বিশাল প্রাণবৃক্ষের একটি শাখা আমাদের জন্য খুব আকর্ষণীয় কারণ স্বয়ং আমাদের অবস্থানই সেই শাখায়। শাখাটির নাম প্রাইমেট। স্তন্যপায়ী প্রাণীরা মোট ২২টি বর্গে বিভক্ত, প্রাইমেট তার মধ্যে একটি। অন্য বর্গের প্রাণীদের মধ্যে আছে মাংসাশী প্রাণীর দল, হাতি, মারসুপিয়াল ইত্যাদি। প্রতিটি সন্তানের মধ্যে যেমন তার বাবা-মার বৈশিষ্ট্য থাকার পাশাপাশি কিছু অনন্য বৈশিষ্ট্যও থাকে তেমনি প্রতিটি প্রজাতির মধ্যে বর্গের সাধারণ বৈশিষ্ট্যের পাশাপাশি প্রজাতি নির্ধারণকারী কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য থাকে। প্রাইমেটরাও তার ব্যতিক্রম নয়।

প্রাইমেটরা শক্তভাবে কোনকিছু আঁকড়ে ধরতে পারে। তাদের সামনের দিকে তাক করা চোখ নিপুণভাবে দূরত্ব মাপতে পারে। যাদের যাত্রা শুরু হয়েছিল গাছে গাছে চড়ে বেরানোর মাধ্যমে তাদের জন্য এ দুইটি বৈশিষ্ট্যই খুব দরকারি। তারা কিভাবে যাত্রা শুরু করেছিল এবং কিভাবেই বা আজকের অবস্থায় পৌঁছেছে সে নিয়ে এই অধ্যায়েই একটু পরে আলোচনা করব আমরা। প্রাইমেটদের বুদ্ধিমত্তা ছাড়িয়ে যেতে পারে অন্য সকল প্রাণীকে। তারা কঠিন সমস্যা সমাধান করতে পারে, মনের মাঝে চিন্তা ও ধারণার জন্ম দিতে পারে এবং গড়তে পারে দীর্ঘস্থায়ী সম্পর্ক। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, প্রাইমেটরা জীবনে চলার পথে যা কিছু শিখে তা মনে রাখতে পারে।

পৃথিবীতে বর্তমানে ৩৫০ টিরও বেশি প্রাইমেট প্রজাতি রয়েছে। ৬ কোটি ৫০ লক্ষ বছর পূর্বে উদ্ভূত এই চালাক প্রাণীরা অনন্যসাধারণ ও বৈচিত্র্যময় নানান পরিবেশের সাথে নিজেদের মানিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছে।

দক্ষিণ ইথিওপিয়ার আওয়াশ অঞ্চল খুবই রূঢ়, দুর্গম এবং করকটে একটি বনাঞ্চল যেখানে গাছ বলতে আছে কেবল ছোট ছোট গুল্মজাতীয় উদ্ভিদ। কিন্তু প্রাইমেটরা শিখে নিয়েছে কিভাবে একে তাদের বাসস্থান বানাতে হয়। এখানকার হামাড্রায়াস বেবুনরা উঁচু খাড়া পর্বতের চূড়ায় রাত কাটানোর পর সকালে জেগে ওঠে। এদের একেকটি পালে ৪০০-র বেশি সদস্য থাকে, কিন্তু মজার ব্যাপার হলে থাকে না কোন একক দলনেতা। তাদের সামাজিক ব্যবস্থা চার ধাপে বিভক্ত। একজন পুরুষের অধীনে থাকা সর্বোচ্চ ১০ জন নারী নিয়ে গঠিত হয় একটি হারেম, এমন দুই বা ততোধিক হারেম নিয়ে একটি গোত্র হয় আর দুই বা ততোধিক গোত্র মিলে হয় একটি জোট। এক জোটের সাথে আরেক জোটের সংঘর্ষ বাধাটা বেশ স্বাভাবিক ঘটনা তবে ক্ষেত্র বিশেষে একাধিক জোট একসাথে মিলে একটি পাল গঠন করতে পারে। এমন পালগুলো সাধারণত একটি পাহাড়ের চূড়া দখল করে রাখে রাত্রিযাপনের জন্য।

সকালে পাহাড়ের চূড়া ছেড়ে তারা নিচে নেমে আসে খাদ্যের সন্ধানে। নেতা গোছের পুরুষেরা থাকে সামনে, বাকিরা তাদের অনুসরণ করে। এই বেবুন সমাজে নারীদের প্রতি পুরুষদের ব্যবহার আমাদের কিছুটা হলেও মধ্যযুগীয় আরব সমাজের কথা মনে করিয়ে দেয়, এবং মজার ব্যাপার হচ্ছে তারা উভয়েই মরু অঞ্চলের অধিবাসী, রুক্ষ মরু প্রকৃতিতে টিকে থাকতে গিয়েই হয়তো তাদের এমন কঠোর পুরুষতান্ত্রিক সমাজ গড়ে উঠেছে। হামাড্রায়াস বেবুন সমাজে হারেমের নারীরা এতো দুর্ভাগা যে পান থেকে চুন খসলেই তাদের শারীরিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়।

প্রত্যেকে শক্ত-সমর্থ হলেও হামাড্রায়াসরা দল বেঁধে ঘোরাঘুরি করতে পছন্দ করে কারণ তাতে নিরাপত্তা বেশি। আর তাদের প্রধান শত্রু যদি তারা নিজেই হয় তাহলে নিরাপত্তার দরকার আছে বৈকি। অনেক মানব সমাজের মতোই এই বেবুনদের এক পালকে অন্য পালের সাথে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে লিপ্ত হতে দেখা যায়। হয়ত এক পাল কোন পর্বতচূড়া দখল নিতে এসে দেখল অন্য পাল ইতিমধ্যেই তাতে দিব্যি রাত্রিযাপন করে আসছে। তখন হাজারেরও বেশি যুদ্ধংদেহী বেবুনের কামড়াকামড়িতে মরুক্ষেত্রটি পরিণত হয় কুরুক্ষেত্রে। এই সুযোগে প্রায় প্রত্যেক পুরুষই পূর্বশত্রুদের এক হাত দেখে নেয়। অন্যের নারী হরণের সুবর্ণ সুযোগও এটা। যুদ্ধ শেষে হারেমগুলো পুনর্গঠিত হয়। যে নারী হারেম ছেড়ে যাওয়ার সামান্যতম চেষ্টাও করেছিল তাকে পুরুষের তীব্র রোষের শিকার হতে হয়। এই সমাজ টিকিয়ে রাখতে যেন নিয়মানুবর্তিতার বিকল্প নেই। তাদের নিয়মকানুন নিঃসন্দেহে প্রচণ্ড নিষ্ঠুর, কিন্তু ইতিহাসের দিকে তাকিয়ে বলতেই হয় এই অনুর্বর সমভূমিতে হামাড্রায়াস বেবুনদের জন্য তা বেশ কাজের।

বিশ্বের অন্য প্রান্তে ভিন্ন ধরণের পরিবেশের সাথে মানিয়ে নিতে প্রাইমেটদের আবার অন্য রকমের সমাজ গড়ে তুলতে হয়েছে। শীতের জাপানি আল্পস থেকে ঘুরে আসলেই এর একটা ভাল উদাহরণ পাওয়া যায়। এখানকার কামিকোচি উপত্যকায় বিশ্বের সর্ব উত্তরে বসবাসকারী বানরদের দেখা মেলে। এখানে তাপমাত্রা কখনো কখনো শূন্যের নিচে ২০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড নেমে যায়। তারপরও দিব্যি টিকে থাকে জাপানি মাকাক। এই তুষার বানরদের পশম খুব পুরু যা শীতের প্রভাব কিছুটা কমায়, তারপরও শীত অনুভব করে তারা। এই সময়ে খাবারও দুর্লভ, কিন্তু মাকাকরা চালাক ও বেশ দক্ষ অভিযোজনকারী। তারা বুঝে ফেলে কোন জলাশয়টি তীব্র শীতেও কখনও বরফে পরিণত হয় না। সেই জলাশয়ের বরফের তলা থেকে সব্যসাচী হাত আর চপল আঙুল দিয়ে শূককীট সংগ্রহে তাদের জুড়ি নেই। শীতকালে মাকাকদের সারাটা দিনই কেটে যায় খাদ্য সংগ্রহে।

