(আগের পর্বের পর…)

৩.০ : ভারতীয় দর্শনের বিভিন্ন সম্প্রদায়

প্রাচীন ভারতে দর্শনের জগতে প্রথমে যে আস্তিক দর্শনেরই উদ্ভব হয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কেননা, এই আস্তিক্যবাদের বিরোধিতার সূত্র ধরেই মূলত নাস্তিক্য দর্শনের সূত্রপাত। আস্তিক দর্শনগুলির মতে বেদ কোন মানুষের সৃষ্টি নয়, অর্থাৎ বেদ অপৌরুষেয়। এবং বেদমন্ত্রগুলি প্রাচীন আর্য ঋষিদের দৃষ্টিতে উদ্ভাসিত হয়েছিলো বলে তাঁরা বিশ্বাস করেন। তাঁদের মতে এই ঋষিরা মন্ত্রকর্তা ছিলেন না, ছিলেন মন্ত্রদ্রষ্টা। এঁরা ধ্যানবলে উপলব্ধ সত্যকে ব্যক্ত করেছেন মন্ত্রে। তাই আস্তিক দর্শনের সূচনা ও ক্রমবিকাশে বেদের স্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
.
রচনাকালের পরম্পরা ও প্রকৃতি অনুযায়ী ‘বেদ’ চারটি- ১) ঋগ্বেদ, ২) সামবেদ, ৩) যজুর্বেদ, ৪) অথর্ববেদ। এখানে আমাদের ধারণা স্বচ্ছ রাখার প্রয়োজনে এটা অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে যে, প্রতিটা বেদ আসলে একেকটা গ্রন্থ মাত্র নয়।
এই প্রতিটি বেদের চারটি অংশ:

ক) ‘সংহিতা’ বা সংগ্রহ- গান, স্তোত্র, মন্ত্র প্রভৃতির সংকলন।
খ) ‘ব্রাহ্মণ’- গদ্যে রচিত একজাতীয় যাগযজ্ঞ-বিষয়ক সুবিশাল সাহিত্য।
গ) ‘আরণ্যক’- অরণ্যে রচিত একজাতীয় সাহিত্য, বিশ্ব-রহস্যের সমাধান অন্বেষণই তার প্রধান উদ্দেশ্য।
ঘ) ‘উপনিষদ’- আক্ষরিক অর্থে গুহ্য-জ্ঞান, দার্শনিক তত্ত্বের বিচারই এর প্রধান বিষয়বস্তু। এই উপনিষদকে ‘বেদান্ত’ সাহিত্যও বলা হয়।

