“গল্প শোনাবে? তাহলে আমি সব গাছে পানি দিয়ে দিব।” – ছোটবেলায় এভাবেই আমাকে দিয়ে কাজ করিয়ে নিতো বাবা-মা কিংবা বড় বোন। আপনার ছোটবেলায় এমন ঘটনা ছিল না? নিশ্চয়ই ছিল। হয়তো এখন মনে করতে পারছেন, তবে ছিল নিশ্চয়ই। আসলে গল্পের জন্য সবার মনেই একটু-আধটু দুর্বলতা আছে। আমার কিন্তু এখনো আছে, যদিও একটু ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে – যেমন, “‘জ্ঞান’ দিলে আমি নাই।” ‘বিবর্তনের পধ ধরে’-এর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে – গল্প বলার ঢং। মিথ্যে বলবো না, বইটা শুরু করেছিলাম একটুখানি জ্ঞান নিতেই; তবে শুরু থেকেই শুরু করা গল্প আমাকে টেনে নিয়েছে গল্পের মধ্যে, শেষ অবধি ধরে রেখেছে গল্পের মধ্যে। গল্পের গল্প শোনাতে এসেছি তাই।

বইটা পড়া শুরু করেছিলাম এক বন্ধুর সাথে তর্কের সূত্র ধরে। সে বলছিলো- “বিবর্তনতত্ত্ব প্রমাণিত”। আমি মানিনি। আমার যুক্তি এইরকম – “প্রমাণ শব্দটা একটা বিশেষ কিছু। কোন কিছুর পক্ষে হাজারটা উদাহরণ দিলেও তা প্রমাণ হয়না, যেখানে কেবল একটা বিপক্ষ উদাহরণই তা ভুল প্রমাণ করতে পারে”। তবে বন্ধু আমার সম্বন্ধে অনেক জানে কী না, তাই এক্কেবারে মোক্ষম জায়গার কথা বলে আমাকে মোটামুটি বোল্ড করে দিলো – “তুমি কখনো বিবর্তনতত্ত্ব নিয়ে পড়াশুনা করোনি, তাই জানো না, আগে পড়ো, তারপর তর্ক করো।” কী আর করা, আমি যখন পড়িই নাই, আর সে যখন পড়েছে, তখন তার কথাতো আপাতত গলাধঃকরণ করতেই হবে।

ভাবছিলাম কোথা থেকে শুরু করা যায়। উইকি থেকেই শুরু করার কথা মাথায় এলো প্রথমে, সাথে কিছু আর্টিক্যাল। শুরুতেই সমস্যা হলো ইংরেজিতে। আরে ভাই, সারাজীবন একাডেমিক কিংবা প্রফেশনাল খাতিরে না হয় পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা ইংরেজি পড়েছি, কিন্তু তাই বলে মনের আনন্দে পড়ার জন্য ইংরেজি পড়েছি নাকি কোনদিন! এমনিতেই নিরস বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব, তার উপর ইংরেজি! এ দু’য়ে মিলে আমার নিতান্ত-খারাপ-না গোছের ইংরেজি দিয়ে বিজ্ঞান-শিক্ষা বেশি দূর এগোলো না। এদিকে বিজ্ঞান বিষয়ক বাংলা বইয়ের উপর আস্থাও নাই তেমন। এ অনাস্থার ব্যাপারে আমার কোন দোষ নাই, আমার পূর্বসূরিরা আমার আস্থা অর্জন করতে পারেনি। এদিকে মুক্তমনার আর্টিকেলগুলো খন্ডিত ধারণা দিলেও সম্পূর্ণতার অভাব থেকেই যায়। যাই হোক, শেষ পর্যন্ত মুক্তমনার উপর একটুখানি আস্থার উপর নির্ভর করে শুরু করলাম বন্যা আহমেদের “বিবর্তনের পথ ধরে” বইটি। ২০০৭ সালে প্রথম প্রকাশিত বইটার পরবর্তী সংস্করণ ২০০৮ সালে বের হলেও, বিদেশ বিভূঁইয়ে যেহেতু মুদ্রিত বই পাওয়া সম্ভব না, অতএব অনলাইন ভার্সনেই ভরসা। বইয়ের প্রতিটা অধ্যায়ের পরের তথ্যসূত্র আমার বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করে নিলো। আর সেই সাথে গল্প বলার ঢং কেড়ে নিল আমার মনোযোগ আর আকর্ষণ। শুরু হলো এর সাথে আমার পথচলা।

