হতবুদ্ধি হতবাক : দ্বিতীয় পর্ব

হতবুদ্ধি আর হতবাক হয়ে সেই যে প্রথম পর্ব লিখেছিলাম, তারপর অনেকদিন হয়ে গেল আর লেখা হয়নি সেপ্রসঙ্গে। যদিও সেই হতবুদ্ধি অবস্থাটি এখনও পুরোপুরি বহাল রয়েছে। এর থেকে সম্ভবত আমার ছাড়া নেই। স্বয়ং বিশ্বপ্রভুই মনে হয় দারুণ রুষ্ট হয়ে আছেন আমার প্রতি। কোনও অপকর্মের জন্য রুষ্ট হলে মেনে নেওয়া যেত, কিন্তু তিনি নিজেই যা বলে গেছেন পবিত্র গ্রন্থের একজায়গায়, তাতে তো মনে হয় আমি জন্ম থেকেই অভিশপ্ত। আমার কোনও আশাই নেই পাপমুক্তির।
উদ্ধৃতিটা এইঃ

“Is he whose foul deeds seem fair to him (like the man who is rightly guided)? God leaves in error whom He will and guides whom He pleases”. (35:8 Translation N.J. Dawood).

আমার ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে এর মানে হলঃ “ও কি সেই ব্যক্তি যে মনে করে সে কোন খারাপ কাজ করেনি (সৎপথে চালিত পুরুষের মত)? আল্লাতা’লা যাকে ইচ্ছা তাকে ভুলের মধ্যে রেখে দেন, আবার যাকে ইচ্ছা তাকে ভাল পথে চালিত করেন”।

অর্থাৎ আমি যতই ভাবিনা কেন যে আমি কোনও অন্যায় করিনি, কোনও অসৎ কর্মে লিপ্ত হইনি, আসলে আমি তা নই। আল্লাতা’লা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন যে আমাকে সৎপথে চলতে দেবেন না। সে-কারণেই হয়ত আমার কলুষিত মন থেকে প্রশ্ন কিছুতেই দূর হচ্ছে না। হতবুদ্ধি আর হতবাক অবস্থাটি থেকে এই যে মুক্ত হতে পারছি না, এটা নিশ্চয়ই এই কোরাণ-বর্ণিত আল্লাপাকেরই ইচ্ছার কারণে।

উদ্ধৃতিটা বিশ্বাস হচ্ছে না বুঝি? আল্লাপাক ইচ্ছে হলে একজনকে সঠিকপথে চালাবেন, আরেকজনকে বেঠিকপথে, তারপর লোকটাকে তার “বেঠিক” কর্মের জন্য গুরুতর শাস্তি দেবেন (যা অত্যন্ত পরিস্কার ভাষায় বর্ণিত আছে পবিত্র কোরাণের ভিন্ন সূরাতে), সেটা একটু অবিশ্বাস্য মনে হবেই তো। আমি কি সাধে হতবাক হয়েছি! কিংবা এমন কি হতে পারেনা যে ভুলটা গ্রন্থের ভাষাতে নয়, গ্রন্থের অনুবাদকের? মৌলানা দাউদের অনুবাদ সম্পর্কে আমার ইমানদার বাংলাদেশী বন্ধুদের অনেকেরই কিঞ্চিৎ সন্দেহ আছে (যদিও অনুবাদ সঠিক কি বেঠিক সেটা তাঁরা বুঝলেন কিভাবে আমার মাথায় ঢোকে না। তাঁদের আরবি জ্ঞান, আমার জানামতে, দুচারটে চলতি বুলির মধ্যেই তো সীমাবদ্ধ)। সেকারণে আমি দাউদের পাশাপাশি আরো দুটি অনুবাদ রেখে দিই—একটি মৌলানা ইউসুফ আলী, আরেকটি মৌলানা পিকথল। মৌলানা ইউসুফ আলীতে উল্লিখিত সূরাটি এরকম:

“For God leaves to stray whom He wills, and guides whom He wills…”।

কই, আমার চোখে তো খুব বড়রকমের তফাৎ ধরা পড়ছে না। নাকি আমারই বোঝার ভুল। কে জানে, হয়ত মূল আরবিতে তার সম্পূর্ণ অন্য অর্থ। এবার বুঝলেন তো এমন হতবুদ্ধি হয়ে আছি কেন।

