নূরনগর জামে মসজিদের পুব পাশে দীঘির মত বড় পুকুর। সেই পুকুরের দক্ষিন পাড়ের মূল রাস্তাটার একেবারে কোল ঘেষে রহিমুদ্দী সেখের বিশাল বেত বাগান। এক সময় সেটা অরুন জঙ্গল ছিল। এখন জংলা বেশ পাতলা হয়ে এসেছে অবহেলা আর মানুষের অত্যাচারে। জংলাটার কাছে পিঠে তেমন মনুষ্য বসতি না থাকলেও এক চিলতে বাস্তু ভিটে চোখে পড়ে। ভিটেটা হাবু গায়েনের। হাবুরা জাত গায়েন- বাপ দাদা চৌদ্দ পুরুষ গানের ফেরিওলা। হাবু গায়েন বেচে নেই- গত হয়েছে দেড় যুগ আগে। আটকুড়া গায়েন কোন সন্তানও রেখে যেতে পারেনি, তাই ঐ ভিটেয় এখন বাস হাবু গায়েনের বিধবা নেকজানের। এই গ্রাম আর তার আশ-পাশে যত দূর লোকে তাকে চেনে সবার কাছে সে এখন ব্যতালে পাগলী- বেত বনের কাছে থাকায় এই নাম। নেকজান নাম তার ঢাকা পড়ে গেছে বেত গাছের শুকনো পাতা, কাটা আর ছিলার তলায়।

পৃথিবীর সাতটা আশ্চর্য্য জিনিস পাশাপাশি সাজায়ে রাখলে তার ভেতরে একটা হবে নিশ্চিত এই গ্রাম- এই নেকজান পাগলীর গ্রাম। এর নাতিদীর্ঘ দেহটা আর সেই দেহের ভেতরে বাস করা মানুষগুলোর চেহারা-চরিত সে কথা বলে দেয়। বেশ কিছু ব্যবধানে দুই পাশে দুই ছোট ছোট শহর, আর তাদের মাঝখানে বড় পেট ফোলা এই গ্রামটা। একটা বড় বাজপাখীর ধড় যেন গ্রামটা আর তার ডানা দুটো দুই পাশের দুই শহর। এই গ্রামে সব আছে- শুধু নেই ইস্কুল আর বিজলী বাতি। এ গাঁয়ের লোকগুলোর ওসবে কোন দরকারও নেই। কি নেই এখানে- নতুন মদজিদ আছে, পুরোন মন্দির আছে, দীনের শিক্ষার জন্যে গোটা দুই মক্তব-মাদ্রাসাও আছে, স্মশান-গোরস্থান সব আছে। ক্ষেত-খামার, তাও আছে- তবে বড় খামার মালিকগুলো কি জানি কোন ভাগ্যবান বাতাসের চাপে পড়ে বাজপাখীর দুই ডানার দিকে আস্তে আস্তে সরে গেছে। বাজপাখীর বড় পেটের মতো এই গাঁয়ের ভেতরে ফেলে রেখে গেছে ঈশ্বরের ছেলে-পুলেদের। দুই শহরকে যোগ করেছে যে পাকা রাস্তাটা, তাও এই গাঁয়ে ঢুকতে যেয়েও ঢোকেনি, লজ্জা পেয়ে পেছন দিয়ে চলে গেছে। তাই ভাগ্যের জাতা ঘোরানো এ গ্রামের মানুষগুলো সত্যি সত্যি জানে না তাদের কি লাগবে আর লাগবে না, তাদের কি আছে আর কি নেই। তাই তারা নিজেদের কারনে ঝগড়াও করেনা, ফ্যসাদও করে না। তবে অন্যের কারনে, অন্যের হয়ে করে দেয়, করে দেয় সব- উকুন বাছা থেকে খুন জখম। কারন এ গাঁয়ের মানুষেরা মনে প্রানে সেবক- সত্যিকারের সেবক।

