ডায়ার,একজন মানুষ নামের পিশাচ। জালিয়ানওয়ালাবাগের সেই হত্যাকাণ্ডের কথা নিশ্চয় মনে আছে?প্রায় দু হাজার( ১৫২৬ WP) নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা নেত্রীত্ব দিয়েছিলে এই পিশাচ। এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে নাইট উপাধি ত্যাগ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ।সারা দেশ জুড়ে চরম বিক্ষোভ বিরাজ করছে। এর বিচার করতে হবে। ডায়ার কে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাও। এমন কি বৃটিশ কমন্স সভায় এই দাবী উঠে। কিন্তু নেটিভ হত্যার জন্য কি ব্রিটিশদের বিচার করা যায়? অমৃতসরের জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের পিশাচ একজন বৃটিশ। তখন ভারতবর্ষ ব্রিটিশদের কলোনি। এখনো আমরা কতটুকু মুক্ত?

বৈশাখী মেলার আয়োজন করা হয়েছে এক ফাঁকা মাঠে। তার চার দিক দিয়েই বদ্ধ। সরু একটা গলিতে দিয়ে যাতায়াত করতে হয়। শহরে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। কিন্তু এই মাঠটি শহর থেকে অনেকটা দূরে। এই ঐতিহ্যবাহী মেলায় গ্রাম গঞ্জ থেকেও অনেক মানুষ এসে উপস্থিত। হঠাৎ গুলির শব্দ। ডায়ারের নেতৃত্বে প্রায় শ খানেক সৈন্য এই গলির মুখ আগলে তাদের আক্রমন চালায়। ডায়ার সাথে দুইটা মেশিন গান নিয়ে এসেছিল। কিন্তু গলিটা এতই চিকন যে তা ঢোকানো গেলনা। শ খানেক বন্ধুক এক সাথে গর্জে উঠল। সাথে চলল বেয়নেট চার্জ। কিছু মানুষ আশ্রয় নিয়েছিল পানির কুয়ার ভেতর, সৈন্যরা বড় বড় পাথর গড়িয়ে এনে চাপা দিল তাদের। সেদিনের মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়ায় ১৫২৬ । অবশ্য ডায়ার অনেক দিন পরে হিসাব করে বলেছিলেন ৩৭৯ জন।

জালিয়ানওয়ালাবাগ , হত্যাকাণ্ডের এক মাস পরে তোলা ছবি।

এই হত্যাকাণ্ডের ফলাফল কি হতে পারে? জনগণ ঘর ছেড়ে রাস্তায় আসতে পারে এমন সন্দেহ জারি করা হয় সেনা শাসন। আর অমৃতসরে যেখানে এই হত্যাকাণ্ড হলো সেখানে চালানো হলো আরো নতুন এক বর্বর নির্যাতন।জালিয়ানওয়ালাবাগ যাওয়ার এক মাত্র গলি পথে, এই ডায়ার একদিন বন্ধ করে দিলেন ইট দিয়ে। দেয়ালের নীচ দিয়ে একটু ছিদ্র করে দিলেন যাতে লোকজন হামাগুড়ি দিয়ে এই পথ দিয়ে যাওয়া আসতে পারেন। প্রতিটি নারী পুরুষকে ডায়ার বাধ্য করেছে হামাগুড়ি দিয়ে বাহির থেকে পানি নিতে। এই হচ্ছে ডায়ার।

তার ডায়রিতে সে উল্লেখ করেছেন:
“দেশীয়দের মাথা নত করার জন্যই আমি এক অভিনব পথ বের করি। আমি জানতাম, শহরের কাঁড়েওয়ালা গলিতে অসংখ্য লোক বাস করে। তাছাড়া অন্য আর একটা সুবিধাও রয়েছে। গলির মহিলাদের খাবার পানি আনতে হয় গলির বইরে একটা জলের কল থেকে। গলির মধ্যে পানি পাওয়ার কোন ব্যবস্থা নেই। আমি স্থির করলাম, যে নেটিভরা মাথা উঁচু করে চলতে চেয়েছে, যারা জালিয়ানওয়ালাবাগে একত্রিত হয়েছে আমাদের এক হাত দেখিয়ে দিতে, তাদের আত্মীয়-স্বজনদেরও উপযুক্ত শাস্তি দেওয়া উচিত। তাই গলির দু পাশ বন্ধ করে দেওয়ার ব্যবস্থা করলাম। সামান্য একটা ছিদ্রপথ রাখা হলো। এই ছিদ্রপথে যাওয়ার সময় মাথা অবশ্যই নত করতে হয়। অধিবাসীরা ব্যবহার করতে বাধ্য হলো আমার উদ্ভাবিত পথ।”।

