড়ে)। তদন্ত টিম ঐ ওয়ার্ডের ওয়ার্ড কমিশনারের কাছে আর থানাতেও গিয়ছিল। ওয়ার্ড কমিশনার সাহেব তো তার পরিচিত এক লোকের কাহিনী বর্ণনা করে মহিলা ফকির প্রতি তার বিশ্বাসের কথা জানিয়েই দিল,আর পুলিশ অফিসার হাসি হাসি মুখে ক্যামেরার সামনে মাঞ্জা মেরে গৎবাঁধা কিছু কথা বলল (তদন্ত করা হবে, কোন দুই নম্বুরী থাকলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে , বক্ বক্ বক্ বক্ বক্ বক্ ………………….. )।
একুশে টিভিতে এই অনুষ্ঠান দেখেই এত দিন আগের সেই স্মৃতির কথা মনে পড়ল।

সবার মনেই ধর্মের অসারতা নিয়ে কথা বলার সাহসের অভাব। যার যখন খুশি সে ধর্মকে তখন সেভাবেই ব্যবহার করতে পারছে (তার পরেও মানতে হবে এ ধর্ম ইশ্বর নিয়ন্ত্রণ করছেন!)। এটি কারও জন্য (অল্প সংখ্যক মানুষের) রুজি রুটির যোগানদাতা আর কারও জন্য(বেশি সংখ্যক মানুষের) প্রতারিত হওয়ার স্থান। তাই ধর্মের অসারতা ধরিয়ে দিলে প্রাণ ভয়ে দেশ ছাড়তে হয়, কিন্তু ধর্মের অপব্যখ্যার মাধ্যমে গণহত্যা, নির্যাতন, নারী ধর্ষণ করেও বুক ফুলিয়ে দেশে রাজনীতি করা যায়।
হায় সেলুকাস!