প্রথম পর্বের নিশানা

একজন সঙ্গীপরিত্যক্তা মায়ের সম্ভাব্য গতিপথ হিসেব করেছেন ট্রিভার্স। তার জন্যে সবচে’ সেরা পথ হচ্ছে আরেকটা পুরুষকে ভুলিয়ে ভালিয়ে তার সন্তানের স্বীকৃতি আদায় করা, যাতে করে সে ‘ভাবে’ এটা তারই সন্তান। যদি ওটা ভ্রূণ থাকে, জন্ম এখনো না-ই হয় তার, তবে ঘটনা খুব জটিল নয়। সন্তানটা নারীর অর্ধেকটা জিন পেলেও, তার সরলবিশ্বাসী সৎ পিতার কোন জিনই কিন্তু সে পাচ্ছে না। প্রাকৃতিক নির্বাচন পুরুষের এহেন বিশ্বাসপ্রবণতার চরম শাস্তি দেবে এবং নিঃসন্দেহে সেসব পুরুষদেরই মুখাপেক্ষী হবে যারা নতুন স্ত্রীর সাথে মিলিত হওয়া মাত্রই সম্ভাব্য যেকোন সৎসন্তানদের হত্যা করার ব্যাপারে কার্যকরী পদক্ষেপ নেবে। খুব সম্ভবত তথাকথিত ব্রুস-ইফেক্টের একটা ব্যাখ্যা এটা দিয়ে করা চলে: পুরুষ ইঁদুর একটা রাসায়নিক নিঃসৃত করে যার গন্ধ শুঁকেই গর্ভবতী মাদি ইঁদুরের গর্ভপাত হয়ে যেতে পারে। তবে, গর্ভপাতটা তখনই হবে যখন তার আগের সঙ্গীর চাইতে গন্ধটা আলাদা হয়। এইভাবে মদ্দা ইঁদুরটা তার সম্ভাব্য সব সৎসন্তানদের হত্যা করে এবং নবপরিণীতাকে তার নিজস্ব যৌনতা গ্রহণক্ষম করে তোলে। আর্ডরে অবশ্য ব্রুস-ইফেক্টকে একটা জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রক পদ্ধতি মনে করেন! একই ঘটনা ঘটে পুরুষ সিংহের বেলায়। নতুন দলে ভিড়লে কখনো কখনো সে সেখানের বাচ্চাগুলো সব মেরে ফেলে, কারণ অনুমেয়। ওরা তার নিজের সন্তান নয়।

সৎসন্তানদের হত্যা না করেও একজন পুরুষ একই উদ্দেশ্য হাসিল করতে পারে। নারীর সাথে সঙ্গম করার আগে সে বাধ্যতামূলকভাবে দীর্ঘমেয়াদি একটা পূর্বরাগ চাপিয়ে দিতে পারে, নারীর নৈকট্যপ্রিয় অন্য সব পুরুষদের দূরে রাখতে পারে, আর বন্ধ করে দিতে পারে তার পালানোর রাস্তা। এই প্রক্রিয়ায় সে অপেক্ষা করে নজর রাখতে পারে তার নারী সঙ্গী গর্ভে অন্য কোন সৎসন্তান ধারণ করছে কি না, আর ধারণ করলে তাকে ছুঁড়ে ফেলতেও পারে। নিচে আমরা নারীর সঙ্গমের আগে দীর্ঘমেয়াদি ‘সম্পৃক্ততা’র একটা কারণ দেখবো। পুরুষও যে কেন এটা চায় তারও একটা কারণ দেখা যাবে। যদি সে তাকে অন্যসব পুরুষের সংস্পর্শ থেকে দূরে রাখতে পারে, তাহলে অন্য পুরুষের সন্তানের বেকুব বাপ হওয়া থেকেও সে রক্ষা পায়।

নিঃসঙ্গ রমণীটির ক্ষেত্রে আরেকটা বিকল্প হতে পারে লেগে থেকে চেষ্টাচরিত্র করে নিজেই বাচ্চাটা মানুষ করা। বিশেষত যদি বাচ্চাটা বড় হয়ে যায় তাহলে ব্যাপারটা তার জন্যে বেশ সুবিধের হবে। বয়েসে সে যত বড়, ততই তার পেছনে বিনিয়োগের মাত্রা বেশি হয়েছে, আর তাতে করে তাকে লালন-পালন করতে তার মায়ের খরচ ততই কম। বাচ্চাটা যদি বেশ কমবয়েসিও হয়, তারপরও মা-টি তার প্রাথমিক বিনিয়োগ থেকে কিছু উদ্ধার করার চেষ্টা লাভজনক হবে, যদিও পুরুষ সঙ্গী চলে যাওয়ায় তাকে হয়তো এখন বাচ্চাটাকে খাওয়ানোর জন্যে দ্বিগুণ শ্রম দিতে হবে। বাচ্চাটার শরীরে অর্ধেক জিন পুরুষেরও এবং তাকে ছুঁড়ে ফেললে প্রতিশোধ নেওয়া যাবে এই চিন্তাও তাকে সান্ত্বনা দিতে পারে না। প্রতিশোধের জন্যে প্রতিশোধ নিয়েও কোন লাভ নেই। ঐ শিশুর অর্ধেক জিন তার, এবং ঝামেলাটা এখন তার নিজেরই।

