(আগের পর্বের পর…)

৪.০ : বার্হস্পত্য, চার্বাক-মতের আদিরূপ

চার্বাকী জড়বাদী চিন্তাধারার উপর কেবলি এক দেহাত্মবাদী ভোগলিপ্সু দৃষ্টিভঙ্গি আরোপ করে এই মতটি যে ঘৃণ্য অসুর মত তা প্রমাণ ও প্রচারে ব্যস্ত হওয়ার নিদর্শন শুধু ভিন্নমতাবলম্বী দার্শনিকদের মধ্যেই নয়, বরং এর প্রবনতা-উৎস ঢের পেছনে সেই উপনিষদ যুগ থেকেই দৃষ্টিগোচর হয়। প্রাচীন ছান্দোগ্য-উপনিষদের (৭০০খ্রীস্টপূর্ব) ‘প্রজাপতি ও ইন্দ্র-বিরোচন সংবাদ’ উপাখ্যানে এই নমুনা অস্পষ্ট নয়। উপাখ্যানটি এরকম-

য আত্মাপহতপাপ্মা বিজরো বিমৃত্যুর্বিশোকা বিজিঘৎসঃ অপিপাসঃ সত্যকামঃ সত্যসঙ্কল্পঃ সোহন্বেষ্টব্যঃ স বিজিজ্ঞাসিতব্যঃ স সর্বাংশ্চ লোকান্ আপ্নোতি সর্বাঃশ্চ কামান্ যস্তম্ আত্মানম্ অনুবিদ্য বিজানাতীতি হ প্রজাপতিরুবাচ।। ৮/৭/১।। (ছান্দোগ্য-উপনিষদ)।
অর্থাৎ : প্রজাপতি এক সময় বলেছিলেন যে, পাপ-জরা-মৃত্যু-শোক-আহারেচ্ছা-পিপাসা রহিত যে আত্মা সত্যকাম, সত্যসঙ্কল্প তাঁকেই অন্বেষণ করতে হবে, বিশেষভাবে জানতে হবে। যে তাঁকে অনুসন্ধান করে জানতে পারে তার কাছে কোন লোক (জগৎ) যেমন অপ্রাপ্য থাকে না, তেমনি কোন কামনাই অপূর্ণ থাকে না।
.
তৎ হ উভয়ে দেবাসুরা অনুবুবুধিরে। তে হোচুঃ- হন্ত তম্ আত্মানম্ অন্বিচ্ছামো যমাত্মানম্ অন্বিষ্য সর্বাংশ্চ লোকান্ আপ্নোতি সর্বাংশ্চ কামান্ ইতি। ইন্দ্রো হৈব দেবানাম্ অভিপ্রবব্রাজ। বিরোচনোহসুরাণাং। তৌ হ অসংবিদানৌ এব সমিৎপাণী প্রজাপতি-সকাশম্ আজগ্মতুঃ।। ৮/৭/২।। (ছান্দোগ্য-উপনিষদ)।
অর্থাৎ : দেব ও অসুরগণ উভয়েই লোকপরম্পরায় এই উপদেশের কথা শুনলেন। দুপক্ষই নিজেদের মধ্যে বসে আলোচনা করলেন, ‘যে আত্মাকে অনুসন্ধান করলে সর্বলোক ও সর্বকাম্যবস্তু লাভ করা যায়, আমরা সেই আত্মাকে অনুসন্ধান করবো’। (এ উদ্দেশ্যে) দেবগণের মধ্যে দেবরাজ ইন্দ্র এবং অসুরগণের মধ্যে অসুররাজ বিরোচন (প্রজাপতির) অভিমুখে গমন করলেন। তাঁরা পরস্পরকে না জানিয়ে সমিৎপাণি অর্থাৎ সমিধ হাতে শিষ্য হয়ে প্রজাপতির সমীপে উপস্থিত হলেন।
.
তৌ হ দ্বাত্রিংশতং বর্ষাণি ব্রহ্মচর্যম্ ঊষতুঃ। তৌ হ প্রজাপতিরুবাচ কিম্ ইচ্ছন্তৌ অবাস্তমিতি ? তৌ হোচতুঃ- য আত্মাপহতপাপ্মা বিজরো বিমৃত্যুঃ বিশোকো বিজিঘৎসঃ অপিপাসঃ সত্যসঙ্কল্পঃ সোহন্বেষ্টব্যঃ স বিজিজ্ঞাসিতব্য স সর্বাংশ্চ লোকান্ আপ্নোতি সর্বাংশ্চ কামান্ যস্তম্ আত্মানম্ অনুবিদ্য বিজানাতীতি ভগবতো বচো বেদয়ন্তে। তম্ ইচ্ছন্তৌ অবাস্মম্ ইতি।। ৮/৭/৩।। (ছান্দোগ্য-উপনিষদ)।
অর্থাৎ : তাঁরা সেখানে দুজনেই বত্রিশ বছর ব্রহ্মচর্য নিয়ে রইলেন। তারপর একদিন প্রজাপতি তাঁদের ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন- ‘কী ইচ্ছা করে তোমরা এখানে এমনভাবে রইলে ?’ তাঁরা বললেন, ‘ভগবানের বাক্য বলে বিদিত যে- যে-আত্মা পাপরহিত, জরারহিত, শোকরহিত, অশনেচ্ছারহিত, যিনি সত্যকাম ও সত্যসঙ্কল্প- তাঁকেই অন্বেষণ করতে হবে, তাঁকেই বিশেষরূপে জানতে হবে। যিনি এ আত্মাকে অনুসন্ধান করে জানেন, তিনি সর্বলোক ও সমুদয় কাম্যবস্তু লাভ করেন। সেই আত্মাকে জানার ইচ্ছা নিয়েই আমরা এখানে আপনার কাছে রয়েছি।’
.
তৌ হ প্রজাপতিরুবাচ- এষোহক্ষিণি পুরুষো দৃশ্যত এষ আত্মোতি হোবাচ এতদ্ অমৃতম্ অভয়ম্ এতদ্ ব্রহ্মেতি। অথ যোহয়ং ভগবঃ অপ্সু পরিখ্যায়তে, যশ্চ অয়ম্ আদর্শে কতম এষ ইতি ? এষ উ এবৈষু সর্বেষু অন্তেষু পরিখ্যায়তে ইতি হোবাচ।। ৮/৭/৪।। (ছান্দোগ্য-উপনিষদ)।
অর্থাৎ : প্রজাপতি তাঁদের প্রার্থনা শুনে বললেন- ‘চক্ষুতে যে পুরুষ দৃষ্ট হয়, ইনিই আত্মা।’ তিনি আরো বললেন- ‘ইনিই অমৃত অভয় এবং ইনিই ব্রহ্ম।’ প্রজাপতির এই উপদেশের মর্মার্থ ধরতে না পেরে তাঁরা জিজ্ঞাসা করলেন- হে ভগবন্ ! এই যে পুরুষ জলে দৃষ্ট হয়, আর এই যে পুরুষ দর্পণে দৃষ্ট হয়, ইহা কে ? প্রজাপতি বললেন- ‘এই সমুদয়েই আত্মা পরিদৃষ্ট হন।’
.
উদশরাব আত্মানম্ আব্যে, যদাত্মনো ন বিজানীথঃ তন্মে প্রব্রূতমিতি। তৌ হ উদশরাবে অবেক্ষাংচক্রাতে। তৌ হ প্রজাপতিরুবাচ- কিং পশ্যথ ইতি ? তৌ হোচতুঃ- সর্বমেবেদম্ আবাং ভগব আত্মানং পশ্যাব আলোমভ্য আনখেভ্যঃ প্রতিরূপমিতি।। ৮/৮/১।। (ছান্দোগ্য-উপনিষদ)।
অর্থাৎ : প্রজাপতি বললেন- ‘জলপূর্ণ পাত্রে আপনাকে (দেখো), দেখে আত্মার বিষয়ে যা বুঝবে না, তা আমাকে বোলো।’ তাঁরা জলপূর্ণ পাত্রে নিজেদেরকে দেখলেন। এরপর প্রজাপতি তাঁদেরকে জিজ্ঞাসা করলেন- ‘কী দেখলে ?’ তাঁরা বললেন- হে ভগবন্ ! আমরা সমগ্র আত্মা- লোম ও নখ পর্যন্ত এর প্রতিরূপ দর্শন করলাম।
.
তৌ হ প্রজাপতিরুবাচ- সাধু-অলংকৃতৌ সুবসনৌ পরিষ্কৃতৌ ভূত্বা উদশরাবে অবেক্ষেথাম্ ইতি। তৌ হ সাধু-অলংকৃতৌ সুবসনৌ পরিষ্কৃতৌ ভূত্বা উদশরাবে আবেক্ষাংচক্রাতে। তৌ হ প্রজাপতিরুবাচ- কিং পশ্যথ ইতি ?।। ৮/৮/২।। (ছান্দোগ্য-উপনিষদ)।
অর্থাৎ : প্রজাপতি তাঁদেরকে বললেন- ‘(এবার) সুন্দর অলঙ্কারে ভূষিত হয়ে, সুবসন পরিধান করে, পরিষ্কৃত হয়ে জলপূর্ণ পাত্রে নিজেদের দর্শন করো।’ তাঁরা সুন্দর অলঙ্কারে ভূষিত হয়ে সুবসন পরিধান করে এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হয়ে জলপূর্ণ পাত্রে নিজেদের দর্শন করলেন। প্রজাপতি তাঁদেরকে জিজ্ঞাসা করলেন- ‘কী দেখলে ?’
.
তৌ হোচতুঃ- যথৈবেদমাবাং ভগবঃ সাধু-অলংকৃতৌ সুবসনৌ পরিষ্কৃতৌ স্ব এবমেব ইমৌ ভগবঃ সাধ্বলংকৃতৌ সুবসনৌ পরিষ্কৃতৌ ইতি। এষ আত্মেতি হোবাচ, এতদ্ অমৃতম্ অভয়ম্ এতদ্ ব্রহ্মেতি। তৌ হ শান্তহৃদয়ৌ প্রবব্রজতুঃ।। ৮/৮/৩।। (ছান্দোগ্য-উপনিষদ)।
অর্থাৎ : তাঁরা বললেন- ‘হে ভগবন ! এই আমরা যেমন সুন্দর অলঙ্কারে ও সুবসনে বিভূষিত এবং পরিষ্কৃত, তেমনি জলের মধ্যেও এই দু’জন সুন্দর অলঙ্কারে ও সুবসনে বিভূষিত ও পরিষ্কৃত।’ প্রজাপতি বললেন- ‘ইনিই আত্মা; ইনিই অমৃত ও অভয় এবং ইনিই ব্রহ্ম।’ (এই জ্ঞান নিয়ে) এরপর দু’জন শান্ত হৃদয়ে ফিরে গেলেন।
.
তৌ হ অন্বীক্ষ্য প্রজাপতিরুবাচ- অনুপলভ্য আত্মানম্ অননুবিদ্য ব্রজতে যতর এতদুপনিষদো ভবিষ্যন্তি দেবা বা অসুরা বা তে পরাভবিষ্যন্তীতি। স হ শান্তহৃদয় এব বিরোচনোহসুরান্ জগাম। তেভ্যো হ এতাম্ উপনিষদং প্রোবাচ। আত্মৈব ইহ মহয্য আত্মা পরিচর্য আত্মানম্ এবেহ মহয়ন্ আত্মানম্ পরিচরণ্ উভৌ লোকৌ অবাপ্নোতি ইমং চ অমুংচেতি।। ৮/৮/৪।। (ছান্দোগ্য-উপনিষদ)।
অর্থাৎ : তাঁদেরকে (চলে যেতে) দেখে প্রজাপতি মনে মনে বললেন- ‘(এরা) আত্মাকে উপলব্ধি না করেই, আত্মাকে অবগত না হয়েই চলে গেলো। এদের মধ্যে যে এটাকে উপনিষৎ (অর্থাৎ প্রকৃত জ্ঞান) বলে গ্রহণ করবে- দেবতা হোক বা অসুরই হোক- সে বিনাশপ্রাপ্ত হবে।’
বিরোচন শান্ত হৃদয়ে অসুরদের নিকট গেলেন এবং তাঁদেরকে এই উপনিষৎ শিক্ষা দিলেন- ‘এই পৃথিবীতে দেহেরই পূজা করবে এবং দেহেরই পরিচর্যা করবে। দেহকে মহীয়ান করলে এবং দেহের পরিচর্যা করলেই ইহলোক ও পরলোক- এই উভয় লোকই লাভ করা যায়।’
.
তস্মাদ্ অপি অদ্য ইহ অদদানম্ অশ্রদ্দধানম্ অযজমানম্ আহুঃ আসুরো বতেতি অসুরাণাম্ হি এষা উপনিষৎ- প্রেতস্য শরীরং ভিক্ষয়া বসনেন অলঙ্কারেণেতি সংস্কুর্বন্তি; এতেন হি অমুং লোকং জেষ্যন্তো মন্যন্তে।। ৮/৮/৫।। (ছান্দোগ্য-উপনিষদ)।
অর্থাৎ : এইজন্য আজও দানহীন, শ্রদ্ধাহীন, যজ্ঞহীন ব্যক্তিকে অসুর বলা হয়। এটাই অসুরগণের উপনিষৎ। তারা গন্ধমাল্যাদি এবং বসন ও অলঙ্কার দ্বারা মৃতব্যক্তির দেহকে সজ্জিত করে এবং মনে করে এর দ্বারা পরলোক জয় করবে।

