এ রাজ্যের মসজিদের ইমামদের মাসিক ভাতা দেওয়ার ব্যাপারে রাজ্য সরকারের সাম্প্রতিক বিজ্ঞপ্তি নিয়ে রাজ্যের প্রধান বিরোধী দলগুলির মৌনতা যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ। ইমামদের মাসিক ভাতা, বাসস্থান নির্মানে অর্থসাহায্য, সন্তান পালনে অর্থসাহায্য – সবে মিলে যে বিশাল প্যাকেজের সগর্ব ঘোষণা হল তারপর কেবলমাত্র বিজেপির রাহুল সিনহা ছাড়া কারোর কোনো ফোঁসফাঁস দেখা গেল না। সবাই যেন কোনো এক কারনে মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছে। ‘সেকুলার’ বামফ্রন্টের শাসনকালে আমরা দেখেছি দুর্গাপুজো-কালিপুজো-ইদ-ইফতার পার্টিতে ‘কমরেড’দের সক্রিয় অংশগ্রহন। তাদের আঙুলের ইশারায় সুদুর মুম্বই থেকে লাস্যময়ী তারকারা পুজো উদ্বোধন করতে এবঙ্গে ছুটে আসতেন। ‘সেকুলার’ দেশের নাস্তিক ‘কমরেড’ তাদের পুরোনো দিনগুলো ভুলতে পারছেন না বলেই কি নতুন সরকারের এরকম নির্লজ্জ মুসলিম তোষনের বিরুদ্ধে ট্যাঁ ফোঁ করছেন না।
সংবিধান অনুযায়ী ভারত ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। কিন্তু রাষ্ট্রনেতারা বরাবরই তার প্রমাণ দিতে ব্যর্থ। এদেশে হিন্দু ছাড়া অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরা সবাই ছাগলের তৃ্তীয় ছানার মত। আমরা বহুবার প্রত্যক্ষ করেছি হিন্দু, মুসলমান, খ্রীষ্টান, শিখ প্রভৃতি ধর্মীয় গোষ্ঠীর মধ্যেকার নিরন্তর টেনশন, তা থেকে রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা। আর এসবের মধ্যে রাষ্ট্রনীতিকার এবং রাজনৈতিক দলগুলির প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ মদত থাকে এও আমরা দেখেছি। আবার প্রচুর নেতাকে দেখেছি প্রগতিশীলতার মুখোশ পরে থাকতে। দীপা মেহতার ‘ওয়াটার’ সিনেমার শুটিং সেটে হিন্দুত্ববাদীরা হামলা চালিয়েছিল। সেই ঘটনার প্রতিবাদে এবঙ্গের বুদ্ধিজীবিরা তাদের নেতাদের অঙ্গুলিহেলনে সরব হয়েছিল। অথচ ‘গদর’ সিনেমার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে মুসলিম মৌলবাদীদের ক্ষোভ সিনেমা হলে আগুন পর্যন্ত লাগিয়েছিল। অথচ এই সংঘবদ্ধ গুন্ডাগিরির বিরুদ্ধে এবাংলার তৎকালীন বুদ্ধিজীবি মহল ছিল আশ্চর্য রকমের নীরব। এখন পরিবর্তনের যুগেও দেখছি সরকারি বা বেসরকারি বুদ্ধিজীবিদের অবস্থান বদল হয়নি।
আসলে, কথায় ও কাজে এক হওয়াটা একটা অভ্যেসের ব্যাপার। সেটা সততার অভ্যেস। ভন্ডামিটাও একটা অভ্যেস। নিজেদের স্বার্থের জন্য জনগনকে ঠকানোর অভ্যেস। ইমাম ইস্যুতে সেটিই বিরোধী দলগুলিকে পেয়ে বসেছে। ভারতকে খাঁটি ধর্মনিরপেক্ষ করার প্রতিজ্ঞা না করে কোনো রাজনীতিক সকালে ব্রেকফাস্ট করেননা। সমস্ত অ-বিজেপি দল বিজেপিকে সাম্প্রদায়িক বলে গাল পাড়ে। অথচ দেখুন এই অ-বিজেপি দলগুলির নেতা মন্ত্রীরা প্রকল্পের শিলান্যাস, উদ্ধোধন সহ সমস্ত রকমের রাষ্ট্রীয় কার্যকলাপে ধর্মীয় আচার পালন করেন, শিক্ষায়তনে ধর্মীয় প্রার্থনা ও পুজো বজায় রাখেন, ভোটব্যাঙ্ক অক্ষূণ্ণ রাখতে ধর্মীয় উৎসবে হুল্লোড় করেন, ধর্মগুরুদের পায়ে হাত দিয়ে আশীর্বাদ ভিক্ষা করেন, অমরনাথ-হজের মত ধর্মীয় যাত্রাতে সরকারি ভর্তুকির ব্যবস্থা করেন। এগুলো সবই কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষতার পরিপন্থী। সোজা বাংলায় বললে সংবিধান বিরোধী কাজ। ১৯৮৯ সালের ‘রিপ্রেজেন্টেশন অফ দ্য পিপল(অ্যামেন্ডমেন্ট) অ্যাক্টের’ ২৯ (এ) ধারায় বলা হয়েছে, কোনো রাজনৈতিক দল অধর্মনিরপেক্ষ কাজকর্মের সাথে যুক্ত হলে সেই দলের রেজিষ্ট্রেশন খারিজ করা হতে পারে। কিন্তু এই অভিযোগে এখনও কোনও দলের রেজিষ্ট্রেশন বাতিল হয়নি। একবার যদিও শিবসেনার বিরুদ্ধে উগ্রধর্মবাদী প্রচারের অভিযোগ উঠেছিল এবং সেই প্রেক্ষিতে নির্বাচন কমিশন শিবসেনার রেজিষ্ট্রেশন বাতিলের হুমকি দিয়েছিল, কিন্তু শিবসেনার পালটা হুমকিতে সব ঠান্ডা মেরে যায়। শিবসেনা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছিল তাদের রেজিষ্ট্রেশন বাতিল করতে হলে ভারতের বড় মাপের সমস্ত দলের রেজিষ্ট্রেশন একই অভিযোগে বাতিল করতে হবে।
দিল্লি, পঞ্জাব, কর্নাটক, হরিয়ানাতে বহু বছর ধরেই ইমামদের ভাতা দানের সরকারি রেওয়াজ রয়েছে। মমতা বন্দোপাধ্যায় এখন এরাজ্যেও ধর্মীয় সুড়সুড়ির এই গুরুত্বপূর্ণ তাসটি খেললেন মাত্র। লক্ষ্যণীয় যে, এ রাজ্যের মসজিদে মসজিদে থাকা ইমামদের বেশিরভাগেরই বেশভূষো, খাদ্যাভাস, জীবনধারণের মান বেশ ভালো, স্বচ্ছল। সোজাকথায় বললে মাসের আড়াই হাজার টাকার ভাতা তাদের জীবনে নতুন করে কোনো পরিবর্তন আনবেনা। তাদের এই স্বচ্ছলতার পেছনের কারণটি নিয়ে আর বিশদে যাচ্ছিনা। তাছাড়া তাদের অনেকেই ভাতা চাইছেন না। কারন ইমামদের অনেকেই মনে করেন, তারা যে কাজ কাজ করেন অর্থাৎ, নমাজ পড়তে সাহায্য করা বা ধর্মীয় কাজকর্মের পরিচালনা করা এসবের জন্য কোনোও ব্যক্তি বা সরকারি অর্থ নেওয়ার বাধা রয়েছে খোদ কোরানেই। কোরানে (১২/১০৪) আল্লা বলছেন, “তুমি তোমার কাজের জন্য তাদের নিকট কোনো মজুরি দাবি করিও না। ইহাতো বিশ্বজগতের জন্য উপদেশ মাত্র”। কোরানের ২/৪১ তে আছে, “ আমার আয়াতের বিনিময়ে সামান্য মূল্যও তোমরা গ্রহণ করিও না”।
তবুও ইমামদের সরকারি সাহায্য দেওয়ার অর্থহীন প্রচেষ্টার একমাত্র উদ্দেশ্য আগামী নির্বাচনগুলিতে মুসলিম ভোট ব্যাঙ্ক আরও নিশ্চিত করা। আমরা সবাই জানি মুসলিম ভোট ধর্মীয় ভাবাবেগে কী পরিমান পরিচালিত হয়। সেজন্য মুসলিম প্রধান অঞ্চলের কোনও নির্বাচনে কোনও অমুসলিম প্রার্থীকে টিকিট দেওয়ার সাহস দেখাতে পারেনা কোনো দলই। তাই আড়াই হাজার নয়, ষোল-আনা দেওয়ার মত কোনো ‘সিম্বলিক’ ভাতা দিলেও সাধারণ মুসলমান ভোটদাতাদের কাছে ‘আমি তোমাদেরই লোক’ মেসেজটিতে খুব একটা ঘাটতি পড়ত না।