.
বেদের সংহিতা ও ব্রাহ্মণ অংশকে কর্মকাণ্ড, আরণ্যককে উপাসনাকাণ্ড এবং উপনিষদকে জ্ঞানকাণ্ড বলা হয়। রচনাকাল ও বিষয়বস্তুর দিক থেকে প্রত্যেকটি অংশের মধ্যে একটা ধারাবাহিকতা রয়েছে বলে স্বীকৃত। বৈদিক সাহিত্যের বহু প্রাচীন অংশই বিলুপ্ত হয়েছে। তবুও যা টিকে আছে তাও আকারে সুবিশাল।
.
উল্লেখ্য, বেদের সুক্ত বা সংহিতাগুলো অতি প্রাচীনকালে দীর্ঘ সময় নিয়ে রচিত হয়েছে। অর্থাৎ তা কোন একক ব্যক্তির রচিত নয়। বংশ পরম্পরাক্রমে তা মুখে মুখে রচিত হয়েছে এবং শ্রুতির মাধ্যমে তা সংরক্ষিত হয়েছে। তাই বেদকে শ্রুতি গ্রন্থ্ও বলা হয়। বেদের রচনাকাল নিয়ে মতভেদ থাকলেও ধারণা করা হয় খিস্টপূর্ব ২০০০ বা ২৫০০-তে এর রচনাকাল শুরু এবং রচনা সম্পন্ন হয়েছে খ্রিস্টপূর্ব ৭৫০ থেকে ৫০০-এর মধ্যে। সুনির্দিষ্ট কোন সন-তারিখের হিসাব করা সম্ভব না হলেও গবেষকদের স্থির সিদ্ধান্ত এটুকু যে, গৌতম বুদ্ধের পূর্বেই এ-সাহিত্যের রচনা ও সংকলন সমাপ্ত হয়েছিলো। এই দীর্ঘ সময়ের পরিক্রমায় বহু শতাব্দির ব্যবধানের কারণেই বেদের প্রথম দিকের রচনাগুলোর সাথে শেষের দিকের রচনাগুলোর উদ্দেশ্য, ভাব ও দৃষ্টিভঙ্গিতে বিস্তর পার্থক্য তৈরি হয়ে গেছে। এ প্রেক্ষিতে তাই এটা খেয়াল রাখা আবশ্যক যে, সুদীর্ঘ যুগ ধরে বৈদিক মানুষদের সমাজ-ব্যবস্থা এবং চিন্তা-চেতনায় যে পরিবর্তন ঘটেছিলো তারই ধারাবাহিক এবং সাহিত্যিক নিদর্শন এই বেদ, ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে যার মূল্য অতুলনীয়। মানবজাতির ইতিহাসে এ-জাতীয় এমন বিস্তীর্ণ নিদর্শন দ্বিতীয়টি বিরল।
.
বেদের ব্রাহ্মণ যুগের শেষের দিকে ক্রিয়াবহুল যাগ-যজ্ঞের বিরুদ্ধে শিক্ষিত অগ্রবর্তী ব্যক্তিদের মনে হয়তো এক ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। তাঁরা মনে করেন ব্যাপক ক্রিয়াবহুল সময়সাপেক্ষ যাগ-যজ্ঞের অনুষ্ঠান নিরর্থক। যেমন শতপথ এবং তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, আত্মজ্ঞান ছাড়া মোক্ষলাভ করা যায় না। কাজেই শিক্ষিত ব্যক্তিদের মনের প্রতিক্রিয়া থেকেই আরণ্যক ও উপনিষদের সৃষ্টি হয়। উপনিষদ হলো জ্ঞানকাণ্ডের চরম পরিণতি। এই উপনিষদের সংখ্যা অনেক হলেও প্রধান উপনিষদ বারোটি। যথা- ঈশ, কেন, কঠ, মুণ্ডক, মাণ্ডুক্য, প্রশ্ন, ছান্দোগ্য, বৃহদারণ্যক, ঐতরেয়, তৈত্তিরীয়, কৌষিতকি ও শ্বেতাশ্বতর।
.
বেদ ও উপনিষদের পরেই ভারতবর্ষে ছয়টি আস্তিক দর্শনের আবির্ভাব হয়। তবে এই আস্তিক দর্শনগুলির ক্রমবিকাশে তিনটি স্তর বা পর্যায় লক্ষ্য করা যায়- (১) সূত্র, (২) ভাষ্য এবং (৩) বার্ত্তিক।
.
ভারতীয় দর্শনে ছোট ছোট অর্থপূর্ণ বাক্যকে বলা হয় সূত্র। মূলত ছোট ছোট অর্থপূর্ণ বচনের সাহায্যে এরকম কিছু সূত্রের আবরণে প্রাচীন ভারতীয় দর্শনের বিভিন্ন দার্শনিক চিন্তাকে সযত্নে গেঁথে রাখা হতো। স্বল্পতম অক্ষরবিশিষ্ট এরকম কিছু সংখ্যক সূত্রের মাধ্যমে দর্শন-চিন্তার প্রথম আত্মপ্রকাশই ভারতীয় দর্শনের প্রচলিত ধারা এবং ভারতীয় দর্শনের অধিকাংশ শাখারই আদি রচনা এই জাতীয় কিছু সূত্রের সমষ্টি বলে মনে করা হয়। সূত্রগুলোয় অক্ষরসংখ্যা নিয়মনের দিকে খুব জোর দেয়া হয়েছে, ফলে সংক্ষিপ্ততম অবয়বে ব্যাপকতম অর্থব্যঞ্জনার প্রবণতা প্রত্যেক সূত্রে দেখা যায়। তৎকালীন প্রেক্ষাপটে তখনো কোন লিখিত গ্রন্থ বা মুদ্রাযন্ত্র ছিলো না। তাই শিষ্যদের পক্ষে তা বোঝা বা মনে রাখা অত্যন্ত কঠিন হতো বলে তা প্রতিকারের লক্ষ্যে ছোট ছোট অর্থপূর্ণ বাক্য প্রয়োগ করা হতো। এই সূত্রগুলিই পরবর্তীকালে লিপিবদ্ধ করা হয়। ফলে এরকম সূত্রগ্রন্থই ষড়দর্শনের আদিগ্রন্থ হিসেবে স্বীকৃত। এসব গ্রন্থে দর্শনের মৌলিক চিন্তাগুলি সূত্রের মাধ্যমে গ্রথিত ও সংরক্ষিত হয়েছে। যেমন-