.
এই দীর্ঘ উপাখ্যানের এখানেই শেষ নয়। এরপর, অসুরদের প্রতিনিধি বিরোচন ওইভাবে দেহকেই আত্মা বলে জেনে সন্তুষ্ট হলেও দেবতাদের প্রতিনিধি ইন্দ্রের কাছে এই দেহাত্মবোধ নিয়ে সন্দেহ সৃষ্টি হওয়ায় তিনি প্রজাপতির কাছে প্রত্যাবর্তন করেন এবং দেহাত্মবোধের ভ্রম উত্তীর্ণ হয়ে তাঁর ক্রমশ সচ্চিদানন্দ আত্মাকে উপলব্ধি করার দিকে অগ্রসর হওয়ার প্রক্রিয়া একে একে বর্ণিত হয়েছে।
.
দেহাতিরিক্ত এই আত্মার ধারণাই মূলত ভারতীয় আস্তিক দর্শনগুলোর মূল বিবেচ্য বিষয়। অন্যদিকে জড়বাদী নাস্তিক দর্শনে ইন্দ্রিয়াতিরিক্ত কোন সত্তা স্বীকৃত নয়, যা চার্বাক দর্শনের মূল কথা। উল্লেখিত উপাখ্যানে ব্রহ্মার বদান্যতায় অসুর মতের যে দেহাত্মবাদী দৃষ্টিভঙ্গি প্রচারিত হয়েছে, তাতে বৈদিক সংস্কৃতির বিপরীত ধারণাটাই অসুর মতের মাধ্যমে উদ্ধৃত করা হয়েছে। তাতে করে অনুমিত হয় যে, প্রাচীন উপনিষদ যুগের শুরুতে কিংবা তারও আগে থেকেই ভারতীয় সমাজে চার্বাক মতের জড়বাদী চিন্তাধারার উদ্ভব হয়ে গেছে। এবং এই দৃষ্টিভঙ্গি নিশ্চয়ই লোকসমাজে যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করেছিলো বা জনপ্রিয়তা পেয়েছিলো বলেই হয়তো প্রাচীন উপনিষদে একে প্রতিরোধের নিমিত্তে বিভিন্ন উপাখ্যানেরও সৃষ্টি হয়েছে। আবার প্রাচীন উপনিষদে দেহাত্মবাদ বিরোধী আধ্যাত্মবাদী ধারণা ও মতামতের মধ্যেও পরবর্তী যুগের পরিণত চার্বাকী দেহাত্মবাদের প্রাথমিক রূপের ইঙ্গিত স্পষ্ট হয়ে ওঠে। যেমন ঐতরেয় উপনিষদে (খ্রীস্টপূর্ব ৬০০-৫০০) বলা হয়েছে-

