কতই না ঘটনা-বৈচিত্রে ভরপুর মানব জীবন ! এই সকল বিচিত্র ঘটনার মালা গেঁথে গেঁথেই জীবন এগিয়ে চলে কাল থেকে কালান্তরে । ঘটনা-স্থল আর ঘটনার কাল থেকে আমরা যতই দূরে সরতে থাকি ততই বুঝি অতীতদিনের স্মৃতিগুলি এসে মনের আঙ্গিনায় ভীড় করে ! তবে সব স্মৃতিই যে একই মহিমায় আবির্ভূত হয় তাও কিন্তু নয় ! অনেক স্মৃতিই তলিয়ে যায় কালের গর্ভে, অনেকগুলো ছিন্ন-ভিন্ন হয় সময়ের নিষ্ঠুর কষাঘাতে, আর কিছু কিছু স্মৃতি ঠিকে থাকে বিপুল বিক্রমে সময়কে তিল মাত্র ভ্রুক্ষেপ না করে ! যে স্থান আর যে মানুষগুলোর কথা আজ লিখতে বসেছি সেই স্থান এখন হয়ে গেছে প্রায় সম্পূর্ণ অন্য রকম আর সেই মানুষগুলোর অনেকেরই ঠিকানা হারিয়ে গেছে – তাদের বর্তমান অবস্হান সম্পর্কে আমি পুরাপুরি অজ্ঞাত ! যাদের সম্বন্ধে এখনো কিছুটা জানি তাদেরও বর্তমান আবাস-স্থল এখান থেকে প্রায় দুই সহস্র যোজন দূরে । তবে সেই সকল স্থান আর বেশির ভাগ মানুষদের সাথে আমার সম্পর্ক ছিল এখন থেকে প্রায় চার যুগ পূর্বে । আজ এতটা বছর পর কিছু স্পষ্ট আর কিছু ছিন্ন স্মৃতি রোমন্হন করতে গিয়ে মন এক ধরনের বেদনায় ভারাক্রান্ত হচ্ছে – তবে আজ ফেলে আসা সেই সকল স্থান আর মানুষদের কথা লিখার সুযোগ পাচ্ছি এই ভেবে মন একই সাথে আনন্দিতও হচ্ছে বৈকি ! সহৃদয় পাঠকরা আমার এই লিখা থেকে কিঞ্চিৎ পরিমান হলেও আমোদ পাবেন এই ভরসায় আমার এই ছিন্ন-স্মৃতি-র অবতারণা !

আমাদের পাড়া ও আমাদের আদি বাড়ি
স্রোতসিনী মেঘনার কূল-ঘেঁষা চাতলপাড় গ্রামের এক প্রান্তে ছোট্ট একটি পাড়া –“নোওয়া হাটি” । সেখানে মাত্র কয়েকটি পরিবারের বাস । সেই পাড়ার এক দিকে অনতিদুরেই ছিল গ্রামের বড় বাজার আর তিন দিকে দিগন্ত বিস্তৃত খোলা মাঠ । আষাঢ়-শ্রাবণে জলে ডুবে যখন সমস্ত মাঠ-ঘাট -পথ হত একাকার – তখন হাঁটা-চলা প্রায় বন্ধ হয়ে যেত, নৌকাই হয়ে উঠত চলাচলের একমাত্র বাহন ! আমাদের বাড়িটি ছিল সেই পাড়ার এক কিনারায় – আম, পেয়ারা আর কাঁঠাল গাছে ভর্তি সারা বাড়ি । সেখানেই আমার জন্ম আর অতি শৈশবের বেড়ে উঠা । আমদের বাড়ির সামনেই ছিল একটা পুকুর আর সেই পুকুরের পাড়ে ছিল একটা বড় কদম গাছ – বর্ষাকালে সেই গাছটা কদম ফুলে ছেয়ে থাকত – বড়দের কাছে বায়না ধরতাম দুটো কদম ফুল পেড়ে দেবার জন্য – আবদার পূরণ হলে খুশিতে সেই ফুল দিয়ে মনের আনন্দে খেলতাম আর তা প্রতাখ্যাত হলে গাছ ভর্তি কদম ফুলের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে হাপিত্যেশ করতাম !

আমাদের পাড়ার পিছন দিকটা ছিল ঘন জঙ্গলে আকীর্ণ – এই জঙ্গলে ছিল কত বিচিত্র রকমের গাছ-গাছালি-লতা-পাতা আর তার সাথে ছিল একটা অনেক বড় বেতের ঝোঁপ । বৈশাখ মাসে সেই বেত গাছে ফুল আসত – তারপর একসময় ফল ধরত – বড় বড় থোকায় থোকায় সবুজ বেতফল – এক এক থোকায় থাকত শত শত ছোট ছোট ফল । অপেক্ষা করতে থাকতাম কবে পাকবে সেই ফল ! ধুসর সাদা রঙের পাকা বেতফল দেখতে লাগত ঠিক যেন মুক্তার মত । বেতের বড় বড় কাঁটাকে উপেক্ষা করে আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে জঙ্গলের মধ্যে ঢুকতাম সেই বেতফল আহরণ করতে । আমাদের সাথে থাকত একমাত্র মেয়ে বন্ধু আমার সহপাঠিনী কণা । কাঁটার ভয় তার ছিল কিনা জানি না কিন্তু সাপের ভয়ে সে থাকত আড়ষ্ট । পাঠকদের জ্ঞাতার্থে জানাই বেত গাছের ঘন বন সাপের জন্য নিরাপদ আশ্রয়স্থল । আজও স্পষ্ট মনে পড়ে আমরা যখন বেত-ফলের লোভে সাপ-বিচ্ছুর ভয় উপেক্ষা করে জঙ্গলের ভিতর ঢুকতাম কণা তখন ঝোঁপের বাহিরে দাঁড়িয়ে আমাদের জন্য অপেক্ষা করতে থাকত কতক্ষণে জামা আর হাফপ্যান্টের পকেট ভর্তি করে বেতফল নিয়ে জঙ্গল থেকে বের হয়ে আসব । কণা খুশিতে লাফাতে থাকত আমি যখন আমার ভাগ থেকে অর্ধেক মুক্তারাশি তাকে দিয়ে দিতাম । বন্ধুদের সাথে মিলে সেই ছোট্ট বেলায় কষা-মিঠে বেতফল খেয়ে কি যে আনন্দিত হতাম তা আজ তুলনা করি কিসের সাথে ? সেই বার আশ্বিন মাসের দূর্গা পূজার পর পরই হঠাৎ করেই একদিন কণারা দেশ ছেড়ে একেবারে ভারতের কুচবিহারে চলে গেল । আজও মনে পড়ে কণারা চলে যাবার দিন আমি খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে জঙ্গল থেকে কণার জন্য অনেক বেত-ফল নিয়ে এসেছিলাম । একটা কাগজের ঠোঙ্গায় করে তাদের বাড়িতে গিয়ে কণার হাতে সেই বেতফলগুলো দিতেই কণা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাদঁতে শুরু করেছিল । আজ এতটা বছর পর বেত-ফলের গল্প লিখতে গিয়ে কেন যেন জীবনানন্দ দাসের কবিতার কয়েকটা চরণ মনে ভেসে আসছে :