পথচলা শেষে একটা কথাই নতুন করে মনে হচ্ছে, মানুষকে যুক্তির সৌন্দর্য বুঝাতে পারলে, আর বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি আকর্ষণ তৈরি করতে পারলে, স্রোতে ভেসে যাবে ভিত্তিহীন ধর্মবিশ্বাস। আজকাল প্রচুর লেখা পাই, যেখানে প্রচলিত ধর্মগুলোর অসারতা, সাংঘর্ষিকতা নিয়ে কথা বলা হয়। সেসব লেখায়ও যুক্তি দিয়েই প্রমাণের চেষ্টা করা হয়, তবে ঐসব যুক্তির বেশিরভাগই হয় ‘আবেগী’ ধরনের। যেমনঃ ইসলাম ধর্মে উত্তরাধিকারে মেয়েদের অধিকার ছেলেদের অর্ধেক। তার মানে, মেয়েরা অর্ধেক মানুষ। নীতিগতভাবে এ ধরনের যুক্তি সমর্থন করলেও, এ ধরনের ‘আবেগী’ যুক্তিতে একজন ধর্মবিশ্বাসীর বিশ্বাসের কতখানি হেরফের হয়, তাতে ঢের সন্দেহ আমার। তাতে ফল বরং উলটো হয়, এটাই আমার পর্যবেক্ষণ। এ ধরনের যুক্তিকে ধর্মবিশ্বাসী তার বিশ্বাসের প্রতি অপমান হিসেবে দেখে, যা সে প্রকারান্তরে নিজেকে অপমান বলেই ধরে নেয়। ফলশ্রুতিতে তার মধ্যে এক ধরনের প্রতিশোধস্পৃহা কাজ করে, মনে মনে প্রতিহিংসা তৈরি হয় তার। একই সাথে, নানান কোণাহীন শোনা ঘটনার উদাহরণ দেখিয়ে তার অবস্থানকে জাস্টিফায়েড করতে চেষ্টা করে। সেই ধর্মবিশ্বাসী আরো একটুখানি তিমিরে তলিয়ে যায়। ‘বিবর্তনের পথ ধরে’ বইটির বিশেষত্ব এখানেই। এখানে আবেগী যুক্তি দিয়ে কিছু বলা হয়নি। কিংবা “ঈশ্বর মানুষের সৃষ্টিকর্তা নয়” কেবল এ কথা বলেই থেমে যাওয়া হয়নি। বরং বিজ্ঞানের যুক্তির সৌন্দর্য দিয়ে বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে যে, মানুষের কোন ‘সৃষ্টিকর্তা’ নেই, মানুষ হুট করে সৃষ্ট হয়নি, প্রতিনিয়ত পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে অন্য প্রাণী থেকে বিবর্তিত হয়েছে কেবল। এ যুক্তির মূল কৃতিত্ব বিবর্তনতত্ত্বের হলেও, লেখিকা যে এর সাথে আবেগকে মিলিয়ে ফেলেননি, সেজন্য তাকে ধন্যবাদ না দিয়ে পারা যায় না।

