(আগের পর্বের পর…)

১.০ : ভারতীয় সাহিত্যে চার্বাক

চার্বাক দর্শন সম্পর্কে প্রকৃত ধারণা পাওয়ার ক্ষেত্রে সবচাইতে বড় অন্তরায় হচ্ছে চার্বাকদের নিজস্ব রচনাসম্ভার বা সাহিত্য সৃষ্টির কোন নমুনা আমাদের বর্তমান জ্ঞানজগতের আয়ত্তে না-থাকা। সেগুলো সম্পূর্ণ বিলুপ্ত। ফলে সম্পূর্ণতই অন্যের রচনার উপরই আমাদের নির্ভর করতে হয়। এক্ষেত্রে চার্বাক দর্শন সম্পর্কিত আমাদের ধারণার উৎস প্রধানত চার্বাক-বিরোধী তথা চার্বাকেতর ভারতীয় দর্শনের বিভিন্ন গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত চার্বাকী মতবাদের সমালোচনা- যেখানে চার্বাক সর্বদাই পূর্বপক্ষ হিসেবে উপস্থাপিত।
.
হয়তো চার্বাকী বক্তব্যের কেবল সেই অংশগুলিই অন্যের মারফৎ প্রচারিত হয়েছে যেগুলির বিরোধিতা বা খণ্ডনের নিমিত্তে অপরপক্ষ নিজ সিদ্ধান্ত স্থাপন করতে যুক্তি-বাণ মোকাবেলায় সক্ষম ছিলেন। ভারতীয় দর্শনের সব ক’টি বিভাগেই চার্বাক মত এভাবেই উপস্থাপিত হয়েছে। ফলে এখান থেকে আমরা হয়তো চার্বাকী দৃষ্টিভঙ্গিটা অনুমান করতে সক্ষম হই বটে, কিন্তু চার্বাক দর্শনের অবিকৃত পূর্ণাঙ্গ স্বরূপটা দৃশ্যের অন্তরালেই থেকে যায়।
.
ভারতীয় দর্শনমতের যে গ্রন্থগুলিতে কঠোর সমালোচনার সূত্র ধরে চার্বাক মতের অন্তর্ভুক্তি দেখা যায় তার মধ্যে নবম শতকের ন্যায়-দার্শনিক জয়ন্ত ভট্টের ‘ন্যায়মঞ্জরী’, অষ্টম শতকের দুই বৌদ্ধ আচার্য শান্তরক্ষিতের ‘তত্ত্বসংগ্রহ’ এবং কমলশীলের ‘তত্ত্বসংগ্রহ পঞ্জিকা’, অষ্টম শতকের জৈন দার্শনিক হরিভদ্র সুরীর ‘ষড়দর্শনসমুচ্চয়’, সপ্তম শতকের অদ্বৈত বেদান্ত দার্শনিক শঙ্করাচার্যের ‘সর্বসিদ্ধান্তসংগ্রহ’ ও ব্রহ্মসূত্রের (৩/৩/৫৩-৫৪) শাঙ্করভাষ্য, চতুর্দশ শতকের অদ্বৈত বেদান্তবাদী মাধবাচার্যের ‘সর্বদর্শনসংগ্রহ’ উল্লেখযোগ্য। এছাড়া অজ্ঞাতনামা লেখকের ‘সর্বমতসংগ্রহ’, চতুর্দশ শতকের বিদ্যারণ্যমুনির ‘বিবরণপ্রমেয়সংগ্রহ’, দ্বাদশ শতকের শ্রীহর্ষের ‘নৈষধচরিত’ (সপ্তদশ সর্গ) প্রভৃতি গ্রন্থেও চার্বাক সিদ্ধান্তের কিছু বর্ণনা রয়েছে।
.
এসব গ্রন্থে চার্বাক দর্শনের যে বিশিষ্ট রূপের প্রকাশ, সেই রূপেরই প্রতিফলন দেখা যায় ভারতীয় সাহিত্যের অন্যান্য বিভিন্ন স্থানে চার্বাক মতের বর্ণনায়। কোথাও ‘লোকায়ত’, কোথাও বা ‘বার্হস্পত্য’ সংজ্ঞায় পরিচিত, অনেক ক্ষেত্রে বিশিষ্ট কোন নামের স্বাক্ষর বহন না করেও বর্ণনাগুলি চার্বাকী মতের প্রতিফলন বহন করে। এই গ্রন্থগুলি ছাড়াও কৃষ্ণ মিশ্র রচিত একাদশ শতাব্দির ‘প্রবোধচন্দ্রোদয়’ নামক রূপক নাটকে সৃষ্ট চার্বাক চরিত্রের মাধ্যমেও চার্বাক মত সম্বন্ধে কিছুটা পরিচিত হওয়া যায়।
ভারতীয় দর্শন জগতে এই বিশেষ মতবাদ ‘চার্বাক’ সংজ্ঞার মাধ্যমে সুপরিচিত এবং চার্বাক দর্শন হিসেবে তা পরিজ্ঞাত।
.