আশ্চর্যের কাণ্ড হচ্ছে, সঙ্গীপরিত্যক্ত হওয়ার ভয় আছে এমন নারীর ক্ষেত্রে যৌক্তিক পন্থা হচ্ছে তার সঙ্গী তাকে ছেড়ে যাওয়ার আগেই তার সঙ্গীকে ছেড়ে যাওয়া। এতে করে তার লাভের আশা আছে, এমনকি যদি সে তার পুরুষ সঙ্গীর চাইতে এরই মধ্যে শিশুর পেছনে চাইতে বেশি বিনিয়োগ করে বসে, তারপরও। তেতো সত্যিটা হচ্ছে কোন কোন ক্ষেত্রে আগে যে-অভিভাবক পালাবে, লাভটা তারই হবে বেশি-সে মা-ই হোক বা বাবা। ট্রিভার্স যেমনটা বলেছেন, যে-সঙ্গী পড়ে থাকে তারই ঠাঁই হবে নিষ্ঠুর বন্ধনে। যুক্তিটা নিতান্ত ভয়াবহ কিন্তু বেশ সূক্ষ্ম। যে-মুহূর্তে পুরুষ বা নারীর পক্ষে এ-কথাটা বলা সম্ভব হবে, তখনই তার সঙ্গীত্যাগের সম্ভাবনা যাবে বেড়ে: “বাচ্চাটা এখন বেশ বড় হওয়ায় আমাদের যে-কেউ তাকে এখন একা একাই লালন-পালন করতে পারবে। তাই সরে যাওয়ায় এখন আমার লাভ হবে, তবে শর্ত হচ্ছে আমার সঙ্গীও যেন সরে না যায় এব্যাপারে আমায় নিশ্চিত হতে হবে। আমি যদি এখন সরে পড়ি, আমার সঙ্গী সেটাই করবে যেটা তার জিনের জন্যে সবচে’ উপযোগী। সে আমার চাইতে অনেক কঠিন একটা সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হবে, কারণ আমি তো এরই মধ্যে চলেই গেছি। আমার সঙ্গী ‘জানবে’ যে যদি সেও সরে যায়, তবে শিশুটার মৃত্যু নিশ্চিত। তাই, আমার সঙ্গী তার নিজের স্বার্থপর জিনের জন্যে সেরা সিদ্ধান্তটা নেবে ধরে নিয়ে আমি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছালাম যে আমার সবসেরা রাস্তাটা হচ্ছে আগে সরে যাওয়া। এটা আরো বিশেষ জোর দিয়ে করার ব্যাপার, কারণ যেহেতু আমার সঙ্গীর মাথায়ও হয়তো একই ‘চিন্তা ঘুরছে’, আর যে-কোন মুহূর্তে সে আমায় ফেলে পালানোর সুযোগটা নিয়ে বসবে!” অন্যবারের মতোই, এই স্বগতোক্তি স্রেফ বোঝার সুবিধের জন্যে। সারকথাটা হচ্ছে প্রথমে পিঠটান-দেওয়া জিনগুলো সফলভাবে নির্বাচিত হবে শুধু একটাই কারণে যে পরের জিনগুলো নির্বাচিত হওয়ার সুযোগই পাবে না।

সঙ্গীপরিত্যক্তা হলে একজন নারী কী করতে পারে তার কিছু বিবরণ আমরা পেলাম। কিন্তু সেসব আসলে সবচে’ খারাপ কিছুর ভেতরে কিছুটা ভালো করার চেষ্টা। পুরুষ সঙ্গীর শোষণ কমানোর জন্যে সে প্রাথমিকভাবে কী করতে পারে? তার হাতে আছে এক দারুণ দান। সে সঙ্গমবিমুখ হতে পারে। বেচার বাজারে তার চাহিদা সুপ্রচুর। কারণ যৌতুক হিসেবে সে আনবে এক বিশাল, পুষ্টিকর ডিম্বাণু। সফল সঙ্গম শেষ করবে যে-পুরুষ, সে পাবে তার অনাগত সন্তানের জন্যে এক মূল্যবান খাদ্যসম্ভার। রমণী রমণের আগে দারুণ দরকষাকষির আসন পায়। একবার যদি তার সঙ্গম সমাপ্ত হলো, খেলে ফেলেছে সে তার টেক্কাটা-তার ডিম্বাণু উৎসর্গ করেছে সে পুরুষ সঙ্গীর উদ্দেশে। দরকষাকষির কথা শুনতে বেশ ভালোই শোনায়, কিন্তু আমরা ভালো করেই জানি যে আদতে ঘটনা সেরকমটা ঘটে না। বাস্তব কোন পথ কি আছে যেখানে প্রচণ্ড দরাদরির মতো কোন ব্যাপার প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে ঘটবে? দুটো মুখ্য সম্ভাবনা নিচ্ছি, একটার নাম ঘরোয়া-আশীর্বাদ কৌশল, আর অন্যটা হচ্ছে অতি-পুরুষ কৌশল। ঘরোয়া-আশীর্বাদ কৌশলের মূল ব্যাপারটা খুব সহজে এরকম। নারী পুরুষ খোঁজার দায়িত্ব হাতে নেয় আর আগেভাগেই বিশ্বস্ততা আর গৃহমুখিনতার চিহ্ন খুঁজে বের করার চেষ্টা করে। জনগোষ্ঠীতে পুরুষদের বিশ্বস্ত স্বামী হওয়ার ঘটনায় ভিন্নতা থাকতে বাধ্য। নারীরা যদি আগেই এসব গুণগুলোর খোঁজ পায়, তারা এমন পুরুষ সঙ্গী নির্বাচন করে নিজেদের ফায়দা তুলবে। নারীদের এটা করার একটা উপায় হচ্ছে লজ্জাশীলা হয়ে দীর্ঘক্ষণ যাবৎ খেলিয়ে-যাওয়া। যে-পুরুষ নারীর সঙ্গমের সম্মতি প্রদানের আগে অনেকটা সময় অপেক্ষা করতে রাজি নয় সে বিশ্বস্ত স্বামী হওয়ার বাজিতে আগেই হেরে বসলো। প্রলম্বিত বাগদানপর্বের ওপর জোর দিয়ে নারীটি সম্ভাব্য বিবাহযোগ্যদের তালিকা ছেঁটে আনে, এবং শেষমেষ সঙ্গত হয় সেই পুরুষটিরই সাথে যে আগেই তার বিশ্বস্ততা আর ধৈর্যের গুণাবলি প্রমাণ করতে পেরেছে। প্রাণীদের ভেতর নারীসুলভ ব্রীড়াপ্রদর্শন এবং সেইসাথে দীর্ঘায়িত পূর্বরাগ বা বাগদানপর্ব বেশ সাধারণ ঘটনাই। আমরা এরই মধ্যে অবশ্য দেখেছি, দীর্ঘায়িত পূর্বরাগের কারণে পুরুষও লাভবান হতে পারে যেখানে অন্য পুরুষের সন্তান তার বলে চালিয়ে দিয়ে তাকে প্রতারণা করার সম্ভাবনা আছে।