নিজের কথা বাদ দিয়ে বরং বইটার সাথে পথচলার গল্প বলি। শুরুতেই (১ম অধ্যায়- এলাম আমরা কোথা থেকে?) দেখা ইন্দোনেশিয়ার ক্ষুদে বামন মানুষদের সাথে। ৩ ফুটের কিছু বেশি (১ মিটার) উচ্চতার ক্ষুদে বামনরা নাকি আমাদের মানুষদেরই আরেক প্রজাতি! যদিও তাদের মস্তিষ্কের আকার আমাদের চেয়ে বেশ ছোট। মজার ব্যাপার হলো, এই বামন মানুষের ফসিলগুলোর পাশেই পাওয়া যায় বেশ কিছু পাথুরে অস্ত্রের ফসিলও। এই দুই ফসিলের সাথে যোগসূত্র থেকে ধারণা করা হয়, ক্ষুদে বামনরা তাদের ক্ষুদ্র মস্তিষ্কের সাহায্যেই হাতিয়ার বানাতে পারতো! পুরো ব্যাপারটা একদম চোখের সামনে ভেসে উঠলো বিজ্ঞানীর যুক্তি আর শিল্পীর তুলি – এ দু’য়ের সমন্বয়ে যখন বামন মানুষদের সম্ভাব্য ছবি দেখানো হলো। এরকমই কোন ক্ষুদে বামন কিংবা নর-বানর যে আমাদের পূর্বপুরুষ আর সমস্ত জীবজগত যে একই আদি জীব থেকে বিবর্তিত হয়েছে সে কথা ছোট্ট করে দেখানোর পাশাপাশি ১ম অধ্যায়ের শেষে পরিষ্কার করে দেয়া হলো যে, “বিবর্তনতত্ত্ব প্রাণের উৎপত্তি ব্যাখ্যা করে না, বরং উৎপত্তির পর প্রাণের বিকাশ নিয়ে আলোচনা করে।”
এরপর (২য় অধ্যায়ে- বিবর্তনে প্রাণের স্পন্দন) চলে গেলাম উনিশ শতকের শুরুতে। মূলতঃ ডারউইনের জীবনকাহিনীর সাথে পরিচিত হতে থাকলাম – কীভাবে ধর্মযাজক হওয়ার পরিবর্তে ডারউইন হয়ে উঠলেন একজন যুগান্তকারী বৈজ্ঞানিক, কীভাবে তার জীবের স্থিরতায় বিশ্বাসী চিন্তাধারা ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হতে লাগলো। বিগল জাহাজে করে ঐতিহাসিক বিশ্বভ্রমণের সময়ে ডারউইনের দেখা প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য ও তাদের মধ্যে সাদৃশ্য-বৈসাদৃশ্যের টুকরো টুকরো উদাহরণ ও স্থানে-স্থানে চিত্রের মাধ্যমে জানতে পারলাম, বুঝতে পারলাম কীভাবে তার চিন্তার দুয়ার একটু একটু করে উন্মুক্ত হয়েছিল। ডারউইনের গল্পের মাঝেই ছোট করে পরিচিত হলাম ল্যামার্ক, লায়েল সহ তৎকালীন বিজ্ঞানী ও তাদের চিন্তাধারার সাথে।

ডারউইনের গল্প চলতে থাকলো এর পরের অনন্ত সময়ের উপহার অধ্যায়েও। এখানে মূলতঃ ডারউইনের চিন্তার সাথে ধর্মের সাংঘর্ষিক ব্যাপারগুলো উঠে এলো। একে একে উঠে এলো ডারউইনের সময়ে ও তার আগে কালের-পর-কাল ধরে ধর্ম কর্তৃক বিজ্ঞানের টুঁটি চেপে ধরার কাহিনীগুলো, উঠে এলো কালে-কালে কিছু কিছু সাহসী ও আলোকিত ব্যক্তির সংগ্রাম ও অবদানগুলো। এরকম পরিস্থিতিতে আলফ্রেড রাসেল ওয়ালেসের সাথে মিলে প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে বিবর্তনের মতো যুগান্তকারী তত্ত্ব দেয়ার আগে হাজার রকম ভাবে নিশ্চিত হওয়ার ঘটনাগুলোও একে একে চাক্ষুষ করলাম। সেই সাথে চাক্ষুষ করলাম মহাপরাক্রমশালী ধর্মান্ধ মৌলবাদীদের ডারউইনের বিরুদ্ধে বিষোদগার, নিন্দা, গালাগাল আর অপমান। দেখলাম, ডারউইন টললেন না তার অবস্থান থেকে, বরং কিছু বিজ্ঞানী-বন্ধুর অকুন্ঠ সমর্থন নিয়ে একে একে প্রতিহত করলেন বিরুদ্ধবাদীদের যুক্তি, তুলে ধরলেন বিবর্তনতত্ত্বের সারকথা।

