পৃথিবী চলছে তার নিজস্ব গতিতে। তার পিছু নিচ্ছি আমরা। পৃথিবী আমাদের অনেক দিচ্ছে ঠিকই, তবে কেড়েও নিচ্ছে বিস্তর! তবু আমরা পৃথিবীর মায়া ছাড়তে পারি না। প্রতিনিয়ত তার শরীরে হেলান দিয়ে স্বপ্নের পথে হেঁটে যাই। হলুদ ফিতার মতো আমাদের বেণিরোগা নদীগুলো আজও আমাদের স্বপ্ন দেখিয়ে যাচ্ছে। মেঘনার পাশ দিয়ে যতবার গিয়েছি ততবারই ইতিহাসের স্বর্ণরেণু ঘিরে ধরেছে। আমি বারবার মেঘনার অববাহিকায় স্বপ্ন ও বাস্তবতার মধ্যে দিয়ে হেঁটেছি আর আয়োনীয়দের চলার পথকে বুঝতে প্রবলভাবে অনুভব করেছি কাউকে- সেরকম কাউকে লেখা এই চিঠিটি অথবা এক ধরনের ব্যাক্তিগত পরিভ্রমণও বলা যায়

ক্রিট,
গত কয়েকদিন ধরে খুব ইচ্ছে করছিল চাঁদপুর যাব। পদ্মা-মেঘনার মোহনা যেখানে মিলিত হয়েছে, ওখান থেকে নাকি কূলকিনারা কিছু দেখা যায় না। আমরা এখন বুড়িগঙ্গার ভেতর দিয়ে ছুটে চলেছি। হাইস্পিডের শব্দ খুব অদ্ভুত, ঝিম মারার মতো। আমরা মুন্সীগঞ্জের কাছে চলে এলাম। এখানে বুড়িগঙ্গা নদীটা অনেক বড় হয়ে গেছে। মুন্সীগঞ্জের পাশে বয়ে যাওয়া নদীর কিনার দিয়ে একটা পাকা রাস্তা চলে গেছে। দেখলে মনে হয় বাঁধানো নদীর পাড়। কয়েক জায়গায় গোসল করার ঘাট, কৃষ্ণচূড়া গাছও আছে। নদীর পাড় দিয়ে এত দীর্ঘ আর সুন্দর রাস্তা দেখলে পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকতে যাওয়ার কথা মনে পড়ে। রোদেলা দুপুরগুলোতে যে পথ দিয়ে আমি অনেকবার হেঁটেছি।

নদী ক্রমাগত চাওড়া হচ্ছে। দুপুর ১টার দিকে আমরা মেঘনায় পড়লাম। চারদিকে আকাশ। মাঝে মধ্যে রোদের আসা-যাওয়ার ফলে মনের মধ্যে দরজা খুলছে আবার থেমে যাচ্ছে। আমি হাইস্পিডের মাস্টার কেবিনের সামনে লোহার চেয়ারে বসে। মাঝে মধ্যে সাম্পান, নৌকা; কখনও জাহাজ চলে যাচ্ছে। আমার সঙ্গের তিনজনের সঙ্গে টুকরো টুকরো কথা বলে চলেছি। এখানে মেঘনা নদী বিশাল।
১টা ৪৫মিনিট। আমরা পদ্মা-মেঘনার মিলিত স্থানে পেৌছে গেলাম। দূরে ছোট নৌকাগুলো দেখা যাচ্ছে। ক্রিট, দুই নদীর সঙ্গমস্থল এত বিষণ্ন লাগছিল কেন?

উজ্জ্বল আলোর দিন নিভে যায়
মানুষেরো আয়ু শেষ হয়
পৃথিবীর পুরনো সে পথ
মুছে ফেলে রেখা তার
কিন্তু এই স্বপ্নের জগৎ
চিরদিন রয়
সময়ের হাত এসে মুছে ফেলে আর সব
নক্ষত্রেরো আয়ু শেষ হয়।
_জীবনানন্দ দাশ

সামনেই চাঁদপুর মাছঘাট। ঘাট অনেকটা খাড়ির মধ্যে। হঠাৎ করে হাইস্পিডের হর্নের শব্দ, যেন মহাকালের স্মৃতিকে মনে করিয়ে দিল। ছোট্ট হ্যাভারসেকটা গুছিয়ে নিলাম। এখান থেকে যখন ঘাটে নামছি, তখন মনে হচ্ছিল_ পরিপূর্ণ একটা জীবন অতিবাহিত হয়ে গেছে।

খাড়ির পাশ ঘেঁষে নদীটা দু’ভাগ হয়ে যাওয়াতে সুন্দর এক নদীতট সৃষ্টি হয়েছে। এখানে আট ঘনফুট আয়তনের সাদা কংক্রিটের অসংখ্য ব্লক ফেলানো। বিকেলের আলোতে অদ্ভুত লাগছিল। মনে হচ্ছিল এই নদী পাড়ি দিয়ে কোনো উপকথার দেশে চলে যাওয়া যাবে। এ যেন এক কংক্রিটের সৈকত। সামনে বিশাল মেঘনা, ভূমধ্যসাগরের কথা মনে করিয়ে দেয়। ভূমধ্যসাগর ঘিরে সেসব প্রাচীন জাতির কথা_ যারা প্রথম সভ্যতাকে বহুদূর এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। সক্রেটিস, প্লেটোর সেই এথেন্স, এসকিলাস আর সফোক্লিসের সেই নগরী এখন বিলুপ্ত, পার্থেনেন_ ২৪০০ বছর আগের দেবী এথেনার মন্দির এখন ধ্বংসস্তূপ।

