আমি গত কয়েকদিন যাবত হুমায়ূন আহমেদ পাঠ করছি। অন্তর্জালে এই লেখকের যত বই পাওয়া যায় আর কোন লেখকের তত বই পাওয়া যায় না, যার জন্য কাজটা অনেক সহজ হয়েছে। কারন হুমায়ূন আহমেদের প্রসবিত বইয়ের সংখ্যা বিপুল। কিনে এই বই পড়া একাবারেই সম্ভব হবে না আমার পক্ষে। সুতরাং যেখানে পাচ্ছি নামাচ্ছি আর তেলওয়াত করে যাচ্ছি নিঃশব্দে। হঠাৎ করে আলাদা ভাবে হুমায়ূন পাঠের একটা কারন তার লেখা সম্পর্কে একটা ধারনা নেওয়া, কারন হুমায়ূন সম্পর্কে আমার ধারনা বিচারিক স্কেলে অন্যান্য লেখকদের তুলনায় দুঃখজনকভাবে নিম্নমুখী। যার জন্য হুমায়ূনমুরীদদের অনেক অনেক প্রশংসার ভীড়ে আমার নিজস্ব মতামত দেওয়ার সময় বিবেকের তাড়না বোধ করি। কারন যার লেখা তেমন পড়িই নি তার সম্পর্কে উক্তি করা কতটুকু যৌক্তিক সেটা বিবেচনার যোগ্য।

যাই হোক আমি এই লেখা হুমায়ূনের সাহিত্য কিংবা হুমায়ুন আজাদের ভাষায় অপসাহিত্য যাই বলি সেটা নিয়ে নয়। এই লেখার উদ্দেশ্য অনেকটাই হুমায়ূনের পক্ষে ওকালতি করার মতন। প্রথমেই একটা খবরের লিঙ্ক দেইঃ

হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস ‘দেয়াল’ প্রকাশে নিষেধাজ্ঞা

দেয়াল সম্পর্কে একটু তথ্যঃ
দেয়াল কী? একটি অপ্রকাশিত উপন্যাস(উপন্যাস নাও হয়ে উঠতে পারে)। কী ধরনের উপন্যাস? ঐতিহাসিক।
কোন পটভূমিতে লেখা হয়েছে? এখন পর্যন্ত আলু পত্রিকার সাহায্যে জানা গেছে এটি ৭৫-এ মুজিবের হত্যাকান্ড এবং ঐ সময়ের বিভিন্ন রাজনৈতিক ঘটনার প্রেক্ষাপট নিয়ে লিখিত। যার দুটি অধ্যায় প্রকাশের সাথে সাথে ব্লগ জগতে আলোচনা সমালোচনা এবং হুমায়ূনমুরীদদের বেশ কষ্টে সময় কাটছে।

যাই হোক এটাও আসল খবর নয়। আসল খবর হল বাঙলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট ডিভিশন বাঙলাদেশের পাঠক সমাজকে সঠিক তথ্য দেয়ার মহান প্রকল্পের আওতায় “দেয়াল” উপন্যাসটিকে ইতিহাস বিকৃতির অভিযোগে অভিযুক্ত করেছে এবং আসল ইতিহাস না দেয়া হলে বইটিকে প্রকাশ হতে দেয়া হবে না বলে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে।

উনি ভুল কী তথ্য দিয়েছেন?
সোমবার আদালতে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, “হুমায়ূন আহমেদের ওই উপন্যাসে হত্যাকাণ্ডের বিবরণ যথাযথভাবে প্রকাশ পায়নি। এক জায়গায় তিনি লিখেছেন `বঙ্গবন্ধুর দুই পুত্রবধূ তাদের মাঝখানে রাসেলকে নিয়ে বিছানায় জড়াজড়ি করে শুয়ে থরথর করে কাঁপছিলেন। ঘাতক বাহিনী দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকল। ছোট্ট রাসেল দৌড়ে আশ্রয় নিল আলনার পেছনে। সেখান থেকে শিশু করুণ গলায় বললো, তোমরা আমাকে গুলি করো না। শিশুটিকে তার লুকানো জায়গা থেকে ধরে এনে গুলিতে ঝাঁঝরা করে দেয়া হলো।“