হরেক কিছিমের সেবকের ভীড়ে এই গাঁয়ের ব্যতালে পাগলীও একজন। তবে সে একটুখানি অন্য রকমও। এই অন্য রকম হবার জন্যেইতো লোকে তাকে পাগলী বলে। আপন মনে কথা কয় সে, হাসে আবার কাঁদে। পাগলামী কি একটু আধটু- পুরা শরীরে তার পাগলামী। নিজে খেতে পায় না, ঘর ভরা তার বাচ্চা- মানুষের বাচ্চা, সত্যিকারের ঈশ্বরের সন্তান, যাদের মালিকানা দাবী করে না কেউ, পাগলী ছাড়া। স্বামী মারা যাবার পর এই পাগলামী রোগ তারে চেপে ধরেছে। রাস্তা ঘাটে মাঠে কত লোক হাটে, কারো কানে যায় না সদ্য ফোটা গ্যাদা বাচ্চার কান্না- নেকজানের কানে সে আওয়াজ ঠিক ঠিক কড়া নাড়ে। গ্রাম-শহরের আদা-বাদা, নর্দমা, ভাগাড় ঘেটে পেয়ে যায় সে সোনার চানদের। এমনি করে করে সাত সন্তানের মা হয়েছে নেকজান পাগলী। সন্তান ভাগ্য বটে তার! মানুষের বাচ্চাগুলো যেন তার সাত রাজার ধন লক্ষ মানিক- জান-পরান দিয়ে আগলে রাখে সবগুলো। সোয়ামী থাকতে খেয়ে পরে মোটের উপর সুখেই ছিল সে। গায়েন গত হবার পর তাকে নামতে হয় কাজে- জীবনের আসল যুদ্ধে। আগে শরীরে তাকদ ছিল- একটু পা বাড়িয়ে শহরে গিয়ে সাহেবদের বাসায় দুয়েকটা ফাইফরমাশ খাটলে তার সোনার চানগুলোর মুখের গ্রাস মিলত। মাঝে মাঝে মিলত কাঁচা পয়সাও। এখন আর তার দেহে সেই ক্ষমতা নেই, তাই ভিক্ষে করতে হয় চেনা অচেনা সবার বাড়িতে। তবে রাস্তায় রাস্তায় ভিক্ষে করতে কোথায় যেন ইজ্জতে লাগে তার। বাচ্চাগুলো তার কলজের বোটা। ওদের জন্যে সে ভিক্ষের চেয়ে অসাধ্য কোন কাজ থাকলে তাও করতে রাজী।

নিজের ঘরে বাচ্চাগুলো নিয়ে তার আদিখ্যেতার যেন শেষ নেই। আদরের উপরে আছে অতিআদর- আর সেসব দেখার জন্যে কেউ কেউ আবার আড়িও পাতে ব্যতালে পাগলীর আতাবেড়ার ফাক ফোকরে। সেসব চার দিকে চাউর হবার পর ঘেন্না আর বিরক্তিতে মানুষের মুখে পিত্তি ওঠে। এইসব নোংরা অচ্ছুত কাজে আশপাশের কারোরই সায় নেই। সায় যেমন নেই তেমনি বিক্ষোভও আছে অনেকের মনে এসব নিয়ে। তবে তা আগুন হয়ে ওঠেনি এখনো, হয়তো নেকজান পাগলী বলে। পাগলীর লেবাসটা তাকে বালা মুছিবত থেকে দূরে রেখেছে অষ্ট-প্রহর। পাগলামী তার এখানেই শেষ নয়- আরো আছে। পাগলীর ভিটের এক কোনা আলো করে আছে হাবু গায়েনের কবর। সেই কবরের ব্যড়া ধরে সময় নেই অসময় নেই হাসে কাঁদে কথা বলে নেকজান- ষাট বছর পেরিয়ে যাওয়া নেকজান পাগলী। দুনিয়ার সব রাগ অনুরাগের কথা যেন তার ঐ কবরটাকে ঘিরে। সব কথা স্মরনে আছে তার, সব কথাই- মনে হয় এইতো সেদিন ঘটে গেছে সব। নেকজান বিবির স্বামী-ভাগ্য বটে- হাজারে একটা হয় এমন। দুনিয়ায় দুটো জিনিস তার গায়েনের অন্তরের ধন ছিল- এক হলো তার গান, আরেক হলো নেকজান। তারে নিয়ে কত গান যে বেঁধেছে হাবু গায়েন তার শুমার করে কে? সেই গান আবার দশের সামনে গাইতোও সে- বড়ই শরমের কথা।

