বর্তমানকালে আমরা যে বাংলা ভাষায় কথা বলি, প্রাচীনকালে তা কি এরূপ ছিল ? অথবা সমসাময়িক বাংলা সাহিত্য, প্রাচীনকালে কেমন ছিল ? কোথা থেকে জন্মলাভ করেছিল বাংলা ভাষা ও সাহিত্য ? ইতিহাসবিদ ও তাত্ত্বিকদের সুগভীর চিন্তাভাবনা ও গবেষণা লব্ধ ফল আমাদেরকে জানতে সাহায্য করে- প্রাচীন বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের কথা। তবে আশঙ্কা এই যে, প্রাচীনকালে সত্যই বাংলা ভাষা-সাহিত্য কিরূপ ছিল তা আধুনিক ভাষাতাত্ত্বিকরা নিরূপন করতে পারেন নি। ফলে তত্ত্ব গবেষণার মাধ্যমে নানা মতের উদ্ভব হয়েছে। তর্কের দ্বারা বাতিল হয়েছে একাধিক, আবার গৃহীত হয়েছে অসংখ্য। ফলে এ বিষয়য়ে কারো মতভেদ থাকবে না যে, বাংলা ভাষা-সাহিত্যের উদ্ভব ও ক্রমবিকাশের ধারার কোনো সুলিখিত প্রতিবেদন নেই। অনুমান নির্ভর ও গবেষণা লব্ধ তাত্ত্বিক ফলকেই আমরা ধরে নেই প্রমাণ বলে।

প্রচীন বাংলা সাহিত্যের কথা বলার পূর্বে যে বিষয়টি উল্লেখ করা প্রয়োজন তা হল- বাংলা ভাষার জন্মকথা। মূলত বাংলা ভাষা কোনো সুনির্দিষ্ট কালে জন্মলাভ করে নি। বিভিন্ন ভাষার বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে রূপলাভ করেছে বাংলায়। মূল আলোচনা ব্যতিরেকে বাংলা ভাষার জন্মকথা নিয়ে আলোচনা গৌণ হয়ে যায় বলে, সংক্ষিপ্ত পরিসরে বাংলা ভাষার আদিরূপ ও ক্রমবিকাশ তুলে ধরছি-

হিন্দ-ইয়ুরোপায়ণ (৫০০০-৩৫০০ পূঃ খ্রীঃ অঃ)- য়ূস্‌ এক্ব্যোম স্পেক্যিএথে।
শতম (৩৫০০-২৫০০ পূঃ খ্রীঃ অঃ)- য়ূস্‌ এশ্বোম্‌ স্পেশিএথে।
আর্য (২৫০০-১৫০০ পূঃ খ্রীঃ অঃ)- য়ূস অশ্বম্‌ স্পশ্যাথ।
প্রাচীন ভারতীয় আর্য (১৫০০-১০০০ পূঃ খ্রীঃ অঃ)- য়ূয়ম অশ্বম্‌ স্পশ্যাথ।
প্রাচীন ভারতীয় আর্য কথ্য বা আদিম প্রাকৃত (১০০০-৮০০ পূঃ খ্রীঃ অঃ)- তুষ্মে ঘোটকং দৃক্ষথ। [সংস্কৃত – য়ূয়ংম (ঘোটকং) পশ্যথ]
প্রাচীন প্রাচ্য প্রাকৃত (৮০০ পূঃ খ্রীঃ অঃ – ২০০ খ্রীঃ অঃ )- তুম্‌হে ঘোটকং দেক্‌খথ। [পালি – তুমহে ঘোটকং দেক্‌খখ।]
গৌড়ি প্রাকৃত (২০০- ৪৫০ খ্রীঃ অঃ)- তুম্‌হে ঘোড়াঅং দেক্‌খহ।
গৌড় অপভ্রংশ (৪৫০- ৬৫০ খ্রীঃ অঃ)- তুম্‌হে ঘোড়অ দেক্‌খহ।
প্রাচীন যুগ (৬৫০- ১২০০ খ্রীঃ অঃ)- তুম্‌হে ঘোড়া দেখহ।
সন্ধিযুগ (১২০০-১৩৫০ খ্রীঃ অঃ)- তুম্‌হি ঘোড়া দেখহ।
মধ্য যুগ (১৩৫০- ১৮০০ খ্রীঃ অঃ)- তুম্‌হি/ তোম্‌হে ঘোড়া দেখহ।
আধুনিক যুগ (১৮০০- বর্তমান) – তুমি ঘোড়া দেখ।
বর্তমান যুগ (১৮৬০- বর্তমান)- তুমি ঘোড়া দ্যাখো।