আমার ধর্মপ্রাণ জ্ঞানীগুণি বন্ধুরা জোর গলায় দাবি করেন যে ইসলাম ধর্ম অত্যন্ত সহনশীল ধর্ম। উদাহরণ স্বরূপ তাঁরা একটা উদ্ধৃতিই বার বার তুলে ধরেনঃ “তোমার ধর্ম তোমার, আমার ধর্ম আমার”। আহা, কি প্রাণজুড়ানো বাণী! বক্ষ শীতল হয়ে যায় নিদাঘ দ্বিপ্রহরেও। উদ্ধৃতিটি যে সত্যি সত্যি পবিত্র কোরাণের পাতায় আছে কোথাও না কোথাও তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহপ্রকাশ করছি না আমি—শয়তানের দোসর হলেও আমি এতটা অধপতিত নই যে দিনকে রাত বানিয়ে ফেলব। কোরাণ নিয়ে তামাশা, ছিঃ, দোজখেও জায়গা হবে না তাহলে। শুধু এই মহান বাণীই নয়, এমনও বয়ান আছে আমাদের এই গ্রন্থতে যে:

“Believers, Jews, Sabaens, and Christians—-whoever believes in God and the Last Day, and does what is right—-shall have nothing to fear or to regret.” (2:62, repeated in 5:69; Dawood)

একই সুরা অন্যত্র, কিঞ্চিৎ রদবদল হওয়া ভাষায়ঃ

“Those who believe (in the Quran), and those who follow the Jewish (scriptures), and the Christians and Sabians,—-any who believe in God and the Last Day, and work righteousness, shall have their reward with their Lord: on them shall be no fear, or shall they grieve.” (Yusouf Ali)

অনুরূপ সুরে আরো আছেঃ

“ If they observe the Torah and the Gospel and what has been revealed to them from their Lord they shall enjoy abundance from above and from beneath,” (5:65; Dawood)
“If only they had stood fast by the Law, the Gospel, and all the other revelations that were sent to them from their Lord, they would have enjoyed happiness from every side.” (5:69; Yusouf Ali)

মহান সৃষ্টিকর্তার আসর থেকে এর চেয়ে মধুর বাণী আর কি হতে পারে? কিন্তু সেই একই গ্রন্থে যখন দেখি পরিষ্কার বলিষ্ঠ অক্ষরে লেখাঃ

“He that chooses a religion other than Islam, it will not be accepted from him and in the world to come he will surely be among the losers” (3:84; Dawood)
“If anyone desires a religion other than Islam(submission to God), never will be accepted of him; and in the hereafter he will be in the ranks of those who have lost (all spiritual good)”, (3:88; Yousuf Ali)

তখন আমি বিস্ময়বিমূঢ় হয়ে ভাবি, হে করুণাময়, এ কি আমারই স্থূল মস্তিষ্কের অক্ষমতা, না তোমার প্রেরিত মহান গ্রন্থের কোনও গূঢ় অর্থ যা মানবকূলের বোধগম্য হবার নয়, যে এই বাণীটির সঙ্গে পূর্ববর্ণিত প্রাণজুড়ানো বাণীসমূহের কোনও সামঞ্জস্য খুঁজে পাইনা।

আবার দেখি এই মহান সৃষ্টিকর্তার আসর হতে একই গ্রন্থে ক্রুদ্ধকন্ঠে ঘোষিত হয় বজ্রবাণী:

“Believers: make war on the infidels who dwell around you. Deal firmly with them.”(9:21;Dawood).

অথবাঃ

“Ye who believe! Fight the Unbelievers who gird you about, and let them find firmness in you, and know that God is with those who fear Him.” (9:123;Yusouf Ali)

এগুলো পড়ার পর আমি আরো দিশেহারা হয়ে পড়ি। কোন্দিকে যাই তাহলে? একদিকে মনে হয় উদারতা ও মহানুভবতার চরম শিখরে, আবার তারই সাথে বেজে ওঠে সমরের বজ্রদামামা। কোনটা সত্য? আমার মত ক্ষুদ্র মানব কেমন করে জানবে সেটা, হে প্রভু?