গেরস্থদের ঘর থেকে নেকজান বুড়ীকে খালি হাতে ফিরতে হয় কচিৎ। কারন সে জানে কার কাছে গেলে পাওয়া যাবে আর কোথায় গেলে পাওয়া যাবে না। ভিক্ষে দেয়, অনেকেই তারে ভিক্ষে দেয় শুধু চেনা জানা হবার কারনে। এই যেমন আজ সকালে কিছু চাইতেই পেশকার গিন্নী নিজের থেকেই বললেন- ‘নেকজান বুয়া, গত রাতের দুধটা পড়ে আছে। আমার ছেলে-পুলেদের একটু প্যাট খারাপের মতন হইছিল, তাই কেউ খায়নি। একটু খানি উজায় উঠতে পারে। তুমি পুরাটাই নিয়ে যাও- ছেলে-মেয়েদের দিও’।
পেশকার গিন্নীরে অনেক আগে বলে রেখেছিল বুড়ী বর্ণ-পরিচয়ের দুয়েকটা পুরান বইটই যদি দিতে পারে। পোলা-মাইয়াদের পড়া-লেখা শেখাতে চায় নেকজান- এই খোয়াবখানা আছে তার মনে। অল্প যতটুক জানে সে তাই শেখাবে। আজ কি মনে করে দুধের সাথে পুরান বইখানাও দিলেন গিন্নী। পেশকার গিন্নীর শরীরে অনেক দয়া। হবে নাই বা কেন? কত বড় ঘরের মাইয়া! যে সে ব্যপার না, স্বামী তার জজসাহেবের পেশকার। একটা বড় মাটির হাড়ীতে পুরা দুধটা ভরে হাতে নিল বুড়ী। পোলা-মাইয়ারা কতদিন খালি শিন্নী শিন্নী করে চুপ মেরে গেছে। আজ বুড়ী ওদের শিন্নী খাওয়াতে পারবে মনের সাধ মিটায়ে। বুড়ীর সবচেয়ে বড় মাইয়াটা পড়েছে এবার বারোতে। ওর কাছে বাকীগুলোরে রেখে সেই সাত সকালে ভিক্ষে করতে বেরিয়েছে নেকজান। বাড়ী পৌছাতে আজ বোধ হয় দুপুর গড়িয়ে যাবে। শহরের রাস্তা ছেড়ে গ্রামের খোলা মেঠো পথ, তারপরে গাঁয়ের কাঁচা রাস্তা, যার দুই ধারে বাঁশ আর সেগুন ঝাড়ের সামিয়ানা। নিজের গাঁয়ের পথে এসে বুড়ীর গা জুড়ায়, প্রান জুড়ায়। দ্রুত পা চালায় নেকজান। মাইয়াটা একলা অতগুলিরে নিয়া কি করতিছে কে জানে- চকিতে একবার ভাবে বুড়ী। শহর থেকে নিজের গাঁ- তা প্রায় তিন ক্রোশ রাস্তাতো হবেই। নেকজান ক্লান্ত পথের ভারে। পথ চলতে চলতে কী যে হয় তার- শুধুই পুরান কথাগুলো চোখের সামনে নাচানাচি শুরু করে দেয়। তার গায়েনের কথা, দেড় যুগ আগের সেই জীবনের বৃত্তান্ত ঝড়ের মতো কোত্থেকে এসে বটগাছের শীতল ছায়ার স্পর্শ দিয়ে যায় মাথায় আর পথশ্রান্ত শরীরে। পথের দুপাশে ঝিঝি পোকাদের ধাতব কন্ঠের বিরামহীন ক্লান্তিহীন চিৎকার তার কানে যেন ভুলেও প্রবেশ করে না। সেখানে প্রবেশ এখন শুধুই হাবু গায়েনের বাঁধা গানের। কতগুলো গান যে বুড়ী তার মাথার ভেতরে ভরে রেখেছে তা সে নিজেই জানে না। হাটলেই মাথা তার কাজ করে ভাল- স্মরনে আসে রূপালী দিনের সব খুঁটিনাটি।

মাথায় উস্কো-খুস্কো ঝাকড়া সাদা চুল, পায়ের নীচে গ্রীস্ম-দগ্ধ পথ, হাতে দুধের হাড়ী, কোমরে ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে নেকজান বুড়ীর পা চলে খরগোশের পায়ের ব্যস্ততায়। ভুলে যায় বুড়ী তার ক্ষুদ্র পরিচয়, কারন মনে তার এখন এক ভয়ানক নেশা- এক অন্য রকম স্মৃতির নেশা। হটাৎ করে একটা কোলাহলের তীব্র ধাক্কায় নেকজান বিবির নেশা ছুটে যায়। শীতের দিনে খেজুর রসের হাড়ীতে যেমন মাছির ঝাক হামলে পড়ে গুঞ্জরনে, ঠিক তেমনি করে একপাল নানান বয়সী ‘হিজলদাগা’ ছেলে-মেয়ে ব্যতালে পাগলীকে দেখে হৈ হৈ করে উঠে উল্লাসে। খেলায় মাতে তারা। মুখে তাদের ছড়ার খই ফোটে।

পাগলী বুড়ীর সাতটা ছাও
জালাই মারে সারাটা গাও।
ক্যান বুড়ী তবে শুদো ভাত খাও-
ওরির একটা পুড়ায় ঝুড়ায় মাহাই খাও।
গায়ে যদি লাগে ক্ষিদের বাও,
জোরে জোরে বুড়ী পা চালাও।
পা চালাও, পা চালাও, পা চালাও।

