[মডারেটরের নোট – অধ্যাপক অজয় রায়ের এ লেখাটি মা দিবসের জন্য লিখিত হয়েছিলো। কিন্তু আমাদের কাছে  একটু বিলম্বে এসে পৌঁছায়।  প্রকাশিত হতে আরো কয়েকদিন বিলম্ব হল। অনিচ্ছাকৃত এ বিলম্বের জন্য আমরা দুঃখ প্রকাশ করছি]

:line:

বাংলা পঞ্জিকা অনুযায়ী বর্ষান্তের চৈত্র মাসের শেষ দিনকে অভিহিত করা হয় চৈত্র সংক্রান্তি নামে। সাধারনভাবে শেষ দিনটি হয়ে থাকে ৩০শে চৈত্র। বাংলা একাডেমী সংস্কারায়িত বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী বছরের প্রথম পাঁচ মাস (বৈশাখ – ভাদ্র) গণনা করা হয় ৩১ দিনে, বাকী ৭ মাস ৩০ দিনে। সে হিসেবে ৩০শে চৈত্রকে ধরা হবে চৈত্র সংক্রান্তি। অন্যদিকে ভারতীয় বাংলা পঞ্জিকাকারগণের পুরানো হিসেব মতে দিনটির তারতম্য হতে পারে, আবার মিলেও যেতে পারে কাকতালীয়ভাবে। যেমন ১৪১৪ সালের লোকনাথ ডাইরেক্টরী মতে চৈত্র মাস ত্রিশ দিনের বাংলা একাডেমীর সাথে একই দিনে পড়েছে (১৩ই এপ্রিল ২০০৮ রবিবার)। এবার অর্থাৎ ১৪১৮ সালের ৩০শে চৈত্র পড়েছে ১৩ই এপ্রিলে তবে বারটি হচ্ছে শুক্রবার। আমাদের সংস্কারায়িত বর্ষপঞ্জির বিশেষত্ব হচ্ছে অধিকাংশ গুরুত্বপূর্ণ দিবসগুলির সাথে গ্রেগরীয় ক্যালেন্ডারের সাথে প্রাষঙ্গিকতা বজায় থাকে। এর ফলে পশ্চিমবঙ্গে প্রচলিত অনেক বাংলা ক্যালেন্ডারের সাথে আমাদের দিনের কোন কোন সময় ব্যতয় ঘটে। তবে সংস্কারায়িত শকাব্দের সাথে খুব একটা বিরোধ ঘটে না, কারণ এটি সংস্কারায়িত হয়েছে ড. মেঘনাদ সাহার বৈজ্ঞানিক সুপারিশ ক্রমে যা বাংলা একাডেমীও গ্রহণ করেছিল আমাদের বর্ষপঞ্জি সংস্কার কালে। আমাদের সাথে পশ্চিম বঙ্গীয় বাংলা পঞ্জিকার বড় অনৈক্য ঘটেছে ১লা বৈশাখের প্রাতিষঙ্গিকতাকে কেন্দ্র করে – ওরা ১লা বৈশাখ করে অধিকাংশ সময় ১৫ই এপ্রিলে আবার কখনও পালন করে ১৪ই এপ্রিলেও,  আর আমরা সব সময় করে থাকি ১৪ই এপ্রিলে প্রতি বছর। এর ফলে পশ্চিমবঙ্গের সাধারন নাগরিকেরা বিভ্রান্ত হয়। তবে বৃহত্তর স্বার্থে এটুকু অসামঞ্জস্য আমাদের মেনে নিতে হয়েছে। তারতম্যের আরও কয়েকটি নমুনা দিই  –

হিন্দুরা এ দিনটিকে অত্যন্ত একটি পুন্যদিন বলে মনে করে। এছাড়া সাধারনত এই বসন্তকালে বাসন্তী দেবী ও অন্নপূর্ণাদেবীর পূজা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। হিন্দু পঞ্জিকা মতে দিনটিকে গণ্য করা হয় মহবিষুব সংক্রান্তি নামে। হিন্দুরা পিতৃপরুষের তর্পন করে থাকে, নদীতে বা দিঘীতে পুন্যস্নান করে থাকে।