‘এষঃ ব্রহ্ম, এষঃ ইন্দ্রঃ, এষঃ প্রজাপতিঃ, এতে সর্বে দেবাঃ, ইমানি চ পঞ্চ মহাভূতানি- পৃথিবী বায়ুরাকাশ আপোজ্যোতীংষি ইতি এতানি, ইমানি চ ক্ষুদ্রমিশ্রাণি ইব বীজানি, ইতরাণি চেতরাণি চ- অণ্ডজানি চ জারুজানি চ স্বেদজানি চ উদ্ভিজানি চ- অশ্বা গাবঃ পুরুষা হস্তিনঃ, যৎকিঞ্চ ইদং প্রাণি জঙ্গমং চ পতত্রি চ যচ্চ স্থাবরং;- সর্বং তৎ প্রজ্ঞানেত্রং প্রজ্ঞানে প্রতিষ্ঠিতং, প্রজ্ঞানেত্রো লোকঃ, প্রজ্ঞা প্রতিষ্ঠা, প্রজ্ঞানং ব্রহ্ম।। ৩/৩।। (ঐতরেয় উপনিষদ)।
.
অর্থাৎ : সেই প্রজ্ঞানস্বরূপ আত্মাই হলেন বিরাট-স্বরাট ব্রহ্ম। ইনিই ইন্দ্র, স্রষ্টা প্রজাপতি, ইনিই দেবরাজ্যের সব দেবতা। ইনিই জগৎ-সৃষ্টির পাঁচটি মূল উপাদান- পঞ্চমহাভূত (মাটি, বায়ু, আকাশ, জল, অগ্নি বা তেজ)। ইনিই ক্ষুদ্র কীটাণুকীট, উভচর থেকে সব কিছুর উৎপত্তিস্থল- বীজ। অণ্ডজ (পাখি ইত্যাদি), উদ্ভিজ্জ (গাছপালা প্রভৃতি) থেকে শুরু করে ঘোড়া, গরু, মানুষ, হাতি- যত প্রাণী, এমনকি স্থাবর-জঙ্গমের মধ্যেও ইনিই হলেন সেই প্রাণ। প্রজ্ঞার সত্তা নিয়েই বিশ্বচরাচর সত্তাবান। প্রজ্ঞাই সব কিছু নিয়ন্ত্রণে রেখেছে। সেই প্রজ্ঞাই হল সব কিছুর মূল। জীবজগৎ, জড়জগৎ, লোকালোক- সব কিছু আশ্রয় করে আছে এই প্রজ্ঞানকেই। বিরাট এই প্রজ্ঞানই ব্রহ্ম। তিনিই সেই আত্মা।

.
উপনিষদীয় এই আধ্যাত্ম ধারণার বিরোধী চার্বাক মতের দেহাত্মবাদ সংশ্লিষ্ট দার্শনিক সূত্রে আমরা দেখি-

‘পৃথিব্যপতেজো বায়ুরিতি তত্ত্বানি। তৎ-সমুদায়ে শরীরেন্দ্রিয়-বিষয়-সংজ্ঞা। (বার্হস্পত্য-সূত্র)।
অর্থাৎ : পৃথিবী, জল, অগ্নি ও বায়ু- এই চারটিই তত্ত্ব। এর সমন্বয়ে শরীর, ইন্দ্রিয়, চৈতন্য ইত্যাদি সৃষ্ট।

.
এখানে আত্মার অস্তিত্ব তো নেই-ই, এমনকি আকাশ নামের কোন ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যহীন ভূত বা তত্ত্বও স্বীকৃত হয়নি। এই দেহাত্মবাদী চার্বাক চেতনার উৎসকাল জানার কোন প্রামাণ্য তথ্য আমাদের হাতে না থাকলেও এটা কল্পনা করতে বাধা নেই যে, উপরিউক্ত উপনিষদীয় ধারণার প্রেক্ষাপটেও যদি বিরোধী দেহাত্মবাদী মত সৃষ্ট হয়ে থাকে তাহলেও উপনিষদ যুগেই চার্বাক ইতিহাসের গোড়াপত্তন হয়েছিলো।
.
একইভাবে বৃহদারণ্যক উপনিষদের (খ্রীস্টপূর্ব ৭০০) একটি অনুচ্ছেদে আত্মতত্ত্ব বিশ্লেষণে মরণোত্তর চৈতন্যের অস্তিত্বের অস্বীকৃতি দেখা যায়-

স যথা সৈন্ধবখিল্য উদকে প্রাস্ত উদকম্ এবানুবিলীয়েত ন হ অস্য উদ্গ্রহণায় এব স্যাৎ। যতো যতস্ত¡াদদীত লবণম্ এবৈবং বা অর ইদং মহৎ ভূতং অনন্তমপারং বিজ্ঞানঘন এব। এতেভ্যো ভূতেভ্যঃ সমুত্থায় তানি এব অনুবিনশ্যতি ন প্রেত্য সংজ্ঞাস্তীতি অরে ব্রবীমিতি হোবাচ যাজ্ঞবল্ক্যঃ।। ২/৪/১২।। (বৃহদারণ্যক উপনিষদ)।
অর্থাৎ : (মৈত্রেয়ীকে) যাজ্ঞবল্ক্য বললেন- একটা নুনের ডেলা জলে পড়ে গেলে ডেলাটাকে তুলে আনতে পারবে না। জলের সঙ্গে সে মিশে একাকার হয়ে যাবে। জলটাই নোনতা হয়ে যাবে। যেখান থেকেই চুমুক দাও, সেই মিশে-যাওয়া নুনের স্বাদটুকু ছাড়া আর কিছু পাওয়া যাবে না। আমাদের সেই মহান বস্তুটিও তেমনি অনন্ত, অপার, বিজ্ঞানময়। ব্রহ্মাণ্ডের স্থাবর থেকে শুরু করে দেবতা, মানুষ যত জঙ্গম দেখি সবই অভিব্যক্ত হয়েছে ঐ মহান আত্মা থেকে। এক এক রূপ, এক এক নাম। যখন এদের সংজ্ঞা লোপ পায়, পরমায়ু শেষে মৃত্যু আসে, তখন সবই গিয়ে মিশে যায় তাঁর সঙ্গে। সেই মহান আত্মাই হল তত্ত্ব।

.
অন্যান্য উপনিষদের বিভিন্ন স্থানেও আত্মতত্ত্ব ব্যাখ্যায় এই জলের সাথে মিশে থাকা লবণের দৃষ্টান্ত উক্ত হতে দেখা যায় (যেমন ছান্দোগ্য উপনিষদ: ঋষি উদ্দালক-শ্বেতকেতু উপাখ্যান ২/৪/১২, ৬/১৩/১-২ ইত্যাদি)। ভূতাত্মক দেহ থেকে চৈতন্যের উৎপত্তি এবং দেহনাশের সমকালীন চৈতন্যের বিনাশসম্বন্ধীয় যে ধারণা চার্বাক মতে অঙ্গীভূত তার প্রতিচ্ছবি এই উপনিষদীয় অনুচ্ছেদে লক্ষ্যণীয়। এই উপনিষদীয় ধারণা থেকে আত্মাটাকে বাদ দিলেই চার্বাকীয় দেহাত্মবাদী রূপটি স্পষ্ট হয়ে যায়।
.
তবে কঠোপনিষদের (খ্রীস্টপূর্ব ৫০০-৪০০) নচিকেতা-যমরাজ উপাখ্যানের এক পর্যায়ে পরলোকগামী আত্মার অস্তিত্বে অবিশ্বাসী সম্প্রদায় বিশেষের উল্লেখ (কঠোপনিষদ: ১/১/২০) আমাদেরকে ভিন্ন বা আদিরূপে চার্বাক মতের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। অর্থাৎ সেই উপনিষদীয় যুগেই চার্বাক দর্শনের আদিরূপের অস্তিত্বে আধ্যাত্মবাদ বিরোধী বস্তুবাদী ধারণার উপস্থিতির সম্ভাবনা অগ্রাহ্য করা যায় না। আলোচ্য এই দীর্ঘ নচিকেতা-যমরাজ উপাখ্যানটির উদ্দিষ্ট অংশটুকুতে আমরা দেখি-
.

