কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগে নয়, কোনো রাষ্ট্রীয় বিপর্যয়েও নয়, নিজেদের শ্রমিকদের উপর রাগ করে একসঙ্গে এতগুলো শিল্প কারখানা বন্ধের কাহিনী পৃথিবীর ইতিহাসে আর দ্বিতীয়টি পাওয়া যাবে কী না সন্দেহ। দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে ৩ দশকের পুরোনো একটি শিল্পের এই হচ্ছে অর্জন। – আরিফ জেবতিক

চীন দেশ থেকে ফেরার পথে কুনমিং বিমান বন্দরে অপেক্ষা করছি ঢাকা ফেরার বিমানে উঠার জন্য। কুনমিং এ তখন রাত বারোটা। বিমানবন্দর ফাঁকা ফাঁকা। এক ঘন্টা আগে বোর্ডিং পাস নিয়ে ইমিগ্রেশন পার হয়ে ঢুকে পড়লাম ডিপার্চার লাউঞ্জে। নিয়মানুযায়ী ঢোকার পথে রেখে এসেছি অতি প্রয়োজনীয় লাইটারখানা। বিড়ি আছে, লাইটার নাই। অবশ্য সেটা চিন্তার কোনো বিষয় না, কারণ ডিপার্চার লাউঞ্জে অবশ্যই স্মোকিং রুম থাকবে। একটু পরে বিড়ি পিপাসায় ঢুকলাম সেই রুমে। একটা বক্সের উপর তালা দিয়ে দশটা লাইটার লাগানো- যেহেতু কারও কাছেই লাইটার থাকার কথা না। আমার সাথে একজন ঢুকে বিড়ি মুখে নিয়ে লাইটার জ্বালানোর চেষ্টা করলেন। জ্বললোনা। একে একে দশটা লাইটার চেক করা হলো, কোনোটাই জ্বলে না। অবাস্তব পরিস্থিতি। এই কঠিন অবস্থায় কলকাতা এবং ঢাকারগামী বেশ কয়েকজন বিড়িখোর হঠাৎ এক হয়ে গেলো স্মোকিং রুমে। সবারই এক হাহাকার, লাইটার কই পাই। রাত তখন প্রায় একটা, ডিপার্চার লাউঞ্জের সকল দোকান বন্ধ।

এই কঠিন পরিস্থিতিতে পরিচয় হলো এক চাইনিজ পোশাক ব্যবসায়ীর সাথে। তিনি কোথা থেকে তার সিগ্রেটটা ধরিয়ে এনেছেন। সেটা দিয়ে আমি ধরালাম। ধরিয়ে দিলাম কোরিয়ান-আমেরিকান নাগরিকের বিড়িটাও- যিনিও বাংলাদেশে পোশাক শিল্পের বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত। সবাই বিড়ি ধরিয়ে আনন্দের সাথে সুখ টান দিলো, একে অন্যের সাথে আলাপও শুরু হলো। কোরিয়ান-আমেরিকান ভদ্রলোক এই প্রথম বাংলাদেশে যাচ্ছেন, আমার কাছে বাংলাদেশে কি কি জিনিস না করলে মিস করা হবে এমন প্রশ্ন করছিলেন। বেশ মিশুক ভদ্রলোক। বললেন বাংলাদেশ পোশাক শিল্পে বেশ ভালো করছে। যে চাইনিজ ভদ্রলোক বিড়ি ধরানোর উপায় বের করে সবাইকে উদ্ধার করেছিলেন, তিনি জানালেন- প্রায় বিশ বছর ধরে তিনি বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পের সাথে জড়িত এবং বাংলাদেশের আসলেই এইখাতে অপার সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ বলতে গিয়ে তিনি চমকপ্রদ এক তথ্য দিলেন। আগে জানতাম চীন দেশের শ্রমের দাম বাংলাদেশের মতো সস্তা- কিন্তু তার কাছ থেকে জানা গেলো চীনে একটি পোশাক কারখানায় সর্বনিন্ম বেতন তিন হাজার RMB বাংলাদেশি টাকায় চল্লিশ হাজার টাকা। একটা বড় বিয়ারের ক্যানের দাম তিন আরএমবি, বিশ আরএমবিতে সুন্দর মতো রাতের খাবার সেরে ফেলা যায়। তাই তিন হাজার আরএমবি সর্বনিন্ম বেতন হিসেবে ভালোই। এই বিবেচনায় বাংলাদেশের শ্রম বাজার একেবারে পানির মতো সস্তা। আর এ কারণেই বাংলাদেশ, ভিয়েতনামের মতো দেশে এখন পোশাক কারখানা গুলো স্থানান্তরিত হয়ে যাচ্ছে।