ভূগর্ভের যেসব ক্রিয়ার প্রভাবে এই জলাশয়টি সব সময় তরল থাকে সেই একই ক্রিয়া অন্য স্থানে আরও আরাম এনে দেয় মাকাকদের জীবনে। জাপানি আল্পসের জন্ম হয়েছিল আগ্নেয়গিরির মাধ্যমে যার অনেকগুলো এখনও সক্রিয়া আছে। এ কারণেই হেলস ভ্যালি বা নরকের উপত্যকা নামক একটি স্থানে জাপানি মাকাকরা পেয়েছে একটি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত পুকুরের সন্ধান যার তাপমাত্রা থাকে প্রায় ৪১ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। সবাই পুকুরে নামতে চায়। কিন্তু প্রাইমেটদের আদিম প্রবৃত্তি তা ঘটতে দেয় না, সকল যুগে সকল স্থানে রাজনীতি করতে পছন্দ করে এই মহান প্রাণী। সবচেয়ে উঁচু বর্ণগুলোর নারী ও শিশুরাই কেবল পুকুরটির স্বাচ্ছন্দ্য উপভোগ করতে পারে। একজন পুরুষ পুকুরের প্রবেশপথ পাহাড়া দেয়, সবাই তাকে মেনে চলে। নিচু বর্ণের বানরদের সব সময়ই তীব্র শীতে দাঁড়িয়ে অন্যের ঐশ্বর্য্য দেখতে হয়। তাদের সমাজ খুবই বিভক্ত। এই বিভক্তি খুব নিষ্ঠুর কারণ পুকুরের তুলনায় ৬০ ডিগ্রি কম তাপমাত্রার প্রতিবেশ মৃত্যুও ডেকে আনতে পারে।

আশার কথা যে পৃথিবীর অধিকাংশ প্রাইমেট প্রজাতিই বর্তমানে উষ্ণ ক্রান্তীয় বনাঞ্চলে বাস করে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় হচ্ছে গরিলা। তারা স্থায়ী পরিবার গঠন করে থাকে, পরিবারের প্রধান যথারীতি একজন পুরুষ যার পিঠের চামড়ার রং রুপালি। এ কারণে তাকে বলে সিলভারব্যাক গরিলা। একটি গরিলা পরিবারের সাথে পরিচিত হতে চলুন কঙ্গো অববাহিকা থেকে ঘুরে আসি। এই পরিবারে একজন পুরুষের অধীনে আছে পাঁচজন নারী ও তাদের শিশুরা। জঙ্গলের জংলী বিপদ থেকে সবাইকে বাঁচানোর দায়িত্ব পুরুষটির। তবে তার ব্যস্ততাও অনেক, বিশাল বপুকে তুষ্ট রাখতে দিনে ৩০ কেজি পর্যন্ত খাদ্য সাবাড় করতে হয় তাকে। খাবার মূলত উদ্ভিজ যদিও পশ্চিমাঞ্চলের গরিলারা উইপোকা খেতেও খুব ওস্তাদ। শিশুদেরকে বাবার তুলনায় অনেক কম খেতে হয় বলে তাদের হাতে বেশ কিছুটা সময় উদ্বৃত্ত থাকে। এই সময় তারা অতিবাহিত করে প্রাইমেটদের উদ্বৃত্ত শক্তির অন্যতম প্রধান বহিঃপ্রকাশটি ঘটিয়ে- যার নাম খেলাধুলা। এর প্রাপ্তি দ্বিবিধ- একে আনন্দ পাওয়া যায় তার উপর গড়ে ওঠে দীর্ঘমেয়াদী সম্পর্ক। মানুষেরও অন্যতম দীর্ঘস্থায়ী সম্পর্ক তথা বন্ধুত্ব কিন্তু অনেক সময় খেলাধুলার মাধ্যমে তৈরি হয়। খেলায় মত্ত বাচ্চাদের দিকেও নিয়মিত চোখ রাখে পুরুষ গরিলাটি। মাঝেমধ্যে তার অবশ্য দিবানিদ্রার প্রয়োজন পড়ে যাতে ব্যঘ্ন ঘটায় হয়ত কোন আর্তনাদের শব্দ। গরিলাদের বনে এমন আর্তনাদ শোনা যায় হরহামেশাই। এই গরিলার জমি হয়ত বনের সবচেয়ে ভাল জমিগুলোর একটি, কিন্তু তার প্রতিবেশী আছে আরও ৮টি গরিলা পরিবার। নিজের জমির আশপাশে যাতে অন্য কেউ ঘেঁষতে সাহস না পায় সেজন্য গরিলাকে মাঝেমধ্যেই বুক চাপড়িয়ে আর্তনাদ করতে হয়। বুক চাপড়ানোর শব্দ তার আধিপত্য জানান দিতে দিতে চলে যায় পাঁচ মাইল পর্যন্ত।

অন্যদিকে আবার খুব আড়ালপ্রিয় প্রাইমেটও আছে। সবচেয়ে ব্যতিক্রমী এক ধরণের প্রাইমেট দেখা যায় ইন্দোনেশিয়ার সুলাবিসিতে। এরা বাস করে স্ট্র্যাংলার ফিগ (যেমন, বটগাছ) গাছের বায়বীয় মূলের আড়ালে। উদ্ভিদের মাটির উপরে থাকা মূলগুলোকেই বায়বীয় মূল বলে। সুলাবিসির এই মূলবাসীদের পূর্বপুরুষরা দিবালোকের শিকারী হলেও পরে হয়ত তাদের মনে হয়েছে রাতের বেলা প্রতিযোগিতা কম। রাতে শিকার করতে করতে তারা হয়ে গেছে নিশাচর, তাই নাম হয়েছে ভুতুড়ে (স্পেকট্রাল) টারশিয়ার। রাতে প্রতিযোগিতা কম হলেও খাবারের পরিমাণ নেহায়েত কম নয়, পাওয়া যায় প্রচুর পোকামাকড়। টারশিয়ারই পৃথিবীর একমাত্র পরিপূর্ণ মাংসাশী প্রাইমেট। সাড়ে চার কোটি বছরের বিবর্তনের ইতিহাসে তাদের পরিবর্তন হয়েছে খুব কম। বিশাল গোলাকার চোখ দিয়ে তারা ক্ষীণতম আলোতেও দেখতে পারে। অক্ষিগোলক এত বড় যে তা এদিক ওদিক নড়াতে পারে না, অন্যদিকে দেখতে হলে পুরো ঘাড়ই ঘোরাতে হয়। কান অতিক্ষীণ শব্দও শুনতে পারে এবং শক্তিশালী পা দিয়ে তারা এক লাফে নিজের দৈর্ঘ্যের ৪০ গুণ দূরত্ব পেরিয়ে যায়। সন্ধ্যার পর পরিবারের সবাই শিকারে বেরিয়ে পড়ে। শিকার খুঁজে পেতে খুব একটা কষ্ট হয় না। কিন্তু সতর্ক থাকতে হয় সব সময়। মাত্র ৫ ইঞ্চি দৈর্ঘ্যের এই প্রাইমেটের জন্য সাপই হয়ে উঠতে পারে ভয়াবহ কোন জন্তু। যে বিপদ দেখে সে শব্দ করে অন্যদের সতর্ক করে দেয়, সবাই ফিরে যায় ঘরে, বিপদ শেষে আবার বেরিয়ে আসে। ভোরে ঘরে ফিরে বয়োজ্যেষ্ঠ নারী-পুরুষরা তীক্ষ্ণ শব্দ করে অন্যদের ডাকে। শব্দ অনুসরণ করে সবাই ফিরে এসে সেদিনের মত বিশ্রাম নেয়।