হতবুদ্ধি শুধু নই, বিমূঢ় আতঙ্কে প্রায় মুহ্যমান।

***

বর্তমান জগতে অগণিত বিজ্ঞানী, মানে ‘বিজ্ঞানী’ নামে পরিচয়ধারী, ধর্মপ্রাণ ইমানদার বিজ্ঞানী, যাঁরা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন যে তাঁদের ব্যক্তিগত বিজ্ঞান শুধু নয়, বিজ্ঞানশাস্ত্রের যত জ্ঞান, যত তথ্য, তার সবগুলোই কোন-না-কোন ভাবে বর্ণিত হয়েছে পবিত্র কোরাণের বিভিন্ন সুরাতে। কেবল বিজ্ঞানই বা বলি কেন, ইহসংসারে এমন কোনও বিষয় নেই, এমন কোনও তত্ব বা গ্রন্থ রচিত হয়নি অদ্যাবধি আজ পর্যন্ত, এবং হবেও না কোনকালে, যার মূল তথ্যগুলো আমাদের এই অসাধারণ গ্রন্থটির কোথাও-না-কোথাও লুক্কায়িত রয়েছে। অর্থাৎ মানুষ আত্মম্ভরিতার বশে যা তার নিজের সৃষ্টি বলে মনে করে তার কোনটাই আসলে তার নিজের নয়, সবই ঐ আল্লাপাকের দরবার থেকে প্রাপ্ত জ্ঞান যা বাণীর আকারে প্রকাশ পেয়েছে সারাবিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ এই গ্রন্থটির পাতায় পাতায়!

এই অসাধারণ বাক্যসমূহ যদি গৃহহীন কোনও নিশাচর মদ্যপায়ীর প্রলাপ হত তাহলে তাতে কর্ণপাত করার প্রয়োজন হত না কারো, কিন্তু যখন জ্ঞানীগুণি মহামহিমদের কলম ও জবান থেকে নির্গত হয় তখন সেগুলো হেসে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। বড় কথা, সেগুলো সত্য হোক বা না হোক, সাধারণ ধর্মবিশ্বাসীদের কানে মধুরতম আশ্বাসবাণীর মতই মনে হবে, এবং তাদের অন্ধ বিশ্বাসের অন্ধত্ত্বকে তীব্রতার চূড়ান্ত শিখরে পৌঁছে দিতে সাহায্য করবে।

আমার নিজের বিশ্বাসের খুঁটিগুলো একটু নড়বড়ে হয়ে উঠতে শুরু করেছিল অনেক আগেই। এবং সেই সন্দেহের বীজ ঢোকানোর কাজটি যে আমার নিজের নয়, আল্লাপাকেরই, তার সাক্ষী তো ওই উপরুল্লিখিত আয়েতগুলোই।

বর্তমান নিবন্ধে পবিত্র কোরাণ থেকে দুচারটে উদ্ধৃতি আমি তুলে ধরব যার বৈজ্ঞানিক ভিত্তি আমার কাছে খুব পরিষ্কার নয়। জানি, ভুল নিশ্চয়ই আমারই, নইলে অন্যেরা এত সহজে বুঝে ফেলে সবকিছু, আমি বুঝি না কেন। অন্যেরা এত সহজে মেনে নিতে পারছে, আমি পারছিনা, তারও যে একটা গূঢ় কারণ আছে সেটা ওই আয়েতগুলো পড়ার পরই বুঝতে পারলাম। পরম করুণাময় জানিনা কি কারণে আমার প্রতি অতিশয় রুষ্ট হয়ে আমার মনে তালা লাগিয়ে দিয়েছেন।
কোরাণের আয়েতটি এরকম:

“You people! If you doubt the Resurrection remember that We first created you from dust, then from a living germ, then from a clot of blood, and then from a half-formed lump of flesh, so that We might manifest to you Our power.” (22:5; Dawood: Yusouf Ali, almost the same)

