ইন্ডিয়ার দালাল অথবা ভারতের দালাল এই শব্দ হারহামেশাই শোনা যায় আমাদের দেশে।মজার ব্যাপার ভারত প্রাসাঙ্গিক এই শব্দ যেভাবে শোনা যায় পৃথিবীর আর অন্য কোন দেশ নিয়েই এধরনের কোন শব্দ সেভাবে শোনা যায়না।হয়তো কেউ রাত-দিন ২৪ঘণ্টা লন্ডন-অ্যামেরিকা যাবার জন্য পাগল হয়েও লন্ডন-অ্যামেরিকার দালাল হতে পারেনা।আমাদের সিলেটের বেশিরভাগ পরিবারেরই কেউ না কেউ লন্ডনে থাকে।তারপরেও তারা লন্ডনের দালাল হতে পারেনা।অথচ ভারতে কেউ থাকুক বা না থাকুক ভারতের পক্ষে অথবা পাকিস্তানের বিপক্ষে কেউ কথা বললেই আমাদের দেশে সে ভারতের দালাল হয়ে যাবে।

এবার আসুন দেখে নেওয়া যাক এই শব্দের উৎপত্তি।৪৭ উপমহাদেশ দ্বিখণ্ডিত হয়ে জন্ম নেয় দুটি রাষ্ট্রের ভারত-পাকিস্তান;যার মধ্যে পাকিস্তান পুরোপুরি ধর্ম ভিত্তিক একটি রাষ্ট্র।ইসলাম ব্যাবহার করে জন্ম নেয় পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান।

ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে একে অন্যের যে বিরোধিতা;ধর্ম ও রাষ্ট্র ভিত্তিক তারও আঁচ লাগে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বাঙ্গালিদের।পশ্চিম পাকিস্তানিদের মত বেশিরভাগ পূর্ব পাকিস্তানিরাও ছিল ভারত বিরোধী।কিন্তু মজার ব্যাপার হল পূর্ব পাকিস্তানের সাচ্চা বাঙালি-পাকিস্তানিরা যতই ভারত বিরোধী হোক না কেন জাতিগতভাবে তারা বাঙ্গালীই ছিল।আর পশ্চিম পাকিস্তানিদের কাছে বাংলা মাত্রই হিন্দুদের  ভাষা,ভারতের ভাষা;বাঙালি সংস্কৃতি হিন্দুদের সংস্কৃতি,ভারতের সংস্কৃতি।ফলে বাঙালি পাকিস্তানিদের তারা কখনই পাকিস্তানি ভাবতে পারতোনা,মুসলিম ভাবতে পারতোনা।ফলে বাঙালি পাকিস্তানিদের তারা জোর করে উর্দু ভাষা গেলাতে চেষ্টা করল।বাংলা সংস্কৃতিকে এদেশ থেকে মুছে ফেলতে চেষ্টা করল।

কিন্তু তাদের এই অন্যায় দাবি  কখনোই মেনে নেয়নি বাঙালি পাকিস্তানিরা।(কিছু সংখ্যক যে মেনে নিয়েছিল তা আমাদের অজানা নয়।কি নামে তাদের সম্বোধন করবো বুঝতে পারছিনা।৭১ এ এরাই রাজাকার-আলবদর নামে পরিচিতি পায়।এদের অস্তিত্ত এখনো এই বাংলার মাটিতে রয়েছে।রক্ত প্রতিম পাকিস্তান প্রীতি হয়েও তারা বাংলাদেশি হয়ে আছে।) ফলে পশ্চিম পাকিস্তান-পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে দূরত্ব বাড়তে থাকে।যে দূরত্ব ছিল দুই পাকিস্তানের মধ্যকার ভৌগলিক অবস্থানের থেকেও অনেক বেশি।

