এই লেখাটা কয়েকদিন আগে আমার ফেসবুকে দিয়েছিলাম। খুবই ব্যক্তিগত কিছু স্বপ্ন আর স্বপ্নভঙের বেদনার কথা ছিল এতে। একজনের তেলমাখানো মাখন মাখন কথায় গলে গিয়ে সেখান থেকে তুলে এনে মুক্তমনায় পোস্ট করলাম। কলেবর আগের চেয়ে অবশ্য কিঞ্চিৎ বড় হয়েছে। কাজটা ঠিক করলাম কি না, সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ এবং দ্বিধা রয়ে গিয়েছে আমার মনে যদিও। এতখানি ব্যক্তিগত বিষয় এবং ব্যক্তিগত স্বপ্নের ক্যারিকেচার নিয়ে ব্লগ লেখা যায় কি না আমি জানি না। আশা করছি মুক্তমনার সদস্যরা আমার এই অনিশ্চিত কর্মকাণ্ডকে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। 

 

কুঁজোর যেমন চিৎ হয়ে শোয়ার স্বপ্ন থাকে, বামনের থাকে চাঁদ ধরার স্বপ্ন, কিংবা রাখাল বালকের থাকে রাজকন্যার হাত ছোঁয়ার স্বপ্ন, সেরকমই আমার বুকের গহীনেও একটা স্বপ্ন ছিলো। স্বপ্ন ছিলো আমার ছেলে একদিন তার বাবার সবচেয়ে প্রিয় দল, বাংলাদেশের জাতীয় ক্রিকেট দলের হয়ে খেলবে। লাল,সবুজের রঙ গায়ে মেখে সারা দুনিয়া কাঁপাবে।

কেউ যখন আমাকে জিজ্ঞেস করতো বড় হলে ছেলেকে কী বানাবো? উত্তর আমার ঠোঁটের ডগায় থাকতো। হাসিমুখে বলে দিতাম, ক্রিকেটার। কেউ বিশ্বাস করতো, কেউ করতো না। কেউ বা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতো আমার এরকম অদ্ভুত এবং আজব ধরণের চিন্তা দেখে। আমি তখন আসলে ওরকম করেই চিন্তা করতাম। না ডাক্তার, না এঞ্জিনিয়ার, না বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কোনোটাই নয়, কোনোটাই বানাতে চাই নি তাকে আমি। আমার স্বপ্ন ছিল হাজারো মানুষের স্বপ্নকে বুকে নিয়ে ছেলে আমার বাইশ গজের ধূসর মরুতে উইলো হাতে হারিকেনের মত ঝড় তুলবে। বৃত্তাকার সবুজ গালিচায় প্রজাপতির মত নেচে নেচে বেড়াবে।

সেই স্বপ্নপূরণের উদ্দেশ্যে মাত্র হাঁটা শিখেছে এমন বয়সে কিনে দিয়েছিলাম নীল রঙের প্লাস্টিকের একটা ব্যাট। সাথে সবুজ রঙের টেনিস বল। খেলোয়াড় মাত্র দুজন। তাও আবার দুই প্রজন্মের। আমি আর আমার ছেলে। আমি বোলার, সে ব্যাটসম্যান। শুরুটা হয়েছিল ঘরের মধ্যে। ঘর বলতে টিএসসির উপরে একটা এক কক্ষের ঘরে বসবাস। ওখানেই শুরু তার হাতে খড়ি। আমি হাঁটুমুড়ে বসে একপ্রান্ত থেকে বল ছুড়ে দিতাম, সে আরেক প্রান্ত থেকে ব্যাটিং করতো। একটা কাঠের চেয়ার কাজ করতো উইকেট হিসাবে। কয়েকদিনের মধ্যেই যখন ব্যাটের আঘাতে বল আমার মাথার উপর দিয়ে উড়ে গিয়ে দেয়ালে লাগানো দেয়াল ঘড়ি, টাঙানো ছবিগুলোকে আঘাত করা শুরু করলো, তখন আন্না ঘরের মধ্যে আমাদের খেলার উপরে হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞা জারি করে দিলো। ঘর থেকে তখন আমাদের আশ্রয় হলো করিডোরে। কিছুদিন পরে গলি থেকে রাজপথ। টিএসসির দোতলায় একটা বড় ব্যালকনি ছিল। সেখানে শুরু হলো খেলা। ওখানে প্রায়শই ছাত্রদের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের রিহার্সেল চলতো। তখন আমরা চলে যেতাম প্রশাসন ভবনের সামনের বকুলতলার ছায়াবীথিময় সবুজ চত্বরে কিংবা শহীদ মিনারের বেদিতে। এভাবেই চলতো আমাদের ক্রিকেট প্রশিক্ষণ। দিনের পর দিন, বছরের পর বছর।