আজ থেকে প্রায় সাড়ে চোদ্দশ’ বছর আগেকার সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে উত্তম বিজ্ঞান সন্দেহ নেই। তবে ভ্রূণতত্বের এই “…created from dust…” ব্যাপারটি বিজ্ঞানের অন্তর্গত হয়ে গেল কেমন করে ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না। তাছাড়া বৈজ্ঞানিক ভ্রূণতত্বের বয়স যে পনেরোশ’ বছরেরও অনেক বেশি সেটি বর্তমান বিশ্বের কারুরই অজানা নয়। পাশ্চাত্য বিজ্ঞানে, আমি যতদূর জানি, মহামতি এরিস্টটোলকেই ভ্রূণতত্বের জনক বলে ধরা হয়। ভদ্রলোককে সাধারণত গ্রীক দার্শনিক বলেই মনে করা হয় পূর্বাঞ্চলে। আসলে তিনি ছিলেন সত্যিকার সব্যসাচী পুরুষ। একাধারে বিজ্ঞানী, দার্শনিক, পদার্থবিদ, প্রাণীবিজ্ঞানী, ভ্রূণতাত্ত্বিক, গাণিতিক, সমাজবিজ্ঞানী, মনোবিজ্ঞানী—আরো অনেককিছু। তাঁরই লেখালেখিতে আমরা প্রথম বুঝতে পারি জীবজগতে যৌনমিলনজনিত জন্মরহস্যের বেশ কিছু খুঁটিনাটি বিষয়, যার একাংশ আমাদের পবিত্র ধর্মগ্রম্থে সঠিকভাবে বর্ণিত হয়েছে। তবে ধর্মগ্রন্থের সেই ‘ধুলিকণা হতে উদ্ভুত’ বিষয়টি এরিস্টটোলসাহেব সম্ভবত লক্ষ করেন নি—-অসম্ভবরকম ঈশ্বরবিশ্বাসী হওয়া সত্ত্বেও। ‘বালুকণা থেকে সৃষ্টি’ আসলেই একটি অলৌকিক ব্যাপার, সকল প্রচলিত বিজ্ঞানকে অনায়াসে হার মানিয়ে দেবার মত এক আধিদৈবিক বিজ্ঞান। পাঠকের অবগতির জন্যে বলে রাখা ভাল যে এরিস্টটোলের জন্ম খৃঃপূঃ ৩৮৪ তে, মৃত্যু খৃঃপূঃ ৩২২, অর্থাৎ আজ থেকে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে।

প্রাচীনকালে জ্ঞানবিজ্ঞানের একটা প্রধান উৎস ছিল বড় বড় তিনটে ধর্মগ্রন্থঃ তওরাত (Old Testament), ইঞ্জিল (New Testament), ও কোরাণ। এগুলোকে তিনটি মুখ্য গ্রন্থ ধরা হয়, তার প্রধান কারণ বিস্বজোড়া এতিনটির অনুসারীদের সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি, এবং স্বয়ং বিশ্বস্রষ্টার দরবার থেকে অহিমারফত সরাসরি প্রেরিত হয়েছে বলে দাবি করা হয়। পবিত্র কোরাণের অনেক জায়গাতে স্পষ্ট লেখা আছে যে ইহুদী (তওরাত) আর খৃস্টানদের (ইঞ্জিল) কাছে তিনিই বাণী পাঠিয়েছিলেন, যা তারা একনিষ্ঠভাবে পালন করেনি বলেই পরিবর্ধিত, পরি্মার্জিত ও যুগোপযোগী আকারে প্রেরণ করেছেন রসূলে করিম মোহাম্মদ মোস্তাফার (দঃ) মারফত। অর্থাৎ তওরাত আর ইঞ্জিলের বাণীর সঙ্গে কোরাণের বাণীর কোনও মৌলিক বিরোধ নেই—তারা একই প্রভুর ইচ্ছা প্রকাশ করেছে।

এখন দেখা যাক মহাবিশ্বের ‘সৃষ্টি’ বিষয়ে এই গ্রন্থগুলোর কি বক্তব্য। ১৬৫০ সালে উত্তর আয়ার্ল্যাণ্ডের জেমস আসার নামক এক বিদ্বান চার্চবিশপ একটি দ্বিখণ্ড গ্রন্থ প্রকাশ করেন “Annals of the Old Testament” শিরোনামাতে। তার ঠিক চার বছর পর গ্রন্থদ্বয়ের পরিশিষ্ঠ হিসেবে প্রকাশ করেন আরেকখানা পুস্তিকা। এতে তিনি ঘোষণা করেন যে অত্যন্ত যত্নসহকারে তওরাত পরীক্ষা করে তিনি সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে পৃথিবীর জন্মক্ষণ ছিল খৃঃপূঃ ৪০০৪ সালের ২২ শে অক্টোবর! আসারমশায়ের এই সনতারিখ ঘোষণার মাত্র দশ বছর বাদে জন লাইটফুট নামক আরেক পণ্ডিত জানালেন যে তাঁর গণনা অনুযায়ী তারিখটা দাঁড়ায়ঃ ২১শে অক্টোবর, খৃঃপূঃ ৩৯২৯। সন্দেহপ্রবণ পাঠক হয়ত ভ্রূকুঞ্চিত করে ভাবছেনঃ কিন্তু এঁরা তো গির্জার উর্দিপরিহিত পণ্ডিত, এঁরা তো বলবেনই। তাহলে শুনুন, কান পেতে শুনুন, বাঘা বাঘা বিজ্ঞানীরা কি বলছেন। স্যার আইজ্যাক নিউটন, যাঁর হাত দিয়েই বলতে গেলে আধুনিক বিজ্ঞান ও আধুনিক যুক্তিবাদের সূচনা, তিনিও সেই বাইবেল ঘাঁটাঘাঁটি করেই পৌঁছে গেছেন খৃঃপূঃ ৪০০০ সালের একটা তারিখে। এমনকি, অবাক হবেন শুনলে যে, সৌরমণ্ডলের গ্রহনক্ষত্রদের পরিক্রমনশাস্ত্রের প্রধান প্রবক্তা ইউহান কেপ্লার, তাঁর হিসেবমতে পৃথিবীর জন্ম খৃঃপূঃ ৩৯৯২ সাল! অতএব এতে আশ্চর্য হবার কারণ নেই যে হিব্রু পঞ্জিকা অনুযায়ী বর্তমান বৎসরটি ঠিক ২০১২ সাল নয়, ৫৭৭২ সাল।