ছড়া কাটা শুনে নেকজান বুড়ীর মাথায় রক্ত চড়ে যায়, কিন্তু চোখ পাঁকিয়ে তেড়ে যায় না- কারন এখন তার সময় নেই হাতে। তবে গলাটারে সপ্তমে চড়িয়ে তেতে উঠে- ‘লক্ষিছাড়া পোলাপান গুলা জ্বালাই মালো। এমন ছড়া কি মানষি কাটে? যাহ, যাহ দূর হ’।
বুড়ীর চিতকারে ছেলে-মেয়েদের উতসাহ বেড়ে যায় দ্বিগুন। কোথা থেকে সেখানে সহসা ইমাম হুজুরের আগমন ঘটে। পোলাপানগুলার চেচামেচিতে যেন বরফ পড়ে- হুজুররে দেখে সবগুলো দৌড়ে পালায়। নেকজান পড়ে মহা ফাপরে। কারন সে জানে এখন ইমাম হুজুর তারে কি বলবেন। এই একই কথা শুনতে শুনতে তার একেবারে মুখস্ত হয়ে গেছে। হুজুর ছোট্ট করে দুটো কাশি দেন- কিছু বলবার জন্যে গলাটারে পরিস্কার করে নেন তিনি।
-দেহ নেকজান বিবি, তুমারে আমি আর কি কবো। তুমি যে পাগল না, এই কতা কেউ না জানলিও আমি জানি। পেত্তেক দিন পাঁচবার আমার মসজিদি আসা লাগে, আসা লাগে তুমার বাড়ীর সামনে দিয়ে। ঐ সব নাজায়েজ ছেলে পুলেদের নাপাক শব্দ কানে আসে। শরীর মন তখন দুটোই নাপাক হয়। তুমারে আর আমি কত কবো? ওগের আমার কাছে দিয়ে দেও, আমি নিয়ে শহরে রাখে আসি। একটা না একটা পথতো হবি। কিন্তু তুমারে দিয়ে তা আজো হলো না। মানষিরি আমি আর আটকায়ে রাখতে পারতিছিনে। এহন কেউ যদি শালিস ডাকে, তাইলে আমারে দোষ দিতি পারবা না। তুমার সোয়ামী বেচারা গান-বাজনা করলিও তার একটা ধর্ম ছিল। তুমার তাও নেই।
এক নাগাড়ে কথাগুলো বলে শেষ করে ইমাম হুজুর। শরীরের সব বিরক্তি আর তিক্ততা মুখে জড়ো হয়ে নুরানী চেহারাটাকে বৈশাখের ঝড়ো আকাশের মতো কালো করে দিয়ে যায়। ওদিকে কাল বৈশাখীর মহা অশণি সংকেত শুনতে পায় যেন নেকজান হুজুরের মুখে। ঠিক সেই মুহুর্তে সাতটা অসহায় মুখ তার দৃষ্টতে ভেষে উঠে। এই দুঃসময়ে তার সাহস হারালে চলবে না। গায়েনের কথা স্মরন করে সে একবার। মরার আগে ধারাল একখান গাছিদাও তার হাতে দিয়ে বলেছিল গায়েন- ‘নেকজানরে, তোর লাগিতো কিছুই রাখে যাতি পারলাম না, তয় এই দাওখান রাখ। এইডা তোরে সাহস দেবে। দুনিয়াতে আল্লা ছাড়া আর কাউরে ডরাবি না। এই যে এক চিলতে জমি- এইটা তোর স্বামীর ভিটে, তোর শ্বশুরের ভিটে। এইডে তোর ইজ্জত। আরও একটা ইজ্জত তোর দেহখানা। তোর এই দুটো ইজ্জত যহন বিপদে পড়বে তহন এই দাও তোর কাজে লাগবে’।
এতদিন ধরে গায়েনের কথামত চলে এসেছে নেকজান বিবি- নিজের ইজ্জত দুটো পাহারা দিয়েছে সে। এখন বয়স হয়ছে। শরীরে সেই ক্ষমতাও কমে আসছে ধীরে ধীরে। ভয় এসে বাসা বাঁধতে শুরু করেছে দেহে মনে। তবে এখন সে উপরে এক আল্লারে ছাড়া দুনিয়ায় দুটো মানুষ কে ভয় পায়- এক হলো ইমাম হুজুর, আরেক জন এ গাঁয়েরই নেতা, সবার নিতাভাই। আর কাউরে ডরায় না নেকজান- কাউরে না।