পরিশেষে মাননীয় মুখ্যমন্ত্রীর প্রতি তিনটি নোট রইলো। প্রথমতঃ কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে ইমামদের ভাতা দিয়ে, হাজার হাজার মাদ্রাসা তৈরি করে অন্ধকারে তলিয়ে যেতে থাকা মধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্ত মুসলিম জনসাধারণকে গভীর অন্ধকারের দিকে ঠেলে দেবেননা, বরং তাদেরকে আধুনিক শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যব্যবস্থার আওতায় আনতে ওই টাকা ব্যয় করুন। ইমামরা যে ধর্মের মনিটর সেই ধর্মে আছে, “ এবং তাহাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করিতে থাক, যাবত অশান্তি দূরীভূত না হয়, এবং আল্লাহর জন্য (অর্থাৎ আল্লাহর পথে চলার জন্য) আদদ্বীন প্রতিষ্ঠিত না হয়। তারপর যদি তাহারা বিরত হয় তবে অত্যাচারীদের উপর ব্যতীত শত্রুতা নাই”। “অতএব যখন নিষিদ্ধ মাসগুলি অতীত হইয়া যায় তখন সেই মোশরেকদিগকে কতল কর, যেখানে তাহাদিগকে ধৃত কর এবং অবরোধ করিয়া রাখ এবং প্রত্যেক ঘাঁটি-স্থলে তাহাদের জন্য ওঁত পাতিয়া বস; কিন্তু যদি তৌবা করে এবং সালাত দাড় করে এবং জাকাত দেয় তবে তাহাদের পথ ছাড়িয়া দাও। নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাশীল রহিম”( কোরান ২/১৯৩, ৯/৫)। ইসলাম ধর্মের পুরোহিত ইমামদের বিশ্বাস করতেই হবে যে, “অবাধ্য স্ত্রীদের প্রহার করা উচিৎ,”(সুরা নিসা ৩৪)। “চারটি পর্যন্ত বিবাহ করা পূণ্যকর্ম”(সুরা নিসা ৩)।“ স্ত্রী তোমাদের শস্যক্ষেত্র, তাই তোমরা তোমাদের শস্যক্ষেত্রে যেভাবে খুশি প্রবেশ করতে পারো”(সুরা বাকারা ২২৩)। এরকম বিশ্বাসের সাথে সরাসরি জড়িত থাকা লোকেদের হাতে সরকারি কোষাগার শূণ্য করা হচ্ছে কেন জনগণ প্রশ্ন তুলতেই পারেন। সরকারি বিজ্ঞপ্তিতে বলা হল, ইমামদের দিয়ে নানা ধরনের জনকল্যান মুলক সরকারি মেসেজ যেমন, পালস পোলিও, জণ্ডিস টীকাকরণ, এইডস সচেতনতা, বিবাহ নিবদ্ধীকরণ ইত্যাদির প্রচার করানো হবে সেজন্যই নাকি এই ভাতা। অবিজ্ঞানসম্মত এবং মৌলবাদী ধারণায় বিশ্বাসী ইমামদের নিয়ে এরকম জনকল্যানমূলক প্রচার কতটা যুক্তিযুক্ত তা একবারও ভেবে দেখা হল না? আমাদের রাজ্যের গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে থাকা অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদের সংখ্যা বাড়িয়ে বা তাদের ভাতা বাড়িয়ে কি এই কাজ করা যেত না? যেসব জনস্বার্থ মামলা হচ্ছে সেখানে এরকম প্রশ্ন উঠতেই পারে। মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী যদি পশ্চিমবংগকে হরিয়ানা বা কর্ণাটক ভাবেন তাহলে ভুল করেছেন।

দ্বিতীয়তঃ উত্তরপ্রদেশের গত বিধানসভা নির্বাচনের দিকে চোখ রাখুন। নির্বাচনের আগে কংগ্রেস নির্লজ্জ ভাবে মুসলিম তোষনে নেমেছিল। নির্বাচনে তাদের শোচনীয় পরাজয় হয়েছে। তাই ম্যরাল অফ দ্য স্টোরি- সাধু সাবধান।

তৃ্তীয়তঃ ইমামভাতা ঘোষনার পরে পরেই পূরোহিত সম্প্রদায় তাদের দাবিদাওয়া নিয়ে ময়দানে নেমে পড়েছে। এবার সম্ভবত পাদ্রীরা নামবে। এভাবে ধর্মগুরুদের আস্কারা দিয়ে ভবিষ্যতে নতুন করে কোনো সমস্যার সৃষ্টি হলে বা অশান্তির বাতাবরণ তৈরি হলে তার দায় কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীকেই নিতে হবে।