(লেখাটি ঠিক কীভাবে শুরু করা উচিৎ বুঝে সারতে পারছিনা।বিষয়টা নিয়ে জানাশোনা কিঞ্চিৎ কম বৈকি। তার উপর আবার এই লেখাটা মানুষের উপর খাটিয়েই উপস্থাপন করা, যদিও মানুষের Sociobiology নিয়ে আমার পড়াশুনা নিতান্তই কম। যাহোক, লেখাটিকে পুরো ১০০% বিজ্ঞানসিদ্ধ না ধরে বিবর্তনের Selfish Gene তত্ত্বের একটি গাণিতিক ব্যাখ্যা প্রদানের প্রয়াস হিসেবে দেখতেই আমি পছন্দ করি। যেকারো এ সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকলে তা জানানোর বিনীত অনুরোধ রইলো। )

একটি কল্পনাচিত্র।ধরে নিন, আপনি এবং আপনার কাছাকাছি বয়সী তরুণ ভাই কক্সবাজার ঘুরতে গিয়েছেন। সাগরে আনন্দ করতে করতে একপর্যায়ে হঠাৎ দেখলেন আপনার ভাই দূরে সাগরে ডুবে মরতে বসেছেন। আপনি কী করবেন? “অবশ্যই গিয়ে ভাইকে বাঁচাতে ঝাঁপিয়ে পড়ব”…আপনার উত্তরটাকে একটু ভিন্ন দৃষ্টিকোণে ব্যাখ্যা করা যাক।

১) আপনার সাথে আপনার ভাইয়ের জিনগত মিল, ~৫০%, অর্থাৎ Co-efficient of Relatedness, r=0.5

২) আপনার ভাইকে আপনি বাঁচাতে পারলে পরবর্তীতে তিনি বিয়ে-শাদী করবেন এবং সাধারণ গড় অনুযায়ী ধরে নিলাম তিনি ২ সন্তানের বাবা হবেন। এক্ষেত্রে আপনি তাকে বাঁচানোর ফলে তার লাভ বা বেনেফিট ,B=2

৩) তাকে বাঁচাতে গেলে আপনাকে সাঁতার কেঁটে বেশ কিছুদুর যেতে হবে এবং তাকে বিপদমুক্ত করতে হবে। ধরে নিলাম, এই পুরো প্রক্রিয়াতে আপনার নিজের-ই সাগরের ঢেউতে ডুবে মরার সম্ভাবনা ২৫%, অর্থাৎ রিস্ক ফ্যাক্টর = 0.25. আর আপনি যদি ডুবে মরেন-ই, তবে আপনার নিজের বংশধর (গড়ে ২ জন সন্তান,ধরে নিচ্ছি আবারো) রেখে যাবার কোন সম্ভাবনা নেই। তাহলে, ভাইকে বাঁচাতে গিয়ে আপনি মরে গেলে আপনার ক্ষতি বা Cost হতে পারে, C = 2X0.25 = 0.50

এবার নিচের গাণিতিক সম্পর্কটি দেখুনঃ

rB > C ;[এখানে, r=0.5, B=2 এবং C=0.50]
বা, 0.5 X 2 > 0.50
বা, 1 > 0.50 , যেটা বাস্তবসম্মত।

অর্থাৎ, আপনি যদি আপনার ডুবতে বসা ভাইকে বাঁচাতে গিয়ে মরেও যান, তবু আপনাদের মধ্যে শেয়ারকৃ্ত ৫০% জিনের টিকে থাকার জন্য এটা কোন বিঘ্ন ঘটাবে না। তাই, আপনার শরীরের জিনগুলোই আপনাকে তাড়িত করবে দৌড়ে গিয়ে ভাইকে বাঁচাতে। যদি আপনি তাকে বাঁচাতে পারেন, তাহলে তো কথাই নেই। আপনাদের দু’জনের মাঝেই সেই ৫০% জিনগুলো বেঁচে থাকবে এবং পরবর্তী প্রজন্মে (২+২ = ৪) বাহিত হবে। আর আপনি যদি মরেও যান , তেমন কোন ক্ষতি নেই, কারণ, আপনি ঐ জিনগুলোর-ই আরেকজন বাহককে বাঁচিয়ে গেলেন………এই না হলে ভ্রাতৃ্ত্ব!!!

কিন্তু এবার এক-ই অবস্থাটা কল্পনা করুন আপনার চাচাতো ভাইকে নিয়ে, যার সাথে আপনার জেনেটিক গঠনে ১২.৫% মিল রয়েছে।

আবারো ফর্মুলাটা দেখুনঃ

rB > C

এক্ষেত্রে যদিও Co-efficient of Relatedness, r=0.125
তাই rB = 0.125 X 2 = 0.25 এবং C= 0.50

কিন্তু 0.25 > 0.50 সত্য নয়, অর্থাৎ rB > C এখানে সিদ্ধ হচ্ছেনা।

তাই আপনাদের শেয়ারকৃ্ত ১২.৫% জিনের টিকে থাকার জন্যও এটা জরুরী যে আপনি আপনার কাজিনকে বাঁচাতে গিয়ে নিজের জীবন মরণ-ঝুঁকিতে ফেলবেন না। তাই, ভাইকে বাঁচানোর জন্য আপনি যতটা আগ্রহী থাকবেন, চাচাতো ভাইকে বাঁচাতে হয়তো অতটা আগ্রহী হবেন না। উভয় ক্ষেত্রেই কিন্তু নেপথ্যে কাজ করছে সেই Selfish Genes. আপনি কাজ করে যাচ্ছেন শুধুই তাদের নির্দেশমত, একটি “Gene Reservoir and Survival Machine” হিসেবে।

যতই বিজ্ঞানের অগ্রগতি হচ্ছে, বেরিয়ে আসছে সামাজিকতা,পারিবারিকতা, পারস্পরিক সাহায্যের মত আপাত-জটিল বিষয়গুলোর পেছনের সরল বিজ্ঞান। মানুষের সব রকমের কর্মকাণ্ড, সব ধরণের সামাজিকতা কিংবা সহযোগীতাকেই এভাবে Selfish Gene দৃষ্টিভঙ্গীতে দেখা সম্ভব বলে মনে করেন অনেক বিজ্ঞানীরা। আমার লেখার ইতি টানছি বিখ্যাত ব্রিটিশ বিজ্ঞানী জে,বি,এস হ্যাল্ডনের একটি উক্তি দিয়ে। তাঁকে যখন একবার জিজ্ঞেস করা হলো, “আপনার ভাইকে বাঁচাতে আপনি জীবন দিতে রাজি আছেন?” উত্তরে তিনি ঠাট্টাচ্ছলে বলেছিলেনঃ

“জ্বি না, এক ভাইয়ের জন্য আমি মরতে রাজি না। তবে আমার দুই ভাই কিংবা আট কাজিনের জন্য মরতে আলবত রাজি আছি।”

(উপরে বর্ণিত ফর্মুলাটি প্রদান করেছেন ডব্লিউ,ডি, হ্যামিল্টন, যিনি ছিলেন রয়েল সোসাইটির একজন বিজ্ঞানী এবং অক্সফোর্ডের একজন সম্মানিত প্রফেসর। অনেকের মতেই বিংশ শতাব্দীর অন্যতম সেরা জীববিজ্ঞানী তিনি। Sociobiology এর অন্যতম রূপকার এই মহান পণ্ডিত বিবর্তনের জিনতাত্ত্বিক ব্যাখ্যারও অন্যতম পথিকৃৎ।)