প্রাইমেট সমাজের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ভাল যোগাযোগ ব্যবস্থা। ভুতুড়ে টারশিয়াররা তীক্ষ্ণ শব্দ দিয়ে যোগাযোগ করলেও থাইল্যান্ডের বন-জঙ্গলে বসবাসকারী লার গিবনদের যোগাযোগ হয় সুরে সুরে, সম্ভবত তাদের চেয়ে সুরেলা যোগাযোগ আর কারও নেই। গানের সুর পল্লববিতানের কয়েক মাইল জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে সবাইকে জানিয়ে দেয় যে এই অঞ্চলটুকু তাদের।

অধিকাংশ প্রাইমেটদের চমৎকার বর্ণীল দৃষ্টিশক্তি আছে, বর্ণও যোগাযোগে সাহায্য করতে পারে। ফেয়ারের পত্রবানর একটি সুন্দর উদাহরণ। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এই বানরপ্রজাতির নাম রাখা হয়েছে ইংরেজ সেনা কর্মকর্তা আর্থার পার্ভস ফেয়ারের নামানুসারে যিনি প্রথম এদের সম্পর্কে লিখেছিলেন। বাংলাদেশেও ফেয়ারের বানর দেখা যায়। পূর্ণবয়স্ক ফেয়ারের বানরদের দেখতে বেশ নিষ্প্রভ লাগতে পারে কারণ তাদের গায়ের রং মেটে। কিন্তু মজার ব্যাপার হল তাদের শিশুদের গায়ের রং মোটেই তেমন নয়। শিশুদের গায়ে গাঢ় কমলা রঙের পশম থাকে বলে বাবা-মা সহজেই তাদের চোখে চোখে রাখতে পারে। নিকটাত্মীয় ও বন্ধু-বান্ধব মাকে বাচ্চা লালন-পালনে সক্রিয়ভাবে সাহায্য করে। অপেক্ষাকৃত অল্প বয়স্করাও এই সুযোগে শিশু প্রতিপালন শিখে নেয় যা তাদের ভবিষ্যৎ জীবনে কাজে লাগবে। এ কারণে, তাদের বাচ্চা কখনোই বেশি সময়ের জন্য একা থাকে না। কয়েক মাস বয়স হলে তাদের গায়ের রংও মায়ের মত ফ্যাকাসে হয়ে যায়। কিন্তু তার আগ পর্যন্ত সে থাকে সবার চোখের মণি।

মাদাগাস্কারের একটি প্রাইমেট প্রজাতির জন্য গন্ধও খুব গুরুত্বপূর্ণ। এদের নাম লেমুর। এদের নাক চোখা এবং ভেজা। মাদাগাস্কারের লেমুরদের দীর্ঘ নলাকার লেজ আছে বলে নাম হয়েছে রিং-টেইলড লেমুর, স্থানীয় নাম অবশ্য মাকি বা হিরা। পুরুষ মাকির কব্জিতে তীক্ষ্ণ প্যাড আছে যা দিয়ে তারা অল্প বয়স্ক গাছের কাণ্ডে আঁচড় কাটে। কব্জির গ্রন্থি থেকে একটি বিশেষ পদার্থ কাটা বাকলে ছড়িয়ে পড়ায় ঝাঁঝালো গন্ধ বেরোয়। এই গন্ধই তাদের জমির সীমানা জানান দেয়, অনেকটা গরিলাদের বুক চাপড়ানোর মত। নারী মাকিও নিজের মত করে গন্ধ বিলায়। তাদের ক্ষেত্রে অবশ্য জমির সীমানার পাশাপাশি গন্ধের আরেকটি তাৎপর্য আছে, তা হচ্ছে যৌন আবেদন। গন্ধ ছড়িয়ে বোঝায় সে এখন রতিক্রিয়ায় আগ্রহী কিন্তু ২৪ ঘণ্টা বা তারও কম সময়ের মধ্যে তার পুরুষ গ্রহণক্ষমতা বা আগ্রহ চলে যাবে। সুতরাং পুরুষরা বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। তারা লেজে গন্ধ মেখে আলতোভাবে নারী মাকির দিকে মেলে ধরে তাকে প্রলুব্ধ করতে। এত উত্তেজনা ও বিক্ষোভের মধ্যে কোন এক পুরুষ আড়ালে আবডালে চলে যায় তার খুব কাছে। নারীটি হয়ত প্রস্তুত কিন্তু ত্রস্তব্যস্ত। অগত্যা পুরুষটি কব্জির গ্রন্থি থেকে লেজে আরও সুগন্ধি মাখে। অবশেষে গন্ধে কাজ হয়, দুজনে একসাথে চলে যায় গোপন অভিসারে, লেজ দুলিয়ে পুরুষটি নিজের বিজয়বার্তা জানায়। অবশ্য মানুষের মত তাদের গোপন অভিসারটি অতোটা গোপন থাকে না। তাদের ক্ষেত্রে যৌনমিলনের আগ্রহ প্রকাশ হয়ত অনেক মানুষের চেয়ে একটু বেশিই সোজাসাপ্টা।

কিন্তু প্রাইমেটরা আরও জটিল যোগাযোগে সক্ষম। সবচেয়ে বড় উদাহরণ মা ও শিশুর সম্পর্ক যা দেখতে আমরা এবার যাব সুমাত্রার ঘনবর্ষণ বনভূমিতে। পর্যবেক্ষণ করব ওরাংওটাং-দের পারিবারিক জীবন। কোন মায়ের বয়স হয়ত দেখব চল্লিশের কোঠায়, তার ৫-৬ বছর বয়সী বাচ্চাকে সে এখনও আগলে রাখে। মানুষ বাদ দিলে সকল প্রাইমেটদের মধ্যে ওরাংরাই বাচ্চাকে সবচেয়ে বেশি সময় নিজের কাছে রাখে। গাছের আগায় জীবন ধারণের জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছু বাচ্চাকে শেখাতে তার নয় বছর লেগে যায়। বাচ্চাকে শিখতে হবে কিভাবে পিঁপড়া ও শূককীট সংগ্রহ করতে হয়, কিভাবে ২০০-রও বেশি খাওয়ার যোগ্য গাছ সনাক্ত করতে হয়, বিষাক্তগুলো কিভাবে এড়িয়ে চলতে হয় আর কিভাবেই বা ফল পেকেছে কিনা বোঝা যায়। বাচ্চার জানতে হবে গাছের কোন শাখাগুলো তার ওজন বহন করতে পারঙ্গম, কোন পোকার বাড়িতে আগ্রাসন চালালে ভয় নেই। পুরো জঙ্গলের একটি খাদ্যতালিকা বাচ্চাকে ধরিয়ে দিতে সময় লাগে। তাছাড়া কেবল খেতে শেখালেও চলে না, সুখে স্বাচ্ছন্দ্যে থাকতে হলে আরও কিছু জিনিস জানা চাই। জঙ্গলের নাম যেহেতু ঘনবর্ষণ বনাভূমি সেহেতু বোঝাই যাচ্ছে বৃষ্টি লেগেই থাকে, প্রায় প্রতিদিনই। ওরা আমাদের মত ছাতা আবিষ্কার করতে না পারলেও পাতা দিয়ে ছাউনি বানাতে শিখে নেয় মা-র কাছ থেকে। ৬ বছর বয়সেই একটি বাচ্চা বেশ ভাল ছাউনি বানাতে পারে, সে হয়ত ৫০ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকবে, যদি থাকে তাহলে মার কাছ থেকে শেখা সবকিছুই তার বাচ্চাকে শিখিয়ে যেতে হবে। তাই কেবল শিখলেই চলবে না, যা শিখেছে তা মনে রাখা প্রাইমেট জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ।