হায় চিল, সোনালী ডানার চিল, এই ভিজে মেঘের দুপুরে
তুমি আর কেঁদোনাকো উড়ে উড়ে ধানসিড়ি নদীটির পাশে !
তোমার কান্নার সুরে বেতের ফলের মতো তার ম্লান চোখ মনে আসে।
পৃথিবীর রাঙ্গা রাজকন্যাদের মতো সে যে চলে গেছে রূপ নিয়ে দূরে ;
আবার তাহারে কেন ডেকে আনো ?
কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদন জাগাতে ভালোবাসে !

একটু বড় হতেই আমরা সেই পুরানো বাড়ি ছেড়ে চলে আসি গ্রামের মধ্যভাগে অন্য এক পাড়ায় ঠিক আমাদের মেঘনা নদীর প্রান্তে । আমার শৈশবের অনেকগুলো বছর কাটে সেই নতুন বাড়িতে । সেই পুরানো পাড়ায় আর যে কটা পরিবার ছিল তারাও একে একে স্থানান্তরিত হল অন্য জায়গায় । মনুষ্য- বিহীন সেই পাড়ায় জঙ্গল, পুকুর আর আম ও কাঁঠাল গাছে ভর্তি ছাড়া- বাড়িগুলো ঠিকে ছিল অনেক বছর । আমি মাঝে মাঝে আমার ঠাকুরদাদার সাথে বেড়াতে যেতাম সেই অতি শৈশবের স্মৃতি বিজরিত সেই সুন্দর স্থানটায়।

নতুন বাড়ি ও আমাদের পরিবার
যদিও একই গ্রামে আমাদের নতুন বাড়ি কিন্তু প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে এ যে অন্য রকম – আগের বাড়ির চারিদিকে ছিল দিগন্ত প্রসারিত মাঠ – বর্ষায় যখন সেই মাঠ ডুবে যেত তখন সেখানে জন্মাত শাপলা আর আরো কত না বিচিত্র সব জলজ উদ্ভিদ । আর আমাদের নতুন বাড়ির পাশ দিয়ে বহে চলে মনোহরা শান্তা মেঘনা নদী । আগে স্নান করতাম একটা ছোট্ট দীঘিতে আর এখন বিশাল নদীতে । প্রথম প্রথম শুশক মাছ আর কুমিরের ভয়ে নদীতে নামতে ভয় পেতাম – কিন্তু অচিরেই সেই ভয় দূরীভূত হলো । একটু বড় হতেই নদীর সাথে আমার গড়ে উঠলো নিবিড় সখ্যতা । প্রতিদিন তার শীতল বক্ষে অবগাহন করে শরীরের মলিনতা দূর হত আর তার তীরে ভ্রমন করে মুক্ত বায়ু সেবনে মনের পুষ্ঠি বর্ধন করতাম । বর্ষার শুরুতে কোত্থেকে ভেসে আসত সব কুচুরিপানা – আমি অবাক বিস্ময়ে তাদের দিকে তাকিয়ে থাকতাম – আমার অবুঝ শিশুমন অজানা রহস্যে ভরে উঠত – মন প্রশ্ন করত – কোথা থেকে আসছে এই লক্ষ কোটি কচুরিপানার দল আর কোন উদ্দেশ্যের পানে তারা ছুটে চলছে নিরন্তর ?

আমাদের নতুন বাড়িটি ছিল অনেক বড় – বাড়ির পিছনে কাঁঠাল আর নারিকেল গাছ – সামনে আম গাছ – আর রান্না ঘরের পাশেই একটা ডেওয়া ফলের গাছ । হলুদ রঙের ডেওয়া ফলগুলি যখন পাকত তখন দেখতে লাগত বড়ই লোভনীয় । একবার রান্নাঘরের চালের উপর অনেক কষ্ট করে উঠে অনেক আগ্রহ নিয়ে কয়েকটা পাকা ডেওয়া ফল পেরেছিলাম – কিন্তু একটা খেয়েই দ্বিতীয়বার খাওয়ার ইচ্ছে একেবারে তিরোহিত হলো । অনেক আম গাছের মধ্যে একটা গাছের আম আমার কাছে ছিল খুব প্রিয় – ছোট ছোট আম কিন্তু স্বাদে আর গন্ধে অনন্য – পাকলে দেখতেও লাগত খুব সুন্দর কিন্তু কাটলেই ভিতরে পোকা – উপরে দেখতে নিখুঁত কিন্তু ভিতরে কি করে পোকা বাসা বাঁধত সেই রহস্য উন্মোচন করার জন্য তখনও আমার বয়স ছিল নিতান্তই অল্প !
আমাদের নতুন বাড়িতে নতুন চৌচালা দোতলা বড় ঘর – উপরে পুরোটাই একটা কক্ষ – সেখানে ছিল একটা চৌকি – আমি মাঝে মাঝে সেখানে দুপুরে শুতে যেতাম – ঘরের পাশেই ছিল একটা বড় করবী ফুলের গাছ ! সেই গাছে হলুদ হলুদ ফুল ফুটত – হালকা বাতাসেও সেই করবী গাছের ডাল-পালাগুলি হেলত -দুলত । আমি ভর-দুপুরে একা একা শুয়ে শুয়ে জানালা দিয়ে আনমনে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতাম সেই চপলা, চঞ্চলা সুধাময়ী করবী গাছের দুলুনি ! এক সময় সেই করবী গাছে ফল ধরত ! সেই ফল থেকে খোসা ছাড়িয়ে তার ভিতরের বড় বিচি দিয়ে আমরা খেলতাম ! প্রকৃতির বিনা মূল্যের এই গোটা দিয়ে খেলতে গিয়ে আনন্দের অনুভুতি কোন অংশে কম হত বলে তো কখনোই মনে হয়নি !

