ফুটপাতের কিনারে কয়েকটি মৃত পিঁপড়া দেখতে পেল সে। লাশগুলো পিঁপড়ার কী-না, এ নিয়ে তার মনে গুরুতর সন্দেহের উদ্রেক হলো। সে বসেছিল রাস্তার উপর, ফুটপাত ঘেঁষে। সামান্য ঝুঁকে, চোখদু’টোকে খুব ছোট করে, অনেকটা বীক্ষণ যন্ত্রের মতো, দেখতে গিয়ে দেখলো – লাশগুলো পিঁপড়ারই। পাশের লাশগুলো আশার চরায় কয়েক ফোঁটা কষ্ট ঝরিয়ে, মনে করিয়ে দিলো –শৈশব। আশপাশ তাকে টেনে টেনে নিয়ে যায় অতীতে, যেখানে খেলার ছলেও হত্যা ছিল আনন্দের। সে-সব মৃত্যু নিয়ে কোন প্রশ্ন জাগেনি মনে।
সমবেত শ্লোগানে তার চমক ভাঙে।
সে চারদিকে চোখ বুলালো। সবাই বসে আছে রাস্তার উপর, এলোমেলো। রাস্তার উপর দাঁড়িয়ে কে একজন একটানা বলে যাচ্ছে । বক্তার কথা সে ঠিক শুনতে পাচ্ছিল না। কানে ভেসে আসছিল, এলোমেলো শ্লোগান। শ্লোগানে যে-রকম তাল-লয় থাকে; সে-রকম কিছুই তার কানে এলো না। তার মনে হলো এরা জানে না, কেমন করে শ্লোগান দিতে হয়। এলোমেলো শ্লোগানে বক্তার ভাষণ; যে-ভাবে সপ্ত-আকাশ উঠার কথা, বা পাতালে, বা হাতের ছন্দময় গতি – কিছুই নেই।
এরা জানে না, কেমন করে ভাষণ দিতে হয়, যেমন করে দেয় রাজনৈতিক দলের নেতারা। ভোট আর হরতালের জন্য কন্ঠের উঠা-নামা, হস্ত সঞ্চালনের গতি এতটাই ক্ষিপ্র হয়ে উঠে, মনে হবে; দুনিয়া দু’ভাগ হয়ে যাচ্ছে। শ্রোতারা মন্ত্রমুগ্ধের গিলে খেতে খেতে রাজপথেই গণ-বমি করতে শুরু করলে; বমি পরিষ্কার করতে নেমে আসা ভাব-মূর্তি রক্ষাকারী বাহিনী সব সময় অতীতের সীমা অতিক্রম করে, নতুন এক বার্তা পৌঁছে দেয়।
খবর বিক্রি-র উপাদান সংগ্রহ করতে আসা সাংবাদিকরা তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলতে তুলতে, ফিরে যায় ছাপাখানায়। আগামীকাল সকালে চায়ের টেবিলে সুশীল সমাজের তুমুল তর্কের দৃশ্য কল্পনা কল্পনা করতে ভুলে যায়, রাত জেগে বসে থাকা সঙ্গি-র কথা।
সে ভেবে পেল না, এরা কেমন করে রুখে দেবে মৃত্যু-দন্ডাদেশ।
আর কিছুক্ষণ পর, ওরা পুশ করবে বিষাক্ত ইনজেকশন। তারপর তাকে মাটিতে পুঁতে ফেলা হবে। কেউ যাতে তার কন্ঠস্বর শুনতে না পায়।
‘উনিও একজন সাংবাদিক ছিলেন। সাংবাদিক ভাইয়েরা আপ্নেরা প্রেস ক্লাবের সামনের জটলা না পাকায়া, একটু এইদিকে চইলা আসেন’, – কারো নির্দেশ ছাড়াই লোকটি যেমন উঠে দাঁড়িয়েছিল, তেমনি আবার কারো নির্দেশ ছাড়াই বসে পড়লো। সবার চোখ তখন তার দিকে। বাতাসে তখনো তার চিৎকার ভেসে বেড়াচ্ছে। মাথাটা দু’হাঁটুর মাঝখানে গোঁজা, যেন কেউ তার মুখ দেখতে না পায়। ভাব-মূর্তি রক্ষাকারীদের ভয়ে না লজ্জায়, ঠিক বুঝা গেল না। কিন্তু শ্লোগান উঠে। চারদিক থেকে মুহুর্মহু শ্লোগান উঠে। এ আওয়াজ কি ঘাতকদের কানে পৌঁছবে?