ঋষি গৌতম রাজশ্রবস যজ্ঞদানকালে একবার রেগেমেগে কথায় কথায় পুত্র নচিকেতাকে যমকে দান করলে পিতৃবাক্য পালনে নচিকেতা যমালয়ে গিয়ে উপস্থিত হন। পরবর্তীতে নচিকেতার গুণে সন্তুষ্ট যমরাজ নচিকেতাকে তিনটি বর দিতে চাইলেন। তৃতীয় বর চাইতে গিয়ে নচিকেতা বললেন-

যেয়ং প্রেতে বিচিকৎসা মনুষ্যেহস্তীত্যেকে নায়মস্তীতি চৈকে। এতদ্ বিদ্যাং অনুশিষ্টস্ত্বয়াহহং বরাণামেষ বরস্তৃতীয়ঃ।। ১/১/২০।। (কঠোপনিষদ)।
অর্থাৎ : মানুষ মাত্রেই মরণশীল। জন্মালে মরতেই হবে। কিন্তু মৃত্যুর পর কী ? কেউ বলেন আত্মা আছে। কেউ বলেন বাজে কথা, আত্মা থাকে না। যতদিন মানুষ বেঁচে থাকে ততদিনই আত্মা থাকে, কাজ করে। মরে প্রেত হয়ে গেলে নাকি আত্মারও আর কিছু করার থাকে না। এ-নিয়ে আমাদের মধ্যে দারুণ সংশয় আছে। এ-ব্যাপারে কোনটা ঠিক, মৃত্যুর অধিপতি আপনি যেমন জানেন, আর কেউ তেমন জানেন না। এর রহস্য জানতে আমার খুব ইচ্ছে। আপনি যখন স্বেচ্ছায় আমাকে বর দিতে চেয়েছেন, তখন এটাই আমার তৃতীয় প্রার্থনা। পরলোকের রহস্য আমায় বলুন।
.
নচিকেতার বর প্রার্থনা শুনে যমরাজ চমকে উঠলেন। ভাবতেও পারেননি যে ঐটুকু ছেলে নচিকেতা তাঁকে এমন একটা প্রশ্ন করে বসতে পারেন। এ যে দারুণ গোপন ব্যাপার। পরলোকের এই রহস্য যদি কোন মানুষ জানতে পারে, তাহলে আর তো সে তার আওতার মধ্যে থাকবে না। তাই কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন-
.
দেবৈরত্রাপি বিচিকিৎসিতং পুরা না হি সুবিজ্ঞেয়মণুরেষ ধর্মঃ। অন্যং বরং নচিকেতো বৃণীষ মা মোপরোৎসীরতি মা সৃজৈনম্ ।। ১/১/২১।। (কঠোপনিষদ)।
অর্থাৎ : তোমার এই প্রশ্নের জবাব দেয়া বড়ই কঠিন। সহজে বোঝানো যায় না, বোঝাও যায় না। দেবতারাও এখনো এ-নিয়ে সন্দেহের মধ্যে পড়ে আছেন, মানুষ তো কোন্ ছার। তুমি ও-বিষয়ে জানার জন্য আমাকে অনুরোধ কোরো না। অন্য বর চাও।
.
নচিকেতা বললেন-
দেবৈরত্রাপি বিচিকিৎসিতং কিল ত্বঞ্চ মৃত্যো যন্ন সুবিজ্ঞেয়মাত্থ। বক্তা চাস্য ত্বাদৃগন্যো ন লভ্যো নান্যো বরস্তুল্য এত্য কশ্চিৎ।। ১/১/২২।। (কঠোপনিষদ)।
অর্থাৎ : (সে কি কথা যমরাজ!) পরলোকের এমনি রহস্য যে বোঝানোও যায় না, বোঝাও যায় না ? আবার দেবতারাও সঠিক জানেন না ! মহারাজ, যদি তাই হয়, তাহলে, এই বর ছাড়া আমার আর অন্য বর নেই। বিশেষ করে আপনার মত ধর্মরাজের অনুগ্রহ যখন পেয়েছি, তখন এই রহস্য ছাড়া আমি আর অন্য কিছু জানতে চাই না। কেননা, আত্মতত্ত্বই হল পরমপুরুষার্থ- সবরকমের বন্ধনমুক্তির একমাত্র উপায়।

.
অতঃপর উপাখ্যানটি পরলোক, আত্মা ইত্যাদি আধ্যাত্মিক ধারণার জটিল থেকে জটিলতর বুননের দিকে এগিয়ে গেছে। কিন্তু সেই উপনিষদের যুগেই যে ইন্দ্রিয়াতীত আত্মা বা পরলোকের অস্তিত্ব নিয়ে বিতর্ক প্রতিষ্ঠিত ছিলো তা নিয়ে হয়তো সন্দেহ থাকে না। এবং চার্বাক মতের আদিরূপে এসব ভাববাদী চেতনায় অবিশ্বাসী বস্তুবাদীদের উপস্থিতিও বেশ জোরেশোরে ছিলো বলে প্রতীতী হয়।
.
ভারতীয় দর্শন সাহিত্যের বিভিন্ন ক্ষেত্রেই এই জড়বাদী চার্বাক দর্শনকে লোকায়ত দর্শন নামেই অভিহিত করা হয় এবং তাকেই বার্হস্পত্য মত হিসেবে উল্লেখ করা হয়ে থাকে। আর বার্হস্পত্য মত মানে বৃহস্পতির মত বা বৃহস্পতি-প্রণীত মত। পৌরাণিক উপাখ্যান অনুসারে বৃহস্পতি দেবগুরু বা দেবতাদের আচার্য। কিন্তু স্বয়ং দেবগুরু-প্রণীত মত হওয়ায় বৈদিক সংস্কৃতির বাহকদের কাছে দর্শনটি খুবই মর্যাদাপূর্ণ হওয়ার কথা থাকলেও তা না-হয়ে যে ঠিক উল্টোটিই হয়েছে, এর কারণ তার জড়বাদী দৃষ্টিভঙ্গিই। এবং এই জড়বাদী মত কী করে দেবগুরুর উদ্ধৃতিতে প্রচারিত হলো, এটাই ভারতীয় দর্শনে এক ধোঁয়াশাপূর্ণ রহস্য। অবশ্য পৌরাণিক উপাখ্যানেই এই রহস্যের জবাবও দেয়া হয়েছে বেশ কৌশলে। মৈত্রায়নী উপনিষদের উপাখ্যান অনুসারে অসুরদের সঙ্গে যুদ্ধে দেবতারা হেরে গেলে দেবগুরু বৃহস্পতি ফন্দি করে অসুর গুরু শুক্রের ছদ্মবেশ ধারণ করে অসুরদের মধ্যে গিয়ে এই বেদবিরোধী বস্তুবাদী দর্শনের প্রচার করেন। এবং এই ভ্রান্ত ও ঘৃণ্য মতের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে অসুরেরা এমন অধঃপাতে গেলো যে সেই সুযোগে তাদেরকে যুদ্ধে হারিয়ে দেবতারা হৃতগৌরব পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হন। এই উপাখ্যানের মাধ্যমে একটা প্রতারণামূলক নাস্তিক্যবাদী শাস্ত্রের প্রবক্তা হিসেবে বৃহস্পতিকে একাত্ম করে দেখানো হয়েছে। সাথে হয়তো এটাও শিক্ষণীয় করার চেষ্টা করা হয়েছে যে, এই শাস্ত্র অসুরদের নাশের জন্যেই সৃষ্ট, তাই এটা অনুসরণ করলে অনুসরণকারীর জন্য অধঃপাত অনিবার্য।
.
অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক হিসেবে আমাদেরকে পুনরায় স্মরণ করতে হয় যে, উপনিষদ হলো বেদের অন্তিম অংশ। সংহিতা বা মন্ত্রের মাধ্যমে যে বৈদিক যুগের প্রারম্ভ এবং বৈদিক ‘ব্রাহ্মণে’ যার পূর্ণ বিকাশ, সেই বৈদিক যুগের পরিসমাপ্তি এই উপনিষদের যুগে। কিন্তু এই যুগের পরিধিকে কোন বিশেষ সীমারেখায় আবদ্ধ করা সম্ভব নয়। খ্রীস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে গৌতম বুদ্ধের আবির্ভাবের কালকে ইতিহাসের এক বিশেষ সীমা হিসেবে চিহ্নিত করে এর সাপেক্ষে ‘ছান্দোগ্য’, ‘বৃহদারণ্যক’ প্রভৃতি কয়েকটি প্রধান উপনিষদের রচনাকালকে বহু প্রাচীন এবং বুদ্ধের আবির্ভাবের পূর্ববর্তী বলে মনে করা হলেও ‘মৈত্রায়ণীয়’ এবং অন্যান্য বহু উপনিষদ বুদ্ধোত্তর বলে অনেকেরই ধারণা। পণ্ডিত রাহুল সাংকৃত্যায়ন তাঁর ‘দর্শন-দিগদর্শন’ গ্রন্থে উল্লেখযোগ্য উপনিষদগুলির ক্রমিক সৃষ্টিকাল নির্ণয় করেছেন এভাবে-