এ থেকে স্পষ্ট হয়, হিন্দ-ইয়ুরোপায়ণ (ইন্দো-ইউরোপীয়) হল বাংলার আদি ভাষা বংশ। কিন্তু প্রশ্ন হল- ভাষা, তথা ধ্বনির উৎপত্তি হল কিভাবে ? ভাষাবিদরা বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করছেন ভাষা সৃষ্টির রহস্য, এবং উদ্ঘাটন করেছেন নানা তত্ত্ব-তথ্য। উনবিংশ শতাব্দীতে মনে করা হত- প্রাকৃতিক ধ্বনি থেকে ভাষা সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু এর যথার্থ কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। এবং এ থেকে যে তত্ত্বগুলো তৈরি করা হয়েছিল, তাও ছিল মনগড়া এবং যথার্থই হাস্যকর। যেমনঃ- কুকুরের আওয়াজ থেকে ধ্বনি তৈরি হয়েছে বলে তৈরি হয় ‘ভৌ-ভৌ তত্ত্ব’, মানুষের আবেগ অনুসৃত ‘পুঃ পুঃ তত্ত্ব’, বস্তু থেকে পাওয়া অওয়াজের জন্য ‘ডিঙ-ডঙ তত্ত্ব’ ইত্যাদি ! এসব তত্ত্ব থেকে ভাষা সৃষ্টির সঠিক তথ্য পাওয়া না গেলেও, এগুলো ভাষা সৃষ্টির আদিরূপের সন্ধান দেয়। বিংশশতাব্দীর শ্রেষ্ঠ ভাষাবিদ Noam Chomsky এ সম্পর্কে মত প্রকাশ করেন- “ভাষা কোনো যান্ত্রিক প্রক্রিয়া নয়। ভাষা মানুষের সৃজনী চেতনার সঙ্গে যুক্ত।” এছাড়া শরীরবিজ্ঞানের সাথে যোগসূত্র রেখে, চমস্কির অনুগামী এরিক লেনেবার্গ আরো গুরুত্বপূর্ণ মত প্রকাশ করেন-“প্রাণিজগতের বিবর্তনের মধ্যে এমন একটা মৌলিক জীবকোষগত রূপান্তর (জেনেটিক মিউটেশন) ঘটে যায়, যার ফলে মানুষ একদিন হোমো সাপিয়েন্‌স অর্থাৎ মননশীল প্রাণী হয়ে ওঠে।” এথেকে বোঝা যায় যে, আমরা যে ভাষায় কথা বলি তা আমাদের মাধ্যমেই তৈরি হয় এবং নতুন-নতুন পরিস্থিতিতে বা প্রয়োজনে আমরা ভাষার ঐ মূলনীতিগুলো ব্যবহার কোরে মনের ভাব প্রকাশের জন্য বাক্য গঠন করি। একজন মানুষ তার জীবনে যতগুলো বাক্য ব্যবহার করে, তা কোনো অতীতে তাকে মুখস্ত করিয়ে দেওয়া হয় না। বস্তুত মানুষ নিজের ইচ্ছামত ভাষাকে ব্যবহার করে। প্রাচীন বাংলা সাহিত্য আলোচনা পূর্বক ভাষার উৎপত্তি ও বাংলা ভাষার ক্রমবিকাশ সম্পর্কে জ্ঞাত হওয়া প্রয়োজন এজন্য যে- ভাষাই সাহিত্যের সৃষ্টি ও স্থির নিদান।

