১.
বাংলার আকাশে এখন বৈশাখী সংকীর্তন। দ্রুতবেগে ধাবমান বিশাখা নক্ষত্র। আজ বাদে কাল ভোরেই সে আছড়ে পড়বে বাংলার দুয়ারে দুয়ারে। বরণের ডালা নিয়ে তাই মানুষের অপলক অপেক্ষা নির্নিমেষ নয়নে।

২.
বৈশাখের উত্তাপ আমার ভিতরও সংক্রমিত হল। একসময় টিকতে না পেরে রাকিবকে ফোন দিলাম, – ‘কাল রমনায় যাবি?’
রাকিব নিরুত্তাপ কণ্ঠে বলল, – ‘ঐ জায়গায় যাওয়ার কোন ইচ্ছা আপাতত আমার নাই।‘
আমি বললাম, – ‘ক্যান, তুই বুমারে ডরাস নিকি?’
রাকিব বলল,- ‘আসলে এইসব অনুষ্ঠানে যাওয়া ঠিক না। ইমান নষ্ট হওয়ার চান্স আছে।‘
আমি অবাক হয়ে বললাম,- ‘কি বলিস, দুই-চারটা গান শুনলেই ইমান নষ্ট হয়ে যায়? তোগো ইমাম সাহেবের নয়া ফরমান নাতো আবার?’ রাকিবের কাছেই শুনেছি ওদের পাড়ার জাঁদরেল এক ইমাম সাহেবের কথা, যিনি নিত্য নতুন ধারা উপধারা জারি করে এলাকাটিকে ধর্মের সুশীতল ছায়ায় নিয়ে আসছেন আস্তে আস্তে। সবাই সেখানে নাক-চোখ-মুখ বুঁজে ইমাম সাহেবের কথামৃত গেলাসে গেলাসে পান করে।
রাকিব যেন কিছুটা শ্রাগ করল, – ‘শুনছি ছায়ানট একটা শয়তানের আখড়া। ছায়ানটের ছাত্র-ছাত্রীরা প্রকাশ্যে ঢলাঢলি করে। নেশা করে। তাই ইমাম রমনায় যাইতে নিষেধ কইরা ভুল কিছু করে নাই। ‘
আমি বললাম, – ‘কিন্তু আমরা তো ওগো ঢলাঢলি দেখতে যাইতেছি না; আমরা যাইতেছি গান শুনতে।’
রাকিব বলল, – ‘ঐসব বিধর্মী গান শোনাও ঠিক না।‘
আমি বললাম, – ‘তাইলে তুই আগামীকাল কি করবি? সারা দিন কাথামুড়ি দিয়ে নিদ্রা যাবি নাকি?’
রাকিব বলল, – ‘রনিদের খেলার মাঠে বিকালে ব্যান্ড সংগীত আছে। ঐখানে যামু চিন্তা করতাছি। আর রনি কইছে, রাতে মালের ব্যবস্থাও থাকব। তুই তাড়াতাড়ি আইসা পড়িস। এক লগে বাইর হমুনে।‘
আমি বললাম, – ‘আরে কি কইলি? আমি ভুল শুনলাম না তো? তুই ব্যান্ড সংগীত শুনবি? মাল খাবি? তোমার ইমান থাকবো তো দোস্ত?’
রাকিব বলল, -‘দেখ, গান শুনি, মাল টানি আর যাই করি না কেন, আমার ইমান মজবুত আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে ইনশাল্লাহ। কিন্তু তোর ছায়ানট, চারুকলার পোলা-মাইয়াগুলি তো আল্লা-রাসুলই মানে না।‘
আমি আমোদিত হয়ে বললাম, – ‘তাইলে বলছিস, গান শোনা আর মাল টানার পরও ইমান থাকে? আচ্ছা, তোগো মসজিদের ইমাম মদ খাওয়া, ব্যান্ড শোনা -এগুলো নিয়া কোন ওয়াজ করে না?’
রাকিব বলল, – ‘এগুলো তো সেকেন্ডারি বিষয়। এগুলি নিয়া ইমামের মাথা ঘামানোর সময় কোথায়? ওয়ার্ল্ডের সবখানে মুসলমানরা মার খাইতেছে। ইহুদি-নাসারা-হিন্দু সব বিধর্মীরা আজ একজোট হইছে মুসলিম জাতির চিহ্ন দুনিয়া থেকে মুইছা ফেলানোর জন্য।‘
আমি বললাম, – ‘এই সর্বধর্মিয় ষড়যন্ত্রের জ্ঞানও কি ইমামের কাছ থেকে পাইলি?’
রাকিব আবারও শ্রাগ করল, – ‘এই কথা পুস্তকেই ভবিষ্যতবাণী করা আছে। পড়লেই জানতে পারবি। শুধু তাই না, বিধর্মীদের সাথে যুদ্ধে মুসলিমরাই শেষ পর্যন্ত জয়লাভ করবে। তখন পৃথিবীতে খালি একটা ধর্মই থাকবে- আর তা হইল গিয়া আমাদের ইসলাম।‘
আমি বেশ আহলাদিত হয়ে বললাম, – ‘লেখা যখন আছে, তখন তো হইয়াই যাইব। মুস্লিম জাতির আর চিন্তা কি? এখন মুসলিম জওয়ানেরা ঝাঁকে ঝাঁকে ঝাপাইয়া পড়লেই খেল খতম!’
রাকিব উৎসাহভরা কন্ঠে বলল, – ‘আর, সে জন্যই তো ইমাম প্রতি শুক্রবার একবার কইরা জেহাদের কথা মনে করায় দেয়।’ ’
আমি বললাম, – ‘আচ্ছা, হুজুর কি খালি জিহাদের কথাই কয়? চুরি, ডাকাতি, খুন-খারাবি, ঘুষ, মজুদদারি এগুলি নিয়া কোন কথা কয় না?’
রাকিব বলল – ‘এখন প্রাইমারি টার্গেট হইল মুসলিম জাতির অস্তিত্ব রক্ষা। এখন ঐসব ছোটখাট বিষয় নিয়ে কথা বলার সময় নাই ইমামের।‘
রাকিবকে ফোন করার আগে আমি বৈশাখী জ্বরে আক্রান্ত ছিলাম। কিন্তু এখন রীতিমত ঘামছি। কিন্তু এই ঘাম জ্বর না ছাড়িয়ে তাকে উলটো আরও বাড়িয়ে তুলল। আমি স্টুপিডটার সাথে আর কথা না বাড়িয়ে দড়াম করে ফোন রেখে দিলাম।