ছোটবেলায় দেখেছি আমাদের পরিবারে মহা ধুমধামের সাথে চৈত্র সংক্রান্তি পালিত হত। ব্রাহ্মমুহূর্তে উঠে পিতৃদেব নদীতে পুন্য স্নান সেরে সূর্য উপাসনা করতেন, পিতৃপুরুষের উদ্দেশ্যে স্মৃতি তর্পন করতেন অনেক্ষণ ধরে। অনেক হিন্দুকে দেখেছি পিতৃপুরুষের উদ্দেশ্যে পিন্ডিদান করতেও। মা সকাল থেকেই স্নান সেরে সুন্দর শাড়ী পড়ে নানা ধরনের সুন্দর সুন্দর রান্নার আয়োজনে ব্যস্ত হয়ে পড়তেন। সংক্রান্তির আগের দিন রাতভর নানা মিষ্টি, বিশেষ ধরনের পিঠা, খৈ, মুড়ি আর তিলের ও চিড়ের লাড়– তৈরী করতেন। সকালে চমৎকার লাল-শাড়ী পড়া মাকে অপূর্ব সুন্দরী মনে হত। আমরা মার আশে পাশে ঘুরঘুর করতাম মিষ্টি আর মিষ্টান্নের লোভে। প্রসন্নময়ী মা আমাদের নিরাশ করতেন না। বিতরণ করতেন দরাজ হাতে।

আমার দাদা বলে উঠতেন ‘মা প্রতিদিন তুমি এত সুন্দর হতে পার না, হতে পার না এরতম দয়াময়ী।’ মা কৃত্রিম রাগে দাদাকে বকতেন, আর পরক্ষণেই চুমুতে ভরে দিত দাদার মুখ। আমরাও বঞ্চিত হতাম না মায়ের সুখস্পর্শ থেকে। বাবার পিতৃব্য সংক্রান্তির দিন সকালে স্নান সেরে মাকে প্রথমেই কাছে ডেকে এনে মাথায় হাত রেখে অনেকক্ষণ ধরে কী সব মন্ত্র আউড়িয়ে মাকে আশীর্বাদ করতেন। প্রতি বছরই এই ছবির পুনরাবৃত্তি ঘটত। মা তাঁকে ভক্তি ভরে প্রণাম সারলে ঠাকুর্দা বলতেন ‘মা তোমাকে আজ দেবী অন্নপূর্ণার মত সুন্দরী লাগছে। তারপর চিবুক ছুয়ে বলতেন, ’চিরআয়ুস্মতী ভব’। গৌড়বর্ণা মা লাজে আরও রক্তিম হতেন। মা’ই ছিলেন আমাদের কাছে সকল আনন্দের, সকল সুখের কেন্দ্রবিন্দু। বাবা অনেকটাই দূরের মানুষ ছিলেন, স্নেহ পরায়ণ হলেও।

মা সেদিন অনেক ধরনের ব্যঞ্জনাদির সাথে অনেক পদের শাক রান্না করতেন। অনেকগুলি শাকই থাকত ওষুধি গুণযুক্ত। মা এসব কোত্থেকে শিখেছিলেন জানি না, অথচ তাঁর শ্বাশুড়ী, মা এই পরিবারে পুত্রবধূ হয়ে আসার ২-৩ বছরের মধ্যে মারা যান, প্রশিক্ষণ পাওয়ার খুব সুযোগ পেয়েছিলেন বলে মনে হয় না। মার মুখেই শুনেছি, মা যখন এ সংসারে এলেন তখন ছিলেন অষ্টাদশী। মা একদিন গল্পচ্ছলে আমাদের ভাইবোনদের বলেছিলেন, ‘জানিস, আমি যখন এ সংসারে এলাম কালাজ্বর থেকে সদ্য সেরে ওঠা, আমার গাত্রবর্ণ দেখে শ্বাশুরী-ননদদের মুখ আমার আপাত কালো বর্ণের চেয়েও কালো হয়ে উঠেছিল।’ এই বলে মা হাসিতে লুটিয়ে পড়তেন। তারপর প্রসাধন চর্চায় কালাজ্বরের প্রভাবে ‘কালাভাব’ ২-১ মাসের মধ্যে সরে গিয়ে মা তাঁর আদি গৌড়বর্ণ ফিরে পেলে, তখন পরিবারের মেয়ে-সদস্যদের হাসি দেখে কে, এই বলে মা আবার হাসিতে গড়িয়ে পড়তেন। আমরা আনন্দে হাততালি দিয়ে উঠতাম।

চৈত্র সংক্রান্তির দিনে আমাদের  বাসায় একটি রীতি ছিল সেদিন সকালে আমরা সবাই প্রাতঃরাশ শুরু করতাম নানা ধরনের ছাতু খেয়ে। ছাতুর গোল্লা তৈরী হত গুড়, দৈ বা দুধের মিশ্রণে, অনেক সময় কলাও মেশানো হতো। দাদা ও আমার ঠাকুরদার চাহিদা ছিল এর সাথে অতি অবশ্য গুড়ের সন্দেশ থাকতে হবে। আমরা তৃপ্তির সাথে খেতাম। ছাতুর প্রকার ছিল – ছোলা বা বুট, পয়রা বা যব, মাকই বা ভুট্টা এবং সুগন্ধী চালের গুড়ো দিয়ে তৈরী ছাতু। মা এতো সব কখন বানাতেন আমরা বুঝতে পারতাম না। মার অবশ্য একজন সার্বক্ষণিক বালবিধবা সহায়িকা ছিলেন, যাকে আমরা ডাকতাম ‘তনু দি’, আর এক জন পরুষ সহায়ক ছিলেন- মার সাথে পিত্রালয় থেকে আসা নেপালী সহচর ‘বুনিয়াদ সিং‘। আমরা সিং কাকু ডাকতাম। তার কাছে আমাদের সবচাইতে আকর্ষণীয় একটি দ্রব্য ছিল তীক্ষ্ণধার ‘ভোজালী’।