চর্যাপদ

বাংলা সাহিত্যের প্রথম নিদর্শন ‘চর্যাগীতিকোষ।’ এছাড়াও নাথগীতিকার উদ্ভব ঐ সময়েই হয়েছিল। কিন্তু ‘নাথগীতিকা’ নামক কোনো পুস্তক পাওয়া যায় নি। ‘চর্যাগিতিকোষ’ নাম থেকেই বোঝা যায়, এটি আদিযুগের বাঙলা ভাষায় লেখা কয়েকজন কবির ‘গীতবিতান।’

‘চর্যাগীতিকোষ’ বা ‘চর্যাপদ’ আবিষ্কারের পূর্বে সাহিত্যের ইতিহাস লেখকেরা মনে করতেন, ময়না-মতীর গান, গোরক্ষবিজয়, শূণ্যপুরাণ, ডাক ও খনার বচন, রূপকথা ইত্যাদি প্রাচীনতম বাংলা সাহিত্যের দৃষ্টান্ত। কিন্তু ১৯০৭ সালে এই ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়। প্রাচীন যুগে বৌদ্ধ তান্ত্রিক মতাবলম্বী সহজিয়া সিদ্ধাচার্যগণ বাংলা ভাষায় কিছু লিখেছেন কি-না, তা নিরূপন করার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ও সংস্কৃত বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী (১৮৫৩-১৯৩১) নেপালে গমন করেন। লেপাল রাজদরবারে ‘নেপাল রয়্যাল লাইব্রেরি’ থেকে তিনি ১৯০৭ সালে প্রাচীন সংস্কৃত পুঁথির সাথে বাংলা ভাষায় লেখা ‘চর্যাচর্যবিনিশ্চয়ে’র পুঁথি আবিষ্কার করেন।

চর্যাপদ যে সময় লিখিত

চর্যাপদের রচনাকাল নিয়ে ভাষাবিদদের মধ্যে মতবিরোধ আছে। ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্‌ মনে করেন- ৬৫০ খ্রীঃ বাংলা সাহিত্যের আরম্ভকাল। এছাড়া ফরাসী পণ্ডিত সিলভ্যাঁ লেভির (Sylvain Levi) তাঁর Le Nepal ( Vol. I.P 347) গ্রন্থে বলেছেন- “মৎসেন্দ্রনাথ (নাথপন্থার আদি গুরু) ৬৫৭ খ্রীষ্টাব্দে রাজা নরেন্দ্র দেবের রাজত্বকালে নেপালে গমন করেন”। ফলে এটা ধারণা করা

অস্বাভাবিক নয় যে, ৬৫০ খ্রীঃ এর দিকেই বাংলা সাহিত্যের জন্ম। কিন্তু আরেকজন প্রখ্যাত ভাষাবিদ ডক্টর সুনীতিকুমার চট্টপাধ্যায় তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ The Origin and Development of the Bengali language (Vol I.P 122)-এ উল্লেখ করেন, “মীননাথের শিষ্য গোরাক্ষনাথের সময় খ্রীঃ ১২শ শতকের শেষে।” ফলে মীননাথ দ্বাদশ শতকের লোক। এজন্য তিনি প্রাচীনতম বাংলা রচনার কাল ৯৫০ খ্রীঃ অঃ বলে নির্দেশ করেন। এবং সুকুমার সেন সহ বাংলা সাহিত্যের প্রায় সব পণ্ডিতই সুনীতিকুমারকে সমর্থন করেন।

চর্যাপদের ভাষা

চর্যাপদের ভাষা মূলত বাংলা। খ্রীঃ দশম শতাব্দীর দিকে বা তার সামান্য পূর্বে, যখন মাগধী অপভ্রংশ সামান্য বিবর্তিত হয়ে বাংলা ভাষায় রূপলাভ করে, সেই অপরিণত ভাষায় সিদ্ধাচার্যগণ চর্যাপদগুলি রচনা করেন। এ ভাষার মূল বুনিয়াদ মাগধী অপভ্রংশ থেকে জাত প্রাচীনতম বাংলা ভাষার উপর প্রতিষ্ঠিত। তাই এর বেশিরভাগ শব্দই মাগধী অপভ্রংশজাত। এবং একে সাধারণভাবে বাংলা ভাষা বলা হয়ে থাকে। কিন্তু হিন্দি, ওড়িয়া, মৈথিল, অসমীয়া ভাষাও এর দাবীদার। ডক্টর সুকুমার সেন, অধ্যাপক প্রিয়রঞ্জন সেন, বিজয়চন্দ্র মজুমদার প্রমুখ বাঙালি বিদ্বানেরাও এ মত অসত্য বলে স্বীকার করেন নি। তবে চর্যাপদের ভাষা ছিল বড় জটিল রহস্যময়। কিছুটা বোঝা গেলেও বাকিটুকু থেকে যেত অসচ্ছ। চর্যাপদের আবিষ্কারক হরপ্রসাদ শাস্ত্রী এজন্য চর্যাপদের ভাষাকে ‘সান্ধ্যভাষা’ উল্লেখে মন্তব্য করেছেন- “সন্ধ্যাভাষার মানে আলো-আঁধারি ভাষা, কতক আলো কতক অন্ধকার, খানিক বুঝা যায় কতক বুঝা যায় না”। অবশ্য কবিদের এ ভাষা ব্যবহারের মূলে একটি কারণ ছিল। তা হল- চর্যাপদের কবিরা ছিলেন সহজিয়া বৌদ্ধধর্মে বিশ্বাসী। ফলে অন্য সম্প্রদায়ের প্রতিকূল ব্যক্তি বা গোঁড়া ব্রাহ্মণ-সম্প্রদায় যাঁরা সহজিয়া বৌদ্ধদের প্রতি প্রসন্ন ছিলেন না, তাঁদের দৃষ্টি থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য কবিগণ এই আলোআঁধার-মেঘরোদজড়ানো রূপক ভাষা ব্যবহার করেন।

চর্যাপদের কবিতা ও কবির সংখ্যা

চর্যাপদ সাহিত্য সৃষ্টির জন্য লিখিত হয় নি। মূলত বৌদ্ধ সহজযানপন্থী সহজিয়াগণ তাদের ধর্ম প্রচারের জন্য গান হিশেবে এই পদগুলি রচনা করেছিল। বৌদ্ধধর্মের পাশাপাশি ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র, যোগ ও নাথধর্মের প্রভাবও লক্ষ্য করা যায় চর্যাপদ সৃষ্টির পিছনে। প্রতীক, রূপক ও চিত্রকল্পের ব্যবহারে বৌদ্ধ সহজযান ধর্ম, সাধনপ্রণালী, দর্শনতত্ত্ব ও নির্বাণলাভ সম্পর্কে পদ রচনা করেছেন কবিগণ। এছাড়া বাংলা, মিথিলা, উড়িষ্যা, কামরূপের সাধারণ জনগণের প্রতিদিনের ধূলি-মলিন জীবনচিত্র, সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না ইত্যাদি বাঙালি আবেগ বিভিন্ন কল্পনাময় রেখাচিত্রের মাধ্যমে কবিতায় জীবন্ত হয়ে উঠেছে।

