এই সবুজ গ্রহ জুড়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে নানান বাহারের বিচিত্র সব প্রাণী। চালচলন, খাদ্যভ্যাস, সঙ্গী নির্বাচন, যৌনতায় তাদের প্রত্যকের রয়েছে পৃথক স্বকীয় বৈশিষ্ট্য। এই বৈচিত্রময় বিশ্বে বৈচিত্র সব প্রাণীদের সম্পর্কে জানা আমাদের এই ক্ষুদ্র জীবনে কুলিয়ে উঠা সম্ভব নয় মোটেই। তারপরেও দুএকটি প্রাণী নিয়ে কিঞ্চিত জ্ঞান লাভের চেষ্টা মন্দ হয় না। তাতে আর কিছু হোক না হোক চিত্তটা প্রফুল্ল থাকে ক্ষণিকের তরে তা নিশ্চিত। সেই ধারাবাহিকতায় বেশ কিছুদিন আগে প্রাগৈতিহাসিক যুগের অতিকায় প্রাণী সাপ নিয়ে কিছুটা লিখেছিলাম। আজ চেষ্টা করছি স্থল জগতে বিচরণ করা সর্বাপেক্ষা স্থূলকায় প্রাণী হাতি নিয়ে।

বাংলা ভাষায় হাতির নানাপদের বাহারি নামের অভাব নেই যেমনঃ- গজ, হস্তী, করী ইত্যাদি। তবে প্রাণীটির বাংলা নাম করণ হাতি(হাত+ই) বা হস্তী(হস্ত+ঈ) প্রচলিত হওয়ার পেছনে কাজ করেছে মাথা থেকে নীচের দিকে ঝুলে আসা লম্বা শুড়ের অবস্থান যা বহু হাজার বছর আগে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া শুড় বর্গের আরো কিছু প্রাণী যেমনঃ- ইরিথেরিয়াম(Eritherium), ফোস্ফাথেরিয়াম(Phosphatherium), ম্যামথদের মধ্যে বিদ্যমান ছিল। তবে বর্তমানে হাতি ছাড়া অন্য কোন প্রাণীতে এই অদ্ভুত অঙ্গটি একেবারে অদৃশ্যমান। শুড় ব্যাবহার করে হাতি শ্বাস প্রশ্বাস নেয়, পানি খায়, জলকেলী ইত্যাদি প্রয়োজনীয় কাজ অনায়াসে সেরে নেয়। শুড়কে হাতের মত যে কোন জিনিস শক্ত করে পাকড়ে ধরার অপূর্ব ক্ষমতা থাকায় বাংলায় এই বিশাল প্রাণীটিকে ডাকা হয় হাতি। গরু, ছাগল, গাধা, ভেড়া, কুকুর, শুকর ইত্যাদি উপকারী প্রাণীর মত বিশেষণে টুইটুম্বুর জনপ্রিয় গালি হিসাবে বাংলা ভাষায় হাতির ব্যবহার না থাকলেও বিশালত্বের উপমা ব্যবহারে রয়েছে হাতির জোরালো উপস্থিতি যেমন- বিশাল শরীরের অধিকারী নাদুস নুদুস কাউকে দেখলেই সাতপাঁচ না ভেবেই আমরা বলি -ও একটা আস্ত হাতি। কখনো কাউকে বেহিসেবি খেতে দেখলেও আউড়ে বেড়াই – বেটা হাতির মত খায়।