বাড়ির বড় উঠানের এক প্রান্তে ছিল ইট দিয়ে বাঁধানো তুলসী তলা – তার ঠিক পাশটাতেই ছিল একটা শেফালী ফুলের গাছ – হেমন্তের সকালে প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠেই দেখতাম তুলসী তলা শিউলি ফুলে ফুলে ছেয়ে আছে ! শিউলি ফুলের গন্ধে আমার শিশুমন আনন্দে ভরে উঠত ! আমার থেকে তিন বছরের বড় আমার বোন মা’র একটা শাড়ি পরে প্রতিদিন ঠাকুর দেবতার পূজার জন্য একটা সাজিতে সেই শেফালী ফুল তুলত ! মাকে দেখতাম এই শেফালী ফুল দিয়ে মাঝে মাঝে ঠাকুরের জন্য মালা গাঁথতেন ! আমাদের ঘরের সামনের দুটি চিলে কোঠার একটি ছিল আমাদের পূজার ঘর ! মা যখন প্রতিদিন দুপুরে শেফালী ফুলে সদ্য পেষা চন্দন মাখিয়ে দেবতার উদ্দেশ্যে নিবেদন করতেন – আমিও তখন সেই ছোট পূজার ঘরে যেতাম ! শিউলি ফুলের সাথে চন্দনের গন্ধ আমার শিশুমনে কি জানি এক অজানা অনুভুতির জন্ম দিত !

বাড়ির আর এক প্রান্তে ছিল গোয়াল ঘর – মা বলতেন লাল গরুর দুধ নাকি মিষ্টি হয় – তাই বোধ হয় আমাদের বাড়িতে সব সময় থাকত একটা লাল দুধেল গরু । আমাদের গ্রাম থেকে অনতিদূরের আর একটা গ্রাম থেকে একটি রাখাল বালক এসে এই গরুটিকে ঘাস খাওয়াতে মাঠে নিয়ে যেত । অন্য সময় সে ঘেরা দেওয়া একটা জায়গায় খড় খেত – আর একটা মাটির গামলায় জলে গুলে দেয়া হত খইল আর কুঁড়া এবং মা প্রতিদিন দুবেলা করে সেখানে দিতেন ভাতের ফেন । সেই শান্ত নিরীহ প্রাণীটির দিকে তাকালেই আমার যেন কেমন মায়া হত ! মনে পড়ে চৈত্রের ভর দুপুরে আমার যেদিন স্কুল থাকত না জনশুন্য চারিদিক কেমন জানি খাঁ-খাঁ করত । মা বলতেন এই ভর দুপুরে বাড়ির বাইরে না যেতে । এই কাঠ-ফাটা রোদের দুপুরে সবাই যখন খাওয়ার পর একটু শুতে যেত আমি তখন বিছানা ছেড়ে উঠে সেই গাভীটির কাছে যেতাম । আমাদের বাড়ির সামনের সীমানার উপরে লাইন ধরে অনেক গুলো ঝিঁকড়া গাছ ছিল । জানি না আমি কি করে জেনেছিলাম সে এই গাছের পাতা পছন্দ করবে । আমি অনেক গুলো ঝিঁকড়া গাছের পাতা এনে তার মুখের কাছে ধরতাম – আর অপলক নয়নে চেয়ে চেয়ে দেখতাম সে কি রকম গোগ্রাসে সেই পাতাগুলো আমার হাত থেকে খাচ্ছে । কাউকে আদর করে খাওয়ানোর মধ্যে যে কত আনন্দ থাকতে পারে তা সেই জীবন প্রভাতে সেই গাভিটিকে খাওয়ানোর মধ্য দিয়ে জেনেছিলাম ।

সেই ছোটবেলায় প্রথম কোন কিছু দেখে এত অবাক হয়ে ছিলাম সেটা ছিল আমাদের সেই লাল গাভীটির সন্তান প্রসব । তখন ছিল শীত কাল – মা আমাকে খুব ভোরে ঘুম থেকে জাগালেন । তখন অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলাম যখন দেখলাম কি সুন্দর হালকা লাল রঙের একটা সুন্দর বাছুর – অবাক হয়ে দেখলাম মা কি অসীম মমতায় তার জিহ্বা দিয়ে অনবরত লেহন করে করে তার সন্তানের দেহের সব বিজল পরিষ্কার করছে । আরো অবাক হয়েছিলাম যখন দেখলাম কিছুক্ষণের মধ্যেই পৃথিবীতে সদ্য আগত সেই গোবৎসটি কি এক অজানা উচ্ছলতায় দিগ্বিদিক জ্ঞান হারিয়ে লাফাতে শুরু করলো ।

আমার সেই ছোট বেলায় আমাদের একান্নবর্তী পরিবারে আমরা একসাথে ছিলাম আমার একমাত্র কাকার পরিবার, আমরা, আমার ঠাকুরদাদা-ঠাকুরমা আর ছোট পিসি । আমরা নতুন বাড়িতে আসার কয়েক বছরের মধ্যেই আমার পিসির বিয়ে হয়ে আমাদের গ্রাম থেকে প্রায় দুই ক্রোশ দূরে নদীর অপরপাড়ে অন্য একটি গ্রামে চলে যান । আমার বাবারও ঔষধের ব্যবসা আর ডাক্তারি ছিল সেই গ্রামে । বাবা যখন প্রতি সপ্তাহে একদিন নৌকা করে সেখান থেকে বাড়িতে আসতেন সেই দিন আমার যেন আনন্দ উপচে পরত । সাথে করে বাবা কত কিছু নিয়ে আসতেন । একদিনের আনন্দ-স্মৃতি কোন দিন ভুলবো না – বাবা যেদিন প্রথম একটা নতুন রেডিও কিনে বাড়ি নিয়ে এসেছিলেন – নতুন রেডিওর অদ্ভুত নতুন গন্ধটা আমাকে কেমন জানি আনমনা করে দিয়েছিল ! আমি অনেকক্ষণ সেটির কাছে বসে বসে মনে মনে কল্পনা করছিলাম কেমন করে কোত্থেকে ভেসে আসছে কথা আর গান এই আজব বাক্সটির মধ্যে !

