(এটি কোনভাবেই কোন মৌলিক লেখা নয়, তবে এটিকে অনুবাদ কর্মও বলা যাবে না, বরং গবেষকদের একাধিক রচনা থেকে পাওয়া ধারণাগুলিকে সংক্ষেপে একত্রীকরণের চেষ্টা, নিউ সায়েনটিস্টের সাম্প্রতিক “God Issue” কে প্রধান রেফারেন্স হিসেবে গণ্য করতে হবে)

এক গবেষণায় দেখা গেছে লাল ছোপ দেয়া হলুদ একটা কাঠিকে যদি গাঙচিল শাবকদের কাছ ধরা হয়, তারা ঐ কাঠিটাকেই তাদের মায়ের ঠোঁট ভেবে বসে। যে ব্যাক্তি কোন দিন জানে না, ধূমকেতু কি জিনিস, সে আকাশে হঠাৎ ধূমকেতু দেখলে, প্রথম বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে সেটিকে মহাজাগতিক ঝাড়ু ভেবে বসতেই পারে। মহাজাগতিক ঝাড়ু ভাবাতে দোষ নেই, কিন্তু রূপকথার ডাইনির ঝাড়ু ভেবে নিলে? বোধশক্তিযুক্ত প্রাণী মাত্রেই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য যে কোন বস্তুকে চেনার চেষ্টা করবে। শিশু অবস্থা থেকেই মানুষ শুধু দৃশ্যমান বস্তই নয়, অবস্তু বা বিমূর্ত ধারণাগুলিকেও চিনতে শুরু করে। কোন অচেনা বস্তু/অবস্তু ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য কিংবা চিন্তার অন্তর্ভুক্ত হওয়া মাত্রই সেটিকে শ্রেণীভুক্ত করে, বা অনুমান করতে চায়। জগত সম্বন্ধে, ইন্দ্রিয় সমূহ কিংবা বোধের মাধ্যমে প্রাপ্ত জগতের ধারণার সম্বন্ধে সম্যক ব্যাখ্যা চায়। এর সাথে মানুষের ধর্ম / ঈশ্বর চিন্তার যোগ আছে কি?

শিশু অবস্থায় মানুষের মধ্যে খুব দ্রুত কোন কিছু চিনে ফেলার একটা প্রবণতা থাকে। এর ফলে আমরা খুব দ্রুতই আমাদের জগত সম্বন্ধে ধারণা পেতে শুরু করি। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, ধর্ম কিংবা ঈশ্বর সম্বন্ধে ধারণাগুলিও দেয়া হয় সেই বাচ্চা বয়স থেকেই? বিজ্ঞানীদের মতে আমাদের বেশির ভাগ “জন্মসূত্রে বিশ্বাসী”। কিছু কু-বিজ্ঞানী বলতে চেষ্টা করেছিলেন, মানুষে তার জিনের মধ্যেই ধর্ম বিশ্বাস নিয়ে আসে, “ঈশ্বর জিন”/ “the god gene” – সুন্দর একটা নামও দেয়া হয়েছিল। আমি অবশ্য ভেবেছিলাম জেনেটিক কোডের মধ্যে যীশুর ছবি পাওয়া গ্যাছে। যাই হোক, ভুয়া বায়োলজিস্টের ভাওতাবাজি না, কথা হচ্ছে মনোবিজ্ঞানীদের নিয়ে। নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী ড্যানিয়েল কানেম্যানের মতে, শিশু অবস্থায় এমন বোধশক্তির(cognitive system) সেইসব অংশ খুব দ্রুত বেড়ে ওঠে, যেগুলিকে বলা হয়, “maturationally natural”। এগুলির প্রভাবে একটা শিশু খুব সহজেই শিখে ফেলে কোনটা জড় বস্তু আর কোনটা নিজে থেকে নড়ে, কোনটা মানুষের মুখ, কোন মানুষের কণ্ঠস্বর ইত্যাদি ইত্যাদি।

মানুষ একেবারে শৈশব থেকেই, মোটামুটি ভাবে বলা যায় তার বোধশক্তি গড়ে উঠার প্রাথমিক স্তরেই, এই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য(perceivable অর্থে) জগত সম্বন্ধে এক ধরণের কৌতুহল অনুভব করে, যার ফলে এর মধ্যে এক ধরণের বিন্যাস/নিয়ম (Design/Order) খুঁজতে আগ্রহী হয়। অন্তত কোন একটা উদ্দেশ্য(purpose) খুঁজতে চায়। দেখা গেছে, একজন প্রাপ্তবয়স্ক বোধ সম্পন্ন মানুষের যেসব মৌলিক বিবেচনা থাকে তার প্রায় সবই একটা মানব শিশুর মধ্যেই বিদ্যমান। ঈশ্বর যদি থেকে থাকে তা এমন একটা কিছু যা কিনা এই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগতের সবকিছু থেকে আলাদা, সর্বশক্তিমান, সর্বজ্ঞ, শ্বাশ্বত এরকম কিছু। শিশু অবস্থায় একটা মানুষের পক্ষে তার আশে পাশের ইন্দ্রিয় গ্রাহ্য জগতের মধ্যে এইরূপ একটা সর্বশক্তিমান/সর্বজ্ঞ কোন সত্তার(agent) উপস্থিতি সম্পর্কে অনুমান করা কি সম্ভবপর? এরপর আরো আছে, এসবের সাথে জগতের সৃষ্টিপ্রশ্ন, উদ্দেশ্য ইত্যাদির মতন আপাত কঠিন দার্শনিক বিষয়সমূহ।