সে এক অসম্ভব কল্পনায় মেতে উঠে। সে দেখতে চায়; ওদের হাত কেঁপে উঠছে। হাতের সিরিঞ্জ ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে মেঝেয়। মৃত্যুর বিরুদ্ধে তারাও বিদ্রোহ ঘোষণা করছে। মৃত্যু কুঠরিতে তখন গগন বিদীর্ণ শ্লোগান। সে উত্তেজিতভাবে চারদিকে তাকায়, আর তখনই তার মনে হলো, সে ফুটপাতের উপর।
একটা বড়-সড় মিছিল সাপের মত গড়িয়ে গড়িয়ে তাদের পাশ দিয়ে চলে গেলো। বিশাল সে মিছিলের শরীরে অসংখ্য চিত্র-কর্ম। ‘ভোটের অধিকার’ তারমধ্যে উজ্জ্বলতর, নক্ষত্রের মত জ্বলজ্বল করছে। হেলে দুলে এগিয়ে চলা মিছিলের শরীর থেকে তপ্ত নিঃশ্বাস এসে পড়লো তার গায়ে। সে অসহায়ভাবে তাকালো ছোট্ট সমাবেশের উপর। আর কেউ কি পুড়ছে?
মিছিলটা অনেক অনেক দূরে চলে গেলে ছোট্ট সমাবেশের বক্তার ভাষণ আবার কিছুটা মূর্ত হয়ে উঠে। কন্ঠ শুনে সে বুঝতে পারে, অন্য একজন। বেশ ধীর, স্থির, মনে হয় সমুদ্রের তলদেশ থেকে কথা বলছেন। তার প্রতিটি শব্দ যেন পাথরের মত, সে-সব পাথরের ঘায়ে ক্ষত-বিক্ষত হ’তে হ’তে সে ভাবলো, হোক ছোট; তবুও এর অস্তিত্ব এখনো অতীত হয়ে যায়নি। এখানে কোন ভোট নেই। শুধু মৃত্যুকে রুখে দেবার দুঃসাহস।
কয়েক ফোঁটা বৃষ্টি তার গায়ে পড়লে সে আকাশের দিকে চোখ তুলে তাকায়। অন্ধকার হয়ে আসছে চারদিক। হয়তো অঝোরে কাঁদবে আকাশ। ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি সয়ে, মুষলধারার সম্ভাবনাকে উপেক্ষা করে লোকগুলো তখনো রাস্তার উপর। যেনো তারা তাদের দাবি আদায় না করে উঠবে না। পৃথিবী যদি অথৈঃ জলে আবার ডুবে যায়, তবুও।
ঠিক সে-সময় তার কানে আসে, ‘ আ-ম-রা স-বা-ই মুমিয়া…..। সে চারদিকে তাকিয়ে দেখলো, সবার হাত মুষ্ঠিবদ্ধ। এই প্রথম সমাবেশের শরীর অনেকটা সংহত, সংঘবদ্ধ। তার শরীর মৃদু উত্তেজনায় কেঁপে উঠে। মনে হল, তার যদি পাখা থাকতো, তবে এ মুহূর্তে সে উড়াল দিয়ে চলে যেত মৃত্যু কুঠরিতে। মুমিয়াকে মুষ্ঠিবদ্ধ হাত দেখিয়ে বলতো, এটা বাঙ্গালীর হাত, তোমার মুষ্ঠিবদ্ধ হাতের সাথে হাত মিলাতে এত দূর থেকে ছুটে আসা।
‘ওদের সাধারণ বোধটুকু পর্যন্ত নেই’, বক্তার মুখ থেকে কথাটা মাটিতে পড়তে না পড়তে পাশ থেকে একজন ফোঁস করে উঠে; ‘ঘরে বসে একটা বিবৃতি দেবে, সে ক্ষমতাও নেই, তারা আবার সাংবাদিক’।
বৃষ্টির ফোঁটা ঘন হয়ে আসছিল। শংকা এসে আচ্ছন্ন করে তাকে। সবাই কি থাকবে, শেষ-পর্যন্ত? যদিও সে নিজে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে, ভারী বৃষ্টি হলে, কাঁধের ঝোলাটা কোন নিরাপদ আশ্রয়ে রেখে আবার ফিরে আসবে সমাবেশে।
এ এক লড়াই।