আমার মা ছিলেন অসম্ভব রকমের শান্ত প্রকৃতির – সংসারের সব কিছুর মধ্যে খুব প্রচন্ড ভাবে থেকেও কেমন যেন সব কিছু সম্বন্ধেই থাকতেন নির্লিপ্ত ও অনাসক্ত । আমাদের ছয় ভাই বোনকে মানুষ করেছেন কি প্রচন্ড ধৈর্য্য নিয়ে ! মাকে আমি জীবনে কখনো রাগতে দেখি নি – আমাদের ভাই-বোনদের কখনো তিরস্কার করতে দেখিনি । নিজের অসুখের কথা, কোনো কষ্টের কথা কখনো মুখফুটে বলতেন না । আমার মা’র মা-বাবার বাড়ি ছিল আমদের গ্রামেই – কিন্তু মার দুর্ভাগ্য মা’কে বিয়ে দেয়ার পর পরই তারা দেশ ত্যাগ করে কলিকাতায় চলে যান । ছোট বেলা থেকেই মা ছিলেন আমার ছায়া-সঙ্গী । মাকে ছাড়া যেন এক মুহূর্তও চলত না – মা কোন দিন শাসন করতেন না – কিন্তু তবুও আমি ছিলাম মার একান্ত অনুগত । সেদিন মার জন্য খুব কষ্ট হয়েছিল একটু বড় হতেই মা যখন একদিন বললেন আমার একটা বড় ভাই ছিল – অর্থাৎ তাদের প্রথম সন্তান । মা-বাবা কত আদর করে তাদের প্রথম সন্তানটির নাম রেখেছিলেন অশোক । কিন্তু অশোক তার প্রথম জন্মদিনের আগেই ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মা-বাবাকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে দিয়ে এই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেল !

আমার ঠাকুরমার স্মৃতি জড়িয়ে আছে তাঁর জীবনের শেষ দুই দিনের সাথে । সেইবার আমাদের এলাকায় মহামারী আকারে কলেরা দেখা দিয়েছে – আমরা সবাই আতঙ্কিত – এর মধ্যেই একদিন ঠাকুরমা কলেরায় আক্রান্ত হলেন । একটা লোক পাঠিয়ে বাবাকে খবর দেয়া হয়েছে – বাবা খবর পেয়েই সেদিন সন্ধ্যায় বাড়ি আসলেন – শুনেছি বাবা ঠাকুরমার পায়ের রগের মধ্য দিয়ে স্যালাইন দিয়ে বাঁচানোর চেষ্টা করেছিলেন । কিন্তু সব চেষ্টাই ব্যর্থ হলো – সেদিনই ভোররাতে তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন চিরতরে। অনেক স্মৃতির মধ্যে সেই স্মৃতিটা আজও ভীষণ স্পষ্ট – সকালবেলা তাঁর শবদেহ আমাদের উঠানে রাখা হলো – তাঁর দুই বুজা চোখের পাতার উপরে দুটি তুলসী পাতা – আমরা যখন কাঁদছিলাম পাড়ার সকলে তখন আমাদের বাড়ির চারিদিকে ভীড় করে দাঁড়িয়েছিল । ঠাকুরমার মৃতুয্র মধ্য দিয়েই জীবনে এই প্রথম আমার মৃত্যুর সাথে পরিচয় ঘটল !

পাড়ার বন্ধুরা
ছোট বেলার আমাদের পাড়ায় আমার তিন ঘনিষ্ট বন্ধু মনোজ, প্রিয়তোষ আর তিমির । আমারদের বাড়ি থেকে তিন বাড়ি পরে ছিল মনোজদের বাড়ি, মাঝখানে প্রিয়তোষদের, আর আমাদের বাড়ির অন্য আরেকদিকে রাস্তার ওপারে তিমিরদের বাড়ি । তাদের মধ্যে আমার সকলের চেয়ে প্রিয় বন্ধু মনোজ – ভীষণ ধীর-স্থির প্রকৃতির, কথা বলত অতি ধীর লয়ে – কক্ষনো তাকে কারো সাথে রাগতে বা ঝগড়া করতে দেখিনি । আমরা দুই বন্ধুতে সবসময় একত্রে স্কুলে যেতাম আর প্রায়ই সন্ধ্যায় তাদের পুরানো জমিদার বাড়ির এক চিলেকোঠাতে বসে সে আর আমি স্কুলের পড়া তৈরী করতাম । আমরা যে ঘরটায় বসে পড়তাম তার পিছনেই ছিল একটা গন্ধ লেবুর বাগান । দখিনা বাতাসে সেই ঘরের খোলা দরজা দিয়ে যখন ভোঁ ভোঁ করে লেবুর সুঘ্রান আসত তখন আমি পড়া বন্ধ করে আনমনে স্তব্ধ হয়ে বসে থাকতাম । অনেক দিনই মনোজ আমাকে ধাক্কা দিয়ে কল্পলোক থেকে বাস্তবে নিয়ে আসত । আজ এতটা বছর পর সেই স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বিনা বাতাসেই মনের মধ্যে যেন সেই গন্ধ লেবুর সুরভি ভেসে আসছে ! আমরা তখন চতুর্থ শ্রেণীতে উঠেছি । এর মধ্যেই আমি পাঠ্য বই বহির্ভূত অন্য বই পড়ার প্রতি একটু একটু আকৃষ্ট হচ্ছি । কিন্তু সেই নিবিড় পল্লীগ্রামে কোথায় পাব সেই সুযোগ । কিন্তু জানি না একদিন কোত্থেকে মনোজদের বাড়িতে পাওয়া গেল কলিকাতা থেকে প্রকাশিত কয়েকটা পুরানো “উল্টোরথ” পত্রিকা । আমার আনন্দ আর দেখে কে ? আমি একটু সময় পেলেই সেই বইগুলি উল্টিয়ে পাল্টিয়ে দেখতাম । ছোট বেলা থেকেই মনোজের নেশা সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, লতা মুঙ্গেশকর আর আশা ভোসলের গান শুনা । তাঁরা তখন আমাদের কাছে স্বপ্ন-রাজ্যের মানুষ । তখন বছরে একবার দূর্গা পুজোর সময় আমাদের গ্রাম থেকে প্রায় দশ ক্রোশ দূরে আমাদের নিকটতম শহর ভৈরব বাজার থেকে ভাড়া করে গ্রামোফোন রেকর্ড আনা হত – আর সেখানে মনের সব আবেগ উজার করে দিয়ে সেই স্বপ্ন-রাজ্যের শিল্পীদের গান শুনতাম । সেই গান শুনে শুনে আমরা দুজনে ভুল-শুদ্ধে মিশিয়ে সন্ধ্যা আর লতার গান আওড়াতে চেষ্টা করতাম । মনোজ স্বপ্ন দেখত যদি কোনোভাবে হেমন্ত আর সন্ধ্যার গানগুলি লিখিত আকারে পাওয়া যেত আর কোনভাবে এই অতি-মানব-মানবীদের ঠিকানা মিলত ! আজও মনে করে মন শিযরিত হচ্ছে একদিন সন্ধ্যায় মনোজ হাঁপাতে হাঁপাতে আমাদের বাড়িতে এসে আমাকে আনন্দে জাপটে ধরে বলল এই অমল আমি সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের ঠিকানা পেয়েছি – তুই আমাকে তাঁর কাছে একটা চিঠি লিখে দিতে হবে । পাঠক কি অনুমান করতে পারেন মনোজের আমাকে চিঠি লিখে দিতে বলার কারণ ? এখানে সবিনয়ে নিবেদন করতে চাই খুব ছোট বেলা থেকেই আমার হস্তাক্ষর ছিল বেশ সুন্দর আর একটু গুছিয়েও লিখতে পারতাম বৈকি, এবং কলিকাতা নিবাসী আমার দাদু, দিদিমা, আর মামা মাসিদের কাছে পত্র লিখার সুবাদে মার কাছ থেকে অতি শৈশবেই শিখে নিয়েছিলাম কি করে বড়দের কাছে পত্র
লিখতে হয় । আমি মহাউল্লাসে মনোজের হয়ে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের কাছে একখানা চিঠি লিখলাম :