তবে পরিবেশকে কিভাবে নিজের প্রয়োজনে ব্যবহার করতে হয় তা শুধু জানলেই চলে না, কখন কাজে লাগাতে হবে তাও জানতে হয়। আফ্রিকার কেইপ উপদ্বীপে আমরা এর খুব ভাল প্রায়োগিক উদাহরণ দেখতে পাব। এর চেয়ে দক্ষিণে কোন বানর বসতি স্থাপন করতে পারেনি। খাদ্য সংকট কাটিয়ে উঠতে এখানকার চাকমা বেবুনরা নিজেদের যোগাযোগ কৌশলের চমৎকার দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। প্রচুর উদ্ভিজ্জ খাবার থাকলেও এই মাটিতে পুষ্টি উপাদানের সংকট রয়েছে। সুতরাং সাধারণ খাবার অনেক খেলেও যথেষ্ট হয় না। তবে সৌভাগ্যের কথা হচ্ছে উপদ্বীপ বিধৌত সামুদ্রিক পানিতে পুষ্টির কোন অভাব নেই। যে কারণে চাকমা বেবুনরা হয়ে উঠেছে জোয়ার-ভাটা বিশেষজ্ঞ এবং খুব সময় সচেতন। প্রতি দুই সপ্তাহ পরপর তেজ কটালের ভাটার সময় খুব পুষ্টিকর একটি খাবার সংগ্রহের সুবর্ণ সুযোগ আসে তাদের। পূর্ণিমা ও অমাবস্যার সময় পৃথিবী, সূর্য ও চাঁদ এক রেখায় আসে বলে জোয়ার-ভাটার প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়ে, একেই বলে তেজ কটাল। এই সময়কার ভাটার সময় পানির স্তর অনেক নিচে নেমে যাওয়ায় তীর থেকে সমুদ্রের দিকে অনেকটা এগিয়ে যেতে পারে বেবুনরা, যেখানে পাওয়া যায় হাঙরের ডিম। একেকটি ডিম খুব ছোট হলেও তাদের সংখ্যা এত বেশি ও একেকটি এত পুষ্টিকর যে এতেই বেবুনদের কাজ হয়ে যায়। কোন দিন কতক্ষণ ধরে এই তেজ কটালের ভাটা থাকবে তা তাদের অন্তঃস্থ করা আছে, জোয়ারের আগে আগে আবার ঠিক বাড়ির কাছে ফিরে এসে গতানুগতিক খাবার ঝিনুকে মনোযোগ দেয়। ঝিনুকের কখনোই অভাব পড়ে না, প্রতিদিন প্রতিটি জোয়ারের ধাক্কায় অনেক ঝিনুক তীরে আসে, ভাটার সময় যা আরাম করে খাওয়া যায়। বেবুনদের শক্তিশালী চোয়াল ও ধারালো কর্তন দাঁত আছে যা ঝিনুকের খোলস ভাঙার জন্য উপযুক্ত। সমুদ্রতীরের এই জীবনে যথেষ্ট খাবার সংগ্রহের জন্য বশ মানাতে হয় সময়কে।

কিছু খাবার আবার নেহায়েত পড়ে থাকলেই খাওয়া যায় না, দরকার পড়ে কুশলী হাত আর তীক্ষ্ণ মেধার। কোস্টা রিকার উপকূলে ম্যানগ্রোভ বনের মধ্যে বাস করা সাদামুখো কাপুচিন সম্ভবত সমগ্র আমেরিকার সবচেয়ে বুদ্ধিমান বানর। তারাও জোয়ার-ভাটার খবর রাখে, তবে তাদের লক্ষ্য ভেনাস-ঝিনুক বা ক্ল্যাম। কাপুচিনরা খুব ছোট ও খোলস ভাঙার মত শক্তি তাদের নেই, কিন্তু আছে মেধা যা দিয়ে কার্যসিদ্ধির এক চতুর উপায় বের করেছে তারা। তা হচ্ছে ঝিনুকটি দিয়ে শক্ত কিছুকে বারবার আঘাত করতে থাকা। এর মাধ্যমে খোলস ভেঙে যাক তা তারা চায় না, আঘাত ও গাছের গুড়ির সাথে ঘষাঘষি করতে থাকলে একসময় খোলস দুর্বল হয়ে যায় এবং সহজেই ভেতরটা বেরিয়ে আসে। সমস্যাটি সমাধানে সেই পুরাতন চেষ্টা, ভুল ও পুনরায় চেষ্টার নিয়মই তাদের কাজে দিয়েছে।

ওদিকে ব্রাজিলে বসবাসকারী তাদের এক নিকটাত্মীয় এই কৌশলকে আরও একধাপ এগিয়ে নিয়ে গেছে। এদের নাম বাদামী থোপার কাপুচিন। মাথায় মাঝেমধ্যে এক গুচ্ছ পশম থাকে বলে এমন নাম। শারীরিক শক্তিকে উন্নত মানের বুদ্ধিমত্তার সাথে মিলিয়ে এরা যন্ত্র বানাতেও শিখে গেছে। যন্ত্র অবশ্য খুবই সাধারণ- তাল ভাঙার উপযোগী পাথর। তালটি কোন পাথরের উপর রেখে আরেক পাথর দিয়ে বাড়ি দিয়ে ভাঙতে পারে তারা। কোন কোন পাথরের ভর এমনকি বানরটির নিজের ভরের প্রায় অর্ধেক। যন্ত্র ছাড়া এই তালের খোলস ভাঙা অসম্ভব হতো।

তবে মানুষ বাদ দিলে প্রাইমেটদের মধ্যে যন্ত্রপাতির সবচেয়ে সূক্ষ্ণ ব্যবহারের দৃষ্টান্ত দেখাতে পারে শিম্পাঞ্জিরা। আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই যে সমগ্র বিশ্বে এরাই আমাদের সবচেয়ে নিকটত্মীয় প্রজাতি। সবচেয়ে সূক্ষ্ণ ব্যবহারটি বোধহয় কাঠি দিয়ে পিঁপড়া শিকার। পিঁপড়ার বাসস্থানের সামনে তারা এমনভাবে একটি কাঠি বা পাতার কাণ্ড ধরে রাখে যে পিঁপড়ারা স্থির অবলম্বন ভেবে তার উপর চড়ে বসে। কাঠিতে অনেক পিঁপড়া উঠে আসার পর কাঠিটি চেটে একবারে সবগুলো পিঁপড়া খেয়ে নেয়, তারপর আবার ফাঁদ পাতে। পশ্চিম আফ্রিকার গিনির বোসু নামক স্থানের জঙ্গলে বসবাসকারী একটি শিম্পাঞ্জি গোষ্ঠীর মধ্যে একেবারে ব্যতিক্রম কিছু বৈশিষ্ট্য দেখা গেছে। যেমন, তারা তালগাছের পাতা কাণ্ডশুদ্ধো ভেঙে তা দিয়ে গুতিয়ে গুতিয়ে গাছের ভেতরকার সুস্বাদু ও পুষ্টিকর শাঁস বের করে আনে। শিম্পাঞ্জিরা এসব দক্ষতা পরবর্তী প্রজন্মকে শিখিয়েও যায়। সাধারণত ৮ বছরের আগেই শিশুরা প্রয়োজনীয় সবকিছু শিখে নেয়।

