প্রথম পর্ব

২য় পর্ব

৩য় পর্ব

৪র্থ পর্ব

৫ম পর্ব

৬ষ্ঠ পর্ব

৭ম পর্ব

৮ম পর্ব

৯ম পর্ব

১০ পর্ব

১১ পর্ব

১২ পর্ব

১৩ পর্ব

আবুল কাশেম

নানা কারণে এই ধারাবাহিক রচনাটি কিছুদিনের জন্য স্থগিত ছিল। বাকী অংশ এখন নিয়মিত প্রকাশের আশা রাখছি।

[রচনাটি এম, এ, খানের ইংরেজি বই থেকে অনুবাদিত “জিহাদঃ জবরদস্তিমূলক ধর্মান্তরকরণ, সাম্রাজ্যবাদ ও ক্রীতদাসত্বের উত্তরাধিকার” গ্রন্থের ‘ইসলামি ক্রীতদাসত্ব’ অধ্যায়ের অংশ এবং লেখক ও ব-দ্বীপ প্রকাশনের অনুমতিক্রমে প্রকাশিত হলো।]

ইসলামি ক্রীতদাসত্ব, খণ্ড ২০

লেখক: এম, এ, খান

ইসলামে ক্রীতদাসদের প্রতি মানবিক আচরণ

এটা সত্য যে, ইসলাম ক্রীতদাসদের প্রতি মানবীয় আচরণ করার জন্য মুসলিমদেরকে তাগিদ দিয়েছে। কোরানের উপরোক্ত আয়াত মুসলিমদেরকে কয়েকটি কারণে ক্রীতদাস মুক্তকরণে উৎসাহিত করেছে, যেমন অনিচ্ছাকৃতভাবে কোনো মুসলিমকে (বিধর্মীকে নয়) হত্যার দায়মোচনের উপায় হিসেবে। ইসলামে ক্রীতদাস মুক্তিকে দেখা হয় দয়াশীলতা বা পাপের প্রায়শ্চিত্তরূপে। এসব যুক্তির ভিত্তিতে ইসলামের কৈফিয়তদাতারা দাবি করে: ‘এটা বলা ঠিক নয় যে, ইসলাম দাসপ্রথা প্রতিষ্ঠিত করেছে বা দাসপ্রথার জন্য ইসলাম দায়ী। বরং সত্য হলো: ইসলামই প্রথম ধর্ম, যা দাসপ্রথা বিলুপ্তির জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল’ (ব্যক্তিগত যোগাযোগ)। এই শিবিরে যোগ দিয়ে পেনসিলভেইনিয়া স্টেইট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক জোনাথন ব্রোকোপ লিখেছেন:

অন্যান্য সংস্কৃতি ক্রীতদাসের ক্ষতি করতে মালিকের অধিকার সীমাবদ্ধ করেছে, কিন্তু খুব কম সংস্কৃতিই মালিককে ক্রীতদাসের প্রতি সদয় আচরণের নির্দেশ দেয়; আর ক্রীতদাসরা যে সমাজের দুর্বল লোকদের অন্তর্ভুক্ত, যারা সুরক্ষা পাওয়ার দাবিদার − এরূপ বিধান কোরানের বাইরে কোথাও পাওয়া যায় না। অতএব, কোরানের অনন্য অবদান পাওয়া যায় সমাজে ক্রীতদাসদের অবস্থান ও ক্রীতদাসদের প্রতি সমাজের দায়-দায়িত্ব নির্ধারণের মধ্যে, যা সে সময়ে ছিল সম্ভবত ক্রীতদাস প্রথার সবচেয়ে প্রগতিশীল বিধান।[২২২]

ক্রীতদাসদের প্রতি সদ্ব্যবহার ও তাদেরকে মুক্ত করার বিষয়ে ইসলামের নির্দেশে নতুন কিছু নেই। উল্লেখ করা হয়েছে যে, ইসলামের আবির্ভাবের প্রায় হাজার বছর আগে বুদ্ধ তাঁর অনুসারীদেরকে ক্রীতদাসদের প্রতি ভাল আচরণ করতে ও তাদেরকে দিয়ে অতিরিক্ত কাজ না করাতে উপদেশ দিয়েছিলেন। এথেন্সে গ্রিক রাষ্ট্রনায়ক ও রাজনৈতিক সংস্কারক সোলোন (আনুমানিক ৬৩৮-৫৫৮ খ্রি. পূ.) ঋণের কারণে ক্রীতদাসকরণ চর্চা বিলুপ্ত করে অধ্যাদেশ জারি করেছিলেন, যখন ঋণগ্রস্ততার জন্য ঋণীকে ক্রীতদাস করা ছিল ক্রীতদাসের বড় উৎস।