চাতলপাড় , ১৪ই এপ্রিল, ১৯৬৬ সাল
পরম-পূজনীয়া সন্ধ্যা দিদি,
পত্রের শুরুতে আমার শত কোটি প্রনাম জানিবেন । আমার বাড়ি কলিকাতা হইতে অনেক অনেক দূরে – পূর্ব পাকিস্তানের একটা ছোট গ্রামে । আমাদের গ্রামের নাম চাতল পাড় । এই গ্রামের পাশ দিয়ে প্রবাহিত হয় একটা বড় নদী । তাহার নাম মেঘনা নদী । এই নদীর পাড়ে বসিয়া আমি আর আমার বন্ধু অমল প্রতিদিন গান গাই । আপনার গাওয়া গান আমাদের খুব ভালো লাগে । কিন্তু কোথাও আপনার গানের বই পাই না । আপনার গাওয়া গান “নিঝুম সন্ধ্যায় ক্লান্ত পাখিরা ” গান খানি আমার গাইতে আমার খুব ইচ্ছা হয় । কিন্তু গান খানা জানি না । যদি আপনি দয়া করিয়া গান খানি লিখিয়া পাঠান তবে বড়ই খুশি হইব । আপনি আপনার এই ছোট্ট অচেনা ভাইটির পত্রের উত্তর দিবেন কিনা জানিনা । তবে যদি দয়া করিয়া উত্তর দেন তবে কি যে খুশি হইব তাহা ভাষায় প্রকাশ করিতে পারিব না ।
ইতি আপনার অজানা ভাই মনোজ ।

চিঠিখানা পোস্ট করে মনোজ আনন্দে আত্মহারা – আর শুরু হলো তার অপেক্ষার পালা । আর আমার লিখা পত্রখানা যদি সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের কাছে পৌঁছে তবে তিনি আমার হাতের লিখা পত্রখানা পড়বেন এটা ভেবে আমি শিহরিত । মনোজ প্রতিদিন তার উত্তরের জন্য অপেক্ষা করে। পাঠক হয়ত ভাবছেন পাগলামি আর কাকে বলে ! আমিও বিশ্বাস করিনি চাতলপাড় থেকে এতটা লম্বা পথ পাড়ি দিয়ে এই অতি ক্ষুদ্র মানবদ্বয়ের এই অতি তুচ্ছ পত্রখানা সেই কলিকাতা মহানগরীর বিশাল সেই মানুষটির কাছে কোনো দিন পৌঁছবে, আর দৈব ক্রমে পৌঁছলেও কোনদিন তাঁর এই পত্রের উত্তর দেবার ফুরসত হবে ! তবে কল্পনাও অনেক সময় সত্যি হয় বৈকি ! মনোজের স্বপ্ন সত্যিই সত্যি হলো । মনোজের নামে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের কাছ থেকে সেই বহু প্রতীক্ষিত পত্র এসে একদিন ঠিকই হাজির হলো – তিনি লিখলেন :

অজানা দেশের অচেনা ছোট্ট ভাইটি আমার,
তোমার সুন্দর চিঠিখানা পেয়ে ভারী খুশি হয়েছি । তুমি আমার গান এত পছন্দ কর এটা জেনে খুব ভালো লাগলো । তোমার অনুরোধের গানখানা লিখে পাঠালাম। এখন নিশ্চয়ই খুব খুশি হবে ।

নিঝুম সন্ধ্যায় পান্হ পাখিরা
বুঝিবা পথ ভুলে যায়
কুলায় যেতে যেতে কি যেন কাকলী
আমারে দিয়ে যেতে চায়
….. ……. ……… ।
……. …….. ……..
স্বপ্ন কথা কলি ফোটে কি ফোটে না
সুরভি তবু আঁখি ছায়

ইতি তোমার দিদি সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় ।

আমাদের স্বপ্নের মানুষ সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় আমার লেখা পড়েছে আর মনোজ তাঁর কাছ থেকে পত্রের উত্তর পেয়েছে এটা ভেবে আমরা দুজনে যে কি এক খুশির জোয়ারে ভেসেছিলাম সেটি পাঠকের কাছে বিশদ ভাবে বর্ণনা করা বাহুল্য মাত্র !

আমার আর এক সহপাঠি বন্ধু প্রিয়তোষ – আমাদের থেকে আর এক বাড়ি পরেই ছিল তাদের সুন্দর দালান বাড়ি । বাড়ির পিছন দিকে কয়েকটা পেয়ারা আম জামরুল গাছ । ফল পাকার মৌসুমে সেই এলাকাতে ছিল আমাদের অবাধ বিচরণ। তার বাবা চাকুরী করতেন ঢাকায়, তিনি যখন বাড়ি আসতেন সেই সময়টায় তাদের বাড়িতে গেলে প্রিযতোষের মা আমাদের আদর করে দিতেন বোম্বাই চানাছুর । প্রিযতোষের ব্যাক্তিত্বটা ছিল আমাদের আর সকল বন্ধুদের থেকে আলদা । আমরা যখন খেলতে যেতাম শরীর আর জামা কাপড়ে ধূলাবালি গ্রাহ্য করতাম অতি সামান্য – কিন্তু আমার বন্ধু প্রিযতোষের ক্ষেত্রে তার ভারী ব্যতিক্রম | জামা-কাপড়ে মাটির স্পর্শ সে একেবারেরই সহ্য করত না – একেবারে গা বাঁচিয়ে অতি সন্তর্পনে খেলত । কোনভাবে তার পোশাকে একটুখানি ধুলির স্পর্শ লাগার সাথে সাথেই -তক্ষণি পরিস্কার করতে লেগে যেত নয়তো তৎক্ষণাৎ খেলা ছেড়ে বাড়ি চলে যেত । আমি এই দৃশ্য দেখে অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকতাম । প্রিযতোষের বড় দুই ভাই প্রীতি দাদা আর প্রতুল দাদা থাকত কলিকাতায় – তার তৃতীয় ভাইটি পরিতোষ দাদা – সেও কিছুদিনের মধেই সেখানে চলে গেল । এর জন্য প্রিযতোষের মা বিমর্ষ থাকতেন । দেখতে দেখতে একসময় প্রিয়তোষরা সবাই তাদের এই সুন্দর বাড়িটা বিক্রি করে দেশ ত্যাগ করে কলিকাতায় চলে গেল । তার কয়েক বছর পর আমাদের পাড়ায় খবর এলো প্রিযতোষের মা ব্লাড-ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ।