চর্যাপদের কবিগণের নাম উল্লেখ পূর্বক চর্যায় কবিতা কয়টি ছিল তা নিয়ে মতভেদটি বর্ণনা করা যেতে পারে। চর্যাপদের মোট গানের সংখ্যা সুকুমার সেনের মতে ৫১ টি। সুকুমার সেন তাঁর ‘চর্যাগীতি পদাবলী (১৯৫৬)’ গ্রন্থে প্রথমত ৫০ টি কবিতার কথা উল্লেখ করলেও সংযোজন করেছেন যে- “মুনি দত্ত পঞ্চাশটি চর্যার ব্যাখ্যা করিয়াছিলেন। টীকাকারের কাছে মূল চর্যার পুঁথিতে আরো অন্তত একটি বেশি চর্যা ছিল (একাদশ ও দ্বাদশ চর্যার মাধ্যখানে)। এই চর্যাটির ব্যাখ্যা না থাকায় লিপিকর উদ্ধৃত করেন নাই, শুধু ‘টিকা নাই’ এই মন্তব্যটুকু করিয়াছেন।” উল্লেখ্য যে, মুনিদত্ত ছিলেন সংস্কৃত টীকাকার। বৌদ্ধতন্ত্রে তিনি অভিজ্ঞ ছিলেন বলে চর্যাপদের ব্যাখ্যা হিশেবে ওই সংস্কৃত টীকার প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করা একান্ত আবশ্যক। সত্য বলতে, মুনিদত্তের সংস্কৃত টীকা এবং ডঃ প্রবোধচন্দ্র বাগচী কর্তৃক আবিষ্কৃত চর্যাপদের তিব্বতী অনুবাদের কারণেই আমরা চর্যার আক্ষরিক অর্থ ও গূঢ়ার্থ অনেকটা সহজে ব্যাখ্যা করতে পারি। অন্যদিকে ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্‌র মতে, চর্যায় গানের সংখ্যা ৫০ টি। আসলে চর্যাপদ ছিন্নাবস্থায় পাওয়া যায় বলে এই মতান্তরের সৃষ্টি হয়েছে।

চর্যাপদে কবি সংখ্যা নিয়েও মতভেদ আছে। ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্‌ তাঁর ‘Buddhist Mystic Songs’ গ্রন্থে ২৩ জন কবির কথা উল্লেখ করেছেন। অন্যদিকে সুকুমার সেন ‘বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস (১ম খণ্ড)’ গ্রন্থে ২৪ জন কবির কথা উল্লেখ করেছেন। বিশিষ্ট পণ্ডিত রাহুল সাংকৃত্যায়ন নেপাল-তিব্বতে প্রাপ্ত তালপাতার পুঁথিতে আরো করেকজন নতুন কবির চর্যাগীতি পেয়ে ‘দোহা-কোশ (১৯৫৭)’ গ্রন্থে সংযোজন করেছেন। ফলে এককথায় বলা যায়, চর্যাপদের মোট কবির সংখ্যা ২৩, মতান্তরে ২৪ জন।

চর্যাপদ কবিদের সংক্ষিপ্ত জীবনী ও পদ

চর্যাপদ কবিদের জীবনী যা জানা যায়, তা শুধুমাত্র তিব্বতী বিভিন্ন গ্রন্থাবলী থেকে। পূর্ব ও পশ্চিম বাংলার ভাষা বিজ্ঞানী ও ইতিহাস গবেষকরা তিব্বতী বইগুলোর জার্মান অনুবাদ থেকে চর্যাপদ গীতিকারদের জীবনী খুঁজে পেয়েছেন। যেসব তিব্বতী বইগুলোতে তাঁদের জীবনী রয়েছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল- Geschichte des Buddhismus in Indien, Edelsteinmine, Die Geschichten des Vierundachtzig Zauberer (Mahasiddhas), Buddhist Philosophy in India and Ceylon, History of Buddhism in India and Tibet, Catalogue du Fonds Tibetain ইত্যাদি। এসব গ্রন্থে সংক্ষিপ্ত ও বিস্তৃত, দু’ভাবেই বৌদ্ধ সহজিয়াদের জীবন কাহিনী তুলে ধরা হয়েছে।

চর্যাপদ কবিদেরকে দু’ভাবে লিপিবদ্ধ করা যায়। প্রথমত, গুরু পরম্পরার ভিত্তিতে; দ্বিতীয়ত, চর্যাপদ গীতিকায় তাদের পদের অবস্থান নির্ণয়ের মাধ্যমে। প্রথমভাগের ব্যাখ্যা জটিলতর। কেননা বিভিন্ন ভাষা-ইতিহাসবিদদের বিভিন্ন মত রয়েছে এই গুরু পরম্পরা নিয়ে। ফলে নিম্নে চর্যাপদ গীতিকায় কবিদের লিখিত পদের অবস্থান অনুযায়ী ক্রমানুসারে চিহ্নিত করা হল-