বিবর্তন যে কেবল বইয়ে লেখা তত্ত্ব নয়, বরং আমাদের চারপাশের প্রাত্যহিক ঘটনাগুলো যে আসলে বিবর্তনকে ধারণ করে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত সেই কথা জানলাম পরবর্তী ‘চোখের সামনেই ঘটছে বিবর্তন!’ অধ্যায়ে। মশার বিবর্তনের কারণেই যে আমরা এখন আর কীটনাশক দিয়ে আগের মতো কার্যকরভাবে মশা ধ্বংস করতে পারি না, ফুল-ডোজ এন্টিবায়োটিক শেষ না করলে যে পরে পস্তাতে হয় আর তার পিছিনে যে দায়ী ব্যাক্টেরিয়ার বিবর্তন – এইসব ঘটনার সহজ-সরল-প্রাঞ্জল ব্যাখ্যা পেলাম এখানে। বিবর্তনতত্ত্বের উপর ভিত্তি করে লম্বা হুলওয়ালা পোকার অস্তিত্বের ব্যাপারে ডারউইনের করা ভবিষ্যদ্বাণী সত্য হওয়া প্রমাণ করে এ তত্ত্বের উপযোগিতা।

৪র্থ অধ্যায়ের মতো ৫ম অধ্যায়ও (ফসিল এবং প্রাচীন উপাখ্যানগুলো) গল্পপ্রেমীদের জন্য চরম আকর্ষণের জায়গা। রাক্ষস-খোক্ষস, দৈত্য-দানব আর ড্রাগনের রূপকথাগুলো যে আদতে ফসিল থেকে পাওয়া সেই গল্পের আকর্ষণ রোধ করা ভার। ডাইনোসর থেকে পাখির বিবর্তনের সাথে গ্রীস রূপকথার গ্রিফিন নামক অর্ধেক পাখী – অর্ধেক সিংহ চরিত্রের বিস্ময়কর মিল দেখে যার-পর-নাই অবাক হতে হয়। চীনদেশের ড্রাগনসমৃদ্ধ রূপকথার সাথে সেখানকার ডাইনোসরের ফসিলের চমকপ্রদ মিলও চোখ বড় করে তাকাতে বাধ্য করে।

গল্পের পাশাপাশি বিজ্ঞানের রোমাঞ্চকর ঘটনাগুলোর সমাহার ঘটেছে ‘ফসিলগুলো এলো কোথা থেকে’ অধ্যায়ে। বৈজ্ঞানিক শব্দ তেমন না কপচিয়ে সহজ ভাষায় প্রাকৃতিক পরিবর্তনের ফলে কীভাবে ফসিলগুলো একে উপরের উপর স্তরে স্তরে বিন্যস্ত থাকে, তা জানতে পারলে কার না ভাল লাগে বলুন! আর সেই সাথে যদি এসব স্তরের সাথে অন্য মজার ঘটনার মিল দেখতে পান, তাহলে ভাল লাগা বেড়ে যাবে না বলুন? ভূতত্ত্বের একটা অন্যতম তত্ত্ব হচ্ছে মহাদেশগুলোর একে-অপরের কাছ থেকে আলাদা হয়ে যাওয়ার তত্ত্ব। আগে সবকটা মহাদেশ একসাথেই ছিল, যা মহাদেশের মানচিত্রগুলো একত্রে করে চমৎকারভাবে দেখানো হয়েছে। একত্রে করার পর দেখা গেলো, ভিন্ন মহাদেশের যেসব জায়গা আগে কাছাকাছি ছিলো সেখানকার প্রাণীগুলোর ফসিলের মধ্যে অসম্ভব মিল। ভিন্ন ভিন্ন তত্ত্ব একই কথা বলছে, মজা না?

