ক.
শুধুমাত্র হরিরামপুর না অত্র এলাকাতেই সোবহান মণ্ডলের বেশ নাম ডাক ছিল। আমি যে বছর প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি হলাম ঠিক তার আগের বছর তিনি অবসর গ্রহণ করলেন। কাজেই গ্রামের বড় ভায়েরা তাঁকে স্যার বলে সম্বোধন করলেও আমি বা আমার সমবয়সীরা তাঁকে দাদা বলে ডাকতাম। আমাদের বাড়ি ছিল সোবহান দাদার বাড়ির কয়েকঘর পিছনে। দাদার বাড়ির সম্মুখ ভাগে পাকুড় গাছের তলে দীর্ঘ একটি মাচান বসানো ছিল। জন্ম থেকে ঐ মাচা দেখে আসছি। আমরা স্কুলে যাবার ও ফিরবার পথে দেখতাম সোবহান মণ্ডল মাচার ওপর একটা কোল বালিশ নিয়ে বেশ আয়েশ করে বসে আছেন। আমাদের প্রায়ই থামিয়ে তিনি এটাওটা জিজ্ঞেস করতেন। একদিন বললেন- এই ছোকড়ারা, এদিকে আয় তো। তুরা কুন ক্লাসে পড়িস যেনে? আমরা তখন ক্লাস ফোরে পড়ি। ক্লাস ফোর বলতেই দাদা হাসতে হাসতে বললেন- কিরে হেড মাস্টারের জুতো চুরি করিস নাকি! তারপর একটু গম্ভীর হয়ে বললেন- রবীন্দ্রনাথ কে ছিলেন বল দিকিনে। আমাদের মধ্যে থেকে ফটিক এগিয়ে গেল। কিছুদিন আগে আমাদের সেকেন্ড স্যার ওকে বলেছিলেন- ‘জানিস ফটিক, তোর এই নামটা না রবীন্দ্রনাথের দেওয়া। তাঁর একটি গল্প আছে সেটার নায়ক হলু কি যে ফটিক। বুঝলি?’ সেই থেকে ফটিকের ধারণা হল সে রবীন্দ্রনাথকে মেলা জানে। আমাদের মাঝে মধ্যে রবীন্দ্রনাথের গল্প শোনাত। ওর দাদা আর রবীন্দ্রনাথ নাকি একসাথে বিলে মাছ ধরতে যেত। রবীন্দ্রনাথ তখন ওর দাদাকে মজার মজার সব গান গেয়ে শোনাত। এইসব আর কি! ফটিক বেশ ভাব নিয়ে বলল- রবীন্দ্রনাথ বেশ ভাল মানুষ ছেল। ভাল গান গাতি পারতুক। হেই আমাকে নি একটা গল্প লেখিছে। দাদার সাথে তার খুব ভাব ছেল। ফটিকের কথা শুনে সোবহান দাদার মুখ হা হয়ে গেল। ফটিক আমার কানে কানে বলল- দেখলি তো, আমি কত জানি! কিছুক্ষণ পর দাদা হো হো করে হাসতে শুরু করলেন। ফটিকের মুখখানা শুকিয়ে একেবারে কাঠ হয়ে গেল। আমরাও হেসে উঠলাম। ভাবখানা এমন, ফটিক যে ভুল বলেছে সেটা আমরা আগে থেকেই জানতাম। আর একদিন দাদা ডেকে বললেন- ‘এই তুরা নামায পড়িস?’ আমরা সবাই একসাথে হ্যাঁ বললাম। ‘কেনে পড়িস সেটা বল দিকি নে।’ আমরা সবাই চুম মেরে গেলাম। আমাদের মধ্য থেকে বিল্টু আমতা আমতা করে বলল- ‘আল্লায় খুশি হয়।’ সাদিক ওকে থামিয়ে বলল- ‘নামায পড়লি জান্নাত পাওয়া যাবি, তাই পড়ি।’ দাদা হো হো করে হাসতে শুরু করলেন। আমাদের কথা শুনে তিনি খালি হাসতেন। কোন কথা বলতেন না। মাঝে মধ্যে কোনো প্রশ্ন করতেন না। আমাদের ডেকে পাকুড় গাছের শেকড়ে বসিয়ে হেড স্যারের মতো বকবক করতেন। আমরা কিছু বুঝতাম, বেশির ভাগই বুঝতাম না। মাঝে মধ্যে হো হো করে হেসে উঠতেন। কেন হাসতেন, বুঝতাম না। কিন্তু বুঝেছি যে সেটা বোঝানোর জন্যে আমরাও হাসতাম।