(১) প্রাচীনতম উপনিষদ (৭০০ খ্রীস্টপূর্ব)- (ক) ঈশ, (খ) ছান্দোগ্য, (গ) বৃহদারণ্যক।
(২) দ্বিতীয় যুগের উপনিষদ (৬০০-৫০০ খ্রীস্টপূর্ব)- (ক) ঐতরেয়, (খ) তৈত্তিরীয়।
(৩) তৃতীয় যুগের উপনিষদ (৫০০-৪০০ খ্রীস্টপূর্ব)- (ক) প্রশ্ন, (খ) কেন, (গ) কঠ, (ঘ) মুণ্ডক, (ঙ) মাণ্ডুক্য।
(৪) চতুর্থ যুগের উপনিষদ (২০০-১০০ খ্রীস্টপূর্ব)- (ক) কৌষীতকি, (খ) মৈত্রী বা মৈত্রায়ণীয়, (গ) শ্বেতাশ্বতর।

.
সেক্ষেত্রে এই মৈত্রায়ণীয় উপনিষদের উপাখ্যান কল্পনা যে দেবগুরুর ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারের এক কৌশলী প্রয়াস হিসেবেই করা হয়ে থাকতে পারে এই সন্দেহ অযৌক্তিক হবে না। অর্থাৎ এই পৌরাণিক কাহিনী সৃষ্টির আগেই চার্বাক বা লোকায়ত মত ভারতীয় সমাজে ব্যাপকভাবেই প্রচলিত ছিলো। তাছাড়া বৈদিক সংস্কৃতির ব্রাহ্মণ্যবাদী অপশাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েই বুদ্ধমতেরও সূচনা হয়েছিলো বলে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়।
.
এছাড়াও বুদ্ধের প্রায় সমকালবর্তী ও বয়োজ্যেষ্ঠ দার্শনিক অজিত কেশকম্বলীর (৫২৩ খ্রীস্টপূর্ব) উক্তিতেও চার্বাকী চিন্তার প্রতিচ্ছবি রয়েছে। বৌদ্ধ ত্রিপিটকের কয়েক জায়গায় যেমন দীঘনিকায় (১/২), মজ্ঝিমণিকায় (২/১/১০, ২/৬/৬) অজিত কেশকম্বলীর দার্শনিক মতের উদ্ধৃতি দেয়া হয়েছে এভাবে-

‘দান-ধ্যান …যজ্ঞ নেই, সুকৃত-দুষ্কৃত কর্মের ফল বিপাক নয়। ইহলোক-পরলোক নয়, মাতা-পিতা-দেবতা নেই। সত্যলোকে পৌঁছে যাওয়া এমন কোন সত্যারূঢ় শ্রমণ-ব্রাহ্মণ নেই, যিনি স্বয়ং ইহলোক-পরলোককে জ্ঞাত হয়ে মানুষকে বোঝাতে পারেন। মনুষ্য চতুর্ভূতের সৃষ্টি। মৃত্যুর পর (দৈহিক) পৃথিবী পৃথিবীতেই বিলীন হয়। …অনল অনলে …জল জলে …বায়ু বায়ুতেই লয় প্রাপ্ত হয়। ইন্দ্রিয় আকাশে গমন করে। মৃত ব্যক্তিকে খাটে করে শ্মশানে নিয়ে যাওয়া হয়। চিতায় অগ্নিসংযোগ পর্যন্ত তার অস্তিত্ব দৃষ্টিগোচর হয়; তারপর অস্থিসমূহ ক্রমশ ক্ষুদ্র ও ধূসরবর্ণ হয়ে আসে, অবশেষে চিতাভস্ম ব্যতীত আর কিছুই থাকে না। দান করার পরামর্শ মূর্খের উপদেশ, যিনি আস্তিক্যবাদের কথা বলেন তিনি তুচ্ছ ও মিথ্যা কথা বলেন। মূর্খ-বিদ্বান সকলেই বিনষ্ট হয়, বিচ্ছিন্ন হয়, মৃত্যুর পর আর কিছু থাকে না।’ (পৃষ্ঠা-৭৪, দর্শন-দিগদর্শন ২য় খণ্ড / রাহুল সাংকৃত্যায়ন)

.
বৈদিক যজ্ঞ ও পুরোহিত সম্প্রদায়ের বিশেষ সুবিধাভোগের বিরোধিতা এবং বেদবিহিত শ্রাদ্ধাদি অনুষ্ঠানের সমালোচনার মাধ্যমে কেশকম্বলী সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা অজিত কেশকম্বলীর উপরিউক্ত চিন্তাধারা চার্বাক দর্শনের সঙ্গে একই আসনে নিজের স্থান করে নিয়েছে বলা যায়। এখানে-
.

‘চার্বাকের মত অজিতও মৃত্যুর পর আত্মার অস্তিত্বে বিশ্বাস করেন না। আর পাপ-পুণ্য, স্বর্গ-নরক, কর্মফল ইত্যাদি ধারণাও অস্বীকার করেন। জাগতিক বস্তুনিচয়ের উপাদান হিসাবে পঞ্চ মহাভূতের পরিবর্তে চার মহাভূতের স্বীকৃতিতে ভারতীয় সাধারণ ধারণার যে ব্যতিক্রম চার্বাক মতবাদে পরিস্ফুট, অজিতের মধ্যে আমরা তার সূচনা লক্ষ্য করি। …অজানিত ভবিষ্যতে সুখের আশায় জীবনের প্রতিদিনের সাধারণ আনন্দের প্রতি যাঁরা উদাসীন- তাঁদের আদর্শবাদী চিন্তাধারার সম্পূর্ণ বিপরীত হল এই সম্প্রদায়ের মনোভাব। এই দৃষ্টিভঙ্গির পরিপ্রেক্ষিতে বিচার করলে চার্বাকদের সঙ্গে কেশকম্বলীদের অনেক সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায়।’ (পৃষ্ঠা-১৬, চার্বাক দর্শন / লতিকা চট্টোপাধ্যায়)।

.
এরকম নাস্তিক্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গির নমুনা রামায়ণেও বিরল নয়। রামায়ণের অযোধ্যাকাণ্ডে (রামায়ণ: ২/১০৮) ব্রাহ্মণ জাবালির উক্তির মধ্যে এই মতাদর্শিয় যে বিবরণ পাওয়া যায়, তাতে পরবর্তীকালের ‘চার্বাক’ নামযুক্ত দর্শনের রূপ সুস্পষ্টভাবেই পরিস্ফুট হয়েছে।
.