স্থলজগতে সদর্পে বিচরণ করা অন্যান্য প্রাণীর মত এই প্রাণীটিকেও বশ্যতা স্বীকার করে তার তুলনায় আকার আকৃতিতে পুচকে মনুষ্য প্রজাতির কলাকৌশলের কাছে। বুদ্ধি খাটিয়ে মানুষ তাকে কাজে লাগিয়েছে নিজের নানান স্বার্থ উদ্ধারে যেমনঃ যুদ্ধের উত্তপ্ত রণ হুংকারে, ভারি মালামাল টানার কাজে, সার্কাসের রঙ্গ মঞ্চে বিনোদন প্রদানে, কখনোবা বিত্ত বৈভবের পরিচায়ক হিসাবে। মানুষের এত উপকার করার দরুন হাতিকে মোটেই হাবারাম বা বুদ্ধু প্রাণী ভাবার সুযোগ নেই। পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে প্রাণী বিজ্ঞানীরা ইতিমধ্যে নিশ্চিত হয়ে বলেছেন মানুষের পরে বুদ্ধিমত্তার বিচারে হাতি সিম্পাঞ্জি বা ডলফিনের সমপর্যায়ের। হাতির মাথায় মগজের পরিমাণ প্রায় ৫ কেজি যা স্থল জগতে সবচেয়ে ওজনদার মগজ। একটি পূর্ণ বয়ষ্ক হাতি সাধারণত ৫০ থেকে ৭০ বছর পর্যন্ত বাঁচে। ব্যতিক্রম হিসাবে ৮২ বছর বেঁচেছে এমন রের্কড আছে। বয়স বাড়লে গেটো বাত সহ নানা রকম অসুক বিসুকে ভুগে এই বিশাল প্রাণীটির প্রাণ বায়ু ঊর্ধকাশে মিলিয়ে যায়। এ ছাড়াও মূল্যবান দন্ত লোভের কারণে কিছু লোভী মানুষদের নির্দয় গুলির কাছে প্রতি বছর অকাল মৃত্যু ঘটে অসংখ্য হাতির।

বিশাল স্বাস্থ্য ও দানবীয় শক্তির অধিকারী থাকায় পূর্ণ বয়ষ্ক হাতিকে চটাতে সাহস করেনা অন্য সব বন্য প্রাণী। অবশ্য বনরাজ সিংহ তোয়াক্কা করে না হস্তী শক্তির। বোধহয় পশু রাজের মান ইজ্জত রক্ষায় হাতির বিশাল শরীরটাকে ছেড়াবেড়া করে শক্তি প্রদর্শন করে মর্জি হলেই । সাথে বাঘ মামার কথাও উল্লেখ না করলে বড্ড ভুল হবে। উদর পূর্তির নিমিত্তে হস্তী শাবকদের হরহামেশা আক্রমণ করে বসে সুযোগ পেলেই।

মা হাতির গর্ভধারণ যন্ত্রণা প্রায় ২২ মাস। শিশুকে যথাযত লালন পালন ও উপযুক্ত জীবন ধারণ শিক্ষায় দীক্ষিত করতে আড়াই থেকে চার বছর বিরতি দিয়ে সাধারণত মা হাতিরা পুনরায় গর্ভধারণে মনস্থির করে। নবজাতক শিশু হাতির ওজন প্রায় ১০৫ কিলোগ্রাম। জন্মের ১৬ মাস পর থেকে শুড়ের দুপাশে দাঁত গজাতে শুরু করে শিশু হাতির। মানুষের মত ছেলেমেয়ে, আত্মিয় স্বজন পরিবেষ্টিত জীবণ হাতি বেশ পছন্দ করে, সেই কারণে তাদের পারিবারিক বন্ধন বেশ সুদৃঢ় থাকে।

রাজনৈতিক নেতার মত নেতৃত্ব হাতে নিয়ে দল পরিচালনা করতে বয়ষ্ক ও শক্তিশালী পুরুষ হাতিদের বড্ড খায়েস। তবে দল নেতা হওয়া এত সহজ কম্ম নয়। যোগ্যতার প্রমাণ দিতে একি দলের অন্যাখন্য পুরুষ হাতির সাথে রীতিমত তুমুল লড়াই করে জয়ী হলে তবেই না নেতৃত্বের ঝান্ডা হাতে আসে। এতে আহত হওয়া বা রক্ত ক্ষরণের মত অপ্রতীকর ঘটনা মেনে নিতে প্রস্তুত থাকে খায়েসি নেতা হাতি। এক একটি দলে সাধারণত ৫ থেকে ১৫টি করে হাতি থাকে। দল বেশী বড় হয়ে গেলে দল ভেঙ্গে নতুন দল গড়ে তোলে।
কচি বাঁশ, বিভিন্ন প্রকার গাছ, লতাপাতা, ঘাস, ফলমূল ইত্যাদি হাতির খুব প্রিয়। শরীরটাকে হাতিময় করে রাখতে ভুরি ভোজনে হাতিকে ব্যয় করতে হয় দৈনিক ১৪-১৯ ঘণ্টা! এই সময়ে হাতি সাবাড় করে প্রায় ১৫০ কেজি খাদ্য সাথে প্রায় ১৪০ লিটার পানি। ভুরি ভোজন উৎসবের মত মল ত্যাগে হাতির জুড়ি মেলা ভার। দিনে ত্যাগ করে মাত্র ১৬-১৮ বার। তাতে মল ত্যাগের পরিমাণ প্রায় ১০০ কেজি! এবার নিশ্চই বুঝতে পারছেন হাতি প্রতিপালনের ঠেলা!