মুখের সামনে দাড়িয়ে থাকা ইমাম হুজুরের কথাগুলো শুনে গায়ের লোম দাড়িয়ে যায় নেকজান বিবির। বিপদের গুরুত্ব বুঝতে পারে সে। এখন মাথা তার কাজ করছে দুনিয়াদার মানুষের মতো, স্বভাবিক লোকের মতো। দুধের হাড়িটারে মাটিতে রেখে আকস্মত ইমাম হুজুরের দুই পায়ে হুমড়ি খেয়ে হাউমাউ কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে পাগলী।
-দায়ের এক কোপে আমার কল্লাটারে নামায়ে দ্যান হুজুর, কিন্তু আমার বাছাদের কিছু কইরেন না। আমি পাপী, অরা না। যা করেন আমারে করেন।
ছেলের বয়সী এক আল্লার বান্দার পা ধরে এক বেকুপ বৃদ্ধার কান্দন দেখে কর্কশ ঝিঝি পোকারা মুখে হাত চাপা দেয়, থামিয়ে দেয় তাদের বেসুরো সংঙ্গীত। বাঁশ গাছের কচি পাতাগুলোও আরো বেশী নুয়ে পড়ে লজ্জাবতী লতার মতো। হুজুর বার কয়েক এদিক ওদিক তাকায় চকিতে- কেউ তারে দেখছে কিনা সেটা নিশ্চিত হয়ে নেয়।
-যাহ যাহ, বেশরম বুড়ী। দূর হ শয়তান।
এক ঝটকায় পা ছাড়িয়ে নেয় ইমাম হুজুর। মসজিদে তার নামাজ পড়াবার সময় পার হয়ে যাচ্ছে। সেদিকে পা চালায় সে। আর ওদিকে উজিয়ে যাওয়া দুধের হাড়ি হাতে বাড়ীর পথে চলতে চলতে ভাবে নেকজান- ‘ইমাম হুজুরের ক্ষ্যমতা অনেক। চক্ষের পলকে গায়ের লোকদের এক করে ফেলতে পারে সে। সে এ গায়ের কাজী। মাইয়ালোকের বিচার তার মতো আর কেউ পারে না- লোক দিয়া বদ মাইয়াগো পিঠে পাছায় দড়া মারতে পারে, পাত্থরও মারতে পারে। না জানি তার কি বিচার করে হুজুর। নিজের জন্যে অতো ভাবে না সে। তার বুকের ধনদের জন্যে তো তার বাঁচতে হবে। ইমাম হুজুররে তাই নাখোশ করা চলবে না’।
নিজের অভিনয়ের সফলতার কথা চিন্তা করে মনে মনে একটু খুশী হয়ে যায় নেকজান পাগলী। পা ধরা তো দুরের কথা- বাচ্চাগুলোর জন্যে সে সব করতে পারে, সব দিতে পারে, শুধু দুইটা ইজ্জত ছাড়া- ভিটে আর দেহ বাদে সবকিছু। আরো একজনকে নারাজ করতে চায় না নেকজান- সে হলো এ গাঁয়ের নেতা, সবার নিতাভাই। নিতাভাই ছোট পদের হলেও কাজ তার অনেক বড় বড়। ক্ষমতাও তার অনেক। রাজার লোক সে- অনেক কিছু করতে পারে। পাইক পেয়াদা কোতোয়াল তার কথা শোনে। ট্যাড়া লোকদের চোখের পলকে ঠান্ডা করে দিতে পারে। তারেও চটানো যাবে না। আজকাল তার উপরে সেও খুব বেশী তুষ্ট না। চোখ কান খোলা রেখে অনেক শিখেছে নেকজান, হয়েছে কৌশলীও। বাচার তাগিদে জটিল সব কুটনীতি বুঝে ফেলেছে ব্যতালে পাগলী।