১. লুইপা-১/২৯

লুইপা বৌদ্ধসিদ্ধাচার্য ও চর্যাপদের প্রবীণ কবি, এই মত প্রকাশ করেছেন অনেক পণ্ডিত ব্যক্তি। কিন্তু মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্‌র মতে, লুইপা ছিলেন শবরপার শিষ্য। তাই তিনি প্রথম কবি হতে পারেন না। তাঁর মতে লুইপা ৭৩০ থেকে ৮১০ খ্রীঃ মধ্যে জীবিত ছিলেন। লুইপা বাংলাদেশের লোক ছিলেন। তবে এ নিয়ে মতভেদ আছে। ‘ব্‌স্তন্‌-গু্যরে শ্রীভগবদভিসময়’ নামক একটি তিব্বতী পুস্তকে তাকে বাংলাদেশের লোক বলা হয়েছে। আবার, তিব্বতী ঐতিহাসিক লামা তারনাথের মতে লুইপা পশ্চিমবঙ্গের গঙ্গার ধারে বাস করতেন। হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতে, তিনি রাঢ় অঞ্চলের লোক। এবং শ্রীযুক্ত রাহুল সাংকৃত্যায়ন তাঁর এক্তি হিন্দী অভিভাষণে বলেছেন – “লূয়িপা মহারাজ ধর্মাপালকে কায়েস্থ বা লেখক থে।” লুইপা রচিত পদ দুটি- ১ ও ২৯ নং। তার রচিত সংস্কৃতগ্রস্থগুলোর মধ্যে পাওয়া যায়- অভিসময় বিভঙ্গ, বজ্রস্তত্ত্ব সাধন, বুদ্ধোদয়, ভগবদাভসার, তত্ত্ব সভাব। লুইপার প্রথম পদটির দু’টি উল্লেখযোগ্য চরণ-

“কাআ তরুবর পাঞ্চ বি ডাল।
চঞ্চল চীএ পৈঠা কাল ।।”
আধুনিক বাংলায়ঃ “দেহ গাছের মত, এর পাঁচটি ডাল/ চঞ্চল মনে কাল প্রবেশ করে।”

২. কুক্কুরীপা > পদ নং- ২/২০/৪৮

চর্যাপদের দ্বিতীয় পদটি কুক্কুরীপা রচিত। মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্‌ ব্যতীত অন্য অনেকে মনে করেন তিনি তিব্বতের কাছাকাছি কোনো অঞ্চলের বাসিন্দা ছিলেন। নিশ্চিতভাবে বললে কপিলসক্র। মুহঃ শহীদুল্লাহ্‌ মনে করেন, কুক্কুরীপা বাঙ্গালা দেশের লোক। তার জন্মকাল নিয়ে দ্বিধামত নেই। খ্রিষ্টীয় অষ্টম শতকে তার জন্ম। কুক্কুরীপার নাম নিয়ে অনেকে মত প্রকাশ করেছেন। ড. সুকুমার সেন সন্দেহ প্রকাশ করেছেন যে, কুক্কুরীপার ভাষার সাথে নাড়িদের ভাষাগত মিল আছে। তাই তিনি নারীও হতে পারেন। আবার তার সহচারী যোগিনী পূর্বজন্মে লুম্বিনী বলে কুক্কুরী ছিলেন বলে, তার এই নাম হয়েছে; এমতও পোষণ করেন অনেক ঐতিহাসিক। চর্যাপদে কুক্কুরীপার তিনটি বৌদ্ধগান ছিল। কিন্তু একটি অপ্রাপ্ত। ২ ও ২০ নং তার লিখিত পদ। এবং চর্যাপদে খুঁজে না পাওয়া ৪৮ নং পদটিও তার রচিত বলে ধরা হয়। কুক্কুরীপার পদযুগল ছিল গ্রাম্য ও ইতর ভাষার। কুক্কুরীপার দ্বিতীয় পদটির দু’টি উল্লেখযোগ্য চরণ-
“দিবসহি বহূড়ি কাউহি ডর ভাই।
রাতি ভইলে কামরু জাই ।।”
আধুনিক বাংলাঃ “দিনে বউটি কাকের ভয়ে ভীত হয় / (কিন্তু) রাত হলেই সে কামরূপ যায় ।”