এবার বড় প্রশ্ন হল আমাদের পবিত্র কোরাণ কি বলছে এসম্পর্কে। কিছুই বলেনি, অন্তত আমার তল্লাশ অনুযায়ী। তবে যা লেখা আছেঃ

“When We substitute one revelation for another,—and God knows best what He reveals (in stages),—they say thou art but a forger. But most of them understand not.”(16:101; Yusouf Ali),

তাতে, আমার ক্ষুদ্রবুদ্ধিতে, তো মনে হয়না যে স্পষ্টভাবে উল্লেখ না হলেও কোরাণের বাণী আর তওরাত-ইঞ্জিলের বাণীতে কোনও তফাৎ আছে। মানে বিশ্বসৃষ্টির সনতারিখের বিষয়ে এই গ্রন্থত্রয় ঠিক একই মতামত পোষণ করে। এবং সেটাই স্বাভাবিক, যদি তিনটি একই উৎস থেকে উদ্ভুত হয়ে থাকে।

প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের মতে পৃথিবীর বয়স অন্ততপক্ষে ৪.৬ বিলিয়ান বছর, যা কিনা দাঁড়ায় ৪৬০ শতকোটি বৎসরে! বৈজ্ঞানিকদের ধৃষ্টতা দেখুন। পবিত্র গ্রন্থাদিতে পরিষ্কার বলা আছে আনুমানিক ৬,০০০ বছর, আর ক্ষুদ্র মানবকূল, যত মাথাওয়ালাই হোন না কেন, তারা বের করেছেন এক অবিশ্বাস্য সংখ্যা!

কোরাণশরিফের তিনটে মুখ্য তরজমাঃ মওলানা ইউসুফ আলি, মওলানা মোহাম্মদ মারমাদুক প্রিকথল—তিনটি গ্রন্থই আমি সংগ্রহ করেছি, এবং বেশির ভাগই মোটামুটি পড়া হয়ে গেছে। আরবি হরফ যে আমি পড়তে পারিনা তা নয়, কিন্তু হরফ শেখা আর বুঝতে শেখার মধ্যে তফাৎ আছে। মুসলিম জগতে এমন কোনও শিশু কি আছে যে তোতাপাখির মত আরবি পড়তে পারেনা, অথচ যার একটি শব্দেরও সে অর্থ বোঝে? ছোটবেলায় আমি পবিত্র কোরাণের বেশ কিছু সুরা একেবারে মুখস্ত করে ফেলেছিলাম। কিন্তু কি মুখস্ত করেছিলাম তার মাথামুণ্ডু কিছুই জানতাম না। পরবর্তীকালে যখন ইংরেজিতে বড় বড় আলেমদের তরজমা পড়তে শুরু করলাম তখনই আস্তে আস্তে গোমর ফাঁক হতে শুরু করল। যেমন আমার ছোটবেলার প্রিয় ‘আল-লাহাব’ সুরাটিঃ

“May the hands of Abu-Lahab perish! May he himself perish! Nothing shall his wealth and gains avail him. He shall be burnt in a flaming fire, and his wife, laden with firewood, shall have a rope round her neck”. (111:1-5;Dawood)

সর্বনাশ! আবুলাহাব নামক এক ব্যক্তি, যে আমার কোনও ক্ষতি করেনি, যাকে আমি দেখিনি কোনদিন, যে থাকত সাত হাজার মাইল দূরবর্তী কোনও বেদুইন মরুভূমিতে, তা’ও দেড়া হাজার বছর আগে, তাকে কি কারণে আমি দিনে দুবার তিনবার উঠতে বসতে এমন জঘন্য ভাষায় গালাগাল করব বলুন তো? তা’ও নামাজে দাঁড়িয়ে, বেহেস্তে যাবার আশায়?