তবে একটি মাত্র গ্রন্থ পাওয়া যায় যেটাতে চার্বাক মতের সিদ্ধান্ত বিচার উত্তরপক্ষ রূপে করা হয়েছে, তা হলো জয়রাশি ভট্ট (সম্ভাব্য ৭০০ খ্রী.) রচিত ‘তত্ত্বোপপ্লবসিংহ’। ১৯৪০ সালে বইটি মুদ্রিত আকারে প্রথম প্রকাশ করা হলে তা নিয়ে যথেষ্ট বিতর্কের তৈরি হয়। কেননা অন্যত্র সবখানেই চার্বাক দর্শনের যে ছবি আমরা দেখতে পাই, এ গ্রন্থে তার অন্যরূপ প্রতিফলন দেখা যায়। সমগ্র চার্বাক দর্শনের অংশমাত্রের পরিচায়ক হিসেবে ধারণা করা হয় বইটি হয়তো চার্বাকের কোন বিশেষ এক শাখার সিদ্ধান্ত, যাদেরকে কেউ কেউ বৈতণ্ডিক চার্বাক নামে আখ্যায়িত করেন।
.
কিন্তু কারো কারো মতে ‘তত্ত্বোপপ্লবসিংহ’ বইটি আদৌ চার্বাকী মতবাদী নয় বরং সর্বপ্রমাণবিরোধী সংশয়বাদের নিদর্শক গ্রন্থ বলে মন্তব্য করা হয়েছে। কারণ, বইটির প্রধানতম প্রতিপাদ্য হলো, প্রমাণমাত্রেরই খণ্ডন। ভারতীয় প্রতিটা দর্শনেই নিজ নিজ সিদ্ধান্তগুলিকে প্রমাণের নিমিত্তে নিজস্ব যুক্তির অনুকূলে ন্যায় বা তর্কশাস্ত্রীয় চর্চাটাকে খুবই গুরুত্বসহকারে উপস্থাপন করা হয়ে থাকে। এবং এসব যুক্তিশাস্ত্রে প্রমাণের স্বপক্ষে বিভিন্ন ধরনের প্রপঞ্চের আমদানি ঘটালেও প্রমাণ হিসেবে প্রত্যক্ষকে অতীব গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। আর ভারতীয় দর্শনের ইতিহাসে ন্যায়দর্শনেই প্রমাণ নিয়ে সবচেয়ে বেশি আলোচনা রয়েছে বলে ন্যায়দর্শন নামান্তরে প্রমাণশাস্ত্র হিসেবেই প্রসিদ্ধ। ন্যায়মতে প্রত্যক্ষই প্রমাণজ্যেষ্ঠ- অর্থাৎ প্রমাণের মধ্যে প্রত্যক্ষই হলো প্রথম বা সবচেয়ে সেরা বা সবচেয়ে মৌলিক। অন্যদিকে দার্শনিকদের মধ্যে অনেকেই একবাক্যে দাবি করেন যে, লোকায়ত বা চার্বাক মতে প্রত্যক্ষই একমাত্র প্রমাণ। অথচ জয়রাশি ভট্ট প্রথমেই দেখাতে চেয়েছেন যে প্রত্যক্ষ বলে আসলে কোনো প্রমাণই হতে পারে না। অর্থাৎ এক তূণে তিনি সকল তত্ত্ব বা দর্শনকেই উড়িয়ে দিচ্ছেন। উল্লেখ্য, বইটির নাম ‘তত্ত্বোপপ্লবসিংহ’ এর অর্থ হচ্ছে সোজা বাংলায়- সিংহের মতো দর্পে তত্ত্বমাত্রকে- অর্থাৎ সবরকম দার্শনিক মতকে- উপপ্লব বা উৎখাত করে দেবার দাবি।
.
দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গিতে চার্বাকেরা প্রত্যক্ষ-বাদী, সর্বপ্রমাণ-বিরোধী নয়। সর্বপ্রমাণ-বিরোধী হিসেবে যাঁরা ভারতীয় দর্শনে প্রসিদ্ধ তাঁরা আসলে চরম ভাববাদী, মোটেও বস্তুবাদী নন। এই চরম ভাববাদী দর্শনগুলির মধ্যে প্রসিদ্ধ দুটো হলো বৌদ্ধ দার্শনিক নাগার্জুনের (১৭৫ খ্রীস্টাব্দ) শূন্যবাদ এবং অদ্বৈত-বেদান্তী দার্শনিক শঙ্করাচার্যের (৭৮৮-৮২০ খ্রীস্টাব্দ) মায়াবাদ। এদিক থেকে দেখলে ‘তত্ত্বোপপ্লবসিংহ’-এর জয়রাশির অবস্থান আসলে বস্তুবাদের সম্পূর্ণ বিপরীত দৃষ্টিকোণযুক্ত অদ্বৈত-বেদান্ত ও বৌদ্ধ-শূন্যবাদের সঙ্গে একই পঙক্তিতে থাকার কথা। তাই জয়রাশি ভট্টের উদ্দেশ্য নিয়েও পণ্ডিতদের মধ্যে অস্পষ্টতা ব্যাপক।
এ প্রেক্ষিতে ‘তত্ত্বোপপ্লবসিংহ’ বইটি সম্পর্কে দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের বক্তব্য উল্লেখযোগ্য।