দানবীয় শক্তির দাপটের সাথে খ্যাপাটে ক্রোধের সমন্বয় থাকায় সাপ, হনুমান, ষাঁড় ইত্যাদি বিষধর ও শক্তিশালী প্রাণীর মত নিজের অজান্তেই হাতির যথারীতি শক্তভিত গড়ে উঠে কিছু ভীরু মানবের মানসপটে। সেখান থেকে ক্রমে সংক্রামিত হয়ে বলিষ্ট না হলেও মিনমিনে অবস্থান নেয় কিছু কিছু ধর্মে। যেমনঃ দেবতা গণেশের ভাবমূর্তিতে তৈরীতে কল্পনা করা হয়েছে হস্তী মস্তকের উপস্থিতি। মিথ রূপে প্রবেশ করানোর চেষ্টা আছে বুদ্ধের জন্মের পূর্বে বুদ্ধের মাতা মহামায়া শ্বেতহস্তী স্বপ্ন দেখার উপখ্যান।

ডারুইনের বির্বতন তত্ত্ব আবিষ্কারের পর থেকেই বিজ্ঞানী মহলে নীরব বিপ্লব ঘটে যায় প্রাণী বিবর্তন শাখার যোগসূত্র প্রতিষ্ঠার। সেই ধারাবাহিকতায় একে একে উন্মোচিত হয়ে সমৃদ্ধ হতে শুরু করে প্রাণী বিবর্তন ইতিহাসের ধারা। প্রকৃতিতে প্রাপ্ত প্রাচীণ ফসিলের দাঁত, মাথার খুলি, হাড়গোড়, কঙ্কাল বিবেচনায় এনে প্রাণী বিজ্ঞানিরা নিশ্চিত হয়ে বলেছেন আজ বিশাল বপু নিয়ে যে সব হাতিকে বনেবাদারে বা আমাদের আশেপাশে হেলেদুলে চক্কর মারতে দেখি তা ৬০ মিলিয়ন বছরের প্রাকৃতিক বিবর্তনের অনন্য উপহার। বিস্ময়কর হলেও সত্যি হাতির পূর্ব পুরুষরা কিন্তু মোটেই এত বিশাল সুস্বাস্থ্যের অতিকায় দানব ছিল না। প্রাপ্ত ফসিলে তার প্রমাণ মিলেছে। বৈশ্বিক উষ্ণতা ও খাদ্যঅভ্যাস পরিবর্তনের মত কিছু জটিল ধাপ ঠেলেটুলে অতিক্রম করে তবেই না হাতি বর্তমান দানব রূপ লাভ করে, আর পেয়েছে হাত রূপি লম্বা শুড়।

বিবর্তনের মত জটিল থেকে জটিলতর সময় সাপেক্ষ স্তর অতিক্রম করে হাতি কিভাবে বর্তমান অবস্থায় এসে ঠেকে বিজ্ঞানীদের দেয়া তার বৈজ্ঞানিক প্রমাণ্য ব্যাখ্যা উইকি সহ অনান্য ব্লগের সহযোগিতায় সংক্ষিপ্তকারে তা সন্নিবেশ করার প্রয়াস নিয়েছি এ লেখায়।
আর কথা না বাড়িয়ে হাতির বিবর্তনের স্তর গুলোতে চোখ রাখার চেষ্টা করি-


হাতি বিবর্তনের শাখা

মোইরিথেরিয়াম(Moeritherium)