৩. বিরুপা > পদ নং- ৩

বিরুপা বা সংস্কৃতে বিরুপ পাদ রচনা করেছিলেন চর্যাপদের তৃতীয় পদটি। বিরুপার জন্মস্থান নিয়ে মতভেদ নেই। তিনি রাজা দেবপালের রাজ্য ত্রিপুরায় জন্মেছিলেন। তবে তার জন্মসন নিয়ে সন্দেহ আছে। মনে করা হয় অষ্টম শতকে তার জন্ম। কিন্তু মুহঃ শহীদুল্লাহ্‌র মতে বিরুপা নামে দু’জন ব্যক্তি ছিলেন। একজন জয়দেব পণ্ডিতের শিষ্য, যিনি সপ্তম শতাব্দীর লোক। আর অন্য জন জালন্ধরীপার শিষ্য। ইনি বাংলার লোক। কিন্তু চর্যাপদের বিরুপার প্রকৃত গুরু ছিলেন জলন্ধরীপাদ। ফলে এখানে হেঁয়ালি রয়েছে। বিরুপা অন্যান্য কবিগণের তুলনায় সামান্য পৃথক ছিলেন। তিনি বিভিন্ন অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী ছিলন বলে জানা যায়। যেমন- তিনি মদ্যমাংসভোজনের অপরাধে বিহার থেকে বিতাড়িত হয়ে এক আশ্চর্য ক্ষমতা বলে গঙ্গা পার হয়ে উড়িষ্যার কনসতি নগরে আসেন। এবং এখানেও নানা বুজরুকি দেখান। বিরুপার ৩য় পদটি ছিল ‘শুঁড়িবাড়ি’ নিয়ে লিখিত। পদটির দুটি চরণ-
“এক সে সুণ্ডিনী দুই ঘরে সান্ধই
চীঅণ বাকলত বারুণী বান্ধই ।।”
আধুনিক বাংলায়ঃ “এক সে শুঁড়িনী দুই ঘরে সান্ধায় / চিকন বাকলেতে মদ বাঁধে।”

৪. গুণ্ডরীপা > পদ নং- ৪

গুণ্ডরীপা চর্যাপদের চতুর্থ পদটি রচনা করেন। তার নাম নিয়ে মতভেদ আছে। কার্দিয়ার ক্যাটালগে তার এই নাম পাওয়া যায়। অনেকে মনে করেন গুণ্ডরীপা তার বৃতি বা জাতিবাচক নাম। যেমন- এ যুগের কর্মকার বা সরকার। প্রথমত তিনি বাংলার পশ্চিমাঞ্চলের কবি বলে জ্ঞাত হলেও, অনেকে মনে করেন তিনি বিহারের লোক। রাজা দেবপালের রাজত্বকালে (৮০৯-৮৪১) সময়ের মধ্যে তিনি বর্তমান ছিলেন বলে অনুমান করা হয়। তার চার নং পদের দু’টি চরণ-
“জোইনি তইঁ বিনু খনহিঁ ন জীবমি।
তো মুহ চুম্বী কমল রস পিব্‌মি ।।”
আধুনিক বাংলাঃ “রে যোগিনী, তুই বিনা ক্ষণকাল বাঁচি না / তোর মুখ চুমিয়া কমল রস পান করি।”

৫. চাটিল্লপা > পদ নং- ৫

চাটিল্লপা সম্পর্কে বেশি তথ্য পাওয়া যায় না। অনেকে মনে করেন, পাঁচ নং পদটি তার শিষ্যের রচিত। জ্যোতিরীশ্বর ঠাকুরের বর্ণ-রত্নাকরে চাটিল্লের নাম লিপিকর প্রমাদে চাটল রয়েছে। তিনি ৮৫০ খ্রিষ্টাব্দের কাছে দক্ষিণবঙ্গের অধিবাসী হিশেবে জীবিত ছিলেন বলে ধারণা করা হয়। তার পদে নদীমাতৃক অঞ্চলের প্রাধান্য লক্ষ্য করা যায়। যেমনঃ নদী, সাঁকো, কাদা, জলের বেগ, গাছ, খনন করা ইত্যাদি। সহজ সাধনভজন তত্ত্বকথা এসবের আলোকেই ব্যাখ্যা করেছেন তিনি।