‘মনে রাখা দরকার, বইটির অভ্যন্তরীণ বিষয়বস্তু থেকে সম্পাদকরা এটিকে প্রসিদ্ধ চার্বাক বা লোকায়ত মতের পরিচায়ক বলে দাবি করেননি। করা সম্ভবও নয়। শুরুতেই গ্রন্থকার বলছেন, সাধারণ লোকের মধ্যে প্রসিদ্ধি আছে যে মাটি, জল, আগুন, বাতাস- এগুলিই মূল সত্য। কিন্তু দার্শনিক বিচারের ধোপে তাও টেকে না ! তার মানে প্রসিদ্ধ চার্বাক মত বর্জন থেকেই বই-এর শুরু। গ্রন্থশেষে জয়রাশি আস্ফালন করে বলেছেন, স্বয়ং দেবগুরু বা বৃহস্পতির মাথাতেও যা আসেনি তা এই পাষণ্ডদর্পচ্ছেদনের বইতে ব্যাখ্যা করা হলো। বৃহস্পতি-মতের কোনো প্রকৃত সমর্থকের পক্ষে এমন আস্ফালন সহজবোধ্য নয়, কেননা গুরুমারা বিদ্যের স্থান আর যেখানেই থাকুক না কেন, অন্তত ভারতীয় দার্শনিক ঐতিহ্যে থাকতে পারে না। বরং, প্রতিটি দার্শনিক মতের প্রকৃত প্রবক্তারা পরের যুগে কোনো নতুন কথা বলার সময়ও যেন-তেন-প্রকারেণ কথাটা সম্প্রদায়-প্রবর্তকের প্রকৃত অভিপ্রায় বলেই প্রচার করতে চান। পাষণ্ডদর্পচ্ছেদনের ব্যাপারটাও উড়িয়ে দেবার মতো নয়। কেননা ভারতীয় দার্শনিক সাহিত্যে প্রচলিত রকমারি গালিগালাজের মধ্যে ব্রাহ্মণেরা বৌদ্ধদের পাষণ্ড আখ্যা দিয়ে সন্তোষ লাভ করলেও, ব্রাহ্মণ-বৌদ্ধ উভয়ের পক্ষেই চার্বাককে সমস্বরে পাষণ্ডশিরোমণি হিসাবেই দেখবার কথা।
তাহলে বইটিতে চার্বাক-প্রবণতার পরিচয় শুরুতেও নেই, শেষেও নেই। আরো বড় কথা হলো, বইটির প্রধানতম প্রতিপাদ্য-বিষয়ের মধ্যেও নয়। ‘তত্ত্বোপপ্লবসিংহ’ অবশ্যই সহজপাঠ্য বই নয়; যুক্তিতর্ক-কণ্টকিত রীতিমতো কঠিন বই। তবুও সাধ্যমতো সহজ করে এবং সংক্ষেপে তার সারমর্ম বলে রাখা দরকার।
জয়রাশি কী করে দেখাতে চান যে কোনো রকম দার্শনিক মতই স্বীকারযোগ্য নয় ? সংক্ষেপে তাঁর বক্তব্য এই : যে-কোনো দার্শনিক মত বা তত্ত্ব হোক না কেন, স্বীকারযোগ্য হতে গেলে তার পক্ষে তো প্রমাণ থাকা দরকার। অথচ বিচার করলে বোঝা যায় যে, কোনো রকম তথাকথিত প্রমাণেরই প্রামাণ্য- বা প্রমাণ করার যোগ্যতা থাকতে পারে না। ভারতীয় দর্শনের ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ, অনুমান, প্রভৃতির প্রমাণ হিসেবে প্রসিদ্ধি আছে। কিন্তু জয়রাশি দেখাতে চান, সে-প্রসিদ্ধি আসলে অলীক, কেননা নামে প্রমাণ হলেও এগুলি সবই আসলে অসার; কোনোটিকেই প্রমাণ বলা যায় না। আর প্রমাণ বলেই যদি কিছু না থাকে তাহলে কোনো রকম দার্শনিক মত বা তত্ত্ব স্বীকার করার কারণও থাকতে পারে না। অতএব ‘তত্ত্বোপপ্লবসিংহ’- সিংহদর্পে সর্বতত্ত্বের উপপ্লব বা উৎখাত।’ (সূত্র : ভারতে বস্তুবাদ প্রসঙ্গে, পৃষ্ঠা-২৯)।