সুকুমার রায়, ঋত্বিক ঘটক, গোর্কি, গান্ধি, নেহেরু, মেন্ডেলা এমন আরও অনেকের কথা বলতেন। আমরা বলার ধরন বুঝে ধরে নিয়েছিলাম, এদের কেউ কেউ দাদার বন্ধু, কেউ কেউ নিকট আত্মীয়।

খ.
দেখতে দেখতে প্রাথমিকের গণ্ডি পেরিয়ে গেলাম, মাধ্যমিকের গণ্ডি পার হব হব। দাদা আগের মতোই বসে থাকতেন, ঠাঁই। সেই আয়েশি ভঙ্গিমাটা তখনও ছিল। বোঝা যাচ্ছে, দাদার সাথে সাথে বয়স বাড়ছে কোল বালিশটারও। একদিন বিকেলে গুজব উঠলো- দাদাকে সকাল থেকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। পরে খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম গুজব না সত্যি। আমরাও খোঁজাখুঁজি আরম্ভ করলাম। দাদা মাঝে মধ্যে পশ্চিমে বিল পর্যন্ত যেতেন। মাসে একবার মেহেরপুর যেতেন পেনশনের টাকা তুলতে তাও এরওর মোটর বাইকে চেপে। আমরা বিলের ধারটা তন্ন তন্ন করে খুঁজলাম। শহরেও লোক পাঠানো হল। সন্ধান মিলল না কোথাও। সন্ধ্যার আগ দিয়ে মুনশি চাচা এসে বলল সে নাকি পড়ন্ত দুপুরে দাদাকে দেখেছিল মেহেরপুরের ভৈরব ঘাটের ধারে বসে থাকতে। শোনা মাত্রই আমরা সাইকেল নিয়ে ছুটলাম। আমাদের দেখে দাদা কেমন যেন ভড়কে গেল। আমি দাদাকে বললাম- দাদা, বাড়ি চলেন। দাদা বললেন- আমি কারু বাড়ি যাব না। এই যে নদী, এখানেই আমার বাড়ি। চৌদগুষ্টির ভিটেমাটি। আমরা বেশ আশ্চর্য হলাম। দাদা এতকিছুর গল্প করতেন, কই কোনো নদীর গল্প তো কখন করেননি! আজ হঠাৎ করে নদী তাঁর বাড়ি হলো কি করে! আমরা অনেকটা জোর করে তাঁকে বাড়ি উঠিয়ে আনলাম। পরদিন সকালে তাঁকে আর মাচানে বসে থাকতে দেখলাম না, বিকালে ফিরবার পথেও না। ছেলে মেয়েরা অনেকটা জোর করে দাদাকে বাড়ি বন্দি করে রেখেছিল। মাঝে মধ্যে উনি স্ত্রী সন্তান কাউকে চিনতে পারতেন না। বলতেন- আমাকে তুমরা ছেড়ে দাও। আমি বাড়ি যাব। মা আমার জন্যি ঘাটে অপেক্ষা করছি। ছেলের বউ কিংবা মেয়েরা চারিদিক থেকে ঝাপটে ধরে জানতে চাইতো- আব্বা, আপনি আমাদের ছেড়ি কুথায় যাবেন? এই যে আপনের বাড়ি, এই আপনের ঘর, আপনের হাতে খুঁড়া কুয়া, গরু ছাগল- সবই তো আপনের। দাদা আপত্তি জানিয়ে বলতেন- না না, এটা আমার বাড়ি না। এ সব তুমাদের চক্রান্ত। তুমরা আমাকে ধরি নি এইছ। আমার বাড়ি ঐ নদীর ধারে। আমার দিদি আর মা থাকে ওখানে। আমাকে ছেড়ি দাও, আমি বাড়ি যাব। বড় মুশকিলে পড়ে গেল গাঁয়ের সকলেই।

আমরা কাছে গেলেই দাদা নদীর গল্প শুরু করতো।

নদীর ওপারে আমার নানীর গাঁ। আমরা নৌকায় চেপি কত গিছি! আমি নানীর বাড়ি যাব। আবার শুরু হতো কান্না আর বাড়ি যাওয়ার বাইনা। আমরা বলতাম- দাদা, তাহলে এই বাড়িটা কার? এটা তো আপনার হাতেই গড়া! আমাদের তেড়ে উঠে বলতেন- না, সব মিথ্যা। সব বানোয়াট। ভাঁওতাবাজি।