প্রাপ্ত ফসিল বিবেচনায় প্রাণী বিজ্ঞানীরা হাতির পূর্ব পুরুষের প্রাথমিক একটি শাখার নাম দেন মোইরিথেরিয়াম। মিলিয়ন বছর প্রাচীণ মিশরের মোইরিস লেকে প্রাপ্ত ফসিল বিবেচনায় বিজ্ঞানীরা লেকের সাথে মিল রেখে হাতির পূর্ব পুরুষ ভাইদের একটি শাখার এইরূপ নাম করণ করেন।
প্রথম ফসিলটি পাওয়া যায় ১৯০৪ সালের দিকে “এল ফাইয়াম” নামে এক ধুধু মরূদ্যানে। যা এক সময় প্রাচীণ মিসরের “মোইরিস লেক” নামে বিশাল জলাভূমি ছিল। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণী বিজ্ঞানী আলেক্সজেন্ড্রা লিউ মতে প্রায় ৩৭ মিলিয়ন বছর পূর্বে ছিল মোইরিথেরিয়ামের সোনালী যুগ। প্রাণী বিজ্ঞানিরা যুগটির নাম দেন ইওচিনি(Eocene)। এই যুগেই ৬ ফুট উচ্চতার দানব পাখি, বড় বড় তিমি, বাদুর, নানান প্রজাতির ম্যামেলদের(স্তন্যপায়ীদের) দাপট ছড়িতে শুরু করে। আকৃতিতে মোইরিথেরিয়াম অনেকটা শুকরের মত উঁচু তবে কিছুটা লম্বা আর দেখতে ছিল তাপিরের মত। যদিও এদের সরাসরি হাতির পূর্ব পুরুষ বলে গণ্য করেননি বিজ্ঞানীরা তবে রায় দিয়েছেন হাতির প্রাথিমক বিবর্তন শুরুর প্রাক্কালের হাতি বর্গের আলাদা একটি শাখা হিসাবে। ফসিল হতে প্রাপ্ত দাঁতের গঠন প্রমাণ করে তাদের আবাসস্থিল ছিল পানিতে, নানান প্রজাতির জলজ উদ্ভিদ ছিল তাদের প্রধান খাবার। জীবণ যাপন করত অনেকটা জলহস্তির মত। মাথার খুলি দেখে বুঝা যায় তাদের কোন শুড় ছিল না। তবে উভয় চোয়ালের দু’পাশেই ছিল দুটো করে চারটি প্রলম্বিত বড় দাঁত। আরো কিছু পরে দক্ষিণ, পশ্চিম আফ্রিকা ও আলজেরিয়াতে মোইরিথিয়ামের আরো বেশ কিছু ফসিল পাওয়া যায়।


মোইরিথিয়ামের খুলির চিত্র

পালাইয়োমাচটোডোন(Palaeomastodon ):

প্রায় ৩৫-৩৬ মিলিয়ন বছর আগে ইওচিনি যুগের শেষদিকে এবং ওলিগোচিনি যুগের শুরুতে এই পালাইয়োমাচটোডোনরা ঘুরে বেড়াত পৃথিবীর বুকে। ওলিগোচিনি যুগেই বিভিন্ন প্রকার স্তন্যপায়ী প্রাণীর(ম্যামেলদের) পূর্ণ বিকাশ ঘটতে শুরু করে। যেমনঃ প্রাইমেট বর্গের প্রাণী বানর প্রজাতির বিভিন্ন শাখায় বিবর্তনের লক্ষণ প্রকাশ পেতে থাকে এই যুগে। একি সাথে দানব ও হিংস্র প্রজাতির মাংসাশী বিভিন্ন প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণীদের বিকাশ লাভ ঘটতে থাকে। আফ্রিকা মহাদেশের মিশরে পালাইয়োমাচটোডোনদের প্রথম ফসিল পাওয়া যায়। অনুমান করা হয় এরা ৩-৬ ফুট লম্বা ছিল, ওজন ছিল প্রায় দুই টনের মত। পানি থেকে জলজ উদ্ভি্দ টেনে তুলতে পারার সুবিধার জন্য উপরের চেয়ে নীচের চোয়াল বেশ কিছুটা লম্বা ও চ্যাপ্টা মত শাবল আকৃতির ছিল। উভয় চোয়ালে দুটি করে মোট চারটি প্রলম্বিত দাঁত ছিল বটে তবে খাদ্য অন্বেষণ সহজ করতে নীচের চোয়ালের দাঁত দুটো কিছুটা লম্বা হয়ে যায়। এই পালাইয়োমাচটোডেনকে বিবেচনা করা হয় মোইরিথেরিয়াম প্রজাতি থেকে পৃথক হয়ে বর্তমান হাতির রূপান্তরের প্রাথমিক শাখা হিসাবে। এক কথায় হাতির পূর্ব পুরুষ। এদের নাক খানিকটা লম্বা হয়ে বের হয়ে উঁকি মারতে শুরু করে। পরবর্তীতে এই নাক ধীরে ধীরে নীচের দিকে আরো লম্বা হয়ে কোন একসময় শুড়ের রূপ নেয়।