.
অতএব ‘তত্ত্বোপপ্লবসিংহ’ গ্রন্থটিকে চার্বাক মতের গুরুত্বপূর্ণ দলিল হিসেবে বিবেচনা করা হবে কিনা তা প্রয়োজনীয় পর্যালোচনার দাবি রাখে হয়তো।
.
এছাড়া কৌটিল্যের ‘অর্থশাস্ত্র’র মতো কিছু প্রাচীন গ্রন্থে এবং প্রাচীনকাল থেকে প্রচলিত কিছু লোকগাথায় চার্বাক মতের বিশেষ বিশেষ দিক সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। তাই চার্বাকমতের একটা পুনর্গঠিত রূপের ধারণা পেতে আমাদেরকে মূলত যেসব সাহিত্য-উপাদানের উপর নির্ভর করে আগাতে হয়, তা হলো-

(১) প্রামাণিক বিবেচনায় প্রাচীন গ্রন্থাবলি,
(২) সম্ভাব্য প্রামাণিক হিসেবে প্রাচীনকাল থেকে প্রচলিত কিছু লোকগাথা, এবং
(৩) প্রাচীন ভারতীয় দর্শনের চার্বাক বিরোধী পক্ষের রচনায় পূর্বপক্ষ হিসেবে চার্বাক বা লোকায়ত বর্ণনাগুলি- যেখানে পরমত খণ্ডনের প্রথা অনুযায়ী প্রথমে পূর্বপক্ষ হিসেবে সে মতটা আসলে কী তা ব্যাখ্যা করে পূর্বপক্ষের সমর্থনে সম্ভাব্য সব যুক্তি দিয়ে তা যথাসম্ভব স্থাপন করে নেয়া হয়, যাতে পরবর্তীতে তা উত্তরপক্ষের যুক্তিবিস্তারে খণ্ডন করা হলে কেউ যেন ওটার সমর্থনে মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে।

.
উল্লেখ্য, চার্বাকদের নিজস্ব রচনা বিষয়ক কোন বিশ্বস্ত দলিল প্রামাণ্য হিসেবে সুনির্দিষ্ট না থাকায় বিভিন্ন উপাদান নির্ভর অনুমানগুলোও ব্যক্তিভেদে ভিন্ন ভিন্ন হতে দেখা যায়। ফলে বিভিন্ন বিদ্বান ও দার্শনিকদের মধ্যেও চার্বাক নিয়ে মতান্তরের অন্ত নেই। আর এতোসব মতান্তরের কারণেই হয়তো চার্বাক দর্শন নিয়ে কোন কালেই কৌতুহলি গবেষকদেরও আগ্রহের কমতি দেখা যায়নি। রহস্যময় বিচিত্র বিভ্রমের তুঙ্গে থেকে সেই প্রাচীন কাল থেকে আজতক মুক্তচিন্তক ভাবুকদের জন্য চার্বাক দর্শন এক অনন্য সাধারণ দর্শন হিসেবে দার্শনিক চিন্তা জগতে ক্রমাগত ঢেউ তুলে যাচ্ছে। এই ঢেউগুলো তো এমনি এমনি তৈরি হয়নি। এর পেছনে রয়েছে বহু প্রশ্ন আর উত্তর খোঁজার এক দীর্ঘ ধারাক্রম। আর এই একই ধারায় এগিয়ে যেতে যেতে আমাদেরকেও জেনে নিতে হয় চার্বাক সংশ্লিষ্ট বেশ কতকগুলো বিষয়ে আপাত সিদ্ধান্তে— উপনীত হওয়ার সন্তোষজনক ব্যাখ্যা ও এর রূপরেখাসমূহ।

(চলবে…)

[আগের পর্ব: ভারতীয় দর্শনের সাধারণ বৈশিষ্ট্য] [*] [পরের পর্ব: চার্বাক নামের উৎস]