২০০৫ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি যখন প্রথম আন্তর্জাতিক টি২০ তে অস্ট্রেলিয়া নিউজিল্যান্ডকে হারালো, কেউই তখন চিন্তা করতে পারেনাই এই ফরম্যাটই এক সময় ক্রিকেটের অন্যতম শক্তিশালী ফরম্যাট হবে। প্রথম টি২০ খেলাও হয়েছিল খুব হালকা চালে, অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ড দুই দলই আশির দশকের খেলোয়াড়দের মত করে পোশাক এবং চেহারা বানিয়ে মাঠে নেমেছিল।এমনকি খেলার শেষের দিকে যখন এইটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল অস্ট্রেলিয়াই জিততে যাচ্ছে, তখন গ্লেন ম্যাকগ্রা মজা করে ট্রেভর চ্যাপেল এর সেই কুখ্যাত ‘আন্ডারআরম’ বা গড়িয়ে গড়িয়ে বল করেছিল। আর বিলি বাউডেন তো আরেক কাঠি সরেস, এই কাজ করার জন্য ম্যাকগ্রাকে লাল কার্ড দিয়ে বসল। কিন্তু এখন আর ঠিক কেউই হালকা চালে টি২০ খেলেনা, মিলিয়ন মিলিয়ন ডলারের ছড়াছড়ি যে খেলাতে সেই খেলা সিরিয়াসলি না খেলার প্রশ্নই আসেনা।

কেরি প্যাকারের সুবাদে যখন প্রথম ওয়ান ডে ক্রিকেটে রঙ্গিন পোশাক এবং এরকম আরও কিছু পরিবর্তন আসলো, ক্রিকেটের শুদ্ধবাদিরা তখন থেকেই ভয় পেয়েছিল যে ওয়ান ডে ক্রিকেট এক সময় টেস্ট ক্রিকেটের জন্য হবে হুমকিস্বরূপ। সময়ের সাথে সাথে আজ এই ভয় মুলত টি২০ কে নিয়ে। অনেকে তো টি২০ কে ক্রিকেট হিসেবে মানতেই নারাজ। এলোমেলো শটে চার-ছয় আর বোলারদের যত্রতত্র মার খাবার দৃশ্য অনেক শুদ্ধবাদিদেরই গাত্রদাহের কারণ হিসেবে দেখা দিয়েছে। কিন্তু আসলেই কি টি২০ ক্রিকেট নয়?

 

আপনি যদি বর্তমানের সেরা ফাস্ট বোলার ডেল স্টেইনকে অনেকক্ষণ তার রুদ্রমূর্তিতে দেখতে চান, আপনার সামনে টেস্ট ক্রিকেটের কোনই বিকল্প আসলে নেই। কিন্তু ভেবে দেখুন তো, বর্তমানে কোন ব্যাটসম্যানই কিন্তু টেস্ট ক্রিকেটে স্টেইন এর উপর চড়াও হয়না বললেই চলে। কোনমতে তার স্পেলটা শেষ হলেই বিপক্ষ দল বাঁচে। কিন্তু টি২০ তে অধিকাংশ সময়ই আসলে কোন বিশেষ বোলারকে সম্মান দেখানোর মত অবস্থা থাকেনা। তখন এই স্টেইনও দেখা যায় ওভার প্রতি দশ রান করে দিচ্ছে। আমার কাছে মনে হয় এইটাও তো একটা দেখার মত ব্যাপার যে স্টেইন এর মত মহীরুহ বেধড়ক পিটুনি খাচ্ছে। এই রকম কোণঠাসা অবস্থায় তার মত গ্রেট কিভাবে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে এইটা দেখতেও ভালো লাগে। আর এই ছার-ছয়ের ক্রিকেটের মধ্যেও কিন্তু স্টেইনের মত ক্লাস ঠিকই নিজের জাত চিনিয়ে দেয়। এই কয়দিন আগেও সদ্য শেষ হওয়া আইপিএল এ বিপক্ষ ব্যাঙ্গালোর এর মহাগুরুত্তপূর্ণ ম্যাচে ৪ ওভারে মাত্র ৮ রান দিয়ে ৩ উইকেট তুলে নিয়েছে স্টেইন। আবার এই একই প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে এর আগের ম্যাচে স্টেইনই ডুবিয়েছিল তার দলকে, সেইটা অবশ্য যত না তার ব্যর্থতা, তার চাইতে বেশি কৃতিত্ব দিতে হবে ব্যাটসম্যান দক্ষিন আফ্রিকারই অধিনায়ক এবি ডি ভিলিয়ারস এর। একটা ইয়রকার লেংথ এর বল অবিশ্বাস্য ভাবে ছয় মেরে হতভম্ব করে দিয়েছিল সবাইকে।