তবে তাদের সবচেয়ে আকর্ষণীয় দক্ষতা হচ্ছে খোসা ছাড়িয়ে বাদাম খাওয়া। এর জন্য যে চপল আঙুল, হাত ও চোখের যোগসাজোশ আর বুদ্ধিমত্তার প্রয়োজন তার পুরোটাই আছে ওদের। এদিক থেকে তারা বাদামী কাপুচিনদের থেকেও বেশ কয়েক ধাপ এগিয়ে। কারণ তারা শিখে ফেলেছে, শক্ত বাদামটিকে সঠিক জায়গায় রেখে, সঠিক ওজনের একটি পাথরের টুকরো দিয়ে ঠিক কত জোরে আঘাত করলে খোসা ভাঙবে কিন্তু ভেতরের বাদাম অক্ষত থাকবে। এক্ষেত্রে তাদের যন্ত্রের ব্যবহার যেমন নিখুঁত তেমনি সূক্ষ্ণ। শিম্পাঞ্জিরা অনেক দয়ালু জীব। বাদাম জোগাড়ের পর হয়ত কেউ দেখল তার হাতে কোন সঠিক আকারের পাথরের টুকরো নেই যা দিয়ে ভাঙা যাবে, তাকে ঠিকই পাথরের টুকরো ধার দিতে প্রস্তুত থাকবে অন্য কোন শিম্প। ভাগাভাগি করা, পরীক্ষা-নিরীক্ষা, অন্যের আবেগ-অনুভূতির সঙ্গে একাত্ম হওয়া, পরিকল্পনা, বুদ্ধিমত্তা- মানুষের এই চিরায়ত বৈশিষ্ট্যগুলোকে কেবলই আমাদের সম্পত্তি ভাবা আসলে স্বার্থপরের মতো আচরণ, প্রাইমেটদের সাথে জিন ভাগাভাগি কেবল নয়, অনেক তথাকথিত মানবীয় বৈশিষ্ট্যও ভাগাভাগি করি আমরা।

তবে অবশ্যই প্রাইমেটদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি উদ্ভাবনী প্রতিভা আমাদের। এতোটাই উদ্ভাবনী যে আমরা নিজেদেরকে প্রকৃতি থেকে আলাদা করতে জন্ম দিয়েছি একগাদা ধর্ম আর ঈশ্বরের। কিন্তু পরিশেষে আমাদের আবিষ্করণী প্রতিভারই জয় হয়েছে, অনেক দেরিতে হলেও বুঝতে পেরেছি আমরা প্রকৃতির খুব ব্যতিক্রমী উৎপাদ কেবল, প্রকৃতি থেকে আলাদা কিছু নই। প্রাণবৃক্ষের একটি সুদীর্ঘ উপশাখাবহুল শাখা- প্রাইমেট পরিবারেরই সদস্য আমরা। এই পরিবারের সবাই শিখে নিয়েছে কিভাবে নিজেদের বহুল কষ্টে অর্জিত জ্ঞান প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে বাঁচিয়ে রাখতে হয়। যে পরিবার টিকে আছে মা এবং শিশুর অভূতভূর্ব বন্ধনের জোড়ে।

প্রাইমেটনামা

প্রাইমেট বর্গের অনেকগুলো প্রাণীর সাথেই আমরা পরিচিত হয়েছি। তাদের অনন্য এবং সাধারণ বৈশিষ্ট্য সবই জেনেছি। এবার কয়েকটি প্রশ্নকে সামনে রেখে ব্যাপারটাকে একটু গুছিয়ে আনা যাক। যেমন, প্রাইমেট একটি বর্গের নাম- এই কথার অর্থ কী? পৃথিবীর কোন অঞ্চলগুলোতে প্রাইমেটদের দেখা যায়? ঠিক কোন কোন বৈশিষ্ট্য থাকলে কোন প্রাণীকে প্রাইমেট বর্গের অন্তর্ভুক্ত করা হবে? প্রাইমেটদের শ্রেণীবিভাগ কিভাবে করা হয় এবং কোন প্রাণী কোন শ্রেণীতে পড়ে? একটি সাধারণ পূর্বপুরুষ থেকে বর্তমানে ৩৫০ টিরও বেশি প্রাইমেট প্রজাতির উদ্ভব কিভাবে ঘটেছে অর্থাৎ তারা কোন পথে বিবর্তিত হয়েছে? আমরা কতোটা অনন্য?

সাধারণ এবং বিশেষ বৈশিষ্ট্যের আলোকে প্রতিটি প্রাণী বা উদ্ভিদকে বিভিন্ন শ্রেণীতে ভাগ করে ফেলা যায়। জীববিজ্ঞানে এমন বিভক্তির সুনির্দিষ্ট নীতিমালাও আছে যা বুঝতে হলে আমাদের সহজ জীববিজ্ঞান পাঠ শুরু করতে হবে শ্রেণীবিন্যাসবিদ্যা বা ট্যাক্সোনমি দিয়ে। প্রথমেই জীবজগৎকে বিভিন্ন রাজ্যে বিভক্ত করা হয়, সকল উদ্ভিদের রাজ্যকে বলে প্ল্যান্টি বা প্ল্যান্টাই, আর প্রাণীর রাজ্যের নাম অ্যানিমেলিয়া। অ্যানিমেলিয়া রাজ্যের অনেকগুলো পর্ব আছে। যেসব প্রাণীর দেহে জীবনের কোন না কোন পর্যায়ে নটোকর্ড নামে একটি বস্তু থাকে তাদেরকে কর্ডাটা পর্বের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। মেরুদণ্ডী প্রাণীদের ক্ষেত্রে এই নটোকর্ডই পরবর্তীতে মেরুদণ্ডে পরিণত হয়। কর্ডেটদের মধ্যে যেসব প্রজাতির নারীরা বাচ্চাদের বুকের দুধ পান করায় তাদের নাম স্তন্যপায়ী বা ম্যামাল। স্তন্যপায়ী শ্রেণীর মধ্যে মোট ২২টি বর্গ আছে যার একটি হল প্রাইমেট।

প্রাইমেট নেই এমন স্থান খুঁজে পাওয়া বোধহয় খুব কষ্টকর হবে। কারণ আমরা নিজেরাও প্রাইমেট, জল-স্থল-অন্তরীক্ষ সর্বত্র নিজেদের অস্তিত্বের ছাপ রেখে আমরা প্রাইমেট বর্গকে বেশ গর্বিতই করেছি বলা যায়। তীব্র গরম, তীব্র শীতল, ভয়ানক শুষ্ক- এমন কোন স্থান নেই যেখানে মানুষ বেঁচে থাকতে পারে না। তবে অপেক্ষাকৃত ছোট্ট মস্তিষ্কের প্রাইমেটরা সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়তে পারেনি। যে কারণে একেক প্রজাতিকে পাওয়া যায় একেক স্থানে। প্রাইমেটদের প্রায় ২৮টি প্রজাতিই বাস করে মাদাগাস্কারে, যার সবগুলোই লেমুর। এর বাইরে মধ্য আমেরিকা, দক্ষিণ আমেরিকা, আফ্রিকা এবং এশিয়া মহাদেশের প্রতিটিতে গড়ে ৫০ টি করে প্রাইমেট প্রজাতির বাস। মানুষ ছাড়া ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা এবং অস্ট্রেলিয়াতে কোন স্থানীয় প্রাইমেট প্রজাতি নেই। আকার-আকৃতির দিক থেকেও প্রাইমেটরা খুব বৈচিত্র্যময়। একদিকে ইঁদুর লেমুরের ভর মাত্র ৮০ গ্রাম, অন্যদিকে আবার পাহাড়ি গরিলার ভর এদের প্রায় ২০০০ গুণ। তবে আকার-আকৃতি যাই হোক না কেন প্রাইমেটরা সাধারণত ক্রান্তীয় অঞ্চলে বাস করে। সব ধরণের ক্রান্তীয় অঞ্চলে এদের দেখা গেলেও শতকরা ৮০ ভাগের বাসস্থান ক্রান্তীয় ঘনবর্ষণ বনভূমি তথা রেইনফরেস্টে।