পূ্র্বরাগ পদ্ধতিতে অনেকসময় পুরুষের প্রচুর প্রাক-সঙ্গম বিনিয়োগের প্রমাণ মেলে। পুরুষ সঙ্গী যতক্ষণ না বাসা বানিয়ে দিচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত নারী তার সাথে মিলিত হবে না। অথবা পুরুষ সঙ্গীর হয়তো তাকে প্রচুর খাবার এনে খাওয়াতে হবে। নারীর দৃষ্টিকোণ থেকে ঘটনা বেশ চমৎকার বৈকি, কিন্তু এটা ঘরোয়া-আশীর্বাদ কৌশলের অন্য একটা সম্ভাব্য সংস্করণও বটে। নারী কি পুরুষকে সঙ্গমের আগে তাদের সন্তানের পেছনে এতোটা সুপ্রচুর পরিমাণে বিনিয়োগে বাধ্য করতে পারে যাতে করে পুরুষেরা সঙ্গমের পর সঙ্গীত্যাগ করে কোন ফায়দা ওঠাতে পারবে না? ধারণাটা ভাবায় বটে। যে-পুরুষ ব্রীড়াবতী রমণীর সঙ্গমের জন্যে অপেক্ষা করছে সে দামটা চুকোচ্ছে এভাবে: অন্য নারীদের সাথে সঙ্গমের সুযোগ ত্যাগ করতে হচ্ছে তাকে এবং পূর্বরাগ পর্যায়ে সে খরচ করছে অনেকটা সময় আর শক্তি। যতক্ষণ পর্যন্ত না সে একজন নির্দিষ্ট নারীতে উপগত হচ্ছে, অনিবার্যভাবেই সে-নারীর প্রতি সে অতিমাত্রায় ‘দায়বদ্ধ’ থাকবে। সে-নারীকে ত্যাগ করার আকুলতা তার কমই হবে, যদি সে জানে যে ভবিষ্যৎ যে রমণীর কাছেই সে যাবে, আসল কম্মে আসার আগে প্রচুর সময় খেয়ে নেবে সে-ও।

একটা পেপারে (প্রকাশিত বৈজ্ঞানিক গবেষণার ফল) আমি দেখিয়েছি যে, এখানটায় ট্রিভার্সের যুক্তিবোধে বেশ একটু ঘাটতি আছে। তিনি ভেবেছিলেন কাউকে ভবিষ্যৎ বিনিয়োগে দায়বদ্ধ করার জন্যে পূর্ববিনিয়োগ একাই যথেষ্ট। এটা ভ্রান্ত অর্থনীতি। একজন ব্যবসায়ী কখনোই বলবে না, “কনকর্ড এয়ারলাইনারে (একটা উদাহরণ) আমি এতোটাই বিনিয়োগ করেছি যে ওটাকে এখন জঞ্জালে পরিণত হতে আমি দিতে পারি না।” বরং বর্তমানে ওতে প্রচুর বিনিয়োগ করার পরও সে সবসময়ই জানতে চাইবে এখন যদি সে প্রকল্পটা ছেড়ে দেয়, কমিয়ে নেয় তার ক্ষতি, তাহলে ভবিষ্যতে তার লাভ হচ্ছে কি না। এমনিভাবে, কোন নারীর কোন পুরুষকে তার পেছনে এই আশায় বিশাল বিনিয়োগে বাধ্য করে কোনই লাভ নেই যে, স্রেফ এই কারণেই পুরুষটা তাকে ছেড়ে যাবে না। ঘরোয়া-আশীর্বাদের এই কৌশলটা আরো একটা গুরুত্বপূর্ণ ধারণার ওপর নির্ভরশীল। সেটা এই যে বেশিরভাগ নারীরা একই খেলা খেলবে বলে বিশ্বাস করা যায়। যদি জনগোষ্ঠীতে স্ত্রীত্যাগী পুরুষদের স্বাগত জানানোর জন্যে শিথিলচরিত্রের নারী সুলভ হয়, তাহলে বৌ ছেড়ে দিয়েও পুরুষটার লাভ আছে বৈকি, তা সন্তানদের পেছনে এরইমধ্যে যতোটাই বিনিয়োগ সে করে থাকুক না কেন।