কিন্তু বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় ঘটনার একটি স্বীকৃত বিবরণ রয়েছে। তাতে দেখা যায়, বঙ্গবন্ধুর বাড়ির কাজের ছেলে রমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে গিয়ে রাসেলকে হত্যা করা হয়।

মঙ্গলবার অ্যাটর্নি জেনারেলের উদ্ধৃতি দিয়ে আলতাফ হোসেন বলেন, “হুমায়ূন আহেমেদের একটি অপ্রকাশিত বইয়ের পত্রিকায় প্রকাশিত অংশে ভুল তথ্য রয়েছে। প্রকৃত সত্য হলো বঙ্গবন্ধুর ছোট ছেলে রাসেল মায়ের কাছে যেতে চাইলে তাকে হত্যা করা হয়।

সূত্রঃ বাঙলানিউজ২৪

আর?
আরেকটি অভিযোগ হল খন্দোকার মোশতাককে বইতে এমনভাবে দেখানো হয়েছে যে তাতে করে তাকে মুজিবের খুনের সাথে সংশ্লিষ্ট মনে হয় না। কিন্তু আদালতে এটা প্রমানিত হয়েছে।

পাঠক,অভিযোগগুলোর সাথে কি আপনি একমত?
আমি একমত। ইতিহাস সচেতন যে কোন সুস্থমস্তিষ্কের মানুষই একমত হবে। কিন্তু সমস্যাটা আসলে অন্যত্র। এর আগে,

বাঙলাদেশের একটি রাজনৈতিক দলের কথা আপনাদের ভাবতে বলছি। যেটি কিনা যুদ্ধাপরাধ করার দায়ে অভিযুক্ত। আদালতে এবং সুস্থ জনমনে। তারা অত্যন্ত সুকৌশলে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের বিরোধিতা করে আসছে বাঙলাদেশ নামক দেশটির পৃথিবীতে প্রসবিত হবার পর থেকেই। পাশাপাশি তাদের সাহায্য করে যাচ্ছে আরেকটি দল। যেটার শুরু তাদের গুরুই করেছিল। দালাল অধ্যাদেশ আইন নামে একটি আইন ১৯৭৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর বিচারপতি আবু সাদত মোহাম্মদ সায়েম জারি করেছিলেন। যেটি কিনা মেজর জেনারেল জিয়া নামে এক খালখোদক বাতিল করে চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদেরকে এই দেশের মাটিতে পূনর্বহাল করেছিল।

দলটির নাম?
জামাত। যাদের কাঁঠালপাতাপ্রীতি সর্বজন জ্ঞ্যাত।
আমার প্রশ্ন এই দলটিকে কেন এখনও নিষিদ্ধ ঘোষনা করা হয় নি?
প্রশ্নটি কার কাছে?
To whome it may concern?
পরিষ্কারভাবে দন্তন্য আকারে না।

আমার প্রশ্ন “অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম” এর প্রতি।
আমার প্রশ্ন “স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে যে দুজন বিচারপতি রুল জারি করেছেন, মানে এএইচএম শামসুদ্দীন চৌধুরী ও বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন ” এর কাছে। কেন জামাত নামের দলটিকে ইতিহাস বিকৃতির অভিযোগে নিষিদ্ধ করা হবে না?

হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাসে ইতিহাস বিকৃত হয়েছে এজন্য যদি তার বই নিষিদ্ধ হয় তাহলে বাঙলাদেশে প্রত্যেক বছর হাজার হাজার বই ইতিহাস বিকৃতির অভিযোগে নিষিদ্ধ হওয়া উচিত।

সাহিত্য সৃষ্টি করতে যেয়ে অপসাহিত্য সৃষ্টি হবার কারনে যদি নিষিদ্ধ করার মতন যৌক্তিক কারন থাকত তাহলে আমি হুমায়ূন আহমেদের প্রত্যেকটি বই নিষিদ্ধ করার পক্ষে প্রচারনা চালাতাম। কিন্তু সেটা হবে সভ্যতার পরিপন্থি। ঠিক যেমনিভাবে হবে ইতিহাস বিকৃতির দায়ে বই কোন বই নিষিদ্ধ করা।