 

অনেকেই বলেন খুব বেশি চার-ছয় দেখতে ভালো লাগেনা। এই কথাটা আসলে সত্যি। মাঝে মাঝে যেমন খুব ব্যাটিং উইকেটে খেলা হতে পারে, ঠিক তেমনি মাঝে মাঝে খুব ব্যাটিংবন্ধুর উইকেটেও খেলা হয়। মাঝে মাঝে এরকম উইকেটে খেলা হলে ব্যাপারটা বিরক্তির পর্যায়ে যায়না কিন্তু ক্রিকেটের স্বার্থেই আসলে এমন পীচে খেলা উচিত যেখানে ব্যাট আর বলের একটা ভারসাম্য থাকে। টি২০ তে ১৩০-১৬০ রান আর টেস্ট ম্যাচে ১১০০-১২০০(চার ইনিংস মিলিয়ে) রানের পীচ গুলোই আসলে দর্শকদের জন্য সবচেয়ে আনন্দদায়ক। সবার কথা জানিনা কিন্তু আমার ক্যালিস এর কভার ড্রাইভ যেমন দর্শনীয় মনে হয়, ঠিক তেমনি গেইল এর ১০০ মিটার বা তার বেশি অতিক্রম করা দানবীয় ছক্কা দেখতেও ভালো লাগে। টি২০ এর পারফরমান্স যে ফ্লুক না, এইটা এই গেইল কে দেখলেই বুঝা যায়। গত ২ বছরে বিশ্বের যেখানেই টি২০ খেলতে গিয়েছে গেইল, সেখানেই পেয়েছে অবিস্মরণীয় সাফল্য। এমনকি হালের অস্ট্রেলিয়ার ডেভিড ওয়ারনার এর উত্থানও কিন্তু এই টি২০ এর হাত ধরেই। টি২০ তে অসাধারণ সব ইনিংস খেলে ওয়ান ডে দলে জায়গা করে নেবার পর এখন সে টেস্ট দলেও নিয়মিত এবং টেস্ট দলে এসেই নিউজিল্যান্ড এর বিপক্ষে অসাধারণ এক ইনিংস খেলে তার প্রতিভা বুঝিয়ে দিয়েছে। এই টি২০ আসার পরই কিন্তু আজকাল হরেক রকমের শট ব্যাটসম্যানদের খেলতে দেখা যায়। আগে হাতেগোনা কিছু ব্যাটসম্যান কে দেখেছি রিভার্স সুইপ বা স্কুপের মত ঝুঁকিপূর্ণ কিছু শট খেলতে। এখন প্রায় সব ব্যাটসম্যানই হরহামেশাই এই ধরনের শট খেলছে তো বটেই, পিটারসেন এর মত ব্যাটসম্যান সুইচ হিট এর মত অস্বাভাবিক শটও সৃষ্টি করেছে। শুধুই টেস্ট ক্রিকেট থাকলে এত ঝুঁকিপূর্ণ শট আমরা আদৌ দেখতে পারতাম কিনা সন্দেহ।

 

তবে সবচেয়ে যে কারণে আমার মনে হয় টি২০ বেশি জনপ্রিয়তা লাভ করেছে তা হলো খেলাটির জমজমাট অনিশ্চয়তা। অনেক টেস্ট ম্যাচই ৩ দিনের মধ্যে শেষ হয়ে যায়, এক দল আরেক দলকে ইনিংস ব্যবধানে হারায়। ওয়ান ডে ক্রিকেটেও অনেক ম্যাচই খেলা শেষ হবার অনেক আগেই ফলাফল নিশ্চিত টের পাওয়া যায়। এইটা দর্শকদের জন্য যেমন বিরক্তিকর, ঠিক তেমনি ব্যবসায়িক দৃষ্টিকোন থেকেও খুবই অলাভজনক। কিন্তু টি২০ এ ক্ষেত্রে একদমই ব্যতিক্রম। অনেক খেলাই শেষ ওভার পর্যন্ত তো যাচ্ছেই, এমনকি শেষ বল পর্যন্ত উত্তেজনা জমিয়ে রাখছে টি২০। এক ওভারের মধ্যে খেলার গতি-প্রকৃতি বদলে যাচ্ছে। সারা খেলা আধিপত্য বিস্তার করেও দেখা যায় শেষ ২ ওভার খুব বাজে করার জন্য ম্যাচ হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে।

 