তাহলে দেখা যাচ্ছে বেশিরভাগটাই নির্ভর করছে সিংহভাগ স্ত্রীকুলের ব্যবহারের ওপর। নারীদের ষড়যন্ত্রের দিক থেকে ভাবতে গেলে সমস্যা বিশেষ নেই। কিন্তু পঞ্চম অধ্যায়ে ঘুঘুদের ষড়যন্ত্রের ঘটনা যেমনটা দেখিয়েছি, নারীদের ষড়যন্ত্রটা তার চাইতে অন্য কোন রকমেই বিবর্তিত হতে পারে না। বরং আমাদের তাকাতে হবে বিবর্তনীয় স্থিতিশীল কৌশলের জন্যে। আসুন চোখ দেই মেইনার্ড স্মিথের আগ্রাসী প্রতিযোগিতা বিশ্লেষণের পদ্ধতির দিকে এবং সেটা কাজে লাগাই লিঙ্গের ব্যাপারে। বাজপাখি আর ঘুঘুর চাইতে ব্যাপারটা একটু জটিল হবে বৈকি, কারণ আমাদের হাতে আছে দুটো নারী কৌশল আর দুটো পুরুষালি কৌশল। মেইনার্ড স্মিথের গবেষণায় দেখা গেছে যে, ‘কৌশল’ শব্দটা নির্বিচার অসচেতন ব্যবহার পদ্ধতির দিকে নির্দেশ করে। আমাদের দুটো রমণীসুলভ কৌশলের নাম দেওয়া হবে লজ্জাসুলভ (coy) ও দ্রুত (fast), এবং পুরুষালি কৌশল দুটোর নাম হবে বিশ্বস্ত (faithful) ও নাগরসুলভ (philanderer)। ওই চারটা প্রকরণের কার্যপদ্ধতি হবে এরকম। লজ্জাশীল রমণীরা ততক্ষণ পর্যন্ত কোন পুরুষের সাথে মিলিত হবে না যতক্ষণ না সে কয়েক সপ্তাহ দীর্ঘ এবং খরুচে পূর্বরাগকালের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। দ্রুত নারীরা যেকারোর সাথেই ঝটপট শুয়ে পড়বে। বিশ্বস্ত পুরুষেরা দীর্ঘমেয়াদি পূর্বরাগের ভেতর দিয়ে যেতে রাজি, আর সঙ্গমের পর তারা নারীকে সঙ্গ দেয় এবং বাচ্চাপালনে সহায়তা করে। নাগরসুলভ পুরুষেরা তাৎক্ষণিক মিলনাগ্রহী নারী না পেলে দ্রুতই ধৈর্য হারিয়ে ফেলে: ওকে ফেলে সে আরেক নারীসন্ধানে বেরিয়ে পড়বে; সঙ্গমের পরেও তারা পাশে থেকে ভালো বাবা হবে না, আবারো বেরিয়ে পড়বে টাটকা নারীদেহের খোঁজে। বাজপাখি আর ঘুঘুর ক্ষেত্রে এগুলো একমাত্র সম্ভাব্য কৌশল নয় বটে, কিন্তু তাদের ভবিষ্যৎ পর্যবেক্ষণ করাটা বুঝতে সাহায্য করবে বৈকি।

মেইনার্ড স্মিথের মতোই, বিভিন্ন লাভ-ক্ষতির খতিয়ান নিতে গিয়ে আমরা ইচ্ছেমত কিছু কাল্পনিক মান নেবো। সাধারণভাবে বুঝতে গেলে বীজগাণিতিক প্রতীক ব্যবহার করলেই চলে, কিন্তু সংখ্যা দিয়ে বুঝতে আরো সহজ হবে। ধরা যাক বাচ্চা সফলভাবে বড় করে তুললে পরে অভিভাবকপ্রতি জিনগত লাভের পরিমাণ হবে +১৫ একক। বাচ্চাপ্রতি লালন-পালন করার, তার খাবারের সব খরচের, তার পেছনে ব্যয়িত পুরো সময়ের, এবং তার পেছনে নেওয়া যত ঝুঁকির খরচ হবে -২০ একক। খরচটা ঋণাত্মক এককে ধরা হলো, কারণ মা-বাবারা এটা ‘ব্যয় করছে’। দীর্ঘমেয়াদি পূর্বরাগে খরচ-হওয়া সময়ের ব্যয়ভারটাও হবে ঋণাত্মক। ধরা যাক এটা -৩ একক।

ধরা যাক এমন একটা জনগোষ্ঠী পেয়েছি যেখানে সব নারীই লজ্জাশীল এবং সব পুরুষেরাই বিশ্বস্ত। একটা আদর্শ একগামী সমাজ এটা। প্রতি জোড়ায় পুরুষ এবং নারী দুজনেই সমান গড় প্রাপ্তির অধিকারী হয়। প্রতিটা সন্তানপালনের জন্যে তারা পাচ্ছে +১৫ পয়েন্ট; পালনের খরচ (-২০) তারা দুজনেই ভাগাভাগি করে নিচ্ছে, প্রত্যেকের ভাগে পড়ছে -১০ একক। দীর্ঘ পূর্বরাগকালে ব্যয়িত সময়ের জন্যে তাদের দণ্ড হলো -৩ পয়েন্ট। প্রত্যেকের জন্যে গড়পড়তা প্রাপ্তি দাঁড়াচ্ছে তাহলে +১৫-১০-৩=+২।

এখন মনে করা যাক একটা মাত্র দ্রুত চরিত্রের নারী ঢুকে পড়লো জনগোষ্ঠীতে। তার জন্যে কিন্তু দারুণ সুবিধে। সে সময়ক্ষেপণে অপচয় করবে না, কারণ দীর্ঘমেয়াদি পূর্বরাগপর্বের ধারেকাছে সে নেই। যেহেতু জনগোষ্ঠীর সব পুরুষই বিশ্বস্ত, যার সাথেই সে মিলিত হোক না কেন তার সন্তানাদির জন্যে ভালো বাবা পাওয়ার নিশ্চয়তা তার থাকছে সবসময়। সন্তানপ্রতি তার গড়পড়তা প্রাপ্তির পরিমাণ হচ্ছে +১৫ -১০ =+৫। সে তার ব্রীড়াবতী প্রতিদ্বন্দ্বীদের চাইতে ৩ একক এগিয়ে থাকছে। তাই এই দ্রুত জিনটি ছড়িয়ে পড়া শুরু হবে।

