বাংলা ভাষায় ‘চোরের মার বড় গলা’ নামে একটি প্রবাদের উপস্থিতি আমাকে বেশ বিব্রত করে;-আমার কী ঐ প্রবাদটি পড়ে আনন্দ পাওয়া উচিৎ কিংবা আমার কী নেয়া উচিৎ ঐ প্রবাদটিকে বাংলা ভাষা থেকে মুছে ফেলার দ্বায়িত্ব- তার কোন কিছুই আমি বুঝে উঠতে পারি না।যদিও বেশ বুঝতে পারি কোন প্রবাদকেই একটি ভাষা থেকে মুছে দেওয়ার ক্ষমতা কারো নেই।কারণ-‘প্রবাদ’ একটি ব্যাপক জনমানসের আন্তর কাঠামোরই ভাষিক প্রতিফলন।সুতরাং যতদিন একটি নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর অধিকাংশ সদস্যদের আন্তর ও মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন না হচ্ছে ততদিন একটি নির্দিষ্ট সমাজ কাঠামোর পরিপ্রেক্ষিতে প্রবাদটি বেঁচে থাকবে। আমাদের চারপাশে একটু চোখ বুলালেই বুঝতে পারি এ প্রবাদটি কেন এখনো গ্রহণযোগ্যতা হারায়নি।চারিদিকে চোরেদের ব্যাপক উপস্থিতি এখনো লক্ষ্য করা যায়;কিন্তু চোরেদেরও মনস্তাত্ত্বিক বিবর্তন ঘটে।এ চোরেরা এখন আর রাতের অন্ধকারে গায়ে তেল মেখে চুরি করতে বেড়োয় না;এরা প্রকাশ্য দিবালোকে, কিছুটা এডভেঞ্চার সিনেমার আদলে, সদম্ভে ও সপ্রতিভভাবে এবং জোড়েসোড়ে ঘোষণা দিয়ে চুরি করতে নামে। তখন আমরা যারা সুশীল;তথাকথিত ভদ্র নাগরিক এবং আরো ভদ্র তথাকথিত-ছাত্র-অধ্যাপক-সাহিত্যসেবী তারা চোখ কান মুখ বন্ধ করে রেখে মূক ও বধির ও অন্ধ সেঁজে বসে থাকি।তাই এ দেশে চোরেরা মহানন্দে লুটতরাজে বের হয়; চুরি করতে করতে ধর্‍ষণকারীতে পরিণত হয় এবং ঠিক তখনই বাংলা ভাষা কলুষিত ও আক্রান্ত ও ধর্ষিত হতে থাকে এবং জন্ম দিতে থাকে নানারকম দুশ্চরিত্র প্রবাদ বাক্যের। এ প্রবাদ বাক্যগুলো দুঃখিনী বাংলা ভাষার সম্পদ নয়-এরা ভাষার শত্রু। এ প্রবন্ধটি লিখতে লিখতে মনে পড়ে গেলো এ রকম আরো অন্ততঃ দুটি প্রবাদ বাংলা ভাষার গলায় কাঁটার মতো বিঁধে আছে। ও দুটো হচ্ছে-‘চুরির চুরি,আবার সিনাচুরি’ এবং ‘চোরা না শুনে ধর্মের কাহিনী’।

আমি নানারকম চোরেদের মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে যাবো না। কিন্তু এক ধরণের চোর আমি শনাক্ত করতে পেরেছি;অথবা এভাবেও বলা যায় যে ঐ চোরেরাই বেশ দম্ভের সাথে আমাকে তাদের পরিচয় দিয়েছিল।আমি তাদের একজনকে বলেছিলাম-‘আপনি চুরি করেছেন’।চোরটি আমার কথা শুনে বেশ উচ্চঃস্বরে হেসে উঠেছিল এবং প্রায় মৃত শিয়ালের মতো ডেকে উঠে বলেছিল-‘আপনি এখনো আমাদের ব্যাপারে কিছুই জানেন না।সবাই চুরি করে।আমাদের এ লাইনের রথী মহা-রথীরাও হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ মিলিয়ন মিলিয়ন চুরি করেছে’। আমি উত্তর দিতে যাচ্ছিলাম;কিন্তু ঠিক তখনই লক্ষ্য করলাম গোটা বাংলাদেশ থেকে ধারালো ছুরি হাতে চোরেদের বাপ ভাইয়েরা এবং বন্ধুরা এবং তথাকথিত সুশীলেরা ছাত্ররা এবং চোরেরা সবাই তেড়ে আসছে আমার দিকে। ওরা উদ্যত ছোড়া হাতে নিয়ে বললো-‘আপনি ওদেরকে চোর বলছেন কেন?ওরা চোর নয়।ওরা প্রতিভাবান।ওরা সৃষ্টশীল।ওরা অন্যের ঘর থেকে চুরি করে মালামাল নিয়ে আসে-কেননা মালামালগুলো ওখানে থেকে নষ্ট হয়’। তারপর ঐ প্রতিভাবানদের কাছ থেকে জানতে পারলাম-অমর হওয়ার জন্য চুরি করতে হয়।চুরি ছাড়া পথ নেই।অনেক অমরই চুরি করেছেন; আমি ওদের কথা শুনি। আমার ছেড়া ছেড়া দুঃখিনী বর্ণমালাগুলোর তাকাই।বর্ণমালাগুলো নিজেরাই স্থান বদল করে জ্বলজ্বলে একটি বাক্য তৈরী করে।আর বাক্যটি যেন পুড়িয়ে নিয়ে যায় সবকিছু।গোটা বাংলায় শুধু একটি বাক্য পুড়ে পুড়ে জ্বলতে থাকে এবং বাংলার মাঠ ঘাট নদী কাঁশফুল চিৎকার দিয়ে শ্লোগান তুলতে থাকে-‘চোরের মায়ের বড় গলা’।

কিন্তু আমি জানি এ আর্ত চিৎকারে লাভ নেই। ওই চোরেরা আরো প্রতিভাবান,শক্তিশালী হিংস্র।ওরা বাংলাকে তার সাহিত্যকে নষ্ট ভ্রষ্টদের শাদা পাতায় পরিণত করবে।

মানুষ হিসেবে আমরা কেউই স্বয়ংসম্পূর্ণ নই।ফলে আমাদের নানারকম চাহিদা মেটাতে অন্যদের সাহায্যের প্রয়োজন হয়ে পড়ে। আমরা যেমন অন্যের চাহিদা মেটাই অন্যরাও ঠিক আমাদের চাহিদা মেটায়। এ পর্‍যন্ত ঠিক আছে এবং অর্থনীতিবিদদের সাথে আমার কোন বিরোধ নেই।কিন্তু কবিতা বা গদ্য-সাহিত্য বা নাটক বা সংগীত আমার ঠিক কোন ধরণের অর্থনীতিক ও বৈষয়িক চাহিদা পূরণ করে? সাহিত্য কারো বৈষয়িক চাহিদা পূরণ করতে পারে না।ওটা সাহিত্যের ক্ষেত্র নয়।সাহিত্যের ক্ষেত্র হচ্ছে মানব মন। এবং তার উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষকে মন্ময় করে তোলা অর্থ্যাৎ তার আন্তর মনকে আনন্দ দেয়া-তরল ও গরল আনন্দ নয়। একজন পণ্য উৎপাদক ঠিক একটি পণ্য উৎপাদন করে বাজারে নিয়ে আসেন তার লাভের জন্য-এটি একটি মুনাফামুখি প্রক্রিয়া। কিন্তু একজন সৎ সাহিত্যিক দিনের পর দিন রাতের পর রাত নানারকম অক্লান্ত ও অশেষ পরিশ্রমের পর যখন সৃষ্টি করতে থাকেন মানুষের কথা;উৎপাদন করতে থাকেন নতুন বোধ-যা কিনা মানুষের বেঁচে থাকার জন্য খুব দরকার-তখন ঠিক কোন ধরণের বৈষয়িক চিন্তা দ্বারা তিনি তাড়িত হন?কিংবা একজন বিজ্ঞানী যখন আবিষ্কার করে ফেলেন নতুন কোন সূত্র কিংবা মহৎ কোন তত্ত্ব? ওসব বাজারী স্বার্থ বুদ্ধি প্রকৃত সাহিত্যিকের বিজ্ঞানীর থাকে না।তবে সাহিত্যিকদের মধ্যে বিজ্ঞানীদের সবাই ভালো নয়।তাদের মধ্যে নানারকম চোরেরা ঢুকে গেছে সুযোগ সুবিধা মতো। হয়তো দেখা যাবে কেউ একদিন নিউটনের তৃতীয় সূত্র চালিয়ে দিতে চাইবে নিজের নামে যেমন সাহিত্যে দেখা যাচ্ছে একজনের নতুন ধরণের বোধ ও নতুন ধরণের বাক্য বিন্যাস দু এক জায়গায় বদল করে আরেকজন দাবি করছে ওটা তার মৌলিক সৃষ্টি। এরা মৌলিক নন;এরা চোর ও চোর-বংশজাত।এবং এদের বংশ বেশ খানদানীও বটে।কেননা ওদের পূর্ব পুরুষেরা যে চোর ছিলেন তারা তা গর্ব করে বেশ উচ্চৈঃস্বরে প্রচার করে থাকেন।আপনি চাইলে ওরা প্রতিবেদনও দিতে পারে যে তাদের পূর্ব পুরুষেরা ঠিক কতখানি চুরি করেছেন অন্যদের কাছ থেকে। এ সব চোরেদের নানারকম সংগঠন থাকে এবং থাকে কুশিক্ষিত অর্ধ শিক্ষিত অনুরাগী-চ্যালার দল । এ সব অনুরাগীর-চ্যালারা ঐ লেখক ও তার চৌর্য প্রকল্পকে বেশ উৎসাহে দিয়ে যান সমান তালে। তবে এখন সময় এসেছে চোরেদের চিহ্নিত করার-ডালপালা ও সন্তান সন্ততি এবং ক্রমবর্ধমান হারে বেড়ে যাওয়া কুশিক্ষিত অনুরাগীর ধরিয়ে দেয়ার এবং আমার দুঃখিনী বর্ণমালার কাছে আমার আলুথালু বাংলা ভাষার কাছে এ কথা বলার যে, চোরেরা এবং তাদের মায়েরা আর কখনো তোমাকে কলুষিত করতে পারবে না।আমরা আছি।থাকবো।