৬. ভুসুকুপা > পদ নং- ৬/২১/২৩/২৭/৩০/৪১/৪৩/৪৯

পঞ্চাশটি চর্যা-পদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা অধিক রচনা করেন কাহ্নপা। এবং তার পরেই ভুসুকুপার স্থান। তিনি মোট আটটি পদ রচনা করেন। তার নাম নিয়ে কিছুটা মতভেদ আছে। মনে করা হয়, তার আসল নাম শান্তিদেব। সুম্‌পা ম্‌খন্‌-পো (১৭৪৭ খ্রীঃ অঃ) তার দ্‌পদ্‌-ব্‌-সম-লজোন্‌-বজন্‌ বইয়ে ভুসুকু সম্পর্কে বলেছেন- “ভুসুকু অষ্টম থেকে এগার শতকের মধ্যে সৌরাষ্ট্রের রাজা কল্যাণবর্মার পুত্র ছিলেন। তার পিতৃপ্রদত্ত নাম শান্তিবর্মা ছিল।” এজন্য তাকে শান্তিদেব নামেও ডাকা হয়। বৌদ্ধাচার্য জয়দেব ভুসুকুকে শিক্ষাসমুচ্চয়, সূত্রসমুচ্চয় ও বোধিচর্যাবতার নামক তিনটি বই দেন। ভুসুকু নিজের আবাসে একমনে লেখাপড়া করতেন বলে অন্য ভিক্ষুরা তাকে অলস মনে করত। এজন্য তারা তাকে উপহাস কোরে ভুসুকু নামে ডাকত। যেখানে, ভু অর্থ ভুক্তি (ভোজন), সু অর্থ সুপ্ত (শয়ন/নিদ্রা), কু অর্থ কুটির ! ভুসুকুপা বাঙালি ছিলেন। অনুমান করা হয় তিনি পূর্ব বাংলা কবি। তার পদে বাংলার বিভিন্ন চিত্র উজ্জ্বলভাবে ফুঁটে উঠেছে। তার ৪৯ চর্যাটির চারখানা চরণ হল-
“বাজনাব পাড়ী পঁউআ খাঁলে বাহিউ
অদব বঙ্গাল দেশ লুড়িউ ।।
আজি ভুসুকু বাঙ্গালী ভইলী,
নিঅ ঘরিণী চণ্ডালেঁ লেলী ।।”
আধুনিক বাংলায়ঃ “ বজ্ররূপ নৌকায় পাড়ি দিয়া পদ্মার খালে বাহিলাম। / অদ্বয়রূপ বাঙ্গালা দেশ লুঠ করিলাম। / হে ভুসুকু, আজি বাঙ্গালিনী জন্মিলেন। / চণ্ডালে (তোমার) নিজ গৃহিনীকে লইয়া গেল”।
[ বাকি অংশ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হবে। ]

তথ্যসূত্রঃ

১. বাংলা সাহিত্যের কথা – মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্‌

২. বঙ্গভাষা ও সাহিত্য- দীনেশচন্দ্র সেন

৩. বৌদ্ধ ধর্ম ও সাহিত্য- প্রবোধচন্দ্র বাগচী

৪. প্রাচীন বাঙলা সাহিত্যের কালক্রম- সুখময় মুখোপাধ্যায়

৫. বাংলা সাহিত্যের সম্পূর্ণ ইতিবৃত- ড. অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়

৬. কতো নদী সরোবর- হুমায়ুন আজাদ

৭. সাহিত্য ও সংস্কৃতি চিন্তা- আহমদ শরীফ

৮. লাল নীল দীপাবলি- হুমায়ুন আজাদ

৯. বাংলা ভাষা ও সাহিত্য জিজ্ঞাসা- সৌমিত্র শেখর

১০. ভাষার ইতিবৃত- সুকুমার সেন

১১. The Origin and Development of the Bengali language- C. Suniti Kumar

১২. ভাষা-শিক্ষা – হায়াৎ মামুদ