মন ভালো থাকলে কি সুন্দর নদীর গল্প করতেন। মাছ ধরার গল্প, নৌকা বাইচের গল্প, নদীতে দিদির সাথে নাওয়ার গল্প, আর কত কি! তখন মনে হতো সব ঠিকই আছে, কে বলে দাদা পাগল? গল্পের ফাকেই দাদিকে দেখে দাদা যখন বলতেন- হ্যঁা গো মেইডা, তুমি কি নদীর পথটা কোনদিকে বুলতি পারো? আমি বাড়ি য্যাতাম। দাদি মুখে কাপড় গুজে কাঁদতে কাঁদতে ঘরের ভিতরে চলে যেতেন। দাদার পাগলামি নিয়ে আমাদের আর সন্দেহ থাকতো না।
সুযোগ পেলেই দাদা বাড়ি থেকে পালিয়ে যেতেন। কখন ভৈরবের কিনারে, কখন বিলের ধারে, কখন বর্ডারের তারকাটার কাছ থেকে দাদাকে জোর করে তুলে আনা হতো। দীর্ঘ কোন জলাশয় দেখলেই দাদা সেখানে দাঁড়িয়ে যেতেন। বাড়িতে নতুন কেউ এলে, কিংবা রাস্তার ধারে বসলে যে যায় তাকেই জিজ্ঞেস করতেন- হ্যঁাগো, নদীটা কুনদিকে বুলতি পারো? অনেক বেলা হয়িছে আমাকে বাড়ি যেতি হবে। মা আমার জন্যি অপেক্ষা করছি।

গ.
দাদাদের বাড়ির পিছন দিকে একটা জলাশয় ছিল। চৈত্রের সময় হাঁটুজল থাকত। তবে বর্ষায় জল একেবারে থৈ থৈ করত। তখন ছিল চৈত্রের মৌসুম। জল একেবারে তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। ভৈরব, খাল বিল সর্বত্র এখন জলের হাহাকার। বর্ষায় এই পুকুরেই আমরা গোসল করতাম। এখন দেখে সেটা বুঝবার জো নেই। পুকুর জুড়ে খালি বালি আর বালি। মেহেরপুরের এই গ্রামটা একেবারে খাপছাড়া- রাস্তা ঘাট সর্বত্র বালিতে ভরা। যেন গ্রামটা আগন্তুক, মরুভূমির কোন দেশ থেকে উঠে এসে এখানে সংসার পেতেছে। একদিন দাদাকে ঐ পুকুরের পাড়ে নিয়ে গিয়ে মশকরা করে বললাম- দাদা, এই হল কি যে তোমার নদী! দাদিও আমাদের সাথে সাই দিল। দাদা একবার পুকুরের দিকে তাকাই, একবার আমাদের দিকে। বুঝলাম বিশ্বাস করে উঠতে পারছে না। বললাম- দাদির মতো শুকিয়ে এই দশা। যে যার মতো করে নদী ভরাট করে ঘর গেড়েছে। দেখছ না, বালিগুলো কেমন দাঁত বের করে আছে? পুকুর, নালা, ডোবায় কি এতো বালি থাকে? নদী না হলে এখানে কাদায় থক থক করতো না বলো? নদী বলেই তো এই বনেদি ভাব। দাদা কোন কথা না বলে পিটুলি গাছটির তলে বসে পড়লো। তারপর থেকে প্রায়ই ওখানে বসে থাকতো। পুকুরের ওপাশ থেকে যারা আসতো তাদেরকে ডেকে জানতে চাইতো- হ্যাঁগো, আমার নানী ভালো আছে? নানীকে বলবা তো নদীর ধারে একটু আসতি। নদীতে নৌকা নেই তো, আমাকে একটা নৌকা এনি দিবা? নদীর ওপারে নৌকার বিরাট হাট বসে। বাপজানের সাথে গেছি একবার। দিবা তো?