কোনকিছুই তাকে তার দাবি থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারবে না। ঝড়-তুফান হলেও সে নড়বে না। কিন্তু ঝোলাটা জন্য সে চিন্তিত হয়ে পড়লো। এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখলো, কোন নিরাপদ আশ্রয় তার চোখে পড়লো না। কিছু জরুরী কাগজ। এগুলো দেশ ও জাতির জন্য খুব জরুরী না হলেও তার নিজের কাছে অনেক মূল্যবান।
কিন্তু এগুলো কি মুমিয়ার চেয়েও মূল্যবান? এ প্রশ্ন মনে উদয় হলে সে কিছুটা সংকুচিত হয়ে যায়।
‘তারা যা কিছু করে, সব সঠিক। কেননা তারা হলো গণতন্ত্র ও মানবধিকারের মালিক। যদিও এটা তারা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে পারেনি, মুমিয়া খুনি। তাই মুমিয়াকে খুন করে প্রমাণ করা হবে, সে ছিল খুনি।‘ মাইকের ঘ্যারঘ্যার আওয়াজ বেড়ে গেলে কথাগুলো আবার হারিয়ে যায়। ঘ্যারঘ্যার আওয়াজ কমে এলে কথাগুলো আবার স্পষ্ট হয়ে উঠে, ‘আর কয়েক ঘন্টা পর কৃষ্ণাঙ্গ সাংবাদিক ও লেখক মুমিয়াকে বিষাক্ত ইঞ্জেকশন পুশ করে হত্যা করা হবে।‘
বক্তার কথা মাটিতে পড়তে না পড়তে শ্লোগান উঠে, ‘আমরা সবাই মুমিয়া …’। এবং তা চলতে থাকে, শ্লোগান থামানোর জন্য বক্তার অনুরোধ না আসা পর্যন্ত। সমাবেশ শান্ত হয়ে এলে, তিনি আবার বলতে থাকেন, ‘ মু্মিয়া মৃত্যুর প্রহর গুনতে গুনতে বলেছেন, ‘আমি লিখতে থাকবো, আমি প্রতিরোধ করতে থাকবো, যে ব্যবস্থা গত ১৩ বছর আগে আমাকে হত্যা করতে চেয়েছে এবং এখনো চাচ্ছে, সে ব্যবস্থার বিরুদ্ধে আমি অব্যাহতভাবে বিদ্রোহ করতে থাকবো।‘
মুনিয়ার এই অবিস্মরণীয় উক্তি আমাদের আন্দোলন ও সংগ্রামে প্রেরণা যোগাবে। মাইকের ঘ্যারঘ্যার আওয়াজটা বেড়ে গেলে সে চোখ তুলে তাকালো।
আর তখনই তার মনে হলো, শব্দটা অন্য কোন দিক থেকে আসছে। সে সে-শব্দ অনুসরণ করে দেখতে পেল; প্রেস ক্লাবের মূল ফটকের সামনে আরেকটা সমাবেশ। কখন শুরু হয়েছে, টের পায়নি। তারমানে পাশাপাশি দু’টো সমাবেশ? ওখানে লোকজনের সমাগম লক্ষণীয়। তাদের ব্যানার আর ফেস্টুন দেখেই বুঝতে পারলো, বসত-বাড়ি হারিয়ে পথে নেমে আসা, উদ্বাস্তু। তারা এখন ঘরে ফিরে যেতে চায়। ঘর অন্যের দখলে। তাদের অভিযোগও কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে। সেদিক থেকে চোখ ফিরিয়ে এনে, নিজেদের সমাবেশের দিকে তাকায়। দু’টো সমাবেশের অভিব্যক্তি বুঝবার চেষ্টা করে।
দু’হাঁটুর মাঝখানে মাথা রেখে ভাবছিলো সে। কন্ঠস্বর শুনে বুঝতে পারলো, বক্তার পরিবর্তন ঘটেছে। ঘোষক কার নাম ঘোষণা করলো, খেয়াল করেনি। মাথা তুলে তাকিয়ে দেখতে ইচ্ছে হলো না তার। সে মনে মনে ভাবছিলো, আর কোন কোন দেশে সম্ভাব্য প্রতিবাদ হ’তে পারে? পৃথিবীতে মানুষের জায়গা দখল করে নিচ্ছে মানব সম্পদ নামে এক ধরণের যান্ত্রিক প্রাণী।
পোট্রেটটা কী চমৎকার!