ইসলামের আবির্ভাবের প্রায় হাজার বছর আগে গ্রিসে দাসমুক্তির চর্চা প্রচলিত ছিল। খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দ ও তার পরবর্তীকালের পাথরে খোদাইকৃত লিখনে ক্রীতদাস মুক্তির প্রমাণ রয়েছে গ্রিসে। তৎকালে সম্ভবত স্বেচ্ছাকৃতভাবে দাস মুক্ত করতো মালিকরা (প্রধানত পুরুষ মালিক; হেলেনিক যুগ থেকে নারী মালিকও)। স্বাধীনতার বিনিময়পণ স্বরূপ ক্রীতদাসরা তাদের সঞ্চয় ব্যবহার করতে পারতো, অথবা বন্ধু কিংবা মালিকের নিকট থেকে ঋণ নিতে পারতো।[২২৩]

সুতরাং ইসলামে নির্দেশিত ক্রীতদাসদের সাথে ভাল আচরণ করা বা তাদেরকে মুক্ত করে দেওয়ার বিষয়ে কোনো নতুনত্ব নেই। হাজার বছর আগে গ্রিসে এরূপ মহানুভবতার চর্চা ছিল। ইসলামের প্রায় দ্বাদশ শতাব্দী পূর্বে সোলোন এথেন্সে ক্রীতদাসকরণের সবচেয়ে বড় উপায়টি নিষিদ্ধ করেছিলেন। এমনকি আরবাঞ্চলেও মুহাম্মদের জীবনকালে বা তার আগে ক্রীতদাস মুক্ত করার চর্চা অনুপস্থিত ছিল না, নিম্নোক্ত হাদিসটি যার প্রমাণ বহন করে (বোখারী ৩:৪৬:৭১৫):

হিসাম জানান: আমার পিতা আমাকে বলেন যে, হাকিম বিন হিজাম ইসলামপূর্ব অজ্ঞতার (জাহেলিয়া) যুগে একশ’ ক্রীতদাস মুক্ত করেছিল এবং একশ’ উট জবাই করেছিল (সেগুলোর মাংস সবার মাঝে বিলিয়ে দিতে)। ইসলাম গ্রহণ করার পর তিনি পুনরায় একশ’ উট জবাই করেন ও একশ’ ক্রীতদাসকে মুক্তি দেন। হাকিম বলেন, আমি আল্লাহর নবিকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘হে আল্লাহর নবি, আমি অজ্ঞতার যুগে যেসব ভাল কাজ করতাম, আমার বিবেচনায় তখন তা সঠিক ছিল, সেগুলোর কী হবে বলে আপনি মনে করেন?’ আল্লাহর নবি জবাব দেন, ‘তুমি ইসলাম গ্রহণ করেছো তোমার সেসব ভাল কাজগুলো সঙ্গে নিয়েই।’

কাজেই ইসলাম প্রতিষ্ঠার পূর্বেও সপ্তম শতাব্দীর আরব সমাজে ক্রীতদাসদের প্রতি ভাল আচরণ ও ক্রীতদাস মুক্ত করার প্রচলন অবশ্যই ছিল। মুহাম্মদ নিজেও ইসলাম প্রচার শুরু করার ১৫ বছর পূর্বে পৌত্তলিক থাকাকালীন তাঁর একমাত্র ক্রীতদাস জায়েদকে মুক্ত করে দেন; এমনকি তিনি জায়েদকে পোষ্যপুত্র হিসেবেও গ্রহণ করেন। পৌত্তলিক মুহাম্মদের এ বদান্যতা ও মনুষ্যোচিত আচরণ স্পষ্টতই ইসলামপূর্ব আরব সমাজে বিদ্যমান প্রথা ও সংস্কৃতিরই প্রতিফলন। সুতরাং দাসপ্রথায় ইসলাম বা মুহাম্মদ নতুন কোনো মানবিক বিষয় সংযোজন করেনি।

[আগামী পর্বে আলোচিত হবেঃ ইসলাম দাসপ্রথার প্রসার ঘটায়]

সূত্রঃ
222. Brockopp JE (2005) Slaves and Slavery, in The Encyclopedia of the Qur’ an, McAuliffe JD et al. ed., EJ Brill, Leiden, Vol. 5, p. 56-60

223. Slavery in Ancient Greece, Wikipedia, http://en.wikipedia. org/wiki/Slavery-in-Ancient-Greece

ইসলামি ক্রীতদাসত্ব, খণ্ড ২১

ইসলাম দাসপ্রথার প্রসার ঘটায়

ইসলাম দাসপ্রথার প্রবর্তন করেনি, বরং বহুকাল ধরে প্রচলিত প্রথাকে প্রসারিত হস্তে আলিঙ্গন করে একে অনন্তকালের জন্য স্বর্গীয় বৈধতা প্রদান করে এবং এর চর্চাকে নজিরবিহীন মাত্রায় বাড়িয়ে দেয়। ইসলাম দাসপ্রথার দরজা বন্ধ করে কিংবা এর অবলুপ্তিতে প্রথম পদক্