কিন্তু সাদা বৃটিশরা বরাবর আইনের বাইরে থাকেন। নেটিভ হত্যা করার জন্য ব্রিটিশদের কোন শাস্তি হবে এটা তারা ভাবতেই পারেনা। অজুহাত দেশের স্বার্থেই এমনটি করেছেন ডায়ার। স্বজাতির কাছে থেকে আসতে থাকলো প্রসংশা পত্র। বৃটিশ শাসনামলে এই পিশাচ হয়ে উঠে ইংরেজদের কাজে সাহসী বীর। প্রতিটা বর্বরোচিত হামলার পরে পেয়েছেন একটি করে প্রমোশন। ভারতবর্ষ এবং ইংরেজ রাজত্বে তার নামে নিন্দা আসলেই তার স্বজাতীয়রা তাকে দিয়েছেন দেশপ্রেমিকের মর্যাদা। এই হলো ব্রিটিশদের চরিত্র।

দেশে জন্মাইলে দেশ প্রেমিক হওয়া যায় না। ডায়ারও জন্মে ছিলেন ভারতবর্ষে ৮ জুন ১৮৬৪ সাল।। তার শিশু কিশোর জীবন, বেড়ে উঠা,লেখা পড়া সবই হয়ে ছে ভারতের মাটিতে। এই ভারতের আলো বাতাস নিয়েই সে মানুষ না হয়ে হয়েছে পিশাচ। তার পুরো নাম এডোয়ার্ড হ্যারি ডায়ার। বাংলাপিডিয়া লেখা আছে রেগিনাল্ড ডায়ার । এত বড় কাজ করার পরেও কি কোন প্রমোশন হবে না। বৃটিশরা তো এমন অকৃতজ্ঞ না। তারা তাকে প্রমোশন দিলেন সামরিক বাহিনীর বিগ্রেডিয়ার জেনারেল। দিলেন পাঞ্জাবের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারি। এই ক্ষমতা বলেই ডায়ার তার পর থেকে সামরিক শাসন জারি করে।

এই হত্যাকাণ্ডের খবর পৌছে গেল বিশ্ববাসীর কাছে। পৃথিবীজুড়ে এর নিন্দা আসতে লাগল , এমন কি ব্রিটেনের কমন্স সভার কিছু বিবেকবান সদস্য এর বিচারের দাবী জানাল। চাপে পরে ভারত সচিব মনটেগু একটি তদন্ত কমিটি গঠন করলেন। এই লোক দেখানো কমিটি দায়সারা ভাবে একটি প্রতিবেদন দাখিল করলো।

সাত মাস পর্যন্ত আর কোন তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়নি। এর প্রতিবাদ হিসেবে সব রকম রাজনৈতিক সমাবেশ বাতিল করলেন মহাত্মা গান্ধী। তিনি আসলে দিল্লীতে বসলেন ব্রটিস শাসকদের সাথে। বুঝালেন এই ঘটনা যদি ইংরেজদের বিরুদ্ধে ভারতীয়রা করতে এতক্ষনে কি হতো? ঐ দিকে বৃটেনের কিছু কমন্স সভার যে সব সদস্য এর বিচার দাবি করেছিল তারা এই দায়সারা রিপোর্টে সন্তুষ্ট হলো না। তারা আবার চাপ দিল কমন্স সভায়। এবার টনক নড়ল মনটেগুর। তার অনুগত লর্ড হান্টারকে প্রধান করে একটি কমিটি গঠন করা হলো। লর্ড হান্ট আরো সাতজন সদস্য নিজের পছন্দ মতো চার জন ব্রিটিশ সদস্য নিযুক্ত করলেন। ভারতীয়দের চাপে বাধ্য হয়ে বাকি তিনজন নিলে ভারতীয়। হান্টারের তদন্ত কমিশন মোট চল্লিশ দিন বসল অধিবেশন। ঘটনা ঘটেছে অমৃতসরে অথচ তদন্ত বসেছে লাহোরে। গান্ধীজী বুঝতে পারলে এর ফলাফল কি হবে। তাই তিনি নিজেই তিনি ছয় সদস্য বিশিষ্ট সাব কমিটি গঠন করলেন।সঙ্গে নিলেন পণ্ডিত মতিলাল নেহেরু, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস, আবাস তায়েবজী ও শেরে বাংলা ফজলুল হক গান্ধী নিজে তো আছেন ই।

এই কমিটি ছুটে গেল, ঘটনাস্থলে,জনে জনে জিজ্ঞাসা করতে লাগল ঘটনার বিবরণ। একে একে বেরিয়ে আসল প্রকৃত সত্য। লাশের স্তূপে অর্ধমৃত অবস্থা থেকে বেঁচে গেলেন মতিলাল। তিনি বর্ণনা করলেন সেই বীভৎস লোমহর্ষক বর্বরতার বিবরণ। ঘটনার দিন গুলির শব্দেই স্বামীকে আনতে গিয়েছিলেন লাশমী । সেও বললেন তার সেই দিনের মানুষের কাতর চিৎকারের কাহিনী।পাগড়ি ভিজিয়ে কি করে মুমূর্ষু মানুষকে পানি খাইয়েছেন।