দ্রুত রমণীর সাফল্য যদি এতোটাই বেশি হয় যে জনগোষ্ঠীতে তারাই হয়ে ওঠে শীর্ষস্থানীয়, পুরুষ শিবিরেও পরিবর্তন দেখা দেবে। এতোদিন, একচ্ছত্রাধিপত্য ছিলো বিশ্বস্ত পুরুষদেরই। এবার যদি দেখা দেয় নাগরসুলভ পুরুষ, তার বিশ্বস্ত প্রতিদ্বন্দ্বীর চাইতে সে সফল হবে। যে-জনগোষ্ঠীতে নারীরা দ্রুত, নাগরসুলভ পুরুষেরাও বেশ সহজেই নির্বাচিত হবে। একটা বাচ্চা সফলভাবে বেড়ে উঠলে সে পাবে +১৫ পয়েন্ট, এবং কোন খরচের ধাক্কাই তাকে পোয়াতে হবে না। এই ব্যয়ের অনুপস্থিতির ফলাফল হবে সে মুক্ত হয়ে নতুন সঙ্গিনীর সাথে ঘুরতে পারবে। প্রত্যেকটা দুর্ভাগ্যবতী স্ত্রী একাকী সন্তান নিয়ে সংগ্রামের মুখে পড়বে, খরচের খাতায় পুরোপুরি -২০ পয়েন্ট, যদিও সে পূর্বরাগের পেছনে ফালতু সময় দেয় নি মোটেই। দ্রুত নারীরা নাগরসুলভ পুরুষদের সাথে মিলিত হলে তাদের মোট খরচ হচ্ছে +১৫ -২০= -৫; আর নাগরটির লাভ +১৫। যে-জনগোষ্ঠীতে নারীরা দ্রুত, দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়তে থাকবে নাগরসুলভ জিন।

যদি নাগরদের বিস্তার এতোটাই সফল হয়ে পড়ে যে তারাই হয়ে ওঠে জনগোষ্ঠীর পুরুষদের সিংহভাগ, দ্রুত রমণীরা পড়বে মহাসংকটে। লজ্জাশীলারাই পাবে প্রবল সুবিধে। যদি একজন লজ্জাশীলা মিলিত হয় একজন নাগরসুলভ পুরুষের সাথে, ফলাফল শূন্য। নারীটি জোর দেবে দীর্ঘমেয়াদি পূর্বরাগের ওপর; পুরুষটি নাড়বে ঘাড় এবং বেরিয়ে পড়বে অন্যকোন রমণীর সন্ধানে। সময়ক্ষেপণের ব্যয়ভার কারো ওপরেই বর্তাবে না। কারুর অবশ্য কোন প্রাপ্তিযোগও ঘটবে না, যেহেতু কোন সন্তানের জন্মই হয় নি। এভাবে নাগরসুলভ পুংমণ্ডলীময় জনগোষ্ঠীতে ব্রীড়াবতীদের প্রাপ্তিযোগ শূন্যের কোঠায়। শূন্য শুনলে হয়তো পাত্তাই দেবো না, কিন্তু যেখানে দ্রুত রমণীদের গড় পয়েন্ট -৫, তার থেকে তো এটা অন্তত ভালো। এমনকি নাগরসুলভ পুরুষ কর্তৃক পরিত্যক্ত হয়ে কোন দ্রুত রমণী যদি তার সন্তানটা ফেলে যাওয়ারও চিন্তা করে, তারপরও সে ডিম্বকের মতো একটা বেশ দামি জিনিস খরচ করেছে। তাই, জনগোষ্ঠীতে আবারো ছড়াবে লজ্জাশীলা জিন।

এই কাল্পনিক চক্র সম্পন্ন করতে, যখন লজ্জাবতীরা সংখ্যায়গুরু হওয়ার মতো বাড়বে, দ্রুত রমণীদের সাথে মসৃণ সময় কাটানো নাগরসুলভ পুরুষেরা নাড়া খাবে। নারীর পর নারীরা জোর দেবে দীর্ঘ এবং কষ্টকর পূর্বরাগের ওপর। নাগরসুলভ পুরুষেরা ছুটে যাবে নারী থেকে নারীতে, আর কাহিনি সর্বত্রই এক। সব রমণীই লজ্জাশীল হলে একজন নাগরসুলভ পুরুষের মোট লাভ শূন্য। এখন যদি একজন বিশ্বস্ত পুরুষের দেখা মেলে, একমাত্র তারই সাথে মিলিত হতে চাইবে লজ্জাবতী নারীকুল। তার মোট লভ্যাংশ দাঁড়াবে +২, নাগরদের চাইতে বেশি। তাই, বাড়তে থাকবে বিশ্বস্ত জিনেদের পরিমাণ, আর আমরা পাবো পূর্ণ চক্র।

আগ্রাসন বিশ্লেষণ করতে গিয়ে গল্পটা আমরা এমনিভাবে বলেছি যেন এটা একটা অন্তহীন দোলন। কিন্তু, ওই ব্যাপারের মতো এখানেও দেখিয়ে দেওয়া যায় যে, আসলে দোলাদুলিরই কোন অস্তিত্ব নেই। পুরো ব্যাপারটাই একটা স্থায়ী অবস্থায় কেন্দ্রীভূত হবে। যদি অঙ্কের হিসেবে যাই, দেখা যাবে যে-জনগোষ্ঠীতে ৫/৬ ভাগ হচ্ছে লজ্জাশীল, আর ৫/৮ ভাগ পুরুষ বিশ্বস্ত, সেটা বিবর্তনীয়ভাবে স্থিতিশীল। এটা আসলে হয়েছে স্রেফ প্রথম দিকে আমরা যে-কাল্পনিক সংখ্যা ধরেছিলাম সেজন্যে, কিন্তু অন্য যেকোন কাল্পনিক ধারণার জন্যেও স্থায়ী অনুপাত হিসেব করাটা সহজ হয়।