এই তরজমাগুলো পড়ার পরই আমার টনক নড়ল কি কারণে আমাদের মৌলবি সাহেবরা কোরাণের অর্থ শেখান না বাচ্চাদের। অর্থ জানতে পারলে তাদের অনেকেই ধর্মত্যাগ করে সেই শিশুবয়সেই নাস্তিক হয়ে যেত। শিশুদের জন্যে ধর্মগ্রন্থের সত্যিকার অর্থ জানা বড় বিপজ্জনক।

তরজমাতে সবচেয়ে বড় যে উপকারটি হয়েছে আমার তা হলঃ ‘পবিত্র কোরাণ সকল জ্ঞানের আধার’, এই আপ্তবাক্যটি নিজের যৎসামান্য বুদ্ধি খাটিয়ে পরীক্ষা করা সম্ভব হয়েছে। যেমন সেই প্রাচীন মধ্যযুগীয় প্রশ্নটিঃ সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে, না, উল্টোটা? এটা অত্যন্ত জরুরি তথ্য বলে মনে হয়েছিল আমার, কারণ কোরাণ নাজেল হয়েছিল হজরত মোহাম্মদ(দঃ) এর সময়কালে, অর্থাৎ ষষ্ঠ শতাব্দীর শেষার্ধে ও সপ্তম শতাব্দীর প্রথমার্ধে, যখন বিশ্ববাসী প্রায় সকলেরই দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে সূর্য, চন্দ্র এবং অন্যান্য গ্রহনক্ষত্রাদি পৃথিবীর চারদিকে প্রদক্ষিণ করে সৃষ্টিকর্তার নির্দেশ অনুযায়ী। দুঃখের বিষয় যে এসম্বন্ধে কোনও স্পস্ট উল্লেখ আমার চোখে পড়েনি পবিত্র কোরাণের পাতায়, অনেক তল্লাশের পরও। আমি সিদ্ধান্তে পৌঁছুলাম যে হয়ত উল্লেখ নাই একারণে যে তওরাত আর ইঞ্জিলে আল্লাতালা নিশ্চয়ই এবিষয়ে যা বলার বলে গেছেন, দ্বিতীয়বার বলার কোনও প্রয়োজন বোধ করেননি (যদিও কোরাণের মাঝেই একই কথা পুনঃ পুনঃ উচ্চারিত হবার নজির রয়েছে অজস্র স্থানে)। তাছাড়া আল্লাপাক তো কোরাণেই বলেছেনঃ

“This is a blessed Book which We have revealed, confirming what came before it, that you may warn the mother city (Mecca) and those that dwell around her”.(6:92;Dawood).

বর্তমান প্রসঙ্গে এই “Confirm” শব্দটা খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে। আমার ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে মনে হয় পরম করুণাময় বলতে চেয়েছেন এখানে যে আগেকার গ্রন্থদুটিতে যা বলা হয়েছে তার সঙ্গে বর্তমান গ্রন্থ, অর্থাৎ কোরাণের কোনও মৌলিক বিভেদ নেই। অতএব দেখা যাক ‘পুর্ববর্তী’ গ্রন্থসমূহতে কি বাণী নাজেল হয়েছিল এবিষয়ে।

ওল্ড টেস্টামেন্ট, অর্থাৎ তওরাতে আছেঃ

Chronicles 16:30 “…tremble before him; yes, the world stands firm, never to be moved.”
Psalms 93:1 “The Lord reigns; he is robbed in majesty; the lord is robbed, he is girded with strength. Yea, the world is established; it shall never be moved.”
Psalms 104:5 “Thou didst set the earth on its foundations, so that it should never be shaken”.

আল্লাপাকের এই শেষ উক্তিটি পড়ে মনে হল পৃথিবী অনড় কেবল নয়, একে বিন্দুমাত্র কাঁপুনি-ঝাঁকুনি দেওয়াও সম্ভব হবে না কারো পক্ষে। তার মানে কি এই দাঁড়ায় যে পৃথিবীতে ভূমিকম্প হবে না কখনও?
আমার হতবুদ্ধি হতভম্ব দশা এবার চরম মাত্রায় পৌঁছে গেছে।