প্রাইমেট জীবনের অর্থ

ঠিক কি কি বৈশিষ্ট্য থাকলে কোন প্রাণীকে প্রাইমেট বলা হবে তা নিয়ে বিতর্ক আছে। এদের শরীর অন্য অনেক প্রাণীর তুলনায় কিছুটা প্রাগৈতিহাসিক বা আর্কায়িক প্রকৃতির হলেও অনেক বৈশিষ্ট্য আবার অন্যদের সাথে মিলে যায়। তারপরও শিকাগো ফিল্ড মিউজিয়ামের বিজ্ঞানী রবার্ট মার্টিন আমাদের প্রাইমেট জীবনের একটা সংজ্ঞা দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছেন। তার সংজ্ঞার বেশ কিছু তাৎপর্যপূর্ণ বৈশিষ্ট্য আমরা ইতিমধ্যে আলোচনা করে ফেলেছি, এমনকি কিছু বৈশিষ্ট্যের জ্বলজ্যান্ত উদাহরণও দেখেছি। তারপরও এক করে ফেলার সুবিধার্থে আবার দেখে নেয়া যাক:

প্রাইমেটদের হাত এবং পায়ের পাতা কোন কিছু আঁকড়ে ধরতে পারে, এজন্য তাদের হাত এবং পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুল সাধারণত অপোজেবল তথা আঁকড়ে ধরার উপযুক্ত হয়। এর একমাত্র ব্যতিক্রম মানুষ, আমাদের পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুল আঁকড়ে ধরার ক্ষমতা বিসর্জন দিয়ে এমন রূপ ধারণ করেছে যাতে পা সমগ্র শরীরের জন্য একটি প্লাটফর্ম হিসেবে কাজ করতে পারে। এজন্যই আমরা খাঁড়া হয়ে হাঁটতে পারি আর গাইতে পারি- চির উন্নত মম শির। আধুনিক প্রাইমেটদের পায়ের আঙুলে তীক্ষ্ণ নখরের পরিবর্তে থাকে সুবোধ নখ, আর হাত ও পায়ের আঙুলের প্যাড বা আবরণীটা খুব প্রশস্ত যাতে গাছের ডাল থেকে ফসকে পড়ে না যায়। কিছু প্রাইমেটের অবশ্য নখরও আছে, ঐ যে বললাম- সংজ্ঞায়নে কিছু সমস্যা থেকেই যায়।

প্রাইমেটদের চলনে মূল ভূমিকা রাখে পশ্চাৎপদ। যে যেভাবেই চলুক না কেন সকল প্রাইমেটকে চলনের জন্য নির্ভর করতে হয় পশ্চাৎপদ বা মানুষের ক্ষেত্রে শুধু পায়ের উপর। বানর পরিপূর্ণ চতুষ্পদী জীব, চার হাত-পায়ে ভর করে গাছ বা ভূমিতে চলাচল করে। গিবন খুব দক্ষ ব্র্যাকিয়েটর, অর্থাৎ পেন্ডুলামের মত দুই হাত দিয়ে গাছের এক শাখা থেকে আরেক শাখায় লাফিয়ে লাফিয়ে চলে। ওরাং ওটাং ও গাছে চড়ায় খুব দক্ষ, কিন্তু গিবনদের মত দুই হাতে চলার পরিবর্তে তারা চার হাত-পা ব্যবহার করে। গরিলা শিম্পাঞ্জির মতোই আঙুলের গাঁটের উপর ভর করে হাঁটে, তারা বানরের মতো হাতের তালু প্লাটফর্মে বসিয়ে ভারসাম্য রক্ষার বদলে শরীরের ভার ছেড়ে দেয় আঙুলের গাঁটের উপর। টারশিয়াররা চার হাত-পা দিয়ে গাছের কাণ্ড বা ডাল বেয়ে বেয়ে উঠানামা করতে পারে। তবে যে যেভাবেই হাটুক পশ্চাৎপদের মুখ্য ভূমিকা অস্বীকার করার উপায় নেই কারও। এদের শরীরের ভারকেন্দ্রে পশ্চাৎপদের খুব কাছে বা তা থেকে একটু উপরে। এজন্যই দেহের পেছনের অংশের তুলনায় সামনের অংশ একটু অগ্রগামী। এর অর্থ হচ্ছে প্রাইমেটদের দেহ এমনিতেই একটু উল্লম্ব থাকতে চায়। সুতরাং বলা যায়, চতুষ্পদী থেকে দ্বিপদী প্রাণী হওয়াটাকে আমরা অনেক সময় যতোটা অস্বাভাবিক বা ব্যতিক্রমী মনে করে থাকি তা আসলে ঠিক নয়।

সাধারণ স্তন্যপায়ীদের তুলনায় প্রাইমেটদের দর্শন ক্ষমতা খুব বেশি কিন্তু ঘ্রাণ ক্ষমতা আবার কম। একমাত্র প্রাইমেটদেরই চোখ দুটি সামনের দিকে যে কারণে তাদের দৃষ্টিশক্তি ঘনছকীয় বা স্টেরিওস্কোপিক। অর্থাৎ আমাদের দুটি চোখ একই ছবির দুটি আলাদা আলাদা ছবি তুলে মস্তিষ্ক পাঠায়, মস্তিষ্ক সেটা বিশ্লেষণ করে একটি ছবি গঠন করে। অগ্রমুখী দুটি চোখ থাকার কারণেই সেই একক ছবির গভীরতা বা তাতে বিভিন্ন বস্তুর আপাত দূরত্ব বুঝতে পারি আমরা। মাথার পাশ থেকে চোখ দুটি সামনে চলে আসায় এবং ঘ্রাণ ক্ষমতা অপেক্ষাকৃত কম হওয়ায় প্রাইমেটদের নাক ছোট। একই সাথে প্রাইমেটদের ছেদন ও পেষণ দন্তের সংখ্যা কম। দাঁত প্রাইমেট গবেষণায় খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ প্রাইমেট দেহে দাঁত খুব শক্ত এবং তা অনেকদিন পর্যন্ত সংরক্ষিত থাকে। জীবাশ্ম গবেষণায় তাই দাঁত অমূল্য সম্পদ। প্রতি পাটির বামের ও ডানের দাঁতগুলো একই রকমের। পাটির মাঝ থেকে যেকোন দিকের দাঁতগুলোকে যথাক্রমে ছেদন, কর্তন, প্রাক-পেষণ ও পেষণ দন্ত বলে। প্রোসিমিয়ান ও নতুন দুনিয়ার বানরদের ক্ষেত্রে এদের সংখ্যা যথাক্রমে ২.১.৩.৩, কিন্তু পুরনো দুনিয়ার বানরদের ক্ষেত্রে ৩.১.৪.৩, আবার সিয়ামাংদের ক্ষেত্রে ২.১.২.৩।

প্রাইমেটদের মস্তিষ্ক সাধারণ স্তন্যপায়ীদের তুলনায় অনেক বড় যার অন্যতম কারণ তাদের উন্নত দৃষ্টিশক্তি। এ কারণে তাদের বুদ্ধিমত্তাও বেশি। অবশ্য প্রাইমেটদের মধ্যেও বানর ও নারবানরদের তুলনায় লেমুর, লোরিস ও প্রোসিমিয়ানদের মস্তিষ্ক বেশ ছোট। ওদিকে আবার দেখা গেছে যেসব প্রাণীর মস্তিষ্ক বড় তাদের জীবনেতিহাসও ভিন্ন রকমের হয়। মস্তিষ্ক ও দেহের ভরের অনুপাতকে এনসেফালাইজেশন কোশেন্ট বা উন্মস্তিষ্কতা অনুপাত বলে। এই অনুপাত যাদের বেশি তাদের গড় আয়ু বেশি কিন্তু প্রজনন ক্ষমতা কম। সাধারণ স্তন্যপায়ীরা যেখানে তড়িৎ গতিতে জীবন যাপন করে দ্রুত মারা যায়, প্রাইমেটরা সেখানে ধীরে সুস্থে জীবনটাকে উপভোগ করে।