মেইনার্ড স্মিথের বিশ্লেষণানুসারে, দুরকম পুরুষ আর দুরকম নারীর কথা ভাবার দরকার আমাদের পড়ে না। বিস্থাকৌ [বিবর্তনানুগ স্থায়ী কৌশল=ESS] বেশ ভালোই খাটবে যদি কোন পুরুষ তার জীবনের ৫/৮ ভাগ সময় কাটায় বিশ্বস্ত হিসেবে আর বাকি সময়টা নাগরসুলভ আচরণ করে; আর প্রতিটি নারীই তার ৫/৬ ভাগ সময় কাটায় লজ্জাশীল হয়ে, আর ১/৬ ভাগ সময় কাটায় দ্রুত নারী হিসেবে। যেভাবেই আমরা বিস্থাকৌ হিসেব করি না কেন, এর মূল মানে এটাই। যথার্থ স্থায়ী অনুপাত থেকে যেকোন লিঙ্গেরই দূরে সরে আসার প্রবণতার দণ্ড হবে অন্য লিঙ্গের কৌশলের অনুপাতে পরিবর্তন, যাতে করে মূল নিয়মভঙ্গকারীর অসুবিধেই হয়। আর তাই টিকে যায় বিস্থাকৌ।

শেষমেষ এই সিদ্ধান্তে আমরা আসতে পারি যেকোনো জনগোষ্ঠীতে বিবর্তনের মাধ্যমে প্রচুর লজ্জাশীলা রমণী আর বিশ্বস্ত পুরুষের আগমন সম্ভব। এই অবস্থায় নারীদের ঘরোয়া-আশীর্বাদ কৌশল ভালোই কাজ করে। লজ্জাশীলা রমণীদের ষড়যন্ত্রের দিকে না ভাবলেও চলবে। লজ্জা কোন নারীর স্বার্থপর জিনেদের সত্যিকার অর্থেই কাজে আসে। এরকম কৌশল কাজে লাগানোর অনেক রাস্তাই নারীদের হাতে আছে। আমি এরইমধ্যে উল্লেখ করেছি যে, যে-পুরুষ তাকে বাসা বানিয়ে দেবে না, বা কমসেকম তাকে বাসা বানাতে সাহায্য করবে না, এমন পুরুষদের সাথে মিলিত হতে নারীটি অস্বীকার করতে পারে। ঠিক এই কারণেই বহু একগামী পাখির মিলন সংঘটিত হয় বাসাটা বাঁধার পরই। এর ফলাফলটা দাঁড়ায় এই যে মিলনমুহূর্তে পুরুষটি স্রেফ তার সস্তা শুক্র থেকে সন্তানের পেছনে অনেক দামি কিছু বিনিয়োগ করেছে। একজন সম্ভাব্য পুরুষ সঙ্গীর কাছে বাসা বানানোর দাবি করে তাকে আটকে রাখার কৌশলটা নারীর ক্ষেত্রে একটা উপযুক্ত উপায়। এটা ভেবে নেওয়া যায় যে তত্ত্বগতভাবে পুরুষের পক্ষে যেকোন কিছুর বিশাল ব্যয়ই মূলত তত্ত্বগত, এমনকি যদি অনাগত সন্তানের সুবিধের জন্যে যদি সরাসরি করা না-ও হয়। যদি কোন জনগোষ্ঠীর নারীরা পুরুষদের সাথে মিলিত হওয়ার আগে ড্রাগনমারা বা পাহাড়জয়ের মতো খুব কঠিন আর খরুচে কাজ করতে বাধ্য করে, তারা তাত্ত্বিকভাবে পুরুষদের সঙ্গমের পর তাদের ছেড়ে যাওয়ার লোভ কমিয়ে দেয়। সঙ্গীত্যাগের লোভাতুর যে-পুরুষ তার জিন অন্য নারীর মাধ্যমে ছড়ানোর ইচ্ছে পোষণ করে, সে তার মাথায় এই ভাবনাটা এলেই দমে যাবে যে আরেকটা ড্রাগন তাকে মারতে হবে। বাস্তবে নারীরা অবশ্য তাদের হবু বরদের ওপর ড্রাগনহত্যা বা হোলি গ্রেল খোঁজার মতো কাজ বাধ্যতামূলক করে চাপিয়ে দেয় না। রোম্যান্টিক যে-রমণী অকারণ প্রেমের খুঁটিনাটি ভার চাপায়, তার চাইতে তার প্রতিদ্বন্দ্বী যে-নারী সমান পরিশ্রমের কিন্তু তার আর তার সন্তানের মঙ্গলজনক কাজের দায়িত্ব দিচ্ছে সে-ই থাকবে এগিয়ে। বাসা-বানানো হয়তো ড্রাগনের মুন্ডুকাটা কি সাঁতরে হেলিসপয়েন্ট পার হওয়ার চাইতে কম রোম্যান্টিক হতে পারে, কিন্তু অনেক বেশি কাজের। আমি এর আগে যেটার উল্লেখ করেছি, পূর্বরাগের সময় নারীকে পুরুষের খাইয়ে দেওয়ার সেই অভ্যেসটাও বেশ কাজে আসে। পাখিদের মধ্যে এটা সাধারণত নারীদের শিশুসুলভ ব্যবহার করার একটা ধরন হিসেবে দেখা যায়। বাচ্চা পাখিদের মতোই সে পুরুষটার কাছে আবদারের ভঙ্গি করে।

এটা ধরে নেওয়া হয়েছে যে এগুলো পুরুষটা স্বাভাবিকভাবেই পছন্দ করবে, যেমনটা মানুষ পরিণত রমণীদের আধো আধো বোল বা ঠোঁটবাঁকানো পছন্দ করে। এপর্যায়ে মাদি পাখিটা বাড়তি যা খাবার চায়, তার সবই পায়, কারণ সে বিরাট ডিম উৎপাদনের জন্যে তার রসদ যোগাড় করছে। পূর্বরাগের সময় পুরুষের খাওয়ানোটা সম্ভবত ডিমের পেছনে তার প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ নির্দেশ করে। এতে করে মা-বাবা দুজনের ভেতর সন্তানের পেছনে প্রাথমিক বিনিয়োগের বৈষম্য কমে আসে।

