ইন্টারনেটভিত্তিক মুক্ত বিশ্বকোষ উইকিপিডিয়া, সংক্ষেপে– উইকিতে যুক্ত হয়েছে সাঁওতালি ভাষা। বাংলা ও বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি ভাষার পর এটি বাংলাদেশের তৃতীয় কোনো ভাষা, যা উইকিতে যুক্ত হলো। এতে সাঁওতালি ভাষার শিক্ষার্থী ও আগ্রহীদের জন্য তো বটেই, আদিবাসী বিষয়ক গবেষণার ক্ষেত্রে উন্মুক্ত হলো অবাধ সুযোগ। উইকিতে বিশ্বের ২৭২টি প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ভাষা অন্তর্ভূক্ত হয়েছে।

সাঁওতালি ভাষাকে ইন্টারনেট জগতে প্রতিষ্ঠা করতে গত মাস থেকে শুরু হয়েছে এই ভাষার উইকি নির্মাণের কাজ। গত বছর ইউনিকোডভিত্তিক সাঁওতালি টাইপিং সফটওয়্যার ‘হড় কাথা’ চালু হয়। এরই ধারাবাহিকতায় নির্মাণ করা হচ্ছে এই ভাষার উইকি। এরই মধ্যে অধিকাংশ কাজ শেষ হয়েছে। গবেষক ও আগ্রহীদের জন্য শিগগির তা উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে।

বাংলাদেশে সাঁওতালি, বিষ্ণুপ্রিয়া মনিপুরিসহ অপরাপর আদিবাসী ভাষার সাংবিধানিক স্বীকৃতি না থাকলেও উইকিতে এই ভাষাদুটি অন্তর্ভূক্তি আরো একবার জানান দেয়, ভাষাগত সংখ্যালঘু হলেও প্রত্যেক আদিবাসীর রয়েছে সমৃদ্ধশালী সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য।

সাঁওতালি ভাষার উইকি নির্মাণ কার্যক্রমে নেতৃত্ব দিচ্ছেন ‘হড় কাথা’র উদ্ভাবক, সহব্লগার সমর মাইকেল সরেন। সে সময় তাকে সহায়তা করেন ফিরোজ আহমেদ নামে আরেক তরুণ উদ্ভাবক। সমর সরেন নিজেও একজন সাঁওতাল। তিনি একই সঙ্গে আদিবাসী বাংলা ব্লগের নির্মাতা ও প্রধান সঞ্চালক।

এই কাজে তাঁকে নেপথ্য সহযোগিতা দিয়েছেন বাংলা উইকির প্রতিষ্ঠাতা ড. রাগিব হাসান। উদ্যোগটিকে স্বাগত জানিয়ে রাগিব হাসান এই লেখককে বলেন, উইকি জগতে আদিবাসী ভাষাগুলোর অংশগ্রহণে উইকি জগৎ আরো সমৃদ্ধ হবে। বাংলাদেশের তরুণ সান্তাল প্রযুক্তিপ্রেমীদের সক্রিয় অংশগ্রহণেই সাঁওতালি ভাষার উইকি আরো সমৃদ্ধ হয়ে উঠবে বলে মনে করছি।

সমর মাইকেল সরেন বলেন, আমরা সাঁওতাল বা সান্তালরা জাতি হিসেবে স্বয়ংসম্পূর্ণ। আমাদের সমৃদ্ধিশালী সংস্কৃতি, কৃষ্টি, রীতি-নীতি, ঐতিহ্য রয়েছে। পাশাপাশি রয়েছে অসংখ্য শব্দভাণ্ডারে সমৃদ্ধ, স্বয়ংসম্পূর্ণ ও উন্নত ভাষা। উপরন্তু আমাদের রয়েছে বর্ণমালা, সমৃদ্ধ ব্যাকরণ ও অভিধান। কিন্তু বাংলাদেশে নানা কারণে আদিবাসীদের মৌলিক মানবিক অধিকার ক্ষুণ্ন হওয়ার পাশাপাশি সাঁওতালি ভাষাও আজ হুমকির মুখে। সাঁওতালি ভাষার চর্চা ও গবেষণা সরকারি পৃষ্ঠপোষকতাও পায় না। এমন অবস্থায় আমরা নিজেরাই এই ভাষাকে রক্ষা করতে উদ্যোগী হয়েছি। এরই অংশ হিসেবে আমরা নির্মাণ করছি সাঁওতালি ভাষার মুক্ত বিশ্বকোষ উইকিপিডিয়া।