.
(১) সাংখ্য দর্শনের আদিগ্রন্থ হলো কপিলের সাংখ্যসূত্র। বর্তমানে কপিলের সাংখ্যসূত্র দুষ্প্রাপ্য বা বিলুপ্ত।
(২) যোগদর্শনের আদিগ্রন্থ হলো পতঞ্জলির যোগসূত্র।
(৩) ন্যায়দর্শনের আদিগ্রন্থ হলো গৌতমের ন্যায়সূত্র।
(৪) বৈশেষিক দর্শনের আদিগ্রন্থ হলো কণাদের বৈশেষিক সূত্র।
(৫) মীমাংসা দর্শনের মূলগ্রন্থ হলো জৈমিনির মীমাংসা-সূত্র।
(৬) বেদান্ত দর্শনের মূলগ্রন্থ হলো বেদব্যাস বা বাদরায়নের ব্রহ্মসূত্র।
.
এভাবে ভারতীয় দর্শনসাহিত্যের আদিগুরুদের যে সূত্র রচনার মাধ্যমে তাঁদের নিজ নিজ দার্শনিক মতবাদের উদ্বোধন, তা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই একাধিক অর্থের দ্যোতনা রয়েছে, কখনো কখনো এদের প্রকৃত অর্থ বোঝাও কঠিন ছিলো। অনেক সময় একই সূত্রের পৃথক পৃথক বা পরস্পর বিরোধী অর্থ করা হতো। ফলে সূত্রগুলির প্রকৃত অর্থ উদ্ধার করার প্রয়োজন দেখা দেয়। এবং এ কারণে সূত্রের পর আসে ভাষ্য। তাই প্রত্যেকটি সূত্রগ্রন্থেরই ভাষ্য রয়েছে। আবার কোন কোন সূত্রগ্রন্থের একাধিক ভাষ্যও দেখতে পাওয়া যায়। যেমন-
.
(১) ঈশ্বর কৃষ্ণের সাংখ্যকারিকার ভাষ্য হলো বাচষ্পতি মিশ্রের তত্ত্বকৌমুদী।
(২) যোগসূত্রের ভাষ্য রচনা করেন বেদব্যাস।
(৩) ন্যায়সূত্রের প্রখ্যাত ভাষ্যকার হলেন ঋষি বাৎসায়ন।
(৪) বৈশেষিক সূত্রের ভাষ্যগ্রন্থ হলো প্রশস্তপাদের পদার্থ ধর্মসংগ্রহ।
(৫) মীমাংসা-সূত্রের ভাষ্য রচনা করেন শবরস্বামী।
(৬) বেদব্যাস রচিত ব্রহ্মসূত্রের ভাষ্যকার হলেন আচার্য শঙ্কর, রামানুজ, মধ্বাচার্য, বল্লভ, নিম্বার্ক।
.
সূত্রগ্রন্থের ভাষ্য রচনার ক্ষেত্রে পরবর্তী যুগের ভাষ্যকারেরা নিজ নিজ অভিপ্রায় অনুযায়ী সূত্রগুলির ব্যাখ্যায় প্রবৃত্ত হওয়ায় এগুলির মাধ্যমে বহুস্থলে পরস্পরবিরোধী সম্পূর্ণ ভিন্ন অর্থের প্রকাশও লক্ষ্য করা যায়। ফলে একই দর্শনে ভিন্নমতাবলম্বী বহু শাখাগোষ্ঠির উদ্ভবও লক্ষ্যণীয়। আর এসব ভাষ্যগ্রন্থের পর এসেছে অজস্র বিখ্যাত প্রকরণ বা টীকাগ্রন্থ। এভাবেই সৃষ্টি হয়েছে ভারতীয় দর্শনের ক্রমবিকাশের বিশাল সাহিত্য-পরম্পরা।
.
আর নাস্তিক দর্শন বলতে ভারতীয় দর্শনে প্রধানত জৈন, বৌদ্ধ ও চার্বাক এই তিনটি দর্শনকে বোঝানো হলেও প্রথম দুটো অর্থাৎ জৈন ও বৌদ্ধ মূলত ভাববাদী দর্শন। অন্যদিকে একমাত্র জড়বাদী বা বস্তুবাদী দর্শন হলো চার্বাক দর্শন। সে বিবেচনায় শুধু ভারতীয় দর্শনেই নয়, এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্তের বিশ্লেষণে চার্বাককে পৃথিবীর প্রাচীনতম জড়বাদী দর্শন হিসেবেও গণ্য করা হয়।
.
তবে আস্তিক দর্শনগুলির মতো নাস্তিক দর্শনগুলির ক্ষেত্রে বিশেষ করে চার্বাক দর্শনের স্বীকৃত কোন সূত্রগ্রন্থ বা ভাষ্যগ্রন্থ পাওয়া যায় না। যদিও সপ্তম থেকে চতুর্দশ শতকের মধ্যে বিভিন্ন আস্তিক ভাবধারার দার্শনিক গ্রন্থের ভাষ্যকারদের রচনায় নাস্তিক দর্শনসূত্রের প্রচুর উদ্ধৃতি রয়েছে। মূলত নাস্তিক মত খণ্ডনের নিমিত্তেই এসব উদ্ধৃতি ব্যবহার করা হয়েছে। এই উদ্ধৃত সূত্রগুলি কখনও চার্বাক, কখনও লোকায়ত, আবার কখনও বা বার্হস্পত্য বিশেষণে বিশেষিত। তবে আস্তিক দর্শনের ক্রমবিকাশের মতোই নাস্তিক দর্শন সম্প্রদায়েরও ক্রমবিকাশ ঘটেছে বলে ধারণা করা হয়।

(চলবে…)

[আগের পর্ব: ভারতীয় দর্শন-সূত্র] [*] [পরের পর্ব: ভারতীয় দর্শনের সাধারণ বৈশিষ্ট্য]