পূর্বরাগের সময় খাওয়ানোর এই ঘটনাটা আরো চোখে পড়ে বেশ কিছু কীটপতঙ্গ এবং মাকড়সার মধ্যে। এখানে একটা বিকল্প ব্যাখ্যা কখনোসখনো বেশ নজরে পড়ে। যেহেতু ঘাসফড়িংয়ের বেলায় পুরুষটার তুলনামূলকভাবে বড় নারীসঙ্গীর ভক্ষ্য হওয়ার আশঙ্কা থাকে, তাই সঙ্গিনীর খিদে কমানোতে সে যাই করে তাতেই তার সুবিধে হতে পারে। হতভাগ্য পুরুষ ঘাসফড়িংটা তার সন্তানদের পেছনে আত্মত্যাগের মাধ্যমে যেভাবে বিনিয়োগ করে বলা চলে সেটায় রীতিমত বীভৎসতার ছাপ আছে। নিজেই খাবার হয়ে সে ডিমগুলো তৈরিতে সহযোগিতার পর মৃত্যু-উত্তরকালে তার সঞ্চিত শুক্রের মাধ্যমে সেসব ডিম নিষিক্ত করার রাস্তা করে দেয়।

ঘরোয়া-আশীর্বাদ কৌশল বেছে নেওয়া একজন নারী, যে পুরুষদের খুঁজে বেড়ায় আর আগেভাগেই চিহ্নিত করতে চায় বিশ্বস্ততার লক্ষণ, নিজেকে রাখে প্রতারণার ঝুঁকিতে। যেকোনো পুরুষ যে নিজেকে ভালো অনুগত গৃহমুখিন ধারার সদস্য হিসেবে চালিয়ে দিতে পারে, কিন্তু আসলে যার মধ্যে সঙ্গীত্যাগ এবং বিশ্বস্ততার প্রতি তীব্র আকর্ষণ, বেশ ভালো সুবিধে পেতে পারে সে। যতদিন অবধি পরিত্যক্ত স্ত্রীরা অন্তত কিছু ছেলেমেয়ে বড় করার প্রক্রিয়া চালিয়ে যায়, প্রতিদ্বন্দ্বী সৎ স্বামী এবং বাবার চাইতে বেশি জিন বংশানুক্রমে চারিয়ে যাওয়ার সুবিধে নাগরটিরই হবে। জিনপুলে পুরুষদের কার্যকর প্রতারণার জিনের প্রতি আনতি বেশি তৈরি হবে। আবার উল্টোদিকে, প্রাকৃতিক নির্বাচন সেসব নারীদের সমর্থন দেবে যারা এসব ধোঁকাবাজির রহস্য বেশ ভালোই ভেদ করতে পারে। এর একটা রাস্তা এরকমটা হতে পারে যেখানে নতুন কোন পুরুষ প্রেম নিবেদন করতে এলে তাকে বেশ শক্তহাতে খেলিয়ে নেওয়া, কিন্তু পরবর্তী মিলনঋতুতে গত বৎসরের সঙ্গীকে বেশ দ্রুতই সুযোগ দেওয়া। এতে করে যেসব তরুণ পুরুষ তাদের প্রথম মিলনঋতুতে অগ্রসর হচ্ছে তারা এমনিএমনিই শাস্তি পাবে, তা তারা ধোঁকাবাজ হোক চাই না-ই হোক। সাদাসিধে নারীদের প্রথম বছরের সন্তানদের মধ্যে অবিশ্বস্ত বাবার জিন থাকার সম্ভাবনা তুলনামূলকভাবে বেশি, কিন্তু বিশ্বস্ত বাবারা সুবিধে পাবে একই মায়ের দ্বিতীয় এবং এর পরের প্রজন্মগুলোয়, কারণ তাদের আর অতোটা শক্তিঅপচায়ক আর সময়খরুচে পূর্বরাগ পদ্ধতির ভেতর দিয়ে যেতে হবে না। যদি কোন জনগোষ্ঠীতে সরলসোজা মায়ের চাইতে অভিজ্ঞ মায়েদের সন্তানসংখ্যা বেশি হয়-যেটা অনেক দিন ধরে টিকে-থাকা কোন প্রজাতির ব্যাপারে একটা যৌক্তিক আন্দাজ-জিনপুলে সৎ, ভালো পিতৃত্বের জিন বেশিই টিকে থাকবে।

সহজ করে বলতে গিয়ে আমি বলেছি যেন পুরুষ হয় আদ্যোপান্ত সৎ হবে অথবা পুরোপুরি অসৎ। বাস্তবে এটাই বেশি সম্ভব যে সব পুরুষই, অবশ্য সব প্রাণীই, কিছু মাত্রায় প্রতারক। নিজের সঙ্গীকে শোষণ করার সুযোগ নেওয়ার সুবিধে নেওয়ার ব্যাপারে সবাই নির্দেশপ্রাপ্ত। প্রাকৃতিক নির্বাচন প্রত্যেক সঙ্গীর অন্যের অসততা সনাক্ত করার ক্ষমতা শাণিত করে বড়মাপের প্রতারণা মোটামুটি কম মাত্রায় সীমিত রাখে। পুরুষেরা অসৎ পথে থেকে নারীদের চাইতে বেশি লাভবান হয়, এবং আমরা অবশ্যই আশা করতে পারি যে, এমনকি যেসব প্রজাতিতে পুরুষেরা চোখে পড়ার মতো পিতৃসুলভ পরার্থপরতা প্রদর্শন করে, তারা সাধারণত নারীদের চাইতে অন্তত কিছুটা হলেও কম কাজ করে, এবং পিঠটান দেওয়ার ব্যাপারে একটু বেশিই উদার থাকে। পাখি আর স্তন্যপায়ীদের মধ্যে ঘটনাটা এরকমটাই ঘটে। কিছু প্রজাতি অবশ্য আছে যেখানে পুরুষেরা সন্তানপালনে নারীদের চাইতে বেশিই কাজ করে। পাখি আর স্তন্যপায়ীদের মাঝখানে এহেন পিতৃসুলভ নিবেদনের ঘটনা ব্যতিক্রমীভাবে বিরল, কিন্তু মাছেদের মধ্যে বেশ সাধারণ। কেন? স্বার্থপর জিনতত্ত্বের জন্যে এই চ্যালেঞ্জটা আমায় অনেক দিন ধরেই ধাঁধায় রেখেছিলো। মিস টি. আর. কার্লাইল একটা টিউটোরিয়ালে সাম্প্রতিককালে আমায় একটা দারুণ প্রতিভাদীপ্ত সমাধান যুগিয়েছেন। ওপরে বর্ণিত ট্রিভার্সের ‘নিষ্ঠুর বন্ধন’ ধারণাটারই ব্যবহার তিনি করেছেন।