আরেকটু বড় হতে প্লাস্টিকের ব্যাটের পরিবর্তে হাতে তুলে দিয়েছি কাঠের ব্যাট। টিএসসির এক কক্ষের বাসা ছেড়ে উঠে এসেছি শিক্ষকদের জন্য করা আবাসিক এলাকায়। বড় এপার্টমেন্ট। বড় বারান্দা। ওখানেই  বুকের সবটুকু ভালোবাসা আর আদর-যত্ন দিয়ে তিলতিল করে শিখিয়েছিলাম আমার জানা ব্যাটিং এর সব ব্যাকরণ আর কলাকৌশল। কীভাবে সামাল দিতে হয় দ্রুতগতির বল, কীভাবে মোকাবেলা করতে হয় নানান ধরণের স্পিন বল, তার প্রশিক্ষণ চলতো লম্বা বারান্দায়। দীর্ঘ সময় ধরে। কতবার বল চলে গেছে বারান্দা পেরিয়ে নিচে। তিনতলার সিঁড়ি ভেঙে হাসি মুখে রাস্তা থেকে বল তুলে এনেছি ছেলের সাফল্যের গর্বে গর্বিত পিতা আমি।

ফুল লেন্থ বল পেলে ওইটুকু বাচ্চা ছেলে নিমেষে বেরিয়ে এসে সজোরে বোলারস ব্যাকড্রাইভ করতো। শর্টপিচ বল পেলে পিছনের পায়ে ভর রেখে কাট করতো। একগাল হাসি মুখে নিয়ে ওই পোজে দাঁড়িয়ে থাকতো আমার হাততালি পাবার আশায়। মাঝে মাঝে আমার লেগ স্পিনের বিপরীতে সিরিয়াস ভঙিতে হাঁটু মুড়ে বসে সুইপ করতো স্কোয়ার লেগ দিয়ে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ শিক্ষকদের নীয়ে একটা ক্রিকেট টিম গড়ে তুলেছিলাম। আমি ছিলাম সেই দলের অধিনায়ক। প্রতি শুক্রবারে ছাত্রদের সঙ্গে বিশ ওভারের ম্যাচ খেলতাম আমরা। আজ এই হল, কাল ওই হলের বিরুদ্ধে। কোনোদিন বা কোনো ফ্যাকাল্টির কোনো ক্লাস আমাদের সাথে ম্যাচ খেলতো। এই সমস্ত খেলাগুলোতেই অর্ক আমাদের সাথে তার ছোট্ট ব্যাট নিয়ে সরবে উপস্থিত থাকতো।

সময়, পরিবেশ আর অন্যভূবনে বসবাস মানুষকে কোথায় নিয়ে যায়। আমার সেই ছেলে এখন আর ক্রিকেট খেলে না। ভুলে গেছে সব ক্রিকেট নৈপুণ্য। শুধু নৈপুণ্যই নয়, এই খেলাটাই এখন তার কাছে অন্য পৃথিবীর মানুষের খেলা। তার খেলা নয়। যে দেশের ক্রিকেট দলের জন্য তিলতিল করে প্রস্তুত করছিলাম তাকে একদিন গভীর স্বপ্ন নিয়ে, সেই দেশ এখন তার কাছে শুধু পিতা-মাতার দেশ মাত্র। নিজের কিছু নয়।

হায়রে প্রবাস জীবন! উত্তরপুরুষ আর পূর্বপুরুষের মাঝে আলোকবর্ষসম অজেয় সমুদ্র তৈরি করে দিতে এর কোনো জুড়ি নেই। এতে অবশ্য উত্তরপুরুষের কোনো দোষ নেই। উত্তরপুরুষের কী এমন ঠেকা পড়েছে পূর্বপুরুষের স্বপ্নের সাধ মেটানোর। সব দোষ আমাদের, এই পূর্বপুরুষদের। ওই মাটি থেকে চারাগাছ থাকা অবস্থায় নিষ্ঠুরভাবে শিকড়সুদ্ধ উপড়ে আনা হয়েছে। এখন সেই আদিভূমিতে শিকড়ের আশা করাটাইতো আসলে ঘোরতর অন্যায় একটা কাজ। অবাস্তব চিন্তার বেশি কিছু নয়।

তারপরেও এই অবাস্তব চিন্তাটা আমাকে ছেড়ে যায় না। পিছনে লেগে থাকে ছায়ার মতন। ঘিরে থাকে সারাক্ষণ, সারাবেলা।