এ দিন আর একটি রীতি পালন করা হতো বেশ নিষ্ঠার সাথে। তা’হলো, নান প্রকারের ওষুধি গাছের পাতা ও শিকড় একত্রে বেধে সুতো দিয়ে প্রতিটি ঘরের দরজার মাথায় ঝুলিয়ে দেয়া হতো এক বছরের জন্য। এ সব সংগ্রহে মাকে সহায়তা করতো সিং কাকু, নানা বনজঙ্গল ঘেটে তিনি সংগ্রহ করতেন। অবশ্য বাবারও এ ব্যাপারে খুব উৎসাহ ছিল। আমরাও প্রবল উৎসাহে গাছ গাছালি সংগ্রহে লেগে যেতাম। এক ধরনের ছোট গাছের কথা আমার এখনও মনে আছে – তাকে আমাদের অঞ্চলে বলা হতো ‘বিষ কুটুলি’। তা ছাড়া থাকত নিমের পাতা, হলুদ গাছের চাড়া, রসুনের গাছু বা পাতা। যত্নের সাথে ঝোলানোর পর, মা দরজার ওপরের আনুভূমিক কাঠটির মাঝখানে, পাঁচটি করে সিন্দুর আর চন্দনের ফোটা লাগিয়ে দিতেন সুন্দর করে। আর থাকতো স্বস্তিকা চিহ্ণ হিন্দুর সব অনুষ্ঠানে মঙ্গলের প্রতীক রূপে। তাছাড়া বাড়ির মেঝেতে আঁকা হতো জল মিশ্রিত চালের গুড়ো দিয়ে শ্বেত শুভ্র ‘আলপনা’। সেদিন দুপুরে নানা পদের নিরামিষ দিয়ে আমাদের চমৎকার দ্প্রিাহরিক ভোজন সমাপ্ত হতো। কিছু অতিথি সব সময় থাকতেন। এ সবের পেছনেই থাকতো মার ভূমিকা। মাকে কেন জানি আমার মনে হতো দশভূজা দুর্গা। সবদিক থেকেই আমাদের পরিবারটিকে মনে হতো যেন একাই রক্ষা করে চলেছেন। মা যেদিন আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন, শয্যাপার্শে আমি ছাড়া কেউ ছিলেন না, পিতৃদেব কয়েক বছর আগেই চলে গেছেন, – যখন বললাম ‘মা আমাদের কে দেখবে ?‘ বাকরুদ্ধ মা কেবল মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করলেন। সেই জগজ্জননী মাকে আমার বারবার মনে পড়ে চৈত্র সংক্রান্তি এলে। পরিবর্তিত পরিবেশে, নাগরিকতার চাপে আমরা আর কেউ সেদিনের মত চৈত্রের শেষ দিনে মহাবিষুব সংক্রান্তি উৎসব পালন করতে পারি না।

চৈত্রের শেষ দিনে আমাদের আর একটি আকর্ষনীয় দর্শনী ছিল একটি খোলা মাঠে অনুষ্ঠিত চড়ক পূজো। একটি সুউচ্চ বাঁশের পোলের উপরে স্থাাপিত আর একটি আনুভূমিক বাশের লিভারের এক প্রান্তে একটি জলজ্যান্ত মানুষের পিঠে বড়শির হুক দিয়ে আটকিয়ে তাকে ঝুলিয়ে দেয়া হত- আনুভূমিক বাশটির অন্য প্রান্তটি দিয়ে ঝুলন্ত মানুষটিকে বন বন করে ঘোরানো হত। আমরা বিস্ফারিত লোচনে অবাক হয়ে দেখতাম আর ভয়ে শিহরিত হতাম। সে এক ভয়ানক রোমঞ্চকর অনুভূতি।

চৈত্র সংক্রান্তির একটি জ্যোতির্বৈদ্যিক দিক আছে। তবে আজকের আলোচনায় সে প্রসঙ্গ টানব না। অন্য একদিন আলোচনা করব। আজকের এ লেখাটি এবারের ’মাতৃ দিবসে’ আমার স্মৃতির উদ্দেশ্যে নিবেদিত শ্রদ্ধাঞ্জলি।