পালাইয়োমাচটোডোনঃ সচিত্র খুলি

গমফোথেরেস(Gomphotheres)

প্রায় ২৩.০৩ লক্ষ বছর থেকে ৫.৩৩২ লক্ষ বছর পূর্বের যুগটিকে বিজ্ঞানীরা অভিহিত করেছেন মিউচিনি(Miocene) যুগ নামে। এই যুগেই বিভিন্ন প্রজাতির তৃণভোজি প্রাণীর বিকাশ লাভ করে। যেমনঃ উট, ঘোড়া, হরিণ ইত্যাদি। একি সাথে আরো কিছু ছোট খাট প্রাণী যেমনঃ ব্যাঙ, ইঁদুর, সাপ, পাখি, নেকড়ে, কুকুর জাতীয় প্রাণীর দ্রুত বিস্তার ঘটে এই যুগে। ৫.৩৩২ থেকে ২.৫৮৮ লক্ষ বছর আগের যুগটিকে বলা হয়েছে পলিওচিনি(Pliocene)। এই যুগেই আবহাওয়া ক্রমেই শীতল ও শুষ্ক হয়ে বর্তমান আবহাওয়ার প্রায় সমপর্যায়ে চলে আসে। বৃষ্টি হীনতা ও অতিরিক্ত শুষ্ক আবহাওয়ার কারণে এশিয়া ও আফ্রিকার কিছু কিছু অঞ্চলে মরুভূমির উৎপত্তি হয়। আবার কিছু কিছু অঞ্চলে পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত হওয়ায় তৃণভূমির সবুজ আস্তর গড়ে ওঠে। খোলসে ঢাকা শামুক ঝিনুকের বিস্তার শুরু হয় জলাভূমি গুলোতে। খাদ্য শিকারের মত কঠিন প্রয়োজনে দক্ষতা ও গতি বেড়ে গিয়ে উৎপত্তি হয় দ্রুত গতির শক্তিশালী ভাল্লুকের। হোমো বর্গের প্রাণীরা গাছে ও স্থলে নিজেদের শক্ত অবস্থান তৈরী করে। ১২-১৬ মিলিয়ন বছর পূর্বে মিওচিনি ও পলিওচিনি এই দুই যুগের সন্ধি ক্ষণে উত্তর আমেরিকা, দক্ষিণ আমেরিকা, ইউরোশিয়া সহ আরো কিছু দেশে বিশেষ করে খাদ্যসহ উপযুক্ত বাসস্থানের খোঁজে গমফোথেরেস ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। ৫ মিলিয়ন বছর পূর্বে এই গমফোথেরেস প্রজাতিটি ধীরে ধীরে বর্তমান হাতিতে রূপান্তরের দিকে ধাবিত হয়। লম্বায় ছিল এরা ৬-৭ ফুটের মত। এক মিলিয়ন বছর আগেও হাতির বড় ভাই গমফোথেরেস প্রজাতিটিকে পৃথিবীর বুকে চড়ে বেড়েত বলে অনুমান করা হয়।


গমফোথেরেস

মাস্টোডোন(Mastodon)