ফসিলের গল্প শেষ হতে চায় না, বরং আকর্ষণ বাড়তে থাকে। ৭ম অধ্যায়েও (প্রাণের মেলা কত পুরনো?) চলতে থাকে ফসিলের চমকপ্রদ গল্প। ফসিলের বয়স নির্ধারণের নানা তড়িকা জানা গেল এখানে। একই ফলাফল কীভাবে বারবার বিভিন্ন পদ্ধতিতে ক্রস-চেক করার মাধ্যমে বৈজ্ঞানিক সত্যতা সম্বন্ধে সন্দেহের অবকাশ কীভাবে উড়িয়ে দেয়া যায়, তা চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে এখানে। ফসিলবিদ ও ভূতত্ত্ববিদরা একত্রে মিলে ভূ-ত্বকের বিভিন্ন স্তরে পাওয়া বিভিন্ন উদ্ভিদ ও প্রাণীর ফসিলের ভিত্তিতে আপেক্ষিক সময়ক্রম তৈরি করেন। মজার ব্যাপার হলো, এ ক্রম তৈরি হয়েছে বিবর্তনতত্ত্বেরও ১৮ বছর আগে। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, মূল ছকটি এখনো প্রায় একইরকম আছে। ভূতত্ত্ব ও ফসিলতত্ত্বের সাপেক্ষে বিবর্তনতত্ত্ব কীভাবে খাপে-খাপে মিলে যায় সে কথা জানতে পারলাম গল্পে গল্পে।

বিবর্তনতত্ত্ব নিজেই বলে যে, ধীরে ধীরে নতুন প্রজাতির উৎপত্তি ঘটে। আর তাই “ডাইনোসর থেকে পাখির বিবর্তন হয়েছে” – একথা সত্যি হলে নিশ্চয় ডাইনোসর আর পাখির মধ্যবর্তী আরো অনেক প্রজাতি থাকার কথা! যতক্ষণ পর্যন্ত এ মধ্যবর্তী প্রজাতিগুলোর অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া যায়নি, ততক্ষণ পর্যন্ত এদের বলা হতো ‘মিসিং লিংক’। এ মিসিং লিংকগুলো যে এখন আর মিসিং নেই তা ছবির মাধ্যমে অত্যন্ত পরিষ্কারভাবে দেখিয়ে দেয়া হয়েছে “মিসিং লিংকগুলো আর মিসিং নেই” অধ্যায়ে।

সময় এগিয়ে চলে, ১৪০০ কোটি বছর আগে থেকে শুরু করা গল্প এসে ঠেকে আমাদের সময়ে। “আমাদের গল্প” নামের নবম অধ্যায়ে ফসিলের সাথে সহজ করে জেনেটিক আলোচনা এবং চারপাশের পরিবেশের পরিবর্তনের গল্প এক-এক করে তোলে আনে আমাদের বিবর্তনের জটিল ইতিহাস!

১০ম অধ্যায়টা এক্কেবারে আক্ষরিক অর্থেই এখনকার সময়ের গল্প। ধর্মের সুবিধাভোগীরা কত ছল-চাতুরী আর ছদ্মবেশে বিবর্তনতত্ত্বকে উঠিয়ে তাদের সৃষ্টিতত্ত্বকে প্রতিষ্ঠা করতে চায়, তার একগাদা ফিরিস্তি পাওয়া যায় এখানে। এসব ছলচাতুরী বিবর্তনের আলোকে নাকচ করে দেয়ার আগে পরিষ্কারভাবে বুঝানো হয়েছে তাদের অন্যতম যুক্তিগুলোর (প্যালের ঘড়ি, সৃষ্টিতত্ত্ব, ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইন) সারকথা। সেই সাথে টেনিসির স্কোপ্‌স মাংকি ট্রায়াল, আরকানসাসের ভারসাম্যমূলক বিচার আইন, লুইজিয়ানার সৃষ্টিবাদী আইন সব বিখ্যাত মামলাগুলোর বিশদ কাহিনী জানলে ও আমেরিকার মতো দেশে বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব গ্রহণের অনীহার কথা জানলে অবাক হতে হয় বৈকি!