এতো সব সম্ভাবনার মাঝে আমার মনে পড়ে গেলো ক্যান্টনমেন্টের রাস্তায় লাইন ধরে হেঁটে চলা মানুষগুলোর কথা। আমাদের বাসার নিচ তলাতেও পোশাক কারখানায় কাজ করেন এমন তিনটি পরিবার থাকে। সকাল সাতটায় তারা বের হন, দুপুরে এক ঘণ্টা বিরতি। ফিরে আসেন রাতে, ওভার টাইম করলে রাতেও না। এই মানুষগুলোই বাংলাদেশের পোশাক খাতকে সর্বস্ব ঢেলে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন, তাদের কারণে আমি কোথাকার কোনো কুনমিং বিমানবন্দরে এসে দেশের জয়গান শুনছি। অথচ বিনিময়ে এই মানুষগুলা কি পেয়েছেন? কোম্পানীর মালিকেরা কোটি-পতি হয়েছেন, জমি-ফ্ল্যাট সব করেছেন, বড় বড় পাজেরো গাড়ি কিনেছেন, এই মানুষগুলোর শ্রম বেঁচে। এই মানুষগুলো কখনও পুড়ে মড়েছে, পুড়ে না মরলেও জীবন যুদ্ধে সামান্য সময়ের জন্য স্বস্তি পায়নি। এই মানুষগুলোর জীবনের দাম নেই, তাদের জীবনে আনন্দ নেই। আছে শুধু ‘বেঁচে থাকা’। পোশাক শিল্পে যখন আগুন লাগে, যখন অস্থিরতা সৃষ্টি হয় তখন এই মানুষগুলোই ছাই হয়, মালিক পক্ষের কোনোদিন কিছু হয় না। পাজেরো গাড়িতে স্ক্র্যাচ পড়েনা।

পোশাক কারখানাগুলোতে প্রায়ই অসন্তোষের খবর পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়। একই সাথে প্রকাশিত হয় মালিক পক্ষের অভিন্ন বিবৃতিঃ একদল ষড়যন্ত্রকারী সম্ভাবনাময় পোশাকশিল্পকে ধ্বংসের জন্য শ্রমিকদের উস্কানী দিয়ে এমন ধরণের ঘটনা ঘটাচ্ছে। মালিকরা কি বলতে চান- অসন্তোষ ঘটার কোনো কারণ নেই, ষড়যন্ত্রকারীরা না থাকলে ফুলে ফুলে ভরে উঠতো আশুলিয়া সহ অন্যান্য জায়গা? কয়জন মালিক সরকার নির্ধারিত সর্বনিন্ম মজুরিটুকু শ্রমিকদের পরিশোধ করেন? বাড়ি ভাড়া, আনন্দ ফানন্দের খোঁজ নেন কিনা এই প্রশ্ন আর করলাম না। রক্ত শুষে পয়সা বানিয়ে শ্রমিকের সেই রক্ত বানাতে তারা কতটুকু কি করেন? নিজেকে একটু ঐ শ্রমিকের জায়গায় বসিয়ে ভেবে দেখি তো। আমার মালিক যদি আমাকে নায্য সুযোগ সুবিধা দিতেন তাহলে আমি কি ষড়যন্ত্রকারীদের সাথে হাত মিলিয়ে নিজের পেটের লাথি মারতাম? মালিক পক্ষের পেটে তো লাথি পড়েনা। বাজেট এলেই দেখা যায় মালিকপক্ষরা একাট্টা হয়ে বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার হাইকোর্ট দেখিয়া নানা ধরনের কর মওকুফের জন্য সরকারকে চাপ দিয়ে পিষ্ট করতে থাকেন।