আমাদের যৌথ পরিবারের বিচিত্র সব সদস্য

আকাশের তারাই বলি আর পৃথিবীর প্রাণীই বলি- শ্রেণীবিন্যাস থেকে কারও নিস্তার নেই। প্রাইমেট একটি বর্গের নাম যার অর্থ আমরা ইতিমধ্যে জানি। তবে জীববৈজ্ঞানিক শ্রেণীবিন্যাস বর্গে এসেই থেমে যায় না। বর্গকেও আরও অনেক ভাগে ভাগ করা হয়।

প্রাইমেট বর্গের দুটি উপবর্গ আছে: স্ট্রেপসিরাইনি এবং হ্যাপ্লোরাইনি। গ্রিক ভাষায় এদের অর্থ হচ্ছে যথাক্রমে মোচড়ানো নাক ও সরল নাক। স্ট্রেপসিরাইন-দের নাক একই সাথে মোচড়ানো এবং ভেজা, অন্যদিকে হ্যাপ্লোরাইন তথা আমাদের নাক সরল ও শুষ্ক। প্রাইমেটদের সাথে পরিচিত হওয়ার সময়ই আমরা দেখেছি লেমুরদের নাক সিক্ত অর্থাৎ তারা স্ট্রেপসিরাইন। এখন পর্যন্ত যাদের সাথে পরিচিত হয়েছি আমরা তাদের মধ্যে একমাত্র লেমুরই স্ট্রেপসিরাইন, এই উপবর্গে আরও আছে লোরিস ও তাদের সগোত্রীয়রা। মজার ব্যাপার হচ্ছে মাদাগাস্কারে মানুষ ছাড়া সকল প্রাইমেটই স্ট্রেপসিরাইন।

হ্যাপ্লোরাইনি উপবর্গকে আবার দুটি অববর্গে ভাগ করা হয়: সিমিফর্মিসটারশিফর্মিস। টারশিফর্মিসের সদস্য হচ্ছে টারশিয়াররা, আমরা ইতিমধ্যে ভুতুড়ে টারশিয়ারদের কথা জেনেছি। টারশিয়ার এবং লেমুর, লোরিস ও তাদের সমগোত্রীয় সবাইকে একসাথে প্রোসিমিয়ান বা প্রাক-বানরসদৃশ বলা হয়। অনেক সময় আবার এদেরকে লোয়ার বা নিম্ন প্রাইমেটও বলা হয়। অন্যদিকে সকল সিমিফর্মিস প্রাইমেটদের বলা হয় আপার বা উর্ধ্ব প্রাইমেট বা সিমিয়ান (বানরসদৃশ)।

সিমিফর্মিস অববর্গকে দুটি অণুবর্গে ভাগ করা যায়: ক্যাটিরাইনিপ্ল্যাটিরাইনি। প্ল্যাটিরাইনি অণুবর্গের মাঝে পড়ে সকল নতুন দুনিয়ার বানর। এমন নাম হওয়ার কারণ হচ্ছে, এদেরকে কেবলই মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকা তথা ইউরোপীয়দের চোখে তথাকথিত নতুন দুনিয়ায় পাওয়া যায়। আমাদের পরিচিত সাদামুখো কাপুচিন ও বাদামী থোপার কাপুচিন যে নতুন দুনিয়ার বানর তা নিশ্চয়ই এরই মধ্যে বুঝে ফেলেছেন, কারণ তাদের বাসস্থান যথাক্রমে কোস্টা রিকা ও ব্রাজিল। মারমোসেট ও হাওলার বানরও নতুন দুনিয়ার বানর।

ক্যাটিরাইনি অণুবর্গকে ভাগ করা হয় দুটি অধিপরিবারে: হোমিনয়ডিয়াসার্কোপিথেকয়ডিয়া। মানুষ সহ সকল নরবানর হোমিনয়ডিয়া অধিপরিবারের অন্তর্ভুক্ত। সার্কোপিথেকয়ডিয়ার সদস্যদের বলা হয় পুরনো দুনিয়ার বানর কারণ তারা বাস করে কেবল আফ্রিকা এবং এশিয়ায়। আমাদের পরিচিত সকল বেবুন ও মাকাক পুরনো দুনিয়ার বানর। আমরা ইতিমধ্যে ইথিওপিয়ার হামাড্রায়াস বেবুন, আফ্রিকার কেইপ উপদ্বীপের চাকমা বেবুন এবং জাপানি মাকাকদের সাথে পরিচিত হয়েছি। এছাড়া বাংলাদেশে যে ফেয়ারের পত্রবানর পাওয়া যায় বলেছিলাম তারাও পুরনো দুনিয়ার বানর।

হোমিনয়ডিয়া অধিপরিবারকে দুটি পরিবারে ভাগ করা হয়: হোমিনিডাইহইলোব্যাটিডাই। হাইলোব্যাটিডাই পরিবারের সদস্যদের ক্ষুদ্র নরবানর বা লেসার এইপ বলা হয়। যেমন: গিবন। থাইল্যান্ডের সঙ্গীতপ্রেমী লার গিবনদের সাথে আমাদের পরিচয় হয়েছে।

হোমিনিডাই হচ্ছে সেই বিখ্যাত সিমিয়ানদের দল যাদেরকে আমরা শুধু হোমিনিড বা গ্রেট এইপ বলে ডাকি। বাংলা বলা যেতে পারে বৃহৎ নরবানর। মানুষ, গরিলা, শিম্পাঞ্জি এবং ওরাংওটাং- এই নিয়ে হোমিনিডদের পরিবার। তবে এদেরকেও আরও ভাগ করা প্রয়োজন। হোমিনিডাই পরিবারকে দুটি উপপরিবারে ভাগ করা হয়: হোমিনিনাই এবং পঞ্জিনাই। পঞ্জিনাই উপপরিবারের সদস্যরাই ওরাংওটাং। সুমাত্রার ঘনবর্ষণ বনভূমিতে এমনই এক ওরাং-এর সন্তান প্রতিপালনে একাগ্রতা দেখে আমরা মুগ্ধ হয়েছিলাম।

হোমিনিনাই উপপরিবারকে ভাগ করে পাওয়া যায় দুটি গোত্র: হোমিনিনি ও গরিলিনি। নাম শুনেই বোঝা যাচ্ছে গরিলারা গরিলিনি গোত্রের সদস্য। যাদেরকে এক সময় খুব নির্দয়ভাবে আমরা ভুল ব্যাখ্যা করেছিলাম। প্রচার করা হয়েছিল গরিলাদের মত নৃশয়স ও ভয়ংকর প্রাণী নাকি আর নেই, অথচ তারা মূলত তৃণভোজী, কেউ কেউ সর্বোচ্চ পোকামাকড় খায়। এক রুপালি পিঠওয়ালা পুরুষ গরিলার বুক চাপড়িয়ে নিজের অস্তিত্ব জানান দেয়ার কাহিনী আমরা আগে শুনেছি। একটা বিষয় ভুলে গেলে চলবে না, গরিলা ও মানুষ একই গোত্রের না হলেও একই উপপরিবারের।

শ্রেণীবিন্যাসের প্রায় শেষ প্রান্তে আমরা নিজেদের সবচেয়ে নিকটাত্মীয়ের কথা শুনবো। এদের নাম শিম্পাঞ্জি। তারা আমাদের একই গোত্রের প্রজাতি, হোমিনিনি। হোমিনিনি গোত্রের সকলকে সাধারণভাবে হোমিনিন বলার চল রয়েছে। হোমিনিনি গোত্রে দুটি গণ রয়েছে: হোমো এবং প্যান। প্যান গণের সদস্যরা শিম্পাঞ্জি এবং বনবো। আর হোমো গণে আছে মানুষ এবং মানুষের অনেক পূর্বপুরুষ। আমরা জানি ট্যাক্সোনমিতে গণ এবং প্রজাতি একসাথে করে একটি প্রাণীর দ্বিপদী নাম রাখা হয়। আমাদের দ্বিপদী নাম: হোমো স্যাপিয়েন্স যা নির্দেশ করে- আমাদের গণের নাম হোমো আর প্রজাতির নাম হোমো স্যাপিয়েন্স। তবে মানুষ নিয়ে খুব বেশি এখানে বলবো না, যেহেতু আমাদের ভবিষ্যৎ আলোচনার পুরোটা জুড়েই থাকবে মানুষ ও তার পূর্বপুরুষদের কথা। এখানে বরং যৌথ পরিবারে আমাদের সবচেয়ে আপন প্রজাতিটির মানবিকতা নিয়ে কিছু বলা যাক।