এই হাতি প্রজাতির অন্যতম বৈশিষ্ট ছিল ধনুকের মত বাকানো বিশাল দন্ত যুগল। যা লম্বায় ছিল প্রায় শুড়ের কাছাকাছি। অবশ্য ম্যামথদের অনুরুপ দাঁত ছিল। তবে মাথার আকৃতি ম্যামথদের তুলনায় মাস্টোডোনের কিছুটা চ্যাপ্টা। ২০০৭ জুলাই গ্রীস রাজ্যের গ্রীভেনা(Grevena) অঞ্চলের নিকটবর্তী গ্রামে ২৫-৩০ বছর বয়সি পুরুষ মাস্টোডোনের একটি দাঁত পাওয়া যায় যার ওজন প্রায় ১ টন আর লম্বায় ৫মিটার। মাস্টোডোনের প্রাপ্ত ফসিল থেকে দেখা যায় এদের পেষন দাঁত গুলোর মাথা স্তন্যের বোটার মত কিছুটা উঁচু যা প্রমাণ করে এরা তৃণভোজী প্রকৃতির ছিল । ৩৩.৯ মিলিয়ন বছর থেকে প্রায় ১১,০০০ বছর পূর্ব পর্যন্ত এশিয়া, আফ্রিকা, ইউরোপ, আমেরিকার সর্বত্রই ছিল এদের বিচরণ। মাস্টোডোনের ১ম ফসিলটি পাওয়া যায় আফ্রিকার কঙ্গোতে। এরপর একে একে ইংল্যান্ড, জার্মানি, নেদারল্যান্ড, উত্তর আমেরিকাকে এদের ফসিল পাওয়া যায়। আকৃতিতে এরা বর্তমান হাতি এবং ম্যামথদের সমপর্যায়ের ছিল। একেবারেই অক্ষত ফসিলটি পাওয়া যায় রুমানিয়ায়। বিশ্বাস করা হয় সর্বশেষে ১০,০০০ বছর আগে এরা ঘুরে বেড়াত আমাদের সবুজ গ্রহে।


মাস্টোডোন

প্রাইমেলেফাস(Primelephas):

প্রাইমেলেফাস(Primelephas) মানে “প্রথম হাতি” স্বাভাবিক ভাবেই তাই এই বর্গের হাতির নাম করণে রয়েছে তার পরিষ্কার আভাস। এই বর্গের হাতি বিবেচিত হয়েছে বর্তমান হাতির সবচেয়ে নিকট পূর্ব পুরুষ হিসাবে। মিউচিনি ও পলিউচিনি যুগে এদের বিকাশ। অনুমান করা হয় আজ থেকে প্রায় ৫-৭ মিলিয়ন বছর পূর্বে এই প্রাইমেলেফাস বর্গের হাতি অতি ধীরে বিবর্তনের নানান জটিল ধাপ পেরিয়ে দুটি ভিন্ন প্রজাতিতে ভাগ হয়ে প্রাইমেলেফাসের স্বকিয়তা বিলুপ্ত করে। যার একটি প্রজাতি এগিয়ে যায় বরফ যুগের অতিরিক্ত ঠান্ডা সহ্য করার ক্ষমতা সম্পন্ন ঘন দীর্ঘ লোমশ ম্যামথ প্রজাতিতে অপর প্রজাতিটি উষ্ণতা সহ্য করার ক্ষমতা সম্পন্ন আফ্রিকান হাতি ও এশিয়ান হাতি প্রজাতিতে। এদের উপর ও নীচের চোয়ালে দু’জোড়া করে মোট চারটি প্রলম্বিত দাঁত ছিল তবে নীচের দাঁত জোড়ার তুলনায় উপরের দাঁত দুটি অপেক্ষাকৃত অধিক লম্বা ছিল।


প্রাইমেলেফাস

ম্যামথ(Mammoth )

ইংরেজী শব্দে বিশালত্বের পরিমাপ বোঝাতে “ম্যামথ” শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। যার সোজা বাংলা করলে দাড়ায় “প্রকান্ড” বা “বিশাল”, এক একটি ম্যামথ ১০-১২ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট ছিল। ওজন ছিল প্রায় ৮ টনের মত। ছিল প্রকান্ড লম্বা দুটি দাঁত। সারা শরীর আবৃত ছিল পাটের মত ঘন দীর্ঘ রেশমি লোমে। “ম্যামথ” শব্দটি মূলত এসেছে রাশিয়ার এক আঞ্চলিক ভাষা থেকে। যেখানে ম্যামথের অর্থ করা আছে “ধরিত্রির শিং” (Eearth horn)। সম্ভবত দাঁত গুলো দেখতে শিং আকৃতি হওয়ায় এই নাম করণ। ম্যামথ বিলুপ্তির প্রকৃত কারণ এখনো নিশ্চিত জানা না গেলেও মোটামুটি ধারণা করা হয় আজ থেকে প্রায় ৭-৮ হাজার বছর আগে বৈশ্বিক উষ্ণতা পরিবর্তনের ফলে অন্যান্য অনেক প্রাণীর মত এরাও পৃথিবী থেকে একেবারে বিলুপ্ত হয়ে যায়। আশার কথা প্রাণী বিজ্ঞানীরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন ম্যামথকে আবার পৃথিবীর বুকে ফিরিয়ে আনার।