আল্লামালিক আমাদের জন্যে সাতটি আসমান তৈরি করে দিয়েছেন, সেকথা তিনি বহু জায়গায় উল্লেখ করেছেন। বর্তমান বিজ্ঞানের পরিপ্রেক্ষিতে এই ‘সাত আসমান’এর সত্যি সত্যি কোনও তাৎপর্য আছে কিনা এবং থাকলেও সেটা কি ওটা আমার স্থূল মস্তিষ্কে এখনো প্রবেশ করেনি। এই সাত আসমানেরই কোন-না-কোন জায়গায় তিনি চন্দ্র-সূর্য-গ্রহ-তারা স্থাপন করেছেন এবং প্রত্যেককে তার নিজ নিজ কর্তব্য নির্ধারণ করে দিয়েছেন। সূর্যের সম্বদ্ধে বলা হয়েছেঃ

“The sun hastens to its resting place: its course is laid for it by the Mighty One, the All-knowing.” (36:38 Dawood)
“And the sun runneth on unto its resting place for him. That is the measuring of the Mighty, the Wise.” (36:38; Pickthall)
মওলানা ইউসুফ আলির তরজমাতে এরই কোমলতর রূপঃ “And the Sun runs his course for a period determined for him: that is the decree of (Him), the Exalted in might, The All-knowing.” (36:38; Yusouf Ali)

যাই হোক এই তিন পণ্ডিতের তিন ভাষ্য থেকে এটুকু পরিষ্কার হয়ে গেল যে সারাদিন পরিশ্রমের পর আমাদের সূর্যমহাশয়ের একটু বিশ্রামের প্রয়োজন হয়। তাই নাকি? তাহলে কি আমাদের আকাশ থেকে বিদায় নিয়ে নিশাযাপনের উদ্দেশ্যে নিদ্রামগ্ন হয়ে পড়েন? সর্বনাশ, তাহলে আমাদের পশ্চিমে যারা বাস করেন সে বেচারিদের কি হবে? এই বিজ্ঞানই কি তাহলে আমাদের পবিত্র গ্রন্থটির সর্বজ্ঞ বিজ্ঞান?

ইমানদার পুণ্যাতারা জোরগলায় দাবি করেন যে আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের ‘কৃষ্ণবিবর’ (Black hole), ‘মহা বিস্ফোরণ’ (Big Bang), সবই কোরাণে আছে। আমি কৃষ্ণবিবর খুঁজতে গিয়ে কিছুই পেলাম না (হয়ত আমি খুঁজতে জানি না বলেই পাইনি)। বিস্ফোরণের কেবল একটাই ছোট করা লেখা উক্তি পাওয়া গেলঃ

“Are the disbelievers unaware that the heavens and the earth were but one solid mass which We tore asunder, and that We made every living thing from water? Will they not have faith?” (21:27;Dawood)(21:30;Yusouf Ali: Do not the Unbelievers see that the heavens and the earth were joined together (as one unit of Creation), before We clove them asunder? We made from water every living thing.”

এই পংক্তিটি হকিং সাহেবের চোখে পড়েছে কিনা জানিনা—কারণ এসম্বন্ধে তাঁর কোনও মন্তব্য আমি পড়িনি কোথাও। বিগ ব্যাং যে ইটপাথরের টুকরো টুকরো হয়ে যাবার ব্যাপার নয়, আরো গভীর কিছু তার কোন আভাস আমি অন্তত এই সুরাটিতে পেলাম না। কে জানে, হয়ত আমারই ভুল। আরো একটা বিষয় আছে—কালের রহস্য। বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে যুগান্তকারি যে-কটি আইডিয়াগুলোর মধ্যে আলবার্ট আইনস্টাইনের সময়বিষয়ক আইডিয়াটি বোধ হয় সর্বাধিক বিস্ময়কর—এটা সাধারণ-অসাধারণ সব মানুষেরই সাধারণ বুদ্ধির সীমানা ছাড়িয়ে যাওয়ার মত। সুতরাং পবিত্র কোরাণে যদি সকল কালের সকল বিজ্ঞানই থেকে থাকে তাহলে এই সময়ের গতি-নির্ভর আপেক্ষিকতার ধারণাটিও কোন-না-কোন রূপে ব্যক্ত হয়ে থাকবে। অন্তত সেটাই আমার মত শ্লথবুদ্ধি ব্যক্তির চিন্তায় থাকা স্বাভাবিক, তাই না? বিশ্বাস করুণ, আমি তন্ন তন্ন করে খুঁজেছি কোরাণের প্রতিটি পৃষ্ঠা—-কোথাও পেলাম না। এ কি আমারই দেখার ভুল? বোঝার ভুল? কে জানে, হতেও পারে। আল্লাতা’লা যদি গোড়া থেকে আমার বুদ্ধিতে তালা মেরে থাকেন, তাহলে তো এমন ভ্রান্তি হতেই পারে।