সবশেষে, আমাদের সামাজিক-সাংস্কৃতিক বিবর্তনের কথা বলে গল্পের ইতি টানা হয়েছে “যে গল্পের শেষ নেই” অধ্যায়ে।

শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এ গল্পের অন্যতম দিক হচ্ছে, সহজবোধ্য প্রতিদিন ব্যবহারের মতো শব্দের সাথে সখ্যতা। শুরুর অধ্যায়গুলোতে বৈজ্ঞানিক পারিভাষিক শব্দের কপচানি বলতে গেলে নেইই, যেটুকু আছে সেটুকুও সহজ ভাষায় বলে নেয়া হয়েছে ব্যবহারের আগে। সাধারণ পাঠকদেরও তাই বিবর্তনতত্ত্বের মূল ধারণা উপলব্ধি করতে এতটুকু বেগ পেতে হয় না। তবে ৭ম অধ্যায় থেকে বৈজ্ঞানিক কঠিন কঠিন শব্দের ব্যবহার কিছুটা বেড়ে গেছে। যদিও লেখিকা নিতান্ত বাধ্য হয়ে কিছু বৈজ্ঞানিক তত্ত্বকথা ও বৈজ্ঞানিক নাম উল্লেখের কথা নিজেই বলেছেন (৯ম অধ্যায়, পৃ-১৪, পৃ-২২) এবং বেশির ভাগ জায়গায় এগুলোর ব্যবহার যুক্তিসংগতও, কিছু কিছু জায়গায় বৈজ্ঞানিক শব্দ ও তত্ত্ব আরেকটু কম বলা যেত বলে মনে হয়। যেমনঃ তেজস্ক্রিয় ডেটিং বুঝাতে গিয়ে (৭ম অধ্যায়, পৃ-১০) ইলেক্ট্রন, প্রোটন, নিউট্রন, ধনাত্মক-ঋণাত্মক চার্জ, পারমাণবিক সংখ্যা, পারমাণবিক ভর, আইসোটোপ সহ রসায়নের প্রাথমিক তত্ত্বগুলো এত বিশদভাবে ব্যাখ্যা না করে, সাধারণভাবে তেজস্ক্রিয় পদার্থের উদাহরণ ও তাদের নির্দিষ্ট গতিতে ক্ষয়ের কথা উল্লেখ করলে সাধারণ পাঠকের জন্য ভাল হতো। একই কথা প্রযোজ্য HIV ভাইরাসের বিস্তারের ক্ষেত্রেও (৪র্থ অধ্যায়, পৃ-২)। সাধারণ পাঠকের জন্য এই ভাইরাস “DNA এর বদলে RNA দিয়ে তৈরি বলে নিজে নিজে বংশ বিস্তার করতে পারে না” – এ তথ্য খুব একটা প্রয়োজনীয় না, কারণ DNA আর RNA এর মধ্যে পার্থক্য তার কাছে পরিষ্কার না। তার জন্য এটুকু জানাই যথেষ্ট যে, ভাইরাসটি মানুষের DNA তে ঢুকে পড়ে বংশবৃদ্ধি করে। এরপর HIV ভাইরাসের মধ্যে রিভার্স ট্রান্সক্রিপ্টেজের উপস্থিতি এবং এ কারণে ভাইরাসের বিবর্তনের ব্যাপারটা খুব সুন্দর করে সহজভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে বইয়ে। দুয়েক জায়গায় এমন একটুখানি বেশি তত্ত্বকথা থাকলেও, একথা এক বাক্যে স্বীকার করতেই হবে যে, খুব সহজ-সরল-প্রাঞ্জল ভাষায় গল্প বলাই এ বইয়ের প্রাণ।