আমাদের বাড়ি ছিল পুকুরের ওপাশে। আমাকে দেখলেই দাদা নানীর কথা জানতে চাইত। মাঝে মধ্যে কাছে ডেকে কোন কথা বলতেন না, খালি কাঁদতেন। আমি বিষয় পরিবর্তন করার জন্যে বলতাম- দাদা, গোর্কির সেই গল্পটা বলো না গো একবার। গান্ধি কি করে ব্রিটিশ ভাগালো সেই গল্পটা ? দাদা তাচ্ছ্বিল্যের সাথে বলতেন- না না কেউ নেই। গোর্কি গান্ধি কেউ নেই, সব নদীতে ভেসি গিছে।

মাঝে মধ্যে দেখতাম একা একাই বসে বসে কাঁদছেন- দিদি গো দিদি, আমাকে নি’ যা। নদীতে অনেক স্রোত। আমি সাতার ভুলি গিছি যে! কখনো কখনো উঠানের কোনের গোয়ালঘর দেখিয়ে বলতেন- ওখানে ঘাট ছ্যালো। ওই ঘাটে মেলা নৌকা বাঁধা থাকতুক। কিচ্ছু নেই। সব ভেসি গিছে জলে। সব।

একদিন আমার কাছে শিশুর মতো বাইনা ধরলেন নদীর শব্দ এনে দিতে হবে। আমি জিজ্ঞেস করলাম- দাদা, নদীর শব্দ কেমন শোনায়? দাদা একটু উদাসীন হয়ে বললেন- সেবার ঐ শব্দ করিই তো নদী গাঁয়ের আদ্ধেকটা সাবাড় করলু। গাঁয়ের ঘর-বাড়ি, গরু-ছাগল সব গি’ নদীতে পড়ে আর নদীর সে কি আনন্দ না! আমি যখন সাঁঝে দিদির সাথে হাঁসগুলো ডেকি আনতি নদীতে য্যাতাম, এক পা নদীতে পড়তিই নদী কেমন খিলখিল করি হেসিই অস্থির। আমি খুব মজা পেয়ি দিদিকে বুলতাম- নদীর মেলা কাতুকুতু, না দিদি? তখন দিদিও হাসতুক, নদীও হাসতুক। দাদা যখন কথাগুলো বলতো তখন দাদার চোখ জোড়া নদীর মতো ছলছল করে উঠতো।

আমি এসএসসি শেষ করে শহরের কলেজে ভর্তি হলাম। দাদার খোঁজ আর নেওয়া হতো না খুব একটা। মার কাছ থেকে শুনতাম, দাদার অবস্থা ক্রমেই খারাপের দিকে। পাগলামি বেড়েই চলেছে। দাদিকে কখন দিদি বলতেন, কখন মা। বাড়ির বৌদেরকেও দিদি অথবা মা বলে ডাকতেন। এ নিয়ে বাড়িতে যেমন কষ্টের অন্ত ছিল না, তেমন হাসাহাসিও কম হতো না। নাতিছেলেরা উঠানে এক বদনা পানি ফেলে বলত- দাদা, এই দেখ তোর নদী। দাদিকে দেখিয়ে বলতো- দাদা, ওই দেখ তোর দিদি আসে।

বর্ষা শুরু হয়েছে সবে। আষাঢ়ের শুরুতেই শুরু হল আসার। বৃষ্টি চলল সারারাত ধরে। আমি টিনের চালে বৃষ্টি পতনের শব্দ শুনতে শুনতে ভাবছিলাম- ভৈরব নদীর বুকটা কেমন শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। এবার বর্ষায় নদীটার পেটটা একটু চাঙ্গা হলেই দাদাকে নিয়ে যাবো একদিন।

সকালে দাদাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। আমি পুকুরে কতটুকু জল হয়েছে দেখতে গিয়ে থ মেরে গেলাম। পুকুরের টাটকা জলে মুখ ডুবিয়ে উপুড় হয়ে পড়ে আছে দাদা। কাছে পড়ে আছে অনেক দিনের অব্যবহৃত জং পড়া একটি কোদাল।

মুরুবিবদের মুখে শুনেছি- ’৪৭-এ দেশ ভাগের সময় দাদা তাঁর বাপের হাত ধরে ভারত থেকে এসে এ অঞ্চলে পত্তন গড়ে। দাদার বয়স তখন সাত কি আট। হরিরামপুর সহ মেহেরপুরের বিরাট একটা অংশ জুড়ে ছিল হিন্দুদের বাস। দাদাদের সাথে আরও অনেকেই আসে। হিন্দুরা বিনিময় করে ওপারে চলে যায়। দাদারা কোথায় থেকে এসেছিলেন, দিদি ও মার কি হয়েছিল সঠিক করে কেউ কিছু বলতে পারে না। গোমুতি নদীর তীরে দাদাদের পৈতৃক ভিটে ছিল, দাদা বিয়ের পরপর এ কথায় সে কথায় দাদিকে বলেছিলেন সে কথা।