ছোটকাল থেকেই ধূমকেতুর প্রতি আমার একটা কৌতূহল ছিল। বিপুল আকাশে এ এক বিপুলতর রহস্য মনে হত আমার কাছে। বড় হয়ে স্কুলকলেজে গিয়ে শিখলাম যে আইজ্যাক নিউটন (১৬৪২-১৭২৭) তাঁর মাধ্যাকর্ষণ তত্ত্বের সঠিকত্ব প্রমাণ করার জন্যে ধূমকেরতুর উদাহরণ ব্যবহার করেছিলেন। পরে আরো জানলাম যে ধূমকেতু নিয়ে তাঁর সমসাময়িক কালে সুইজার্ল্যাণ্ডের জ্যাকব বার্নুলি (১৬৫৪-১৭০৫) নামক এক গণিতজ্ঞও তাঁর নিজস্ব ধ্যানধারণা প্রকাশ করেছিলেন, যদিও বিশেষজ্ঞদের মতে তাঁর চিন্তাভাবনার সঙ্গে বাস্তব চিত্রের খুব একটা সম্পর্ক ছিল না।

যাই হোক, আমার প্রশ্ন এখানেঃ ধূমকেতু সম্বন্ধে কোরাণ কি বলছে। যেহেতু সেটা স্বয়ং সৃষ্টিকর্তার আসর থেকে উদ্ভূত সেহেতু সেটা হবে অকাট্য সত্য, তাই না? আমি এবিষয়ে কতগুলো উদ্ধৃতি তুলে দিচ্ছি নিচে-

১।“We have decked the heavens with constellations and made them lovely to behold. We have guarded them from every cursed devil. Eavesdroppers are pursued by fiery comets.” (15:18;Dawood)

“…Save him who stealeth the hearing, and then doth a clear flame pursue.”(15:18; Pickthall)

২।“They guard it against rebellious devils, so that they may not listen to those on high. Meteors are hurled at them from every side; then, driven away, they are consigned to an eternal scourge. Eavesdroppers are pursued by fiery comets.” (37:8; Dawood)

“We have indeed decked the lower heaven with beauty (in) the stars,—(for beauty) and guard against all obstinate rebellious evil spirits, (so) they should not strain their ears in the direction of Exalted Assembly but be cast away from every side, repulsed, for they are under a perpetual penalty, except such as snatch away something by stealth, and they are pursued by a flaming fire of piercing brightness.” (37:7-10, Yusouf Ali)

৩।“We made our way to high heaven, and found it filled with mighty wardens and fiery comets. We sat eavesdropping, but eavesdroppers find comets lying in wait for them.” (72:10;Dawood)
“And (the jinn who had listened to the Quran said): We had sought the heaven but found it filled with strong warders and meteors. And we used to sit on (high) places therein to listen. But he who listened now findeth a flame in wait for him…” (72:8-9; Pickthall)

অথবা

৪।“We have adorned the lowest heaven with lamps, missiles to pelt the devils with.” (67:4;Dawood)

“And We have (from of old) adorned the lowest heaven with Lamps, and We made such (Lamps) (as) missiles to drive away the Evil Ones, and prepared for them the penalty of the blazing Fire.” (67:5; Yusouf Ali)

এই সুরাগুলি পড়ার পর একটা জিনিস পরিষ্কার হয়ে গেল—আল্লাতা’লার ধূমকেতু তৈরির উদ্দেশ্য—-দুষ্ট লোকের কুৎসা শ্রবনের জন্যে। তবে এতে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাটি কোথায় ঠিক বুঝতে পারলাম না। নিউটনের মাধ্যাকর্ষণের ব্যাখ্যা কি তাহলে ভুল? তিনি নিজেও তো পরম ধার্মিক ব্যক্তি ছিলেন—বাইবেল ঘাঁটাঘাঁটি করে অনেক রহস্যই আবিষ্কার করে গেছেন। তাহলে ধূমকেতুর কানকথার দায়িত্বটি খেয়াল করলেন না কেমন করে?

যাই হোক আপাতত এই থাকল। তৃতীয় পর্বে আরো হতবুদ্ধির বিষয় বলা যাবে।

অটোয়া,
২৭শে এপ্রিল, ‘১২
মুক্তিসন ৪১