এ বইয়ে আমার মুগ্ধতার পেছনে আরো একটা কারণ আছে। কেবল একটা দিক থেকে বিবর্তনের তত্ত্বের গ্রহণযোগ্যতা ব্যাখ্যা করা হয়নি এখানে, বরং ফসিলবিদ্যা, ভূতত্ত্ববিদ্যা, জেনেটিক্স সহ বিজ্ঞানের কয়েকটি শাখার কিছু কিছু তত্ত্বের সহজ ব্যাখ্যা করে সেগুলোও যে একই বিবর্তনের পক্ষে সংহতি প্রকাশ করে, তা পরিষ্কারভাবে বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে। এই ক্রস-চেকিংয়ের মাধ্যমে বিবর্তনতত্ত্ব যেরকম শক্তভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তা যে ঠুনকো যুক্তিতে অস্বীকার করার উপায় নেই তা পাঠক উপলব্ধি করতে পারে তীব্রভাবে।

আরো একটা ব্যাপার বিশেষভাবে উল্লেখ করার দাবি রাখে। লেখিকা কেবল বিবর্তনতত্ত্ব ব্যাখ্যা করেননি, বরং এর বিরুদ্ধবাদীদের মতবাদও সহজ ভাষায় সুন্দর করে বুঝিয়ে নিয়েছেন। এবং তা করেছেন পর্যাপ্ত রেফারেন্স দিয়ে। বিরুদ্ধবাদীদের মতামত ব্যাখ্যা করার পর তা খন্ডনের কথাও বলেছেন রেফারেন্স দিয়ে। এত করে পক্ষে-বিপক্ষের মতামতগুলো পর্যালোচনা করা পাঠকের জন্য বেশ সহজ ও আকর্ষণীয় হয়েছে।

বইটির শুরুর দিকে (৫ম অধ্যায় পর্যন্ত) ছবিগুলোর লেবেলিং ও ক্যাপশন বাংলায় রূপান্তর করার প্রয়াসও প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য। এ প্রয়াস পরবর্তী অধ্যায়ের ছবিগুলোতেও বজায় থাকলে আরো ভাল হতো। সেই সাথে আরো ভাল হতো যদি একই তথ্যের বিভিন্ন জায়গায় উদ্ধৃতিগুলোর মধ্যে কিঞ্চিৎ অসামঞ্জস্যতাটুকুও না থাকতো। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় মানুষ আর শিম্পাঞ্জির জিনের মধ্যে মিল-অমিলের পরিমাণের কথা [মিল ৯৮.৬% (১ম অধ্যায়, পৃ-৬), অমিল ১.২% (৯ম অধ্যায়, পৃ-৭), মিল ৯৯% (৯ম অধ্যায়- পৃ-৯)], কিংবা বিভিন্ন জায়গা বা মানুষের নামের বানানের কথা [আরকানসাস/আর্কানসাস, স্পেনসার/স্পেন্সর]।

কোপার্নিকাসের উদাহরণ প্রাসঙ্গিকভাবেই বারবার এসেছে বইটিতে। তবে “কিছু কৈফিয়ত এবং কৃতজ্ঞতা” ছাড়াও আরো ছয়টি অধ্যায় মিলিয়ে অন্তত ১২ বার একই ঘটনার উল্লেখের ফলে শেষের দিকে এর আবেদন যেন একটু কমে গেছে বলে মনে হলো। এই ঘটনার পুনরাবৃত্তির পাশাপাশি আলফ্রেড ওয়ালেসের ধার্মিকসত্তার কথা ও মানুষের ক্ষেত্রে নিজের প্রস্তাবিত “প্রাকৃতিক নির্বাচন” তত্ত্ব প্রয়োগের অনীহার কথার অনুপস্থিতি দেখে কিছু অবাকই হয়েছি বলতে হবে। ঘটনাটা বইয়ে আসলে এবং একারণে বিজ্ঞানীমহলে তার গ্রহণযোগ্যতা কীভাবে কমে এসেছিল সে কথাও বললে পাঠকের জন্য তা আরো আকর্ষণীয় হতো।