‘পিতার মৃত্যুর পর ভরত বনবাসী রামকে অযোধ্যায় প্রত্যাবর্তন করে পিতৃসিংহাসনে অধিষ্ঠিত হবার জন্য অনুরোধ জানালে পিতৃসত্য পালনে কৃতসংকল্প রাম তাঁর সেই অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেন এবং অরণ্যজীবনের কঠোরতা বরণের সমর্থনে অভিমত জ্ঞাপন করেন। রামকে কৃচ্ছ্রসাধনের দৃঢ় সংকল্প থেকে প্রতিনিবৃত্ত করার প্রচেষ্টায় ব্রাহ্মণ জাবালি উপদেশাত্মক এক বিবৃতি দেন এবং রামায়ণে অন্তর্ভুক্ত নাস্তিকবাদ এই প্রচেষ্টারই সাক্ষ্য বহন করে।
জাবালি বলেন যে, পারলৌকিক ধর্মের মোহে বৈষয়িক সুখকে বিসর্জন দেওয়ার পক্ষে কোন যুক্তি নেই। এর ফলে বর্তমান জীবন দুঃখময় হয়, কিন্তু পরিণামে দেহত্যাগের পর সুখের কোন সম্ভাবনা থাকে না। কারণ ফলভোক্তার দেহাতিরিক্ত কোন পৃথক সত্তা নেই। অন্ন প্রভৃতি ভোজ্য বস্তুর সাহায্যে প্রত্যক্ষগ্রাহ্য যে ভোগ সম্ভব, শ্রাদ্ধাদি অনুষ্ঠানের আয়োজন করে আমরা সেটাকেই কেবল নষ্ট করি, নতুন কোন ফল পাই না। জাবালি বলেন যে, মৃত্যুর পর প্রাণীর কোন অস্তিত্ব থাকে না। কাজেই মৃতের উদ্দেশ্যে আমরা যে ভোজনের আয়োজন করি তা নিরর্থক হয়।
আপাতঃ রমণীয় হলেও জাবালির উপদেশকে রাম প্রতিপালনের অযোগ্য বলে বর্ণনা করেছেন এবং এঁর প্রভাবে প্রভাবান্বিত হয়ে নিজ সঙ্কল্প পরিত্যাগ করেননি।’ (পৃষ্ঠা-১১, চার্বাক দর্শন / লতিকা চট্টোপাধ্যায়)

.
উল্লেখ্য, বর্তমানে মহাভারতকে যে আকারে পাওয়া যায় তার রচনাকালের পূর্বসীমা খ্রীস্টপূর্ব চতুর্থ এবং শেষ সীমা খ্রীস্টিয় চতুর্থ শতক বলে সাধারণভাবে ধরে নেয়া হয় তা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। অন্যদিকে খ্রীস্টিয় দ্বিতীয় শতকের শেষের দিকেই রামায়ণ রচনা সম্পূর্ণ হয়েছে বলে পণ্ডিতদের অভিমত। অর্থাৎ রামায়ণ এবং মহাভারতের পূর্ণ রূপায়ণের বহু পূর্বেই ভারতীয় দর্শনের জগতে ‘চার্বাক’ নাম বিশিষ্ট না হলেও এই মতের আবির্ভাব সূচিত হয়েছিলো বলেই প্রতীয়মান হয়। এবং এই মত যে প্রকৃতই তৎকালীন লোকসমাজে যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করেছিলো, প্রাচীন সাহিত্যগুলিতে এর উপস্থিতি এই সাক্ষ্যই দেয়। হতে পারে এই মতকে অসার বা প্রয়োগযোগ্যতাহীন প্রতিপন্ন করার প্রয়োজনেই তৎকালীন সাহিত্য-আয়োজনে এর উপস্থাপন করা হয়েছিলো, তবু ইতিহাসের নিরীখে এই উপস্থিতির গুরুত্ব কোনভাবেই খাটো করে দেখার উপায় নেই।
.
প্রসঙ্গক্রমে এটাও মনে রাখা দরকার যে, ‘অবশ্যই মহাভারত একজনের রচনা নয়। অধুনালভ্য মহাভারতের সংস্করণটি নানা কবির হাত ঘুরে নানাভাবে পরিবর্তিত হয়ে আমাদের কাছে পৌঁছেছে। তাই মহাভারতের সর্বত্র হুবহু একই মতাদর্শের পরিচায়ক হবার কথা নয়।’ (পৃষ্ঠা-২২, ভারতে বস্তুবাদ প্রসঙ্গে / দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়)। অতএব মহাভারতে নাস্তিক্য বা লোকায়ত বস্তুবাদী মতের আভাস যেমন বিরল নয়, তেমনি বস্তুবাদ-বিদ্বেষের নজির দেখানোও কঠিন নয়।
.
মহাভারতের বনপর্বে (মহাভারত: ৩/৩০-৩১) দেখা যায়, দ্যুত ক্রীড়ায় পরাজিত পঞ্চপাণ্ডব যখন বন থেকে বনান্তরে ঘুরে অশেষ দুর্দশায় কালাতিপাত করছিলেন, সে সময় যুধিষ্ঠিরের উদ্দেশ্যে দ্রৌপদী বৈষয়িক স্বাচ্ছন্দ্যের অনুকুলে নানা ধরনের যুক্তি দেখিয়ে যে বক্তব্য রাখেন তাতে ‘নাস্তিক্য’ মতের আভাসই পরিলতি হয়। নিজ শক্তিতে বৈষয়িক স্বাচ্ছন্দ্য অর্জন করে নেবার জন্য যুধিষ্ঠিরকে কর্মে উদ্বুদ্ধ করার যে প্রয়াস দ্রৌপদীর বক্তব্যে লক্ষ্য করা যায়, তা যে তৎকালীন ভারতীয় বৈদিক সংস্কৃতিতে প্রচলিত অদৃষ্ট, প্রাক্তন বা পূর্বজন্মের কর্মের সংস্কার ইত্যাদি ধারণার পরিপন্থি ছিলো বলার অপেক্ষা রাখে না। কেননা সনাতন ধর্মের এই সংস্কারে পূর্ণ প্রভাবিত মানুষ গভীরতম দুঃখেও বিচলিত না হয়ে নিজের দুর্দশাকে অতীতেরই স্বকৃত কর্মফল হিসেবে বিচার করে তা স্বীকার করে নিতে প্রস্তুত থাকেন। ঈশ্বরের ন্যায়বিচার এবং ধর্ম ও শাস্ত্রবিহিত ক্রিয়ানুষ্ঠানের উপর গুরুত্ব আরোপ করে আধ্যাত্মিক মতের মোক্ষকে চরম লক্ষ্য স্থির করে তারই প্রস্তুতি হিসেবে প্রাত্যহিক জীবনের ক্রিয়াকলাপকে নিয়ন্ত্রিত করার চেষ্টা করেন এই শ্রেণীর লোকেরা। ফলে ধর্মকে একান্তভাবে অবলম্বন করেও যে ঐহিক উন্নতি লাভে যুধিষ্ঠির অসমর্থ, ধর্মকে সম্পূর্ণ পরিত্যাগ করে কেবলমাত্র নিজ শক্তিতে কর্মের অনুষ্ঠানের মাধ্যমেই দুর্যোধন তা অর্জন করেছেন বলে দ্রৌপদীর অভিমত। এখানে দ্রৌপদীর উল্লেখিত ‘কর্ম’ প্রচলিত সনাধন ধর্মের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে দেখা দেয়।
.
ঈশ্বরের বিরুদ্ধেও দ্রৌপদীর অভিযোগ পরিলক্ষিত হয়। যুধিষ্ঠিরকে বিপদ এবং দুর্যোধনকে সম্পদ প্রদান করার মধ্যে যে পক্ষপাতিত্বের প্রকাশ তার জন্য দ্রৌপদী ঈশ্বরকে দোষারোপ করেন। কর্মফলবাদের নীতি অনুসারে স্বকৃত কর্মের ফল প্রত্যেককেই ভোগ করতে হয়। এই নীতি স্বীকৃতি পেলে ঈশ্বরও তাঁর কৃতকর্মের জন্য পাপে লিপ্ত হতে এবং সে অনুযায়ী ফল ভোগ করতে বাধ্য। কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি যে স্বকৃত পাপের ফল ভোগের ব্যাপারে অব্যাহতি লাভ করেন তার মূলে ঈশ্বরের শক্তি ও প্রতাপ কার্যকরী। অর্থাৎ দ্রৌপদী তাঁর বক্তব্যে এটাই পরিস্ফুট করতে চেয়েছেন যে, নিজ শক্তির পূর্ণ অভিব্যক্তিযুক্ত কর্মের মাধ্যমেই কেবল জাগতিক সুখ ও সমৃদ্ধি লাভ সম্ভব। ধর্ম, কর্মফল বা ঈশ্বরের দোহাই দিয়ে নয়।
দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্যহেতু ঈশ্বরে সরাসরি অস্বীকৃতি না থাকলেও দ্রৌপদী বণিত এই নাস্তিক্য মত যে আমাদের পরিচিত বার্হস্পত্য বা চার্বাক মতের মূল নীতিগুলিরই অনুগামী, তা অস্পষ্ট নয়।
.
আবার মহাভারতের শান্তিপর্বে সাংখ্যাচার্য পঞ্চশিখকে নিজ মতবাদ প্রচারের সময় সমসাময়িক যে সব মতগোষ্ঠীর বিরোধিতার সম্মুখীন হতে হয়েছিলো সেবিষয়ক উপাখ্যানও দেখতে পাওয়া যায়। এগুলির মধ্যে ‘চার্বাক’ বিশেষণের প্রয়োগ না হলেও চার্বাক মতের অনুরূপ মতেরও অন্তর্ভুক্তি রয়েছে (মহাভারত: ১২/২১৮/২৩-২৯)।
.
তবে আনুমানিক খ্রীস্টপূর্ব চতুর্থ শতকে রচিত কৌটিল্যের ‘অর্থশাস্ত্রে’র সাক্ষ্যে বার্হস্পত্য সম্পর্কে চমৎকার প্রামাণিক তথ্য পাওয়া যায়। এই গ্রন্থের প্রথম অধিকরণ বিনয়াধিকারিকম্ এর বিদ্যাসমুদ্দেশ নামক দ্বিতীয় অধ্যায়ে স্বীয় মত প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বিভিন্ন প্রকারের বিদ্যা ও তাদের সম্মন্ধে পূর্ববর্তী শ্রদ্ধেয় আচার্যগণের মতভঙ্গি উদ্ধৃত করতে গিয়ে কৌটিল্য বলেন-