বিভিন্ন সংস্কৃতির বাচ্চাদের মধ্যে গবেষণা করে গেছে, এমন কিছু ব্যাপারে, যা তারা ঠিক ভাবে জানে না, বা করতে পারে না, তখন তারা এমন কিছু সত্তার নাম করেছে, যারা এগুলি জানে বা করতে পারে। অর্থাৎ সর্বজ্ঞ এক প্রকারের সত্তার অস্তিত্ব আছে, এমনটা চিন্তা করতে তারা সক্ষম। ফলে ছোট থেকেই যখন তাদের কে রুটি দেবতা কিংবা সাপমুখো ঈশ্বর, কিংবা অন্যান্য ঐশ্বরিক/অলৌকিক কল্পনার/ধারণার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়, তখন তারা সেগুলিকে গ্রহণ করে। তারা ভাবতে চায়/এটা ভাবতে সক্ষম কিংবা বলা যায় এরকম ভেবে থাকে, যে ব্যাপারটা তারা জানে না, বা করতে পারে না, সেটা এমন কেউ আছে যে জানে কিংবা পারে। ঠিক একই কারণে তারা রূপকথার গল্প শুনতে ভালোবাসে, যেখানে ইভান নামের এক বালক সমুদ্রের নিচে গিয়ে অনন্ত বসন্ত লাভ করে। একই ভাবে বিশ্বাস করে যখন বলা হয় মিশরের রাজপুত্র মুসার সাগর ভাগ করার কথা কিংবা বোরাকে করে ইসলামের নবীর মহাকাশ ভ্রমণের কথা। তবে এটা ঠিক এই সর্বজ্ঞ/সর্ববিদ্যাবিশারদ সত্তার স্থান টিকে তারা সবসময় “ঈশ্বর” দিয়ে পূরণ করে না। যেমন কারো কারো ক্ষেত্রে হয়ত, “আমার মা সব জানে”, বা “আমার বাবা সব পারে” এই পর্যন্তই।

সর্বজ্ঞতা/সর্বশক্তিমান হওয়া ছাড়া বিভিন্ন ধর্মে ঈশ্বর/দেবতার আরেকটা বিশেষ গুণ থাকেঃ তা হলো অমরত্ব বা শ্বাশ্বত সত্তার ধারণা। এই ব্যাপারেও শিশুদের বেশ সরলীকৃত একটা ঝোঁক থাকে- তারা ধরেই নেয় বাকী সব সত্তা অমর। ফলে শিশুদের ধর্মে দীক্ষিত করার জন্য তেমন বেগ পেতে হয় না, এই বিকাশমান অবস্থায় তাদের মধ্যে কাছাকাছি প্রবণতা স্বাভাবিকভাবেই থাকে। আর এই প্রবণতাকে অনেক গবেষক নাম দিয়েছেন, “natural religion”, যা কিনা যে কোন প্রকার যদু-মদু-কদু ধর্ম থেকে সম্পূর্ণভাবেই আলাদা। ফলে “জন্মসূত্রে বিশ্বাসী” শব্দবন্ধকে প্রচলিত ধর্মের অর্থে নিলে হবে না। জেনেটিক কোডে শ্রীকৃষ্ণ/যীশু/আল্লাহ লেখা থাকার সম্ভাবনা নাই।

এখন প্রশ্ন হতে পারে, ঈশ্বরচিন্তা কি তাহলে শিশুসুলভ? শিশু বয়সে পাওয়া ধারণা কি একজন প্রাপ্তবয়স্ক ছুড়ে ফেলে দিবে না? কিংবা ঐ সাপমুখো দেবতা কিংবা, রূপকথার গল্পের ইদূরখেকো ডাইনী/ভুত-পরীদের সাথে ইশ্বরধারণার পার্থক্যই বা রইলো কোথায়? বেড়ে উঠার সাথে সাথে সে যখন বৈজ্ঞানিক গবেষণার ফলাফলগুলি পাবে, সেগুলির সাথে সাপমুখো দেবতার যে সহাবস্থান ঘটেনা এটি আবিষ্কার করার পর কোন বোধশক্তিসম্পন্ন মানুষ অবশ্যই সাপমুখো দেবতা/ ইত্যাদিকে ছুড়ে ফেলে দিতে পারে। ছোট্ট বাচ্চাটা বিশ্বাস করে, সান্তা ক্লজ সত্যিই তার মোজার মধ্যে বালিশের গোড়ায় তার জন্য উপহার রেখে যান। কিন্তু কোনদিন হয়তো সে জেনে যায় এটি করেন আসলে তার পিতা। এতদ সত্ত্বেও দেখা গেছে অনেকেই শিশু বয়সে এই সব ধারণা, যেগুলিকে তারা গ্রহণ করেন নি পূর্ণবোধশক্তি সম্পন্ন হবার পরে সেগুলিরই দ্বারস্থ হচ্ছেন।