প্রসঙ্গত, বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, নেপাল, মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কাসহ অল্প কয়েকটি দেশে সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর বসবাস। তবে বাংলাদেশ ও ভারতেই তাঁরা সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় বাস করছেন। বিশ্বে সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর সংখ্যা আনুমানিক ৮৬ লাখ। তাঁদের রয়েছে ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি, কৃষ্টি, রীতি-নীতি, সাহিত্য, লোকগাঁথা ও সমৃদ্ধ ইতিহাস। তাঁরা নিজেদের ‘সান্তাল’ বলে পরিচয় দিতে পছন্দ করেন।

১৮৫৫ সালের ৩০ জুন সিধুঁ-কানহু নামক দুই সাঁওতাল সহোদর জীবন দিয়ে গড়ে তোলেন সাঁওতাল বিদ্রোহ, যা ইতিহাসে ব্রিটিশ রাজের সিংহাসন-কাঁপানো ‘সান্তাল হুল’ নামে পরিচিত। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সাঁওতালরা সরাসরি সম্মুখ সমরে বীরত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। স্বাধীন দেশের বিভিন্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলনেও রয়েছে তাঁদের সক্রিয় অবদান।

সাঁওতালি ভাষার উইকিটি বর্তমানে উইকি’র ইনকিউবেটরে রয়েছে। বিভিন্ন তথ্য সাঁওতালি ভাষায় অনুবাদ করে এই ভাষার উইকিতে যুক্ত করার কাজ দ্রুত এগিয়ে চলেছে। মিডিয়া উইকির (উইকিপিডিয়া সফটওয়্যার) অধিকাংশ কাজ শেষ হয়েছে। মোবাইল ফোন থেকেও যাতে ইন্টারনেট ব্রাউজ করে এই ভাষার উইকি পাঠ করা যায়, এমন সুবিধা থাকছে। সাঁওতাল ভাষায় পারদর্শী যে কেউ এই অনুবাদ কার্যক্রমে অংশ নিতে পারবেন। সাঁওতালি উইকিতে অনুবাদ কার্যক্রমে প্রতিদিনই এই ভাষার প্রযুক্তিপ্রেমীরা যোগদান করছেন। পারস্পরিক সহযোগিতায় তথ্য ও বানান শুদ্ধির কাজ চলছে। বাংলা উইকির জন্য ‘বিএন’ এবং ইংরেজি উইকির জন্য ‘ইএন’-এর আদলে আন্তর্জাতিক মান নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা আইএসও’র ল্যাঙ্গুয়েজ কোড হিসেবে সাঁওতালি উইকির জন্য বেছে নেওয়া হয়েছে ‘এসএটি’ শব্দ।


সাঁওতালি উইকিপিডিয়ানরা আরো জানান, এ ভাষায় বিভিন্ন তথ্য অনুবাদ করে তা উইকিতে যোগ করার ক্ষেত্রে প্রায়ই তাদের সাঁওতালি ভাষার অভিধানের সংকটের মুখোমুখি হতে হয়েছে। শিক্ষার্থী ও গবেষকদের যেন সাঁওতালি অভিধান দুষ্প্রাপ্যতায় ভুগতে না হয়, সে চিন্তা থেকে তাঁরা সাঁওতালি উইকিতে ইংরেজি-সাঁওতাল ভাষার অভিধান ই-বুক আকারে যুক্ত করতে যাচ্ছেন। আগ্রহী যে কেউ বিনা মূল্যে পিডিএফ আকারে সাঁওতালি অভিধানটি ডাউনলোড করে নিতে পারবেন।

মাতৃভাষাকে ভালবেসে সম্পূর্ণ স্বেচ্ছাশ্রমে যারা দিনরাত নিরলসভাবে কাজ করে চলেছেন অভিনব উইকিটির জন্য, আমরা অভিনন্দন জানাই সেই সব তরূণ সাঁওতাল ইকিপিডিয়ানদের। জয় হোক আদিবাসীর সংগ্রাম!