আমার আর এক বন্ধু তিমির – তার গায়ের রং ছিল যেমন ফর্সা তেমনি তার মনটাও ছিল খুব সরল – জানি না কি মনে করে তার মা-বাবা তার নাম রেখেছিল তিমির । সে ছিল খুবই বন্ধু বৎসল – সবাই তাকে খুব পছন্দ করত । তিমিরদের বাড়ি ছিল একেবারে আমাদের বাড়ির সন্নিকটে নদীর পাশে । যখন তখন সে আমাদের বাড়ি চলে আসত । সে ছিল দুপুরে নদীতে স্নান করতে আমার নিত্য সাথী । সহপাঠি হলেও বয়সে সে ছিল আমার চেয়ে একটু বেশিই বড় । সে সাঁতার শিখেছিল আমার আগে, তাই নদীতে যখন প্রথম প্রথম সাঁতরাতে চেষ্টা করতাম তিমির আমাকে সাহস জোগাত । তিমিরদের বাড়িতে ছিল একটা বিশাল জাম গাছ । জৈষ্ঠ্য মাসে যখন জাম পাকতে শুরু করত তখন সেই জামতলায় ছিল আমাদের নিত্য আনাগোনা । মনে বড় ব্যথা পেয়েছিলাম যখন তিমিররাও একদিন হুট করে বাড়ি ঘর ফেলে রেখে ভারতের ত্রিপুরায় চলে গেল । অনেকদিন পর তিমির একবার এদেশে আবার এসেছিল । তখন আমরাও সেই গ্রাম ছেড়ে আর এক গ্রামে চলে গিয়েছি। কিন্তু তিমির আমাকে ঠিকই খুঁজে বের করে আমাদের বাড়িতে বেড়াতে এসেছিল। একজন বাল্য সখাকে আবার দেখতে পেয়ে সেদিন মনে কি যে খুশির জোয়ার বইছিল তা প্রকাশ করি কি ভাবে ? তিমিরের সাথে যখন দেখা হয়েছিল সেদিন তাও ছিল আজ থেকে প্রায় ৩৫ বছর আগের এক দিন । এখন আমি আর তার সম্বন্ধে কিছুই জানি না।

আমার স্কুলের বন্ধুরা
আমাদের ছোট বেলায় আমাদের অঞ্চলে রেওয়াজ ছিল আনুষ্ঠানিক ভাবে বন্ধু পাতান আর মেয়েদের ক্ষেত্রে সই (সহি) পাতান। আমাদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আমার ক্লাসে আমার এমন পাতানো বন্ধু ছিল দুই জন – দুলাল দাস আর মনি শংকর পাল । আমাদের পাশের দুই গ্রামে তাদের দুইজনের বাড়ি । দুলালের বাড়ি দুর্গাপুরে আর মনি শঙ্করের গ্রামের নাম রতনপুর । তাদের সাথে মনের সম্পর্ক মনোজ, তিমির আর প্রিযতোষের চেয়ে বেশি ছিল ” সেইটি বললে বোধ হয় সত্য বলা হবে না । তবে ক্লাসের সবাই জানত তারা আমার স্বীকৃত বন্ধু । আমরা একে অপরকে ডাকতাম “বন্ধু” বলে আর সম্বোধনের শব্দটি “তুই ” অথবা “তুমি” ছিল না – সেটি ছিল “আপনি” । জানি না কেন দুলাল আমাকে খুবই পছন্দ করত । মজার ব্যাপার হলো দুলাল আর মনি দুজনেই প্রস্তাব করলো আমি তাদের সাথে বন্ধু পাততে চাই কিনা । আমি তাদের সেই প্রস্তাবে খুব খুশি হয়েছিলাম কিন্তু তাদেরকে কথা দেবার আগে মা-বাবার অনুমতির জন্য অপেক্ষা করলাম। বাবা তখন বাড়ি ছিলেন না – কিন্তু মা তাতে সানন্দে সম্মতি দিলেন । দুলাল আর মনি দুজনেই আমার পাতানো বন্ধু হলো – তাদের উপর আমার বন্ধুত্বের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হলো ।

তখন আমরা তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ি । দুলাল একদিন আমাকে তাদের বাড়িতে যাওয়ার নিমন্ত্রণ করলো । বন্ধুর বাড়ি যাবার নিমন্ত্রণ – মনে খুব আনন্দ – কিন্তু আরেক গ্রামে যাওয়া – বাবার অনুমতি দরকার । বাবা তখন বাড়িতে নেই । এক সপ্তাহ পর বাবা বাড়ি আসলে যাবার অনুমতি মিলল, কিন্তু মন আমার দুরুদুরু, মাকে ছাড়া আর এক গ্রামে গিয়ে রাত কাটাতে পারব তো ! তবু নতুন জায়গায় যাওয়ার আনন্দে সিদ্ধান্ত পাকা হলো । এক সপ্তাহান্তে স্কুল ছুটির পর সেখান থেকেই হেঁটে রওয়ানা দিলাম দুর্গাপুরের উদ্দেশ্যে । আমাদের গ্রাম থকে প্রায় এক ক্রোশ দুরে তাদের বাড়ি । দুলাল প্রতিদিনই সেখান থেকে হেঁটে স্কুলে যাওয়া আসা করে – কিন্তু আমার কাছে সেদিন মনে হচ্ছিল বাড়ি থেকে অনেক দুরে যাচ্ছি । প্রশস্ত নদীর পাড় দিয়ে মানুষের হাঁটা-চলায় তৈরী সরু রাস্তা ধরে দুই বন্ধু হাঁটছি । আমাদের গ্রামের শেষ প্রান্তে একটা ছোট চক বাজার । সেটি পার হবার পরই আর কোন বাড়ি ঘর নেই, – তখনই আমার মন জানি কেমন মার জন্য ছটপট করতে শুরু করলো – তবুও হেঁটে-চলছি বন্ধুর সাথে – পথের উপর একটা বিশাল বট গাছের দেখা মিলল – এর চারিদিক জুড়ে বটের ঝুরি – তাঁর ছায়ায় বসে দুই বন্ধু খানিকটা ঝিরিয়ে নিলাম । আর একটু হাঁটতেই একটা ছোট্ট শাখা নদী যাকে আমরা বলি খাল – তার দেখা মিলল। খালের ওপারে দেখা যাচ্ছে একটা ছোট্ট সুন্দর গ্রাম – দুলাল বলল ওটাই তাদের গ্রাম – দুর্গাপুর । খালের মধ্যে একটা কলা গাছের ভেলা – তার দুই পাশে দুটি লম্বা দড়ি লাগানো – দুই দিকের দড়ির দুই মাথা খালের দুই পাড়ের দুটি খুঁটির সাথে সংযুক্ত – এক পার থেকে অন্য পারে যাওয়ার সময় অন্য পাড়ের দড়ি ধরে টানতে টানতে ভেলা সেই পাড়ে এসে লাগে – এই ভাবে অনবরত লোক পারাপার চলছে – আমি দুলালের সাথে খুব মজা করে খাল পার হয়ে তাদের বাড়িতে পৌঁছলাম ।