৩.
ড্রয়িং রুমে যেয়ে দেখি বড় চাচা পত্রিকা হাতে বসে রয়েছেন। উনি সরকারী কর্মচারী ছিলেন। সম্প্রতি অবসর নিয়েছেন। ব্যাপক অর্থ-সম্পদের মালিক। চাচাকে লম্বা সালাম দিলাম। আমার চাচা আবার পরহেজগার মানুষ। লম্বা সালাম শুনতে ভালবাসেন।
চাচার সাথে টুকটাক কথা হচ্ছিল। একটু পরে মা ছানার সন্দেশ দিয়ে গেলেন আমাদের। বড়চাচা জিজ্ঞেস করলেন, – ‘সন্দেশ কেন হঠাৎ?’
আমি বললাম, – ‘ পয়লা বৈশাখের সন্দেশ, চাচা। আপনি আসাতে কালকের জিনিস এডভান্স খেতে পারছি।’
চাচা বেখুশ হয়ে বললেন, ‘ব্যাপার স্যাপার তো বুঝতিছা না! তোমরা দেখি পয়লা বৈশাখরে ঈদ বানায় ফালাইতেছো?’
আমি বললাম, – ‘পয়লা বৈশাখ তো ঈদের মতই আনন্দের দিন, চাচা।‘
চাচা বললেন, – ‘খবরদার, এমন কথা যেন আর না শুনি। মুসলমানদের কেবল দুইটা ঈদ। এ ছাড়া মুসলমানদের আর কোন আনন্দের দিন থাকতে পারে না। ইসলামের নিয়মকানুন ঠিকমত জাইনা-বুইঝা কথা বলতে আসবা‘
আমি তখন মনে মনে আমার ইমানদার চাচা কি করে এত বিত্ত বৈভবের মালিক হল, তার উত্তর তালাসে ব্যস্ত। এক সময় চাচাকে একটু বাজিয়ে দেখার জন্য জিজ্ঞেস করি, – ‘আমরা কি জানা থাকলেই ইসলামের সব নিয়ম-কানুন মানতে পারি, চাচা?’
চাচা কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললেন, – ‘এইটা ঠিক যে, আমরা সবসময় মানতে পারি না। কিন্তু যেটা পারবা, সেটা তো অন্তত পালন করবা। যেমন ধর, তুমি পয়লা বৈশাখের বিজাতীয় অনুষ্ঠান ইচ্ছাশক্তি দ্বারাই বর্জন করতে পার। তুমি ইচ্ছা করলেই নামায পড়তে পার, রোযা করতে পার। এগুলোর জন্য কোন অর্থকড়ি লাগে না। সামান্য ইচ্ছাই যথেষ্ট।‘
কিন্তু চাচার উত্তরে আমি সন্তুষ্ট হতে পারি না। ইসলামের কোন নিয়মটা আমরা জানা থাকার পরও মানতে পারি না, তার জন্য খানিক ব্রেইনস্টর্মিং করলাম। বেশিদূর যেতে হল না। চাচার জীবন বিশ্লেষণ করতেই গড়গড় করে স্লট থেকে কাচা পয়সার মত উত্তর বেরিয়ে আসলো। তবে এ নিয়ে চাচাকে আর প্রশ্ন করতে লজ্জা লাগছিল।

চাচার মিষ্টি তখনো পাতে পড়ে ছিল। আমি বললাম, ‘চাচা, আপনি কি পয়লা বৈশাখের মিষ্টি খাবেন?’
চাচা আমাকে অবাক করে দিয়ে বললেন, – ‘কেন খাব না? অবশ্যই খাব। প্রত্যেকটা খাবার জিনিস আল্লাহর নেয়ামত। এগুলো ফালায় দিলে কবিরা গুনাহ হবে।‘

মনে মনে চাচার প্রতি মুগ্ধতা বাড়ছে আমার। চাচা আসলে যেকোনো খাওয়ার জিনিসকেই আল্লাহর নেয়ামত বানাতে পারেন। চাকুরিকালীন সময়ে করা তার অঢেল সম্পত্তি আল্লাহর নেয়ামত বলেই হয়ত ফিরিয়ে দিতে পারেননি, এমনকি ধর্মের নিয়মকানুন ব্যাপকভাবে জানা থাকা সত্ত্বেও।

চাচাকে আর একটা সালাম দেই আমি। মন থেকে। চিরদিনের জন্য।