ম্যামথ ফসিল

লক্ষ লক্ষ বছর ধরে ক্রমাগত উষ্ণতা পরিবর্তনের মত কঠিন ধাপ পেরিয়ে বর্তমানে টিকে থাকা আমাদের চির চেনা হাতি প্রজাতিটি দু’ভাগে ভাগ হয়ে পড়েছে।
একটি ভাগের নাম এশিয়ান হাতি যার বৈজ্ঞানিক নাম দেয়া হয়েছে Elephas maximus


এশিয়ান হাতির চিত্র

অপর ভাগের নাম আফ্রিকান হাতি যার বৈজ্ঞানিক নাম Loxodonta ।


আফ্রিকান হাতির চিত্র

লক্ষ লক্ষ বছর এশিয়া ও আফ্রিকায় তিথু হয়ে বসবাসের ফলে আবহাওয়া জনিত কারণে মানুষের মত এই হাতি প্রজাতিতে চলে আসে আকার আকৃতি ও গঠন গত কিছু ভিন্নতা।
আসুন পার্থক্যগুলো একনজরে দেখে নেয়া যাক।
লম্বায় সাধারণত এশিয়ান হাতি ৬-১১ফুট হয়ে থাকে আর আফিকান হাতি হয় ৬-১৩ ফুট। গড় ওজন এশিয়ান হাতির যেখানে ২-৫ টন, আফ্রিকান হাতির সেখানে ২-৭ টন। এশিয়ান হাতির গায়ের রং বেশ ফর্সা ও মসৃণ তুলনা মূলকভাবে আফ্রিকান হাতির গায়ের রং কালসেটে ও কুচকানো। কানের আকৃতি নিশ্চত প্রমাণ দেয় কোনটা আফ্রিকান আর কোনটা এশিয়ান। আফ্রিকান হাতির আছে প্রকান্ড কান যা দিয়ে প্রচন্ড গরমে বাতাস করে নিজের গা নিজেই জুড়িয়ে নিতে পারে। পক্ষান্তরে এশিয়ান হাতির আছে ছোট কান। ভুরির আকৃতিতেও দেখা যায় ভিন্নতা। এশিয়ান হাতিদের ভুরি গলা থেকে নীচের দিকে অনেকটা সমান। আর আফ্রিকানদের বেলায় গলা থেকে ভুরি ক্রমান্বয়ে নীচের দিকে ঝুলে আসে। এশিয়ান হাতিদের বুকের পাঁজরের হাড় এক জোড়া কম অর্থাৎ আফ্রিকান হাতির রয়েছে ২১ জোড়া হাড় আর এশিয়ান হাতির ২০ জোড়া। আফ্রিকান স্ত্রী পুরুষ উভয় হাতির প্রলম্বিত দাঁত আছে কিন্তু এশিয়ান হাতিদের ক্ষেত্রে শুধু পুরুষ হাতিদের এই দাঁত দেখা যায়। এশিয়ান হাতির শুড় তুলনামূলক একটু শক্ত ও শুড়ের শেষ প্রান্ত একদিক সামান্য বেড়িয়ে থাকে আঙ্গুলের মত। যা তাকে যে কোন জিনিস শক্ত ভাবে ধরতে সাহায্য করে। আফ্রিকান হাতিদের শুড়ের শেষ প্রান্তে দু’দিক বেড়িয়ে থাকে। খাদ্য পছন্দের তালিয়ায় এশিয়ান হাতিরা বেশি পছন্দ করে ঘাস পক্ষান্তরে আফ্রিকান হাতির পছন্দ পাতা।