দুলালদের গ্রামে এসে হলো এক নতুন অভিজ্ঞতা – তাদের বাড়ি সহ যেখানেই যাই – চারিদিকে কেবল শুটকি মাছের ছড়াছড়ি । দুলালের কাছেই শুনলাম এই গ্রামের সবাই জেলে – মাছ ধরা – মাছ বিক্রি করা – আর মাছ শুকিয়ে শুটকি মাছ তৈরী করা তাদের পেশা । তাদের ঘরের মধ্যেই দেখলাম শুটকি মাছের দুইটি বড় বড় বাঁশের ডোল । সারা ঘরময় কেবল শুটকি মাছের গন্ধ । তাদের উঠানের এক কোনে সে আমাকে দেখালো মাটির মধ্যে পোতাঁ একটা বড় মাটির মটকা । এই মটকার গলাটা শুধু বাহিরে – তার মুখটা ঢাকনা দিয়ে তার মধ্যে কাঁদা মাটির লেপ দিয়ে সম্পূর্ণ বন্ধ করা – আমার বন্ধু আমাকে বুঝলো এর মধ্যে কি ভাবে পুঁটি মাছ দিয়ে সিঁদল শুটকি তৈরী হয় । এখানে বলে রাখি সেদিন সারা রাত মার জন্য মন খারাপ লাগার কারণে আর বোধ করি শুটকি মাছের তীব্র গন্ধে যদিও এক ফোঁটা ঘুমাতে পারিনি – কিন্তু দুলাল আর তার মা-বাবার আন্তরিক আতিথেয়তায় আমার মন ভরে উঠলো । পরের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দুলাল আমাকে তাদের বাড়ির পাশে একটা মাঠে নিয়ে গেল । অবাক হয়ে দেখলাম সারা মাঠ জুড়ে চার কোনায় খুঁটি ঘেরে বড় বড় জাল টাঙানো আর তাতে শুকানো হচ্ছে সব শুটকি মাছ । আজও স্পষ্ট চোখে ভাসে রোদেল সকালে খোলা মাঠে এক সাথে এত মাছ শুকাতে দেখে আমি অবাক বিস্ময়ে অনেক ক্ষণ সেইসবের দিকে তাকিয়ে ছিলাম । সেদিন বিকেলে দুলাল এসে আমাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে গেল ।

বন্ধু মনিশঙ্করের বাড়ি রতন পুরে গিয়েছিলাম এক দূর্গা পূজায় । পূজা দেখার সাথে আর একটা নতুন জিনিস জীবনে প্রথম দেখলাম । মনির বাবার ছিল মাটির তৈরী জিনিসের ব্যবসা । অবাক হয়ে দেখলাম কি নিপুন দক্ষতায় তার বাবা তৈরী করছে মাটির হাঁড়ি আর কলস আর দেখলাম এক ধরনের বিশেষ কাঁদা মাটি দিয়ে তৈরী করছে ছোট ছোট লজেন্চ আকৃতির মাটির ঝিকর । মনির কাছে জানলাম এ গুলো একটু রোদে শুকিয়ে তারপর আগুনে সামান্য পুড়িয়ে বাজারে বিক্রি হয় এবং অনেকে এটি খায় । মাটিও তাহলে মানুষ খায় এটি শুনে মনে মনে সেদিন ভীষণ ধাক্কা খেয়েছিলাম । মনির বাড়িতে রাত্রি যাপন করা হয়নি কোন দিন কিন্তু তাদের গ্রামটায় গেলে আমার খুব ভালো লাগত, সব কিছুই যেন সেখানে কেমন অন্য রকম মনে হত !!

পাদটীকা
চাতলপাড় গ্রামের যেখানটায় ছিল আমাদের পুরাতন বাড়ি অনেক বছর পূর্বে একবার দেখতে গিয়েছিলাম সে স্থানটি – তার চারদিকের আকাশ ছোঁয়া মাঠ তখনও ঠিকে আছে – তবে আমার শৈশবের স্মৃতি বিজড়িত সেই জঙ্গলটা হয়েছে তিরোহিত – পুকুরটাও ভরাট হয়ে গেছে নতুন মাটিতে । বেতের ঝোঁপ দেখতে না পেয়ে একটু মন খারাপ হয়েছিল বৈকি কিন্তু মন খুশিতে ভরে উঠেছিল যখন দেখলাম সেখানে গড়ে উঠেছে একটা বড় হাইস্কুল । প্রাণোচ্ছল সব কিশোর-কিশোরীদের কল-গুঞ্জনে সেই স্থান তখন নিত্য মুখরিত |