৭১ এ দুই পাকিস্তানের একত্রে থাকার শেষ দিন পর্যন্ত পশ্চিম পাকিস্তানিরা এদেশের বাঙ্গালিদের ভারতের দালাল বলে মনে করতো।স্বাধীনতাকামী প্রত্যেকটা বাঙ্গালিকে তারা ভারতের দালাল মনে করতো।মুক্তিযোদ্ধাদের ভারতের দালাল মনে করতো।জয় বাংলা শ্লোগান দেওয়া প্রত্যেক বাঙ্গালিকে তারা ভারতের দালাল মনে করতো।

৭১ এ স্বাধীনতা যুদ্ধে পৃথিবীর মানচিত্র থেকে পূর্ব পাকিস্তানের নাম মুছে দিয়ে জন্ম নেয় বাংলাদেশ।স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতে যে ১ কোটি শরণার্থী আশ্রয় নিয়েছিল যার বেশিরভাগই ছিল হিন্দু ধর্মাবলম্বী।দেশ স্বাধীন হবার পর যার একটা বড় অংশই আর স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে আসেনি।কিন্তু লক্ষ্য করলে দেখা যাবে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বা যুদ্ধের আগে-পরে যে পরিমাণ হিন্দু দেশ ত্যাগ করেছিল তার থেকে অনেক বেশি হিন্দু দেশ ত্যাগ করেছে যুদ্ধ পরবর্তী স্বাধীন বাংলাদেশ থেকে।

নিচের চার্ট লক্ষ্য করলে আমরা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি  ১৯৭১ এর পরে অন্য সব ধর্মের মানুষের সংখ্যা বেড়ে গেলেও হিন্দু ধর্মাবলম্বীর সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে।

ধর্ম শতকরা জনসংখ্যা১৯৭৫ শতকরা জনসংখ্যা১৯৯০ শতকরা জনসংখ্যা২০১০
ইসলাম ৮৪% ৮৭% ৮৯.৫%
হিন্দু ১৫.৬% ১২.৪% ৯.৫%
খ্রিস্টান ০.১% ০.১% ০.৩%
বুদ্ধ ০.৩% ০.৫% ০.৭%

আরও পিছনে তাকানোর জন্য আমরা নিচের চার্টটি লক্ষ্য করি।

সাল ১৯৪৭ ১৯৬১ ১৯৭৫ ১৯৯০ ২০১০
শতকরা হিন্দু  ৩১%  ১৯%  ১৫.৬% ১২.৪%  ৯.৫%

১৯৪৭ সালে এদেশে মোট জনসংখ্যার ৩১ শতাংশ ছিল হিন্দু ধর্মাবলম্বী।১৯৭৫ সালে যা নেমে যায় ১৫.৬ শতাংশে।আর ২০১০ সালে যা মাত্র ৯.৫ শতাংশে নামে।অর্থাৎ পাকিস্তান আমলেও  হিন্দুরা এদেশে নিজেদের যতটা নিরাপদ মনে করতো স্বাধীন বাংলাদেশে তারা ততোটা নিরাপদ মনে করেনা।৪৭এ ভারত-পাকিস্তান জন্মের সময় যারা দেশ ত্যাগ করেনি,৬৪ এর দেশভাগের সময় যারা দেশ ত্যাগ করেনি,৭১ এর স্বাধীনতা যুদ্ধের পরেও যারা ভিটে মাটি ছেড়ে যায়নি,তাদেরই  একটা বড় অংশ স্বাধীন বাংলার মাটি ছেড়ে গেছে দেশ স্বাধীন হবার পরে।কঠিন হলেও সত্য ১৯৯১ আর ২০০১ সালে যা তীব্র আকার ধারণ করে।

বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামীলীগের জয়-পরাজয়ের উপরও নির্ভর করে কি পরিমাণ হিন্দু এবার সীমান্ত অতিক্রম করবে।প্রতি বছর খবরের কাগজে মূর্তি ভাঙ্গার সংবাদ পড়ে আমরা শারদীয় দুর্গা পূজার আভাস যেমন পাই তেমনি নির্বাচন পরবর্তী বাংলাদেশে সংখ্যালঘু (পড়ুন হিন্দু) সম্প্রদায়ের প্রতিনিয়ত খবরের কাগজের শিরোনাম হতে দেখে আঁচ করতে পারি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের দেশ ত্যাগ করার সময় আবার এসেছে।

স্বাধীনতার সময়কালে নিচের  এই পোস্টারের ব্যাপক প্রচলন ছিল।

বাংলার হিন্দু

বাংলার খ্রিষ্টান

বাংলার বৌদ্ধ

বাংলার মুসলমান

আমরা সবাই বাঙালী

ছিলও তাই।ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে কাধে কাধ মিলিয়ে বাংলার মাটি শত্রু মুক্ত করেছিল এদেশের বাঙ্গালিরা।কিন্তু বছর বছর হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ঐক্যফ্রন্টের মানববন্ধন উপরের এই পোস্টারটির সার্থকতা প্রকাশ করে?

পাকিস্তানিরা তীব্র মাত্রায় ভারত বিরোধী-হিন্দু বিরোধী।৭১ সালে এদেশে গণহত্যা তারা পশ্চিম পাকিস্তানে প্রচার করেছিল পূর্ব পাকিস্তানের কিছু মানুষ ভারতের দালালি করছে,পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে তাই পাকিস্তান সরকার সেই সব ভারতের দালালদের প্রতিরোধ করছে।যেহেতু পাকিস্তান সরকার ভারতের দালালদের বিরুদ্ধে ব্যাবস্থা গ্রহণ করেছে তাই পশ্চিম পাকিস্তানিরাও কোন মাথা ব্যাথা দেখায়নি।তাদের কাছে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কথা বলা মানেই ভারতের দালালি করা।কিন্তু আমরাতো জানি ৭১এ আমরা ভারতের দালালি করিনি।৭১ আমাদের অস্তিত্ত।৭১ আমাদের স্বাধীনতা।৭১ আমাদের প্রেরণা।

৭১ এ পাকিস্তান দুই টুকরো হয়েছে।স্বাধীন বাংলাদেশ ৪১ বছরে পা দিয়েছে।আজকে স্বাধীনতার ৪১ বছর পরেও আমরা ভারতের দালাল এবং শুধুমাত্র ভারতের দালালই খুজে পাই আমাদের দেশে।এতদিন এদেশের হিন্দুরাকেই শুধুমাত্র ভারতের দালাল হিসেবে গন্য করা হলেও এখন যুগ বদলেছে।পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কথা বললে যে কেউই ভারতের দালাল হয়ে যেতে পারে।

‘যদি বাংলাদেশকে একটি ইসলামী প্রজাতন্ত্র হিসাবে ঘোষণা করা হয় তাহলে ভারতের আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। যেদিন আমার সৈনিকরা বাংলাদেশকে মুক্ত করে সেদিনই আমি এ কথা উপলব্ধি করি। বাংলাদেশীদের কখনোই ভারতের প্রতি তেমন ভালবাসা ছিল না। আমি জানতাম ভারতের প্রতি তাদের ভালবাসা অস্থায়ী। অনুপ্রেরণা লাভের জন্য ভারতের দিকে না তাকিয়ে তারা মক্কা ও পাকিস্তানের দিকে দৃষ্টিপাত করবে। আমাদেরকে সত্যাশ্রয়ী হতে হবে। বাংলাদেশীদের প্রতি আমরা সঠিক আচরণ করিনি। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশকে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য আমাদের সব রকমের সাহায্য করা উচিৎ ছিল, কিন্তু আমাদের রাজনীতিবিদরা তা করেননি। তারা বেনিয়ার মতো আচরণ করেছেন।’
ফিল্ড মার্শাল মানেক শ’
(ভারতের সাবেক সেনাবাহিনী প্রধান)
স্টেটম্যান, ২৯ এপ্রিল ১৯৮৮।