[কৌটিল্যস্য স্বমতং চ।] আন্বীক্ষিকী ত্রয়ী বার্তা দণ্ডনীতিশ্চেতি বিদ্যাঃ।
.
ত্রয়ী বার্তা দণ্ডনীতিশ্চেতি মানবাঃ। ত্রয়ীবিশেষো হ্যান্বীক্ষিকীতি।
.
বার্তা দণ্ডনীতিশ্চেতি বার্হস্পত্যাঃ। সংবরণমাত্রং হি ত্রয়ী লোকযাত্রাবিদ ইতি।
.
দণ্ডনীতিরেকা বিদ্যেত্যৌশনসাঃ। তস্যাং হি সর্ববিদ্যারম্ভাঃ প্রতিবদ্ধা ইতি।
.
চতস্র এব বিদ্যা ইতি কৌটিল্যঃ। তাভির্ধর্মার্থৌ যদ্বিদ্যাত্তদ্বিদ্যানাং বিদ্যাত্বম্ ।। ১/২/১।। (কৌটিলীয়ম্ অর্থশাস্ত্রম্)।
.
অর্থাৎ :
কৌটিল্যের মতে, বিদ্যা চার প্রকারের, যথা- আন্বীক্ষিকী (হেতুবিদ্যা বা তর্কবিদ্যা বা মোক্ষদায়ক আত্মতত্ত্ব), ত্রয়ী (ঋক্-যজুঃ-সামবেদাত্মক বেদ-বিদ্যাসমুদায়), বার্তা (কৃষি, পশুপালন ও বাণিজ্য বিষয়ক বিদ্যা) এবং দণ্ডনীতি (অর্থাৎ রাজনীতি বা নীতিশাস্ত্র ও অর্থশাস্ত্র)।
.
মানব সম্প্রদায় অর্থাৎ মনু-শিষ্যগণ বলেন- ত্রয়ী, বার্তা এবং দণ্ডনীতি- বিদ্যা এই তিনপ্রকার। কারণ, আন্বীক্ষিকী (বা হেতুবিদ্যা) ত্রয়ীর অর্থবিচার করে বলে সেটি ত্রয়ীবিশেষ-মাত্র অর্থাৎ ত্রয়ীরই অন্তর্ভুক্ত।
.
বৃহস্পতির শিষ্যগণের (বার্হস্পত্যগণের) মতে, বার্তা ও দণ্ডনীতি- এই দুই প্রকারের বিদ্যা ; কারণ, ত্রয়ী লোকযাত্রাবিদের অর্থাৎ বার্তা ও দণ্ডনীতির অনুষ্ঠান বিষয়ে অভিজ্ঞ মানুষের পক্ষে সংবরণের অর্থাৎ আচ্ছাদনের কাজ করে মাত্র (লোকতন্ত্রজ্ঞ হলেও ত্রয়ীজ্ঞান না থাকলে নাস্তিক বলে লোকসমাজে যে নিন্দিত হতে হয়, তার থেকে রক্ষার উপায়মাত্র হওয়ায় ত্রয়ীর স্বতন্ত্র বিদ্যাত্ব স্বীকারের কোনো প্রয়োজন নেই)।
.
ঔশনস (উশনা-পুত্র শুক্রাচার্যের শিষ্য-) গণের মতে, দণ্ডনীতি বা অর্থশাস্ত্রই একমাত্র বিদ্যা, কারণ দণ্ডনীতিতেই অন্যান্য সমস্ত বিদ্যার আরম্ভ (অর্থাৎ কর্মনীতিপদ্ধতি এবং যোগক্ষেম) প্রতিষ্ঠিত আছে।
.
কিন্তু কৌটিল্যের মতে, (প্রথম উক্ত) চারটিই বিদ্যা। (এই চারটিকে বিদ্যা বলবার কারণ-) এই চারটির দ্বারাই ধর্মসংক্রান্ত সমস্ত ব্যাপার এবং অর্থ বা জাগতিক সকল প্রয়োজনবস্তু জানা যায় ; এবং এদের দ্বারা জানা যায় বলেই এদের ‘বিদ্যাত্ব’ সার্থক হয়েছে।

.
এবং এই বিদ্যাগুলোর ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে কৌটিল্য আবার বলেন-

সাংখ্যং যোগো লোকায়তং চেত্যান্বীক্ষিকী।
.
ধর্মাধর্মৌ ত্রয্যাম্ । অর্থানর্থৌ বার্তায়াম্ । নয়াপনয়ৌ দণ্ডনীত্যাম্ । বলাবলে চৈতাসাং হেতুভিরন্বীক্ষমাণান্বীক্ষিকী লোকস্যোপকরোতি, ব্যসনেহভ্যুদয়ে চ বুদ্ধিমবস্থাপয়তি, প্রজ্ঞাবাব্যক্রিয়াবৈশারদ্যং চ করোতি।
.
প্রদীপঃ সর্ববিদ্যানামুপায়ঃ সর্বকর্মণাম্ ।
আশ্রয়ঃ সর্বধর্মাণাং শশ্বদান্বীক্ষিকী মতা।। ১/২/২।। (কৌটিলীয়ম্ অর্থশাস্ত্রম্)।
অর্থাৎ :
সাংখ্যদর্শন, যোগদর্শন ও লোকায়ত- এই তিনটি শাস্ত্রই উক্ত আন্বীক্ষিকী-বিদ্যারই অন্তর্ভুক্ত।
.
এই আন্বীক্ষিকীর দ্বারা এবং সূক্ষ্ম অন্বীক্ষার সাহায্যে ধর্ম এবং অধর্মের বিষয় ত্রয়ীতে প্রতিপাদিত হয় ; অর্থ এবং অনর্থ প্রতিপাদিত হয় বার্তা-নামক বিদ্যায় ; এবং দণ্ডনীতিতে নয় ও অপনয় (good policy and bad policy) প্রতিপাদিত হয়। এই তিন বিদ্যার বল ও অবল (সামর্থ্য ও অসামর্থ্য) বা প্রাধান্য ও অপ্রাধান্য যুক্তির দ্বারা নির্ধারণ করা হয় বলে আন্বীক্ষিকী লোকসমাজের উপকার করে থাকে, বিপৎকালে এবং অভ্যুদয়ের সময় মানুষের বুদ্ধি অবিচলিত রাখে এবং মানুষের প্রজ্ঞা, বাক্য-ব্যবহার ও কর্মশক্তির নৈপুণ্য সম্পাদন করে।
.
আন্বীক্ষিকীবিদ্যা (অপর-) সকল বিদ্যার প্রদীপস্বরূপ (মার্গদর্শক), সকল কর্মের (অর্থাৎ কর্মসাধনের পক্ষে) উপায়তুল্য, সকল (লৌকিক ও বৈদিক-) ধর্মের আশ্রয়স্বরূপ বলে সর্বদা পরিগণিত হয়ে থাকে।