আমি পরিষ্কারভাবে এই নিষিদ্ধের বিরুদ্ধে। প্রতিবাদ জানাই এই নিষিদ্ধের। কারন কোন বই নিষিদ্ধ করা প্রমান করে সংশ্লিষ্ট দেশটি অসভ্য। তারা ভিন্নমত সহ্য করতে পারে না। তারা ভীতু।

ব্যক্তিগতভাবে আমার কোন কেশ ছিড়বেনা যদি হুমায়ূন আহমেদ বলে মেজর ফারুক মুক্তিযোদ্ধা ছিল। কারন আমি জানি ও ছিল না। ইতিহাস তাই বলে। কেবলমাত্র হুমায়ূন আহমেদের মতন জনপ্রিয় মধ্যম শ্রেনীর লেখক লিখলেই সেটা আমাকে বিশ্বাস করতে হবে? প্রশ্নই আসে না। আর যে সকল হুমায়ূনপাঠীরা ইতিহাস জানার জন্য লালা ঝরিয়ে হুমায়ূনের বইয়ের অপেক্ষা করে তাদের আসলে ইতিহাস না জানলেও কোন ক্ষতি নেই জানলেও লাভ নেই। যারা ইতিহাস জানে উপন্যাস পরে তাদের ইতিহাস জানার আসলে কোন দরকার নাই। কারন তারা মাকাল ফল। ইতিহাস জেনে তারা কেবল পাতিহাসই হবে।

এই ঘটনার একটা মজার দিক হল, হুমায়ূন আহমেদ পড়েছে গ্যাড়াকলে। হুমায়ূনের মাথা নিউইয়োর্কের রোদেলা দুপুরে যদি জাম্বুরায় পরিনত না হয়ে থাকে তাহলে মনে থাকবে যে হুমায়ুন আজাদের একটি বিশেষ বই সম্পর্কে তার উক্তি ছিল এমনঃ
““কারণ যে বইটা তিনি লিখেছিলেন, তা এতই কুৎসিত যে, যে কেউ বইটা পড়লে আহত হবে। তার জন্য মৌলবাদী হতে হয় না।””

আমরা চাই আম্লিগের টেরোরিস্ট সংগঠন ছাত্রলিগ(ছাত্রীলিগ নাই, যদিও মতিয়ার মতন অগ্নিকন্যাদের এখন হাটে বাজারে কিনতে পাওয়া যায়) হুমায়ূন আহমেদের উপরে কোন হামলা না করুক ইতিহাসসঠিকীকরন কিংবা সহজ ভাষায় ইতিহাসের পাতিহাসিকরন জোশে উদ্বুদ্ধ হয়ে। কিন্তু যদি হয় তখন তার উত্তরটা কী হবে? এমন কী এই নিষিদ্ধ করনের বিপক্ষেই সে কী যুক্তি দেবে?

আমরা চাই ইতিহাস বিকৃতি করার জবাব দেওয়া হবে ইতিহাসের সঠিক তথ্য জানানোর মাধ্যমে। ইতিহাস “গুম” করার মাধ্যমে নয়। যদিও বর্তমান সরকারের রাজনৈতিক অভিধানে “গুম” একটি অতি প্রিয় শব্দে পরিনত হয়েছে।

কারন আমরা যারা নিজেদের অসভ্য মনে করি না তারা বিশ্বাস করি একটা মহৎ উক্তিতেঃ
I disapprove of what you say, but I will defend to the death your right to say it- Evelyn Beatrice Hall

শুধু হুমায়ূন আহমেদ না, আমরা চাই লেখকের স্বাধীনতা। যেখানে একজন লেখক লেখার আগে কী কী লিখবেনা সেটা নোট করে রাখতে হবে। ভাবতে হবে না “স্বতঃপ্রনদিত” হয়ে কোন এটর্নি জেনারেল কিংবা বিচারপতি(জানি না পত্নি নাই কেন) তার লেখার উপরে কাচি চালাবে। কারন তাকে আর যাই বলা যাক, সভ্যতা বলা যায় না।