ইমাম হুজুরের সাথে দেখা হওয়া একটা বদ-খোয়াবের মতন। নেকজানের শেষ বদ-খোয়াবটা শেষ হয়েছিল আজকে নিয়ে সাত দিন আগে। এর ভেতরে শালিস ডাকা হয় নাই, বিচারও বসে নাই। যাক বাঁচা গেল, আল্লায় বাচাইছে নেকজান বিবিরে। পড়ন্ত বিকেলের আলোয় এক চিলতে উঠোনে বরই গাছটার নীচে বসে সে মেঘহীন আকাশের দিকে তাকায় একবার। উপরওলাকে শুকরীয়া জানায় মনে মনে। ভিটের সীমানা-বেড়া বরাবর বেশ কিছু লোকজনের চলাচল খেয়াল করে সে। কিছু সময় পরে বাশের চটার দরজাটা নড়েচড়ে উঠে- কারা যেন ঢুকছে বাড়ীর ভেতরে। ভাল করে দেখার জন্যে চোখ দুটো রগড়ে নিল পাগলী। এক দুই জন নয়, পাঁচ পাঁচ জন মানুষ ঢুকলো হাবু গায়েনের ভিটেয়। সেই কবে গায়েন মারা গেছে, তারপরে আর কোন মানুষ এই ভিটেয় এসেছে কিনা মনে করতে পারে না সে। পাগলীর ভিটেয় ঢুকবেটা কে, কারন এখানে ঢোকাতে ভয় আছে, আছে ঘেন্নাও। জলজ্যন্ত পাঁচজন মানুষ দেখে চমকে গেলো নেকজান। ওর ভেতরে দুইজনকে সে চেনে- একেবারে হাড়ে হাড়ে চেনে বলা যায়। তারা একজন ইমাম হুজুর, আরেক জন নিতাভাই। এই দুই জনকে এক সাথে দেখে ভয়ে গায়ে কাঁটা দিল তার। সর্বনাশ! এরা তো দুই জনে দুই তরিকার মানুষ- দুই জগতের বাসিন্দা, এক হলো কিভাবে? কি মতলবে ওরা এখানে? ওরা দুইজন কাছে এগিয়ে এলো ব্যতালির। গলায় একটা খাকারি দিল হুজুর কিছু বলবার জন্যে।
-ওনারা বড় সাংবাদিক, ঢাহা শহর থেইকা আইছেন- কিছু কইবার চান তোমারে।
হুজুরের কথায় নিতাও ঘাড় নাড়ে। আরো কিছু যোগ করে সেও।
-হ ব্যতালী, ওনারা তোমারে নিয়া অনুষ্ঠান করবো।
সাংবাদিক তিন জন এগিয়ে আসে। তাদের ভেতরে একজন মাইয়া মানুষও আছে, তবে তার পরনে মরদের পোষাক- চোখ বড় করে দেখে নেকজান। তাদের প্রত্যেকের হাতে কালো কালো চোঙার মতন কি সব মেশিন-পত্তর। হঠাৎ হঠাৎ আকাশের বিজলীর মতন চমকায়। শহরে কতো সাহেব-শুবোদের বাসায় কাজ করেছে নেকজান কিন্তু এমন জিনিস সে কখনো দেখে নাই। এমন চকচকে মানুষও দেখে নাই কখনো। ‘মেশিনের চকমকিতে গায়ে আগুন লাগবে নাতো’- ভাবে নেকজান। ওদের ভেতরে মেয়েলোকটা কথা বলে।
-আমরা দেশের নিঃস্বার্থ মানুষ, যারা সমাজের জন্যে কিছু করছেন, তাদের নিয়ে একটা প্যনেল করেছি। তাদের ভেতরে আপনিও একজন। আপনি একজন মহত মা। আমদের এই প্রগ্রামের নাম- সাদা মন সাদা প্রান। আগামী দুই মাস পরে এসে আমরা আপনাকে ঢাকায় নিয়ে যাবো, সম্বর্ধনা দিবো প্যনেলের সবাইকে। আজকে কিছু ছবি নিয়ে গেলাম।
ফটাফট জ্বলে উঠলো কালো মেশিনগুলো। আচানক ইমাম হুজুর আর নিতাভাই হাসি হাসি মুখ করে নোংরা ছেলে-মেয়েগুলোর কাছকাছি দাড়িয়ে গেল। ছবি উঠলো তাদেরও। আপন ভাল পাগলেও বোঝে। পাগলীর সাথে ভাব-সাব রাখা তাদের এখন জরুরী। দুনিয়ায় সবই তেজারতী। নিজেদের প্রচার প্রসারের স্বার্থের দিকে নিতা, হুজুর দুজনেই সজাগ। ছবি তোলার কাজ শেষ করে ফেললো বিদেশী মেহমানরা। আর ওদিকে পরদেশী মাইয়ালোকটার কথার আগা-পাছা-মাথার কিছুই ঠাহর করতে না পেরে কাঁপুনি ধরলো নেকজান বিবির গায়। অবিশ্বাসে ভ্রু কুচকালো বিবি- কি ভাষায় কতা কয় অরা?- এই প্রশ্ন তার এখন দুই ভ্রুর মাঝখানে। ভয়ে সব কথা এসে গলার গোড়ায় আটকে রইলো তার, শুধু কম্পিত কন্ঠ থেকে জবান ফসকে দুটো শব্দ বেরিয়ে এলো।
-আমার অপরাধ কি?
পাগলীর কথা শুনে একসাথে খ্যাক খ্যাক করে হেসে উঠলো নিতা আর হুজুর, কিন্তু পরদেশী লোকগুলো হাসলো না। শুধু অবাক হয়ে তাকালো বিদেশী মেয়েটা মহত মায়ের মুখের দিকে।
-না না, অপরাধ হবে কেন? এই পাঁচশ টাকা থাকলো, আপনার ছেলে-মেয়েদের মিষ্টি কিনে খাওয়াবেন। আমরা এখন যাবো।
পরদেশী মেয়েটা কথাগুলো বলে অচেনা দৃষ্টিতে কিছুক্ষন অপলক চেয়ে রইলো নেকজান বিবির মুখের দিকে। পাগলীর হাত অসাড় এখন- হাত বাড়িয়ে এতোবড় একটা টাকার ভার নেবার ক্ষমতা নেই সেই হাতে। তাই সেটা যেমন ছিল তেমন পড়ে রইলো পায়ের কাছে। চলে গেলো পরদেশী লোকগুলো। চলে গেলো ইমাম হুজুর আর নিতাও। কিন্তু তারা নেকজান বিবির মনে-মগজে ফেলে রেখে গেলো জটিল কিছু ভয়, সন্দেহ আর বিস্ময়।