লোকটির চোখ অনুসরণ করে তার চোখ চলে গেল পোট্রেটটার দিকে। সে কিছুটা অবাক হলো, এতক্ষণ কেন তার চোখে পড়েনি, ভেবে। একজন তরুণী এমনভাবে ধরে রেখেছে, যেন ছবিটা ব্যথা না পায়। হয়তো পোট্রেটটার মুখ অন্যদিকে ঘোরানো ছিল, তাই চোখে পড়েনি। পোট্রেট হাতে তরুণীকে খুব বিষণ্ন মনে হচ্ছিল, যেন সে তার প্রিয় বন্ধুকে হারাতে চলেছে।
শ্লোগান উঠে, ‘আমরা সবাই মুমিয়া হবো…।‘
তরুণী নির্বিকার। যেনো কিছুই তার কানে যাচ্ছে না। কে জানে, হয়তো মনে মনে মুমিয়ার সাথে কথা বলছে।
হঠাৎ ফ্লাস বাতি জ্বলে উঠায়, তার চমক ভাঙ্গলো। কয়েকজন সাংবাদিক ছবি তুলছে। শেষ পর্যন্ত তারা এলো, তার মন একটুখানি চাঙ্গা হয়ে উঠে। সবাই জানবে, পৃথিবীতে এখনো মানুষ আছে। একটা ভারী পাথর নেমে যেতে না যেতে, তার কানে এলো, মনে হয় না, ওরা সাংবাদিক। কোন গোপন সংস্থা থেকে এসেছে।
পাশ থেকে একজন বলে ওঠে, না, না, এরা সাংবাদিক।
কাল যদি কোন পত্রিকায় একটা ছবি দেখাতে পারেন তো নাম পাল্টায়া ফেলবো।
সুব্রত ভাঙতে থাকে।
এ-ও কি হয়? যারা ছবি তুলছে সাংবাদিক সেজে, তারা সাংবাদিক নয়? তার বিশ্বাস হয় না। হয়তো বাড়াবাড়ি।
মুমিয়া একজন সাংবাদিক, সেইজন্য সাংবাদিকদের আসাটা স্বাভাবিক।
মুমিয়া একজন লেখক, তাই লেখকদের আসাটা স্বাভাবিক।
মুমিয়া অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী, তাই প্রতিবাদী মানুষের আসাটা স্বাভাবিক।
ভাবতে ভাবতে সে আবার পোট্রেটটার দিকে তাকায়। মুখে হাসি, হাতদু’টো শৃঙ্খলিত কিন্তু মুষ্ঠিবদ্ধ, ঊর্ধ্বমুখি।
মাথা নোয়াবার নয়। সে ভেবে পায় না, মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে একজন মানুষ হাসে কেমন করে?
সেও কি তবে কর্নেল তাহের?
মাথাটা ঝিমঝিম করতে থাকে তার। পৃথিবীটা যেন টলছে। সে আবার দু’হাঁটুর মাঝখানে মাথা গুঁজে দেয়। এমন সময় সবাবেশের সমাপ্তি ঘোষণা ভেসে আসে। সবাই ওঠে দাঁড়ায়। সুব্রত কিছুটা অপ্রস্তুত। সে কি ভেবেছিল, এ মিটিং অনন্তকাল চলবে? সবাই শ্লোগান দিচ্ছে।
সে আশাহতের মত উঠে দাঁড়াতে গিয়ে দেখলো, মৃত পিঁপড়াগুলোর পাশ ঘেঁষে জীবন্ত পিঁপড়ারা যেন মিছিল করতে করতে এগিয়ে যাচ্ছে।