অথচ এই পার্থেনেন ছিল গ্রিক সংস্কৃতির চূড়ান্তরূপ। একে বিবেচনা করা হতো প্রাচীন গ্রিস ও এথেনীয়দের গণতন্ত্রের প্রতীক হিসেবে। বলা হয়, মানব ইতিহাসে মহত্তম সাংস্কৃতিক স্থাপত্য এটি। এখানেই গড়ে উঠেছিল পৃথিবীর প্রথম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্লেটোর একাডেমি। স্বপ্ন দেখাতে চেয়েছিল মানবজাতিকে মৌলিক সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে, মানবিক বোধের সংজ্ঞা নির্ধারণে। এর আগেও শিক্ষাদান কেন্দ্র ছিল। কিন্তু তা ছিল কেরানি তৈরির কাজে নিয়োজিত। তার থেকে খুব বেশি অগ্রসর হয়নি প্রতিষ্ঠানগুলো! এখন পণ্য আর যন্ত্র তৈরি করছে_ যা স্বার্থপর সমাজের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। নক্ষত্রে যাওয়ার বদলে অন্যকে বঞ্চিত করার প্রবণতা। ৩৮ লাখ বছরের সাংস্কৃতিক অর্জনের কী মর্মান্তিক পরিণতি!

এখানে বিকাশ ঘটেছিল সফিস্টদের। তারা এক ধরনের তার্কিক সম্প্রদায়। পেশাদারি বক্তৃতা শুরু করেন তারাই। তাদের মাধ্যমে খুব মৌলিক কিছু প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছিল। সময়টা ছিল খ্রিস্টপূর্ব ৪০০ অব্দের এথেন্স। প্রথম সফিস্ট প্রোটোগোরাস বলেছিলেন, ‘মানুষ ও প্রকৃতির মধ্যে যদি বিপরীত ধর্মীয়ভাব বিদ্যমান থাকে, তাহলে এ বিশ্ব প্রকৃতিতে মানুষের স্থান কোথায়?’ কিন্তু সফিস্টদের বাগ্মিতা, বক্তৃতার সাবলীলতা উদ্দেশ্যমূলকভাবে ব্যবহৃত হওয়ায় বিলুপ্তি ঘটে। এরপর সক্রেটিসের আগমন ঘটে। তিনি এথেন্সের লোকসমাগমপূর্ণ বিভিন্ন স্থানে, হাটে-বাজারে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করতেন।
মিতব্যয়ী হওয়ার মধ্য দিয়ে লোভহীন জীবনের কথা বলেছিলেন। নিজেকে জানার মধ্য দিয়ে বুঝিয়েছিলেন বিশ্বকে উন্মোচনের কথা; যা লালনও বলেছিলেন ২২শ’ বছর পরে। কিন্তু কেন পরমাণুবাদের জনক ডেমোক্রিটাস আবদেরা থেকে এথেন্সে এসেছিলেন, কেনই-বা সক্রেটিসের সঙ্গে দেখা না করে চলে গিয়েছিলেন? এ এক অদ্ভুত প্রহেলিকা। অনেকে বলেন এ ঘটনা বিশুদ্ধ গণিতের জন্মের সঙ্গে বিজ্ঞানের দ্বন্দ্ব জড়িত। ফলে বিজ্ঞানের অগ্রগতি থেমে গিয়েছিল।

এই কংক্রিট ব্লকের ওপর বসে অনেক কথা ভাবছিলাম। দেখতে পাচ্ছিলাম চলে যাওয়া প্রাচীন ফিনিশীয়দের বহর, রোমের পথে ওয়ারি বটেশ্বরের বিডসগুলো নিয়ে দূরে চলে যাওয়া কালো নৌযানগুলো। আমি সঙ্গে করে যে বাঁশিটা এনেছিলাম তা বাজানোর চেষ্টা করলাম_ ‘বে অব লাপলাতা’। সেই সুরটা যেটা শুনে একদিন তুমি অভিভূত হয়েছিলে। হঠাৎ করে তোমার কথা মনে হলো।
ক্রিট ইদানীং তোমার কথা মাঝে মাঝে মাঝে ভাবি। অবশ্য তোমার কথা মনে করার কারণও আছে। মনে হচ্ছিল_
এ পথেই আলো জ্বেলে_ এ পথেই পৃথিবীর ক্রমমুক্তি হবে
সে অনেক শতাব্দীর মনীষীর কাজ।

আচ্ছা ক্রিট, আয়োনীয় জ্ঞানচর্চার গতি যদি রুদ্ধ না হতো, তাহলে আমরা কি মহাজাগতিক সভ্যতায় উপনীত হতে পারতাম? হয়তো পেঁৗছে যেতে পারতাম বার্নাড, সাইরাস অথবা টাউসেটির মতো নক্ষত্রগুলোতে। আমাদের স্টারশিপগুলো শত শত আলোকবর্ষ দূরে ঘুরে বেড়াত নতুন কিছুর অন্বেষায়।

শেষ বিকেলে সূর্য ক্রমাগত দিগন্তের পাড়ে মিশে যাওয়ার সঙ্গে অপর দিক অন্ধকারে নিঃশেষিত হচ্ছিল। দূর নৌকাগুলো শুধুই কালো বিন্দু। এ যেন শাশ্বত রৌদ্রের থেকে অনন্ত রাত্রির দিকে যাওয়া। ক্রিট, তুমি যখন আমার এখানে এসে চশমা খুলে চোখ মোছ_ আমি সেই দৃশ্য অনুভব করছি। পৃথিবীটা খুব অদ্ভুত, তাই না?

শনিবার – ২৮ ফ্রেবুয়ারি ১৯৯৮