বিবিসি, ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক বা ডিসকভারি চ্যানেলের কল্যাণে এখন নেচার সিনেমাটোগ্রাফি বা প্রকৃতির চিত্রগ্রহণ একটি আলাদা পেশার মর্যাদা পেয়ে গেছে। সিনেমার চিত্রগ্রহণের চেয়ে এটি কোন অংশেই কম আকর্ষণীয় নয়। ডেভিড অ্যাটেনব্রো অনন্যসাধারণ লেখনী আর অন্তর্ভেদী ধারাবর্ণনার মাধ্যমে প্রকৃতির প্রামাণ্য চিত্রকে একটি শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছেন। বিবিসি-র লাইফ সিরিজের “প্রাইমেট” পর্বে তিনি বর্ণনা করছিলেন কিভাবে একজন তরুণ চিত্রগ্রাহক তার জীবনে প্রথমবারের মত শিম্পাঞ্জিদের ক্যামেরায় ধারণ করতে গিয়ে তাদের সাথে একাত্ম হয়ে পড়েন।

প্রাইমেটদের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ব্যবহারগুলো ভিডিও করার জন্য বিবিসি টিমকেও প্রয়োগ করতে হয়েছিল তাদের নিজস্ব সর্বোচ্চ প্রাইমেট গুণাবলী। যন্ত্রপাতি ব্যবহারের দক্ষতা প্রাইমেটদের কতদূর নিয়ে গেছে তার একটা পরীক্ষা হয়ে যাচ্ছিল সেদিন। শিম্পাঞ্জি ও আমাদের শতকরা ৯৯ ভাগ জিন একই রকম। গাছের ঢালে ঘুমন্ত একটি শিম্পাঞ্জির ঠোঁট নড়া দেখে মনে হচ্ছিল সে বুঝি স্বপ্ন দেখছে। জাস্টিন ইভান্স আগে কখনো শিম্পাঞ্জিদের সান্নিধ্যে আসেনি। একজন অভিজ্ঞ প্রাইমেটবিজ্ঞানী তাকে বোঝাচ্ছিল কেমন ব্যবহার করা উচিত এই বনবাসীদের সাথে। না, আহামরী কোন সতর্কতার প্রয়োজন নেই, সহজ স্বাভাবিক থাকাই যথেষ্ট, তাদের চোখের দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকলে ওরা বিরক্ত হয়। আর বিরক্ত হলে সমস্যা, কারণ ভিডিও করতে চাইলেই করা যাবে ব্যাপারটা এমন না। শিম্পাঞ্জিরা যদি ক্যামেরার সামনে আসতে না চায় তাহলে চোখের নিমেষেই উধাও হয়ে যাবে। কোন কোন শিম্প আবার বাচ্চাদের মত কাঠি দিয়ে খোঁচাতে পারে জাস্টিনকে, সেটা কেবলই দুষ্টামি, মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা।

জাস্টিন স্বল্প আলোয় ক্যামেরা তাক করে শিম্পাঞ্জিদের পিঁপড়া ধরা ভিডিও করার চেষ্টা করছিল। যতোটা ধীরস্থিরভাবে শিম্পরা কাঠিটি ধরে ছিল পিঁপড়ার বাসার সামনে ততোটা স্থিরতার সাথে ক্যামেরা ধরে রাখাটাই হয়ে উঠেছিল তার জন্য চ্যালেঞ্জ। শিম্পাঞ্জিরা বেশ দ্রুতই ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল বিবিসি টিমের সাথে। নিজেদের চলচ্ছবি ক্যামেরায় দেখে মানুষের যন্ত্র ব্যবহারের কারিশমায় তারাও হয়তো মুগ্ধ হয়েছিল। জাস্টিন শিম্পাঞ্জিদের সাথে সবচেয়ে বেশি একাত্মতা বোধ করে তাদের ভাগাভাগি করার প্রবণতা ও মায়া দেখে। বাদামের খোসা ভাঙার জন্য নারী শিম্পাটি পাথরের উপযুক্ত কোন টুকরা খুঁজে পাচ্ছিল না। পুরুষটি তাকে নিজের পাথর ধার দেয়। তবে তারা সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল কখন শিম্পরা গাছের গুড়িতে লাথালাথি করে শব্দ করে। অনেকটা গাছের গুড়িতে পা দিয়ে ঢোল বাজানোর মত ব্যাপার। ভিডিওর জন্য অনেকটা সময় তার শিম্পাঞ্জিদের সাথে থাকতে হয়েছিল। এই কয়দিনে সে গ্রামের প্রায় প্রতিটি শিম্পাঞ্জিকে আলাদা আলাদাভাবে চিনে ফেলেছিল। প্রত্যেকের আলাদা ব্যক্তিত্ব আর মুখভঙ্গি তাকে আবিষ্ট করেছিল। প্রাইমেট নিয়ে এত গবেষণা হয়েছে যে, তাদের সামাজিক জীবন সম্পর্কে আমরা অনেকেই কিছু না কিছু জানি। কিন্তু সামনে থেকে তাদের দেখতে পারাটা হয়ে ওঠে জাস্টিনের সারা জীবনের সম্পদ।

আজ থেকে প্রায় ৬৫ লক্ষ বছর পূর্বে আমাদের এবং শিম্পাঞ্জিদের বিবর্তনের পথ আলাদা হয়ে যায়। এর মধ্যে অনেক অনেক নতুন প্রজাতির জন্ম হয়েছে, বিলুপ্ত হয়ে গেছে অনেকে। কিন্তু আজকেও আমাদের সবচেয়ে নিকট সম্পর্কের প্রজাতি রয়ে গেছে শিম্পাঞ্জি। আজ থেকে ৩০ হাজার বছর পূর্বেও মানুষের একাধিক প্রজাতি পৃথিবীতে জীবিত ছিল, আমাদের সেই আপন ভাইয়েরা সবাই প্রকৃতির সংগ্রামে হেরে গেছে। বেঁচে আছে কেবল আমাদের এক মাসতুতো ভাইয়ের দল- শিম্পাঞ্জি। নিজেদের অনন্যতার বাহাদুরি না করে শিম্পাঞ্জিদের সাথে একাত্মতা এবং সামগ্রিকভাবে গোটা বিশ্বপ্রকৃতির সাথে একাত্মতা পোষণই হোক আমাদের ভবিষ্যৎ। দার্শনিকদের শিক্ষা যদি সত্য হয়ে থাকে তাহলে বলতে দ্বিধা নেই যে, এই পথ অনুসরণ করলে আমরা কোনদিন মূলোৎপাটিত হব না।

তথ্যসূত্র
১। বিবিসি টিভি সিরিজ ‘লাইফ’ এর শেষ পর্ব: ‘প্রাইমেটস‘। ধারাবর্ণনা করেছেন ডেভিড অ্যাটেনব্রো। [এই প্রামাণ্য চিত্রের ধারা বিবরণী আমি হুবহু অনুবাদ করেছি অনেক স্থানে]
২। রজার লিউয়িন, “Human Evolution: An Illustrated Introduction”, ৫ম সংস্করণ। অধ্যায় ১০: Primate Heritage