.
উল্লেখ্য, আন্বীক্ষিকীর অন্তর্ভুক্ত বিদ্যা হিসেবে কৌটিল্যবর্ণিত যে যোগদর্শনের উল্লেখ রয়েছে, পণ্ডিতদের মতে সেটা আসলে পতঞ্জলির (২৫০ খ্রীস্টাব্দ) যোগদর্শন নয়, মূলত ন্যায়-বৈশেষিক অর্থে প্রাচীন যোগ বোঝানো হয়েছে। কেননা, পণ্ডিত ফণিভূষণ তর্কবাগীশ এবং কুপ্পুস্বামী শাস্ত্রী উভয়েই মূল্যবান সাক্ষ্য ও যুক্তি প্রদর্শন করে নিশ্চিত করেছেন যে, পরবর্তীকালে যে-দার্শনিক মতকে আমরা ন্যায়-বৈশেষিক নামে সনাক্ত করতে অভ্যস্ত, প্রাচীন কালে তাকেই ‘যোগ’ নামে অভিহিত করার প্রথা ছিলো। কৌটিল্যর রচনাতেও যোগ শব্দ এই প্রাচীন অর্থেই ব্যবহৃত।
.
এখানে কৌটিল্যের মতে বিদ্যা চারটি হলেও উল্লেখিত শ্লোক অনুযায়ী কৌটিল্যবর্ণিত বার্হস্পত্যদের মতে বিদ্যার সংখ্যা দুই- দণ্ডনীতি এবং বার্তা। বেদ অথবা আন্বীক্ষিকীকে বার্হস্পত্যরা বিদ্যা হিসেবে স্বীকৃতি দেন না। তাঁরা বেদকে ‘লোকযাত্রাবিদ্’ বা লৌকিক ব্যবহারে অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের ‘সংবরণ’ বা পোশাক বলে অভিহিত করেছেন। এ থেকে প্রতীয়মান হয়, বার্হস্পত্যদের অভিমত অনুসারে সে সময়ে বেদজ্ঞ বলে যাঁরা নিজেদের প্রচার করতেন তাঁদের প্রকৃত স্বরূপ সব সময়ই বেদজ্ঞানের আবরণে গোপন থাকতো। তা থেকে অনুমিত হয় যে, ‘অর্থশাস্ত্রে’র সময়কালে অর্থাৎ খ্রীস্টপূর্ব চতুর্থ শতকেই বার্হস্পত্য মতবাদ বৈদিক সংস্কৃতির বিরোধী মতবাদ হিসেবে চিহ্নিত বা প্রতিষ্ঠিত হয়ে আছে।
.
তবে এখানে যে কৌতুহলোদ্দীপক বিষয়টি নজর এড়িয়ে যাওয়া সঙ্গত হবে না, তা হলো, কৌটিল্য বর্ণিত যে আন্বীক্ষিকীর অন্তর্গত শাস্ত্র হিসেবে লোকায়তের পরিচিতি, সেই আন্বীক্ষিকীকে কৌটিল্য সর্ব ধর্মের আশ্রয় বলে বর্ণনা করলেও বার্হস্পত্যরা এই আন্বীক্ষিকীকে বিদ্যারই অন্তর্ভুক্ত করেন নি। এখানে আন্বীক্ষিকী মানে অনুমান-মূলক দর্শন। এক্ষেত্রে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, তবে কি প্রাচীন লোকায়ত শাস্ত্র আর পরবর্তীকালের চার্বাক দৃষ্টিভঙ্গির লোকায়ত মত এক নয় বা পরস্পর বিপরীত ? হতেও পারে। কেননা পরবর্তীকালের ‘চার্বাক’ নামে বিশেষিত লোকায়তিক দর্শনের পরিধি থেকে ধর্ম সম্পূর্ণ বহিষ্কৃত হওয়ার কারণেই হয়তো এই বৈপরিত্য সৃষ্টি হয়েছে। সময়ের ব্যবধানে দর্শনমতের বিবর্তন অসম্ভব কিছু নয়।
.
তাই কৌটিল্যের এই বার্হস্পত্য মত বর্ণনার সাপেক্ষে পরবর্তীকালের সাহিত্যে চার্বাক দর্শনের সাযুজ্য বিশ্লেষণ করতে একাদশ শতকের কৃষ্ণমিশ্র রচিত ‘প্রবোধচন্দ্রোদয়’ নাটকটিকে গুরুত্বপূর্ণ নমুনা-উদাহরণ হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। এই রূপক নাটকে বর্ণিত চার্বাক সিদ্ধান্তে বলা হচ্ছে-

দণ্ডনীতিরেব বিদ্যা। অত্রৈব বার্তান্তর্ভর্বিষ্যতি ধূর্ত প্রলাপস্ত্রয়ী।। (প্রবোধচন্দ্রোদয়, পৃষ্ঠা-৬৫)।
অর্থাৎ : দণ্ডনীতিই একমাত্র বিদ্যা। বার্তা দণ্ডনীতির অন্তর্ভুক্ত এবং ত্রয়ী বা বেদ ধূর্তদের প্রলাপ।

.
আবার অষ্টম শতকের প্রখ্যাত অদ্বৈত-বেদান্ত দার্শনিক শঙ্করাচার্য লোকায়ত প্রসঙ্গে তাঁর ‘সর্বসিদ্ধান্তসংগ্রহ’ গ্রন্থে উল্লেখ করেন-

কৃষিগোরক্ষবাণিজ্যদণ্ডনীত্যাদিভির্বুধঃ। দৃষ্টৈরেব সদোপায়ৈর্ভোগাননুভবেদ্ ভুবি।। ২/১৫।। (সর্বসিদ্ধান্তসংগ্রহ)।
অর্থাৎ : (লোকায়তরা) কৃষি, গোরক্ষা, বাণিজ্য, দণ্ডনীতি ইত্যাদি দৃষ্ট উপায়ের মাধ্যমে জাগতিক বস্তু উপভোগের পরামর্শ দেন।

.
অতএব, ‘প্রবোধচন্দ্রোদয়’ গ্রন্থের বার্হস্পত্য-চার্বাক বা ‘সর্বসিদ্ধান্তসংগ্রহ’ গ্রন্থের বার্হস্পত্য-লোকায়তের আদি রূপ হিসেবে কৌটিল্যবর্ণিত বর্ণিত বার্হস্পত্যের অনুমান করা খুব অসঙ্গত হবে না বলেই মনে হয়। তারপরও প্রশ্ন থাকে, চার্বাক তথা বার্হস্পত্য দর্শনের প্রকৃত উৎস কোথায় ?

(চলবে…)

[আগের পর্ব: চার্বাক ও বৃহস্পতি] [*] [পরের পর্ব: বার্হস্পত্য-সূত্র]