বড় মানুষ হতে হলে বোধ হয় নিশ্চয় কিছু বড় গুন থাকতে হয় । আমরা সবাই জানি গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় একজন কত বড় শিল্পী । কিন্তু আমরা অনেকেই হয়তবা জানি না তিনি একজন মানুষ হিসাবেও কতটা বড় । পাঠক নিশ্চয় লক্ষ্য করে থাকবেন সেই শৈশবে যে গানটি লিখে পাঠানোর জন্য আমার বন্ধুর হয়ে আমি তাকে পত্র লিখেছিলাম এবং পত্রে তার গাওয়া গান হিসাবে উল্লেখ করেছিলাম তা ছিল ভুল । আমরা সকলেই জানি গানটির আদি শিল্পী লতা মুঙ্গেশকর । পত্রটি ডাকে পাঠানোর কয়েকদিনের মধ্যেই আমরা সেই ভুলটা ধরতে সক্ষম হয়েছিলাম এবং আমরা দুজনেই সেদিন এই বোকামির জন্য অশেষ লজ্জা পেয়েছিলাম এবং আমরা নিশ্চিত হয়েছিলাম এই পত্র সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় পেলে তিনি অশেষ বিরক্ত হবেন – আর আমাদের পত্রের উত্তর দেবার পরিবর্তে আমাদেরকে মনে মনে তিরস্কার করবেন | কিন্তু পাঠক তার লিখা পত্রখানা পরে নিশ্চয় উপলব্ধি করতে পেরেছেন তার অপার মহত্ব – তিনি তাঁর অশেষ মহত্বের মহিমায় আমাদের ভুলটির কথা বিন্দুমাত্র উল্লেখ না করে লতা মুঙ্গেশকরের গাওয়া গানখানা সানন্দে লিখে পাঠিয়ে আমাদের অশেষ শ্রদ্ধাভাজন হলেন|সেই অতি শৈশবেই এই অতি গুণী মানুষটির কাছ থেকে এই শিক্ষা পেয়েছিলাম কি করে অন্যের ভুল ত্রুটি উদার দৃষ্টিতে দেখতে হয় আর ছোটদেরকেও কেমন সম্মানের সহিত বিবেচনা করতে হয় |

আশা করি পাঠক ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন আমার লেখায় ঘুরে ফিরে চলে আসে “দ্বিজাতি তত্ব” নামক এক অদ্ভুত ভুল তত্বের উপর প্রতিষ্ঠিত ১৯৪৭ সালের অমানবিক দেশ বিভক্তির কথা | দুই বাংলার অসংখ্য মানুষের মতই এই নিষ্ঠুর ভাঙ্গনের শিকার আমাদের পরিবার ও আমাদের অনেক আত্মীয় আর আমার ছোট বেলার অনেক বন্ধুরা |আমার মা হারালেন তার মা-বাবা আর ভাই-বোনদের | মা আর কোনদিন তাঁর বাবাকে দেখার সুযোগ পান নি – মা আর ভাই-বোনদের দেখার সুযোগ হয়েছিল দীর্ঘ ৩৫ বৎসর পর | আমার বাবা আর কোনো দিন দেখতে পাননি তাঁর দুই বোনকে | তিমির, প্রিয়তোষ আর কণাদের পরিবার দেশ ছেড়ে ভারতে চলে যায় | আমি আমার প্রিয় বন্ধুদের হারালাম | তিমিরের সাথে যদিও একবার দেখা হয়েছিল কিন্তু প্রিয়তোষ আর কণা হারিয়ে গেল চিরতরে | অনেক বছর আগে একবার শুনেছিলাম কলিকাতা গিয়ে অল্প কিছুদিনের মধ্যে প্রিয়তোষ তার মাকে হারানোর পর বাবাকেও হারায় | ভাইদের কাছ থেকে কোনো সহায়তা না পেয়ে সে জীবন সংগ্রামে হয়েছিল প্রচন্ড রূপে বিপর্যস্ত | কিন্তু কণাদের কথা আর কিছুই জানারও সুযোগ হলো না ! আজ এতটা বছর পর মনে মনে ভাবি পৃথিবী তো এখন ক্রমেই অনেক ছোট হয়ে আসছে – কণার সাথে দৈবাৎ একবার দেখা হলে বোধ হয় মন্দ হত না !

আমার অতি প্রিয় বন্ধু মনোজ এখনো আছে আমার সেই জন্মের স্থান চাতলপাড় গ্রামে | তার সাথে শেষ দেখা হয়ে ছিল আজ থেকে প্রায় ১৮ বছর আগে | তাকে আর একবার দেখতে আমার এখন ভারী ইচ্ছে করে | আমার পাতানো বন্ধু দুলালের সাথে প্রাথমিক বিদ্যালয় ত্যাগ করার পর আর কোনদিন দেখা হয়নি | হাইস্কুলে যাওয়া আর তার ভাগ্যে জুটে নি – দারিদ্রের কষাঘাতে জর্জরিত বাংলাদেশের অসংখ্য শিশুদের মতই সেই শৈশবেই দুলাল তার পৈত্রিক পেশাকেই তার জীবিকার অবলম্বন হিসাবে বেছে নিতে বাধ্য হয় | আজ এত বছর পরেও দুলালের কথা মনে করে মনে হচ্ছে মানুষ কত সাধারণ হয়েও হতে পারে কত অসাধারণ ! জীবনভর জানা-শুনা অনেক মানুষের সাথে যখন তাকে তুলনা করি তখন মনে হয় দুলাল দাস ছিল সত্যিই এক বিরল প্রকৃতির মানুষ – অসম্ভব রকমের নম্র আর ভদ্র এবং খুবই বন্ধু ভাবাপন্ন । বন্ধু দুলালের সেই মায়াভরা চোখ দুটি এখনও আমার মনে ভাস্বর ! আজ এত গুলো বছর পরে মনে হচ্ছে এর পর একবার দেশে গেলে খুঁজতে যাব আমার সেই অতি শৈশবের ফেলে আসা বন্ধু দুলালকে | তবে ভয় হয় খুঁজে পেলেও দুলাল এতটা বছরে মনে রেখেছে কিনা আমাকে – দেখলেও চিনতে পারবে কিনা আমাকে – আর চিনলেও এখন আগের মতই সম্বোধন করবে কিনা ” বন্ধু” বলে ? নাকি ভাববে আমি এখন তার থেকে “অনেক দুরের মানুষ” ?

শেষ কথা
আমার এই লেখা যখন প্রায় সমাপ্তির দিকে টানছি তখন মনের মধ্যে এসে উঁকি দিচ্ছে আরো কত কাহিনী | পাঠকদের কথা চিন্তা করেই তা আর দীর্ঘতর করতে সাহস পেলাম না | জানি না কয়জন আমার এই লেখা পড়বেন আর পড়লেও আদৌ কেহ তা পছন্দ করবেন কি না | যদি এমন ধারণা পাই কোন পাঠকের ভালো লেগেছে আমার সেই আটপৌরে শৈশবের এই বিক্ষিপ্ত স্মৃতি-কথা তবে মনে বাসনা রইলো আবার লেখার – আমার এই “ছিন্ন স্মৃতি”-র “তৃতীয় পর্ব” !!