ব্যতালে পাগলীর সব সন্দেহ গিয়ে পড়লো ইমাম হুজুর আর নিতাভাইয়ের উপর। কার্তিকের ঝড় উঠলো তার ভাবনায়। ভাবে পাগলী আকাশ পাতাল- ‘যাদের কোন দিন এক হওনের কথা না, তারা কেমনে এক হইলো? এইবার হুজুর আর নিতা এক হইয়া তারে শেষ করবো বিচারের দড়ায় অথবা পাত্থরের ঘায়ে। বিলাইয়ের বাচ্চার মতন তার সোনাধনদের শহরের রাস্তায় ছাইড়া দিয়া আইবো। এই জন্যেই তারা শহর থেইকা লোকগুলিরে ভাড়া কইরা আনছে। এই গায়ে হেরাই সব। তার মরন বুঝি এবার এদের হাতে। পালাইতে হইবো, দুই মাসের জন্যে পালাইতে হইবো। দুই মাস পর ভিটেয় ফিরা আইলে আর কোন বিপদ নেই’।
নেকজান বিবি মনে মনে বাঁচার রাস্তা তৈরী করে ফেলে। এই ঘোর বিপদে গায়েনের কথা মনে হয় তার হটাৎ করে। মনে পড়ে যায় তার বান্ধা গানও। তার গায়েনের গানের কথা কি মিথ্যা হতে পারে? কক্ষনো না।

শিয়াল কুকুর যদি পিরিত করে ওগো হায়
এক থালাতে যদি তারা কখনো ভাত খায়,
তবে জেনো সর্বনাশের আরতো বাকী নাই
ভাইরে আরতো বাকী নাই।
ওরে ভাই ঠিক তেমনি করে-
খোদার দাস আর রাজার দাসে যদি পিরিত হয়,
একসঙ্গেতে যদি তাদের উঠা বসা হয়,
যদি রাজার আসন সচল রাখা
তাদের কর্মধারা হয়-
তবে সর্বনাশের মাথায় বাড়ি
হবেরে নিশ্চয়।
ও ভাই হবেরে নিশ্চয়।

গানের ভেতরে গায়েনের আত্মা যেন লুকিয়ে আছে। সেই আত্মাই ধাক্কিয়ে বের করে দেয় নেকজান বিবিকে তার ভিটে থেকে- যা নেকজান যা, পালা- পালা।

শহরের এক কোণায় রেল ষ্টেশন। সেখানে দাড়িয়ে আছে সারি সারি বেশ কিছু পরিত্যাক্ত বগী। ওর একটায় বাসা বান্ধে নেকজান তার সোনার চানদের নিয়ে। দেখতে দেখতে কেটে গেলো তার বিপদের দুটো মাস। পাগলীর সময় কাটে ঘোর ব্যস্ততায়। ছোট ছোট মুখের ভয়াবহ নেশা তারে ভুলায়ে দেয় সময়ের সরল হিসাব। দুই মাস থেকে দুই বছর কেটে যায় সাত সাতটা জীবনের অবিরাম আবর্তে- ক্লান্তিহীন ঘুর্ননে। বিপদ কেটে গেছে সেই কবে। এতো দিনেও তার গায়েনের ভিটেয় পা রাখা হয়নি। এ কোন হাসিস, সিদ্ধি অথবা আপিমের নেশা, যা তাকে ভুলিয়ে দিল ভিটের মায়া, মাটির মায়া।

বহুদিন পর সুন্দর ব্যতিক্রমী এক ফুটফুটে শীতের সকাল ক্ষনিকের জন্যে হলেও ব্যতালে পাগলীর শক্ত নেশাটাকে হটিয়ে দেয়। চমকে যেয়ে একবার সে সাতটা ফুটফুটে মুখের দিক থেকে দৃষ্টিটাকে ঘুরায়ে সূর্য্যের গমন পথে রাখে। ঐ পথেই তো সময় ঘড়ির আসা যাওয়া। অগ্নি-ঘোড়ার পিঠে সওয়ার যে মহাকাল, তার দিকে নজর যায় না এমন কেউ কি আছে? তাই ঠিক ঠিক নেকজানের মনে পড়ে যায় গায়েনের ভিটের কথা- নিজের মাটির ইজ্জতের কথা। বড় দেরী হয়ে গেছে- আর দেরী নয়। গলায় অনেক খানি শক্তি জড়ো করে ফাল পাড়ে, বড় মাইয়াটারে ডাকে পাগলী- গরবী, এই গরবী, ওঠ মা ওঠ। এট্টু সকাল সকাল গায়েনের ভিটেটারে দেইখা আসি।
-তাড়াতাড়ি আইসো মাও। তোমারে না দেখলে প্যাট পোড়ে- সব ব্যরাচ্যরা লাগে।
মায়ের একলা বাইরে যাওয়ার কথা শুনে বড় মেয়েটা ধড়ফড়িয়ে বিছানায় উঠে বসে। চোখ ডলে মলে কথাগুলো বলে কাত হয়ে ক্যথা বালিশে মুখ গোজে আবার।

সকাল সকাল বেরিয়ে পড়ে ব্যতালে পাগলী। সূর্য্যের নরম আদর গায়ে মেখে তিন ক্রোশ পথ পাড়ি দিয়ে অবশেষে রহিমুদ্দী সেখের বেত বাগানের কোলে এসে পৌছে বুড়ী। বেত বাগানের সীমানা পেরুলেই তো তার বাড়ী- হাবু গায়েনের ভিটে। ঠিক জায়গায়ইতো সে দাড়ায়ে আছে। তার ভিটেটা গেল কই? চোখের মাপে ভিটের সীমানাটা আন্দাজ করে নেকজান- ঠিক ঠিক সেখানে দাড়িয়ে গেছে ঝলমলে রাজার বাড়ী। এই বাড়ী কি সে বানিয়েছিল? সে কি রানী? এই বাড়ী কি কেউ তাকে বানিয়ে দিয়েছে? অনেক অলীক প্রশ্ন তার মনে। গায়ে জোরে একটা চিমটি কাটে নেকজান বিবি- না না, সে তো ব্যতালে পাগলী, ভিখারীও সে- অন্য কেউ তো নয়। বিশাল লৌহ ফটকের সামনে এসে ভয়ে ভয়ে সেটা ধরে ছোট একটা ধাক্কা দেয় বুড়ী। ভেতর থেকে বন্ধ ওটা। গেটের দুই পাটের মাঝখানের ছোট ঘুলঘুলি দিয়ে ভেতরে তাকায় নেকজান। অবাক হতেও ভুলে যায় যেন সে। চোখ ঘুরিয়ে এমন অনেক জিনিসের চেকনাই সে দেখতে পায়, যা সে জীবনেও দেখেনি। আহহারে, তার ভিখারিনী ভিটে আজ কি সাজেই না সেজেছে! একটা মলিন অভিমান এক নিমেষে নেকজান বিবির মনের ভিটেটাকে দখল করে ফেলে। সহসা গায়েনের কবরটার কথা মনে হয় তার। দৃষ্টির তীক্ষ্ণতা আরো বাড়িয়ে খুজতে থাকে সেটা, কিন্তু কোথাও মেলে না। কোথায় গেল কবরটা? বুকের ভেতরে শক্ত একতাল পাথর অনুভব করে নেকজান। পাথরটার নীচে এক দঙ্গল কান্না চাপা পড়ে ছটফট করতে থাকে। বেরোতে চায় তারা, কিন্তু পথ পায় না। শুধু একটা নীরব দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে পাথুরে কন্ঠ হয়ে বাইরের ঠান্ডা বাতাসে। উল্টো দিকে ঘুরে দাড়ায় নেকজান বিবি। পা বাড়ায় তার আসল ঠিকানায় যেখানে সাত মানিকের সৌভাগ্য তার জন্যে অপেক্ষা করছে। যাক ভালই হলো- গাঁয়ের সাথে তার আর কোন বাঁধনই রইলো না। সে এখন শহরে থাকবে- বাজপাখীর ডানার উপরে বসে বসে ভাগ্যবান বাতাসের গন্ধ নেবে। সে আসলে ভাগ্যবানই- তার ঘরে সাত রাজার ধন লক্ষ মানিক। চলতে চলতে গুনগুনিয়ে গান ধরে নেকজান বিবি- হাবু গায়েনের গান নয়, নিজের গান। সে এখন গান বানতে পারে। ভেতরের শক্ত পাথরটা তার নরম হয় গানে গানে।

গায়েনরে তুই কোথায় শুয়ে
কেমন করে কই!
এই অন্তরে করে দিলাম
তোর কব্বরের ঠাই।
ঘরে আমার সাত রাজার ধন,
সেথায় দেবো তোরে আসন-
সত্যি করে কই।
এই মনেতে করে দিলাম
তোর কব্বরের ঠাই।