তদন্ত শেষ করে গান্ধি তার রিপোর্ট লিখলেন।”এমন অমানুষিক কার্যকলাপ একমাত্র দানব ছাড়া আর কারো দ্বারা সম্ভব নয়। অমৃতসরে যে অত্যাচার চালানো হয়েছে তার নজির পৃথিবীর আর কোথাও আছে কিনা তা আমাদের জানা নেই। অমৃতসর যতদিন বেঁচে থাকবে ততদিন ভুলতে পারবেনা এই পৈশাচিক হত্যা যজ্ঞের কথা। একটা সুসভ্য জাতি হিসেবে কি করে এমনি ভাবে মানুষকে হত্যা করা যায় আমাদের জানা নেই……।

হত্যা যজ্ঞের পর এই খবর যাতে প্রকাশিত হতে না পারে এর জন্য সব পত্রিকা বন্ধ করে দেয়া হলো। কেবল ইংরেজদের জন্য রইল ইংরেজীতে প্রকাশিত দুটি পত্রিকা। এই দুইটি পত্রিকার একটিতে হঠাৎ করেই জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের খবর প্রকাশ করে দিল। সেই সাহসী সম্পাদক কালীনাথ রায়কে গ্রেফতার করা হলো । সামরিক আদালতে তার রায় হলো প্রাণদণ্ড।
লর্ড হান্টের কমিটিতে তিনজন ভারতীয়ের প্রতিবাদে হান্ট বাধ্য হলে ডায়ার পদচ্যুত করার সুপারিশ দিতে। সারে এগার মাস পরে ২৭ মার্চ ১৯২০ তারিখ ডায়ার পদত্যাগ করতে বাধ্য হলো। তাকে ইচ্ছার বাইরে যেতে হলো লন্ডনে। কিন্তু এই পিশাচকে বরণ করে নিলেন তার স্বজাতীয়রা,দেশপ্রেমিক হিসেবে পুরস্কারে ভুষিত করলেন। ২মে ১৯২০ সালে জাহাজ থেকে নামার পরেই তাকে দেয়া হলো বিপুল সম্বর্ধনা।

তবু ডায়ার তার পদচ্যুত করার ব্যথা ভুলতে পারলেন না তিনি তার পদ পুনঃ বহালের দাবী ব্রিটিস পার্লামেন্টে উত্থাপন করলেন। যদিও দাবিটি ধোপে টেকেনি কিন্তু তার পক্ষে ভোট পরেছিল ১২৯টি। তার মানে ১২৯ জন পার্লামেন্ট মেম্বার তাকে সমর্থন করেছিলেন। তারা তাকে বিজয়ী করতে না পারলেও বিশাল টাকার তহবিল গঠন করেছিলেন এবং এই তহবিল ও তার উপহার সামগ্রী বহনের জন্য দুটি ট্রাক ভাড়া করতে হয়েছিল। তার স্বজাতিদের এখানে রাজত্ব কায়েম দীর্ঘস্থায়ী কারা জন্য তিনি ইংল্যান্ডে নন্দিত হলেন। এই হলো ইংরেজ জাতি।

অনেক দিন পরে জালিয়ানওয়ালাবাগ কে জাতীয় সম্পতি করার কংগ্রেসের উদ্যোগে গ্রহন করলো।ভারতের সর্বস্তরের জনগনের সহায়তায় বিস্তর অর্থ জমে গেল। সেই সময়ে এই টাকার পরিমান ছিল ৫ লক্ষ পয়ষট্টি হাজার।কল্পনা করা যায়? কমিটি কিনে নিলেন বাগটা। সমুদয় সম্পত্তি পরিনত হলো জনগনের সম্পত্তিতে। আরো চাঁদা সংগ্রহ করে সেই কুয়াটার উপর নির্মাণ করা হয় স্মৃতিস্তম্ভ ।

সেই কুয়ার উপর নির্মিত স্মৃতিস্তম্ভ

দুরারোগ্য সন্নাস রোগে আক্রান্ত হওয়া তিনি ১৯২৭ সালে মারা যান। এই সাত বছর বিশাল প্রাচুর্যের ভেতরেই ছিলেন। তাকে ব্রিটিশরা চাঁদা তুলে বিলাসবহুল একটা বাড়ি কিনে দেয়। মৃত্যুর আগে সে “জীবন কাহিনী” লিখতে শুরু করেছিলেন। তার এই আত্মজীবনীতে ভারতীয়দের দমনের জন্য জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের পক্ষে আবারও ফিরিস্তি গেয়েছেন। এই ঘটনার জন্য সে গর্ববোধ করেছেন। সাম্রাজ্যকে রক্ষার জন্য আরো কঠোর হতে পরামর্শ দিয়েছেন।
কিন্তু এই বিপুল পরিমান মানুষ হত্যা করার জন্য কোন অনুশোচনা করেন নি। দুইশত বছর আমাদের শোষণ করার কারনে কি ব্রিটিশ কখনো অনুশোচনা করেছে?

সূত্র;
১।জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ড-জহুরুল আলম সিদ্দিকী
২। উইকি ও বাংলা পিডিয়া।