এই উক্তিটি করেছেন সেই ব্যক্তি, যিনি ১৯৭১ সালে ভারতের সেনাবাহিনী প্রধান ছিলেন। তিনি বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার দিনই উপলব্ধি করেছিলেন, বাংলাদেশের মানুষের জীবনধারা এবং মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে যে চেতনা বিরাজ করছে তাতে করে মুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষতার স্থান হওয়া সম্ভব নয়।

৭১ আমাদের স্বাধীনতা দিয়েছে।আমাদের একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে।কিন্তু কঠিন হলেও সত্য ৭১ পারেনি আমাদের দেশের বেশিরভাগ মানুষের হৃদয় থেকে মুছে ফেলতে পাকিস্তানকে।জাতিতে তারা অবশ্যই বাঙালি,কিন্তু হৃদয়ে পাকিস্তানি।

তবে আমাদের দেশের হিন্দু ধর্মাবলম্বীদেরও ভারত প্রীতি চোখে পরার মত।কিন্তু তাদের এই অতিরিক্ত ভারত প্রীতিতে সমাজের ভুমিকাও কম নয়।ছোট থেকেই নিজ ধর্ম,ধর্মের মানুষদের নির্যাতিত হতে দেখে মনের অজান্তেই তারা এসব থেকে মুক্তি চাইতে শুরু করে।চাকরির বাজারে থাকে অবহেলিত।মানসিকভাবে ধর্ষিত।এসব থেকে মুক্তির আশায় তাকিয়ে থাকে ভারতের দিকে।আর যখন দেয়ালে ঠেকে যায় পিঠ,সীমান্ত পারি দিয়ে চলে যায় ভারতে।

বাংলাদেশের হিন্দুরাও যে ইসলাম বা মুসলিম বিদ্বেষী নয় ব্যাপারটা ঠিক তা নয়।এদেশের হিন্দুরাও মুসলমানদের পছন্দ করেনা।আগে প্রায়ই শোনা যেতো,অনেক হিন্দু তাদের রান্নাঘরে কোন মুসলমানকে ঢুকতে দিতেননা।মুসলমানের স্পর্শ করা খাবার তারা মুখে নিতোনা।কিন্তু এদেশের মুসলিমদের হিন্দু বিদ্বেষ বিভিন্ন সময়ে যতটা প্রকাশ পেয়েছে এবং পাচ্ছে,হিন্দুদের মুসলমান বিদ্বেষ সেভাবে প্রকাশ পায়নি।এর কারন হিন্দুরা এখানে নিজেদের নিরাপদ মনে করেনা,প্রকাশ্যে মুসলিম বিরোধিতা কিভাবে করবে?

৭১ আমাদের নতুন একটি স্বাধীন দেশ দিয়েছিল ঠিকই কিন্তু অন্তরের স্বাধীনতা দিতে পারেনি।পাকিস্তানি চেতনা থেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারেনি।পাকিস্তানিদের মতই তীব্র ভারত বিরোধিতা করেই সময় চলে যায় আমাদের,দেশের কথা ভাববে কখন?ক্রিকেট খেলতে অন্য কোন দেশ যখন পাকিস্তানে যেতে চায়না নিরাপত্তার অভাবে আমাদের বিসিবি সভাপতি লোটাস কামাল জাতীয় দলকে পাকিস্তানে  পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেন।দেশের বেশিরভাগ মানুষই এই সিদ্ধান্ত মেনে নেয়নি কিন্তু যারা মেনে নিয়েছে তাদের সংখ্যাও কম নয়।

৭১ এ দেশ স্বাধীন করেছিল কারা?দেশে এতো পাকিস্তানপন্থি দেখি,ক্ষমতাবান রাজাকার দেখি।মুক্তিযোদ্ধা তো দেখিনা…মুক্তিযুদ্ধের চেতনা তো দেখিনা…।