ধর্ম কিংবা বিজ্ঞান কোনোটাই কি এইসব ধারনাগুলিকে নিয়ে কালক্ষেপণ করে? আমাদের এদিকে দর্শনের সাথে ধর্মের সম্পর্ক অনেক প্রগাঢ় বলেই মনে হয়, ব্রাট্রান্ড রাসেলের এক লেখায় পেয়েছিলাম, দর্শনের অবস্থান এই দুটোর মাঝামাঝি। এই মাঝামাঝি কাজটা আসলে করে থিওলজি(theology)। থিওলজির কাজ হলো ধর্মীয় আজগুবি ধারনা ও দাবিগুলির তত্ত্বীয় দিকটা নিয়ে কাজ করা, যাতে বোধশক্তিসম্পন্ন মানুষের মধ্যে তৈরী হওয়া দ্বন্দ্বসমূহের মোকাবিলা করা সম্ভবপর হয় যৌক্তিকভাবে। উদাহরণ স্বরূপ, “ঈশ্বরের ত্রিমূর্তি ধারণা”, কিংবা “ইশ্বর সর্বভূতানাং(panentheism)” এইগুলি বোঝার জন্য সাধারণ মানুষকে একটু বেগ পেতে হয় বৈকি। এজন্যই দরকার পরে থিওলজি। তাহলে কি বেশিরভাগ ধর্মে যেগুলি টিকে আছে এই তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব মোকাবিলা করে? থিওলজিই কি তাহলে মানুষকে ধর্মের পথে টিকিয়ে রেখেছে। আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি, বেশির ভাগ মানুষের মধ্যে যে ধর্ম বিশ্বাস কাজ করে তা হলো ধর্মের জনপ্রিয় ভাষ্য। তারা কান দিয়ে শোনে ধর্মের তত্ত্বীয় ব্যখ্যা-ভাষণ কিন্তু মনে প্রাণে মানে ও পালন করে জনপ্রিয় ধারাটিকেই। হিন্দি সিনেমার আইটেম গানে নায়িকার শীর্ণ কটিদেশের মতন, সেইসবের দিকেই তারা আকৃষ্ট হয় বেশি। কারণ থিওলজিক্যাল দ্বন্দ্ব মোকাবিলা করে ধর্ম পালন কষ্টসাধ্য বটে। এই খানে দুনিয়ার বেশিরভাগ ধার্মিক সুবিধাবাদী।

অপর দিকে অনেক পাঁড় নাস্তিকের অন্ধ দাবি, বিজ্ঞান একদিন এই সব ধর্মগুলিকে উড়িয়েই দিবে। বিবর্তনবাদ কিংবা এরকম আরো আবিষ্কারগুলি তাদের এইসব ধারণার মূলে। অথচ জনপ্রিয় ধর্মবিশ্বাস মতে বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারগুলি ধর্মের জন্য কোন প্রকারের হুমকি নয়। (যেসব ধর্ম বিশ্বাস বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারকে অস্বীকার করে সেগুলি অনির্নায়ক) সব মিলিয়েই পাঁড় নাস্তিকদের দাবি সহসাই পূরণ হচ্ছেনা। প্রথমেই, “maturationally natural cognition” এর প্রভাবকে তারা অগ্রাহ্য করেন। সবাই হয়তো ধার্মিক নন, কিন্তু ধর্মীয় চিন্তাভাবনাগুলি অর্থাৎ ঐ রকম একটা সর্বজ্ঞ/শ্বাশ্বত/সর্বশক্তিমান সত্তা থাকতে পারে এই চিন্তাটা স্বাভাবিক। এর পরে, তারা খারিজ করে দেন থিওলজির আবেদন কিংবা সাফল্য। অথচ কোপারনিকাশ-গ্যালিলিও-ডারউইন দেখার পরেও যৌক্তিক মানুষের কাছে ধর্ম/ঈশ্বর টিকে আছে থিওলজির কল্পশক্তির কল্যাণে। আরেকটা ব্যাপারে নাস্তিকদের ভুল হয়, সেটা হলো, জনপ্রিয় ধর্ম পালন কিংবা থিওলজির দ্বন্দ্ব সামলানো, এই সবগুলির থেকে শক্ত কাজ হলো, “বিজ্ঞান সাধনা”। থিওলজি থেকে লক্ষ-হাজারগুণে জটিল এ বিষয়টিকে সাধারণ মানুষ এত সহজেই বুঝে নিতে পারবে, এমনটি ভাবাই ভুল। আরেকটা ব্যাপারে প্রকট ভ্রান্তি আছে, তা হলো, বিজ্ঞান সাথে ধর্মের তুলনা বা এর উল্টোটা। নাস্তিকের জন্য বিজ্ঞানের কাছাকাছি কিছু হলে হতে পারে একমাত্র থিওলজি, জনপ্রিয় ধর্ম কোনোভাবেই নয়।