বিশ্বায়নের এই যুগে ক্রিকেট যদি ১০ দেশের খেলার খোলস থেকে বের হতে চায়, তাহলে আসলে টি২০ এর কোন বিকল্প নেই। যদি কোন ফরম্যাট বাদ দিতেই হয়, সেইটা ওয়ান ডে ক্রিকেট। টেস্ট ক্রিকেট এক ধরনের স্কিলের পরীক্ষা নেয়, টি২০ আর এক ধরনের। এর মাঝে এখন ওয়ান ডে ক্রিকেটটাই আমার কাছে অপাংতেয় লাগে। এইটা মনে হয় আইসিসির লোকজনও টের পাচ্ছে, তাই ওয়ান ডে ক্রিকেট নিয়ে তারা গিনিপিগের মত পরীক্ষা নিরীক্ষা করছে, এত এত নিয়মনীতি এরা ২ দিন পর পর পরিবর্তন করছে যে ক্রিকেটের একনিষ্ঠ ভক্তের পক্ষেও এগুলো অনুসরণ করা কষ্টকর হয়ে পড়েছে। দুঃখের সাথে লক্ষ্য করছি প্রায় সব দেশের ক্রিকেট প্রশাসনই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ওয়ান ডে ক্রিকেটকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। ৫ টা/৭ টা অর্থহীন ওয়ান ডে খেলে কার কি লাভ হয় কে জানে। ৩ টার বেশি ওয়ান ডে রাখার কোন যুক্তিই আমি বুঝিনা, ওয়ান ডে কমিয়ে আন্তর্জাতিক টি২০ বেশি বেশি খেলা উচিত।

 

সব চাইতে বড় সমালোচনা টি২০ কে নিয়ে বোধ হয় আইপিএল এর উত্থান। এইটাকে ঠিক টি২০ এর সমালোচনা বলা যায়না, কিন্তু আইপিএল এর দেখাদেখি বিশ্বের সব প্রান্তেই এখন এমন ব্যাঙের ছাতার মত টি২০ লীগ গড়ে উঠছে যে এইটা নিয়ে কথা না বললে আসলে আলোচনাই অসমাপ্ত থেকে যায়। ব্যক্তিগত ভাবে আমার মনে হয় দূর ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কমে যাবে, এই টি২০ লীগ গুলোই আধিপত্য বিস্তার করবে সব খানে। খেলোয়াড়দের দোষ দিয়ে তো আর লাভ নেই। আপনি এখন যে চাকরি করছেন অন্য এক জায়গায় তার চাইতে কম পরিশ্রমে যদি কয়েক গুন বেশি টাকা পান, তাইলে ঠিক কয়জন বর্তমান চাকরিই করবে বলুন তো? তবে হ্যাঁ, কিছু কিছু ব্যাপার আসলেই বিরক্তিকর। ক্রিকেট খেলা তো বটেই, কোন খেলার মধ্যেই চিয়ার লিডার দের ঠিক কি দরকার পড়ল আমি আজ পর্যন্ত বুঝে উঠতে পারলাম না। এই সমস্যা অবশ্য আন্তর্জাতিক টি২০ তেও আছে। আর আইপিএল বা বিপিএল দুই লীগেই দেখা গেছে চরম অব্যবস্থপনা, উঠেছে দুর্নীতির অভিযোগ। এইসব অভিযোগ আর ভুল অবশ্য আন্তর্জাতিক ক্রিকেটেও দেখা যায়। ম্যাচ পাতানো, স্পট ফিক্সিং এর মত ঘটনার সূত্রপাত আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকেই, আবার ২০০৭ বিশ্বকাপ ফাইনাল অন্ধকারের মধ্যে শেষ করার মত বোকামিও আমরা দেখেছি। খেলোয়াড়দের চাইতে তাই বেশি দোষ আসলে ভয়াবহ রকমের অপরিণামদর্শী ক্রিকেট প্রশাসকদের। এরা ক্রিকেটকে মনে করছে সেই ইশপের গল্পের সোনার রাজহাঁস। সব দিক দিয়েই লাভবান হবার এই উদগ্র বাসনা থেকেই আজ এত সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে ক্রিকেটে। এরা আইপিএল, বিপিএল, পিপিএল চালিয়ে দু’হাত ভরে টাকা কামাবে, আবার খেলোয়াড়দের সারা বছর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটও খেলাবে। কারো ভালো লাগুক আর নাই লাগুক, যে পরিমাণ টাকার ছড়াছড়ি এই টি২০ লীগ গুলোতে, এরা ঠিকই টিকে থাকবে। তাই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের অহেতুক ৫/৭ টা ওয়ান ডে খেলা বন্ধ করতে হবে। আমার তো মনে হয় হয়ত এক সময় আন্তর্জাতিক টি২০ কিংবা ওয়ান ডে দুটোর একটাও থাকবেনা।

 

টিকে থাকবে এই টি২০ লীগ আর টেস্ট ক্রিকেট।