গত কয়েক বছরের ধারাবাহিক এই অসন্তোষের সর্বশেষ সংযোজন বারই জুন আশুলিয়ায় বেতন বাড়ানোর দাবীতে শ্রমিকদের আন্দোলন। তেরো তারিখ বিশ পুলিশ সদস্য সহ আহত হয় প্রায় দেড়শ শ্রমিক। বেতন বাড়ানো সম্ভব নয়, বিজেএমইএ থেকে বেশি ঝামেলা করলে সকল কারখানা বন্ধ করে দেবার এই হুমকি আসে এর পরের দিন। এবং সত্যি সত্যি সতেরই জুন রোববার আশুলিয়ায় সকল কারখানা অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়। ঘোষণাটা দেখে অবাক হলাম। আঠারো তারিখে মালিক পক্ষরা জানালেন শ্রম আইনের ১৩ (১) ধারায় তারা কারখানা বন্ধ করেছেন বিধায় এইসময়ের জন্য কোনো বেতন-ভাতা দিতেও তারা রাজি নন। হয়ে গেলো!

সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলা মালিকদের কয়েকদিনের কারখানা বন্ধের ক্ষতি খুব একটা ক্ষতি করতে পারবেনা, যতটা ক্ষতি সেটা করবে হাজার হাজার মানুষদের। কিন্তু এটা নিয়ে তারা ভাববেন ক্যানো? তারা শ্রমিকদের একটা উচিত শিক্ষা দিয়ে লাইনে ফেরাতে চান। যেদিন মালিকপক্ষরা মনে করবেন, উচিত শিক্ষা দেওয়া হয়েছে সেদিনই যে এই কারখানাগুলো আবার খুলবে এটা নিশ্চয়তা দিয়েই বলা যায়। এবং এই উচিত শিক্ষার সময়টা নির্ধারিত হবে, মালিকদের লাভ-ক্ষতি যোগ বিয়োগেই। শ্রমিকদের লাইনের আনার জন্য মালিকপক্ষ কতটুকু ক্ষতি স্বীকার করবে ইত্যিমধ্যেই তার হিসেবে হয়ে গেছে নিশ্চয়ই। শ্রমিকদের কথা চিন্তা করে লাভ কি। এরা তো মানুষ না, গুন্ডা-বদমাইশ। গাড়ি পোড়ানো ছাড়া আর কিছুই পারেনা।

অতিলোভ আমাদের ধ্বংস করে দিচ্ছে। লাইনে আনার জন্য তারা যদি কারখানা বন্ধ না করে এতে কর্মরত শ্রমিকদের মানুষ হিসেবে বিবেচনা করতেন, তাদের পরিবারের মতো দেখতেন, সামান্য বাসস্থানের কথা ভাবতেন, সফলতায় এদের অবদান অনুধাবন করতেন তাহলে আখেরে তাদেরই লাভ বেশি হতো। তখনও হয়তো ষড়যন্ত্রকারীরা থাকতো অনিষ্ট করার আশায়, কিন্তু তাদের পালে হাওয়ার বেগ কম হতো। তার আগ পর্যন্ত আর ষড়যন্ত্রের গল্প শুনতে চাইনা, সবচেয়ে বড় সমস্যা সৃষ্টিকারীর থেকে অবশ্যই না।

এই অনৈতিক কারখানা বন্ধের প্রতিবাদ জানিয়ে লাভ কি! বাংলাদেশে ‘কে শোনে কার কথা’ এই প্রবাদ সাধারণ মানুষের জন্য সত্য হলেও বড়লোকের কথা সবাই শুনে। বড়লোকেরা বলছে বন্ধ থাকবে, থাকবে! আমি খালি বইলা যাই- পারলে আজীবনের জন্য বন্ধ কইরা দ্যান দেখি! পারবেন?