বেশিরভাগ মাছই মিলিত হয় না, বরং স্রেফ তাদের যৌনকোষগুলো পানিতে ছেড়ে দেয়। মুক্ত পানিতেই নিষেকক্রিয়া ঘটে, কোন সঙ্গীর শরীরের ভেতর নয়। এভাবেই যৌনজনন প্রথমদিকে শুরু হয়েছিলো। অন্যদিকে পাখি, স্তন্যপায়ী আর সরীসৃপের মতো স্থলভাগের প্রাণীরা এরকম বহিঃনিষেকের সুবিধে নিতে পারে না, কারণ তাদের যৌনকোষগুলোর শুকিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা খুব বেশি। একটা লিঙ্গের গ্যামেট-পুরুষের, যেহেতু শুক্রাণুগুলো চলমান-অন্য লিঙ্গের একজন সদস্যের-নারী-ভেজা অভ্যন্তরে অনুপ্রবিষ্ট হয়। এটুকু তথ্য। এবার এলো চিন্তাটা। সঙ্গমের পর স্থলজ নারীর দেহের দখলে থাকে ভ্রূণটা। এটা থাকে তার ভেতরে। যদি সে নিষিক্ত ডিমটা এমনকি তাৎক্ষণিকভাবে প্রসবও করে, পুরুষের তখনও উধাও হয়ে যাওয়ার সময়টা থাকে, আর তাতে করে নারীটা ট্রিভার্সের ‘নিষ্ঠুর বন্ধন’-এ পড়ে। পুরুষটা অনিবার্যভাবে ত্যাগ করার প্রাথমিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ পায়, নারীর বিকল্পগুলোর পথ দেয় বন্ধ করে, আর সে কি বাচ্চাগুলো নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে রেখে পালিয়ে যাবে, না তাদের সাথে থেকে গিয়ে তাদের বড় করবে এই সিদ্ধান্ত নিতে তাকে বাধ্য করে। তাই, স্থলজ প্রাণীদের ভেতর বাবার যত্নের চাইতে মায়ের আদর বেশি হয়।

কিন্তু মাছ বা অন্যান্য জলজ প্রাণীর বেলায় ঘটনা পুরো অন্যরকম। পুরুষ যদি নারীর শরীরে তার শুক্রাণু না ঢোকায় তাহলে নারীর ‘সন্তানধারণ’-এর কোন প্রয়োজনই নেই। যেকোন সঙ্গীই নবনিষিক্ত ডিমগুলো অন্যের হেফাজতে রেখে চটপট পালানোর রাস্তা ধরতে পারে। কিন্তু সম্ভাব্য একটা ব্যাখ্যা আছে কেন পুরুষটাই ত্যাজ্য হওয়ার আশঙ্কায় বেশি পরিমাণে থাকে। কারা তাদের যৌনকোষ আগে ত্যাগ করবে এটা নিয়ে যথাযথভাবে একটা বিবর্তনীয় লড়াই বাধতে পারে। যে-সঙ্গী এই কাজটা করে সে তার নারী বা পুরুষ সঙ্গীকে নতুন ভ্রুণের দায়িত্বে ফেলে পালানোর সুযোগ পায়। অন্যদিকে, যে-সঙ্গী আগে ডিম ছড়াবে সে তার সম্ভাব্য সঙ্গীর যথাযথ ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হওয়ার ঝুঁকি নিচ্ছে। যদি শুক্রাণুগুলো কম ওজনের হয় আর ডিম্বকের চাইতে ছড়িয়ে পড়ার প্রবণতা এর বেশি থাকে, শুধু তখনই এক্ষেত্রে পুরুষ বেশি দুর্বল হবে। যদি নারীরা বেশি আগেভাগে ডিম পাড়ে, মানে পুরুষটা তৈরি হওয়ার আগেই, সেটা খুব বেশি গোনায় আসে না, কারণ ডিমগুলো তুলনামূলকভাবে বড় আর ভারি হওয়ার কারণে কিছু সময় ধরে একত্রে জট পাকিয়ে থাকবে। তাই একটা মেয়ে মাছ আগেভাগে ডিম পাড়ার ‘ঝুঁকি’ নিতে পারে। একটা পুরুষ কখনো সে-ঝুঁকি নেবে না, কারণ মেয়েমাছ তৈরি হওয়ার আগে সে শুক্রাণু ছাড়লে ওগুলো ছড়িয়ে পড়বে, তখন মেয়েটা আর একা একা ডিম পাড়বে না, কারণ তাতে করে তার কোন লাভ হচ্ছে না। ছড়িয়ে-পড়ার এই সমস্যার কারণে তাকে অপেক্ষা করতে হয় মেয়েমাছটা কখন ডিম পাড়বে, আর অবশ্যই তারপরেই সে শুক্রাণু ছাড়বে ওই ডিমগুলোর ওপরে। কিন্তু মেয়েমাছটা ছেলেমাছটাকে দখল বুঝিয়ে দিয়ে পালানোর দামি কিছু মুহূর্ত পাচ্ছে, আর তাকে ট্রিভার্সের সংকটে পড়তে বাধ্য করছে। তাই এই তত্ত্ব স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করে কেন স্থলের চাইতে জলে বাবার ভালোবাসা বেশি।

[আগামী সংখ্যায় সমাপ্য]