একটা ব্যাপার না বললেই নয় যে, রাম-সাম-যদু-মধুদের বই থেকে সুলেখিত বই পার্থক্য করার একটা প্রাথমিক হাতিয়ার হলো – শুদ্ধতা। অনলাইনে থাকা ই-বইয়ের যে ভার্সনটা যদি বইটির ১ম প্রকাশের কপি হয়ে থাকে, তাহলে আমাকে বলতেই হবে যে, আমি যার-পর-নাই হতাশ। এখানে এত এত ভুল যে, এক সময় সেগুলো আর মস্তিষ্ক পর্যন্ত যায়নি। একবার আর্টসেলের কনসার্টে গিয়েছিলাম, তখনো আর্টসেলের গান সম্বন্ধে তেমন জানাশুনা নেই আমার। সেখানে গিয়ে তাদের অনবরত চিৎকার-চেঁচামেচি আমাকে এতই বিরক্ত করেছিল যে, চিৎকারের সুষমতায় আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ঠিক এমনটাই ঘটেছে বইটি পড়ার ক্ষেত্রে। ভুলগুলো একসময় আর মস্তিষ্ক পর্যন্ত পৌঁছাচ্ছিল না। বইটির ভুলের ছোট্ট একটা পরিসংখ্যান দেই। ৯ পৃষ্ঠার একাদশ অধ্যায়ে ভুলের সংখ্যা ৬০ এরও বেশি। ৯ম ও ১০ম উভয় অধ্যায়েরই ভুলের সংখ্যা শতাধিক। বাকিগুলোর হিসাব করিনি। তবে আমি বিশ্বাস করতে চাই যে, ১ম প্রকাশের আগেই বেশির ভাগ ভুলগুলো সংশোধন করা হয়েছিল এবং ১ম সংস্করণে ভুলের সংখ্যা শূণ্যের কোঠায় নেমে এসেছে।

ও হ্যাঁ, আমার সেই বন্ধুটির সাথে বিবর্তনের ব্যাপারে এরপর আর কথা বলা হয়নি, বলবো নিশ্চয়। তাকে এখন আমি আত্মবিশ্বাসের সাথে বলতে পারবো, আমার যুক্তি থেকে নড়িনি আমি। তাই বলে আবার “বিবর্তন প্রমাণিত নাকি অপ্রমাণিত” তা নিয়েও তর্ক করতে চাই না। তত্ত্বের ব্যাপারে আমার বর্তমান ধারণা হলো – তত্ত্ব কোন গাণিতিক সূত্র নয় যে প্রমাণ করার প্রশ্ন উঠবে, বরং এটা একটা মডেল, যার মাধ্যমে বাস্তবকে ব্যাখ্যা করা যায়। কোন একটা মডেলের সীমাবদ্ধতা থাকলে সে মডেল বাদ হয়ে যায় না, বরং আরো ভাল একটা মডেল খুঁজতে উৎসাহিত করে বিজ্ঞানকে। একটা মডেল বা তত্ত্ব কেবল তার থেকে আরো ভাল একটা মডেল বা তত্ত্ব দিয়ে প্রতিস্থাপন করা যায়, যা বাস্তবকে আরো ভালভাবে ব্যাখ্যা করতে পারবে। বিবর্তনতত্ত্বের পক্ষে ভূরিভূরি উদাহরণের উপস্থিতি ও তার বিপক্ষে কোন উদাহরণের অনুপস্থিতি এ তত্ত্বকে বিজ্ঞানের জগতে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছে।