বাংলায় ‘ছোটগল্প’ শব্দটার সরাসরি ইংরাজী অনুবাদ করলে দাড়ায় শর্ট-ফিকশান বা শর্ট-স্টোরী। কিন্তু সে তার দেহে কি বৈশিষ্ট ধারন করে তার ভিতরে নিহিত রয়েছে tartarতার প্রকৃত রূপ। এক কথায় ছোটগল্পকে সুত্রবদ্ধ করা সহজ নয়। কোন গল্পকারকে ব্যপারটা জিজ্ঞেস করলে সেও বোধ করি ভাল বোধ করবেন না। ভেবে চিন্তে বলবেন- একটা পানির মাছকে সাঁতার কি তা জিজ্ঞেস করা আর গল্পকারকে ছোটগল্প কি তা প্রশ্ন করা প্রায় একই কথা। তারচেয়ে বরং দেখা যাক দেড়’শ বছরের পুরান লেখক, ঋষি ঋষি চেহারার রবি বাবু কি বলেন এ ব্যপারে।

ছোট প্রাণN ছোট ব্যথা
ছোট ছোট দুখকথা
নিতান্ত সহজ সরল।
সহস্র বিস্মৃতি রাশি
প্রত্যহ পড়িছে খসি
তারি দুচারিটি অশ্রু জল।
নাহি বর্ণনার ছটা
ঘটনার ঘনঘটা—-
–শেষ হয়ে হইলো না শেষ।
ইত্যাদি, ইত্যাদি

রবি বাবু ঠিকই বলেছেন। তবে তা আরো ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে। একটার পর একটা ঘটনা জড়ো করে মালা গাঁথতে পারলে হয় গল্প, কিন্তু এই ঘটনা গুলোর পেছনে যে সুক্ষ্ম কারুময় অনুভুতিগুলো থাকে সেগুলোর উপরে সার্চলাইটের তীব্র আলো ফেলে সামনে নিয়ে আসতে পারলে তা হয় ছোটগল্প। সেই জন্য গল্প ছোটগল্প নয় কিন্তু ছোটগল্পকে গল্প বলা যেতেও পারে। তাই ছোটগল্পের ভেতরে কাহিনীর শিড়ি খুঁজতে জাওয়াটা বোকামী। ঠিক একই কারণে, ইশপস ফেবল বা আদম-হাওয়ার কাহিনী গুলো গল্প- ছোটগল্প নয়। সব দোষ হাওয়ার। আদম তার বউকে দোষারোপ করে- এই নারীটাই সব সর্বনাশের মূল। জ্ঞানবৃক্ষের ফলটা সে না খেলে সর্বনাশটা হতো না। কিন্ত হাওয়ার নিষিদ্ধ ফল ভক্ষনের পেছনে কি সুক্ষ্ম অনুভুতিগুলো কাজ করছিল তার কোন শিল্পায়িত প্রকাশ গল্পে নেই। সেই জন্যে ঠাকুরমার ঝুলিকে কেউ ছোটগল্প বলবে না। কিন্ত কাদম্বিনীকে ছোটগল্প বলতে কারো দ্বিধা নেই। আঙ্গিকের দিকে তাকালে ছোটগল্পের চরিত্রদের যোগ্যতা ও অবস্থান অনুসারে ডায়লগগুলো হতে হবে, যার ভেতর দিয়ে সমকালিনতা এবং সমাজটা উঠে আসবে। এবার আসা যাক মূল্যায়ন গুলোতে- এখানেও পাত্র পাত্রিদের চিন্তা ভাবনার কাঠামোটা অবিকল তাদের মতো হতে হবে। কোন অবস্থাতেই লেখক সে চিন্তায় অংশ গ্রহন করতে পারবে না। চরিত্র গুলো সব সময় সমাজের ক্ষুদ্র অবহেলিত মানুষ হতে হবে এ ব্যপারে আমি রবি বাবুর সাথে এক মত না। ছোট প্রান হলে সুবিধে হয়, কারণ ছোটপ্রান গুলো প্রকৃতিক ভাবে প্রাচুর্য্যময়। তাই তাদের চিত্রায়ীত করতে লেখকের পরিশ্রম কম হয়। সমাজের ধনী ও শিক্ষিত চরিত্রগুলো বেশ কৃত্রিম, যাদের মুখোশ ভেঙ্গে মূল জিনিস বের করে আনতে বেশ খাটা খাটুনীর দরকার হয়। তবে এটা আমার একান্ত নিজস্ব মতামত। অন্যেরা এ ব্যপারে দ্বিমত পোষন করতে পারে। তবে একটা ব্যপারে কারোরই দ্বিমত নেই ছোটগল্পে কাহিনী সব সময় ছায়ার মতো ভাসা ভাসা এবং ইঙ্গিতে প্রকাশ থাকে, পাঠক কোন রকমে বুঝে নিতে পারলেই হলো। তবে একটা সফল ছোটগল্পের লক্ষন হলো, পড়া শেষ হয়ে যাবার পরও একটা বাঁকা প্রশ্ন এবং একটা কাটার ঘায়ের মতো অনুভুতি মনের ভিতরে কাজ করে।

এবার আসা যাক পশ্চিমা গল্পকারেরা ছোটগল্পকে কিভাবে সংজ্ঞায়ীত করার চেষ্টা করে সে ব্যপারে। বার্নার্ড বারগঞ্জি, একজন আমেরিকান সাহিত্য সমালোচক। ছোটগল্পের ব্যপারে সে একটু নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করেন। তিনি মনে করেন ছোটগল্প সব সময় এই দুনিয়াটাকে এক অন্য দৃষ্টিকোণ থেকে দেখে থাকে। কেমন সেটা- এ যেন এক বড়সড় পার্টি যেখানে রয়েছে দ্রুত কথা বলা বাচাল ঘোষক আর অসংখ্যা দামি যন্ত্রপাতি- যেন চাপিয়ে দেয়া হবে কোন একটা ভাল-মন্দ স্বিকৃতি অথবা উল্টো কিছু- সব কেমন আরোপিত। যেন একটা ছোট্ট নগন্য পাম্পের শক্তি রয়েছে অনেক বেশী চাপ সৃষ্টি করার, আর ধাক্কা ও বিজলী চমকের মাধ্যমে সেই চাপ যেন অবমুক্ত হবে স্বাধীনতা ও অন্যান্য ভাল ভাল বিষয় সহযোগে, বোতাম টেপার সাথে সাথে। পরিশেষে একটা সরু পথের ভেতর দিয়ে যেন একটা সেলুলয়েড পুতুল প্যরাসুট দিয়ে পার্টির মাঝখানে মেঝেতে এসে পড়বে। এ রকম বাস্তবে হয় না। সব কিছু বড্ড বেশী আরোপিত।

মার্গারেট আতউদ কানাডার একজন বুকার জেতা সাহিত্যিক। তার দৃষ্টিতে ছোটগল্প সাহিত্যের এক অনন্য মাধ্যম। তার কথা তার জবানীতেই শোনা যাক- ‘আমি মনে করি কবিতা হলো ভাষার হৃতপিন্ড, যার ভেতর দিয়ে ভাষা নিয়ত নব জীবন লাভ করে এবং বেঁচে থাকে। আমি আরো বিশ্বাস করি ছোটগল্প একটা জাতির নৈতিকতা ও বিবেককে অনুভবে ধারণ করে এবং তার অবিভাবক হিসাবে পাহারায় থাকে। বর্তমানে আমরা চারিদিকে একটু তাকালেই দেখতে পাই সংগবদ্ধ ধর্মগুলোর বিশৃঙ্খলা আর রাজনৈতিক নেতাদের অধঃপতন। ঈশ্বরই জানেন তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা আজ ধংসের কোন পর্যায়ে। তাই এই অবস্থায় ছোটগল্প অনেকগুলোর ভেতরে একটা উপায়, যার মাধ্যমে আমরা নিজেদের দেখতে পারি, একে অপরের সংগে আমরা কিভাবে আচরণ করি, কিভাবে নিজেদের ও অন্যদের বিচার বিবেচনা করি’। কাজেই এটা পরিস্কার, ছোটগল্পের সব সময় একটা দায়বদ্ধতা থাকে- মোনালিসার মতো ঠিক শিল্পের জন্যে শিল্প সৃষ্টি তার পোষায় না।

এবার আসি ছোটগল্পের দেহের আঁকার প্রসঙ্গে। অনেকেই মনে করেন- ছোটগল্পের আঁকার ন্যূনতম এক লাইনও হতে পারে। তবে তা নির্ভর করে স্রষ্টা কতো সুন্দর ভাবে গুটিকয় শব্দে নিজেকে প্রকাশ করতে পারেন, তার উপর। তবে তার সর্বোচ্চ দেহাকৃতি নিয়ে অনেকের দ্বিমত রয়েছ। সমারসেট মমের সবচেয়ে বড় শর্ট-ফিকশানটা ২০০০০ শব্দের। আবার ফ্রাঙ্ক সার্জেসনের সবচেয়ে বড় গল্পটায় রয়েছে ৩২০০০ শব্দ। তবে আঁকার যাই হোক না কেন ছোটগল্প কখনই উপন্যাস হয়ে উঠবে না কারণ ছোটগল্প কাহিনী-প্রধান নয়, অনুভুতি বা ভাব-প্রধান।

জোসি লিওনার্দো উরবিনা চিলির মানুষ। ১৯৭৭ সালে কানাডায় চলে আসেন চিলির অপরাজনীতির শিকার হয়ে। উরবানা কানাডার একজন নামকরা ছোটগল্পকার। তার খুব ছোট আকারের একটা ছোটগল্প দিয়ে লেখাটার ইতি টানবো।

পুলিশ সার্জেন্ট যখন মা ও মেয়েকে তাদের বাড়ীতে এসে জেরা করছিল তখন পরিবারের ছোট ছেলাটার দিকে তার নজর গেল। ছেলেটিকে সে ইশারায় ডেকে পাশের রুমে নিয়ে গেল।
-তোমার বাবা কোথায়? প্রশ্ন করলো সার্জেন্ট।
-সে স্বর্গে থাকে, ছেলেটা ফিস্ফিসিয়ে বললো।
-সেটা আবার কি? সে কি মারা গেছে? জিজ্ঞেস করলো সার্জেন্ট বিস্ময়ে।
-না, তিনি মৃত নন। প্রতিরাতে বাবা আকাশ থেকে নেমে আসেন, আমদের সবার সাথে ডিনার করার জন্যে। আবার ফিসফিসালো ছেলেটা।
সার্জেন্ট উপরের দিকে তাকালো এবং দেখলো ছাদের ছোট্ট ভাঙ্গা দরজা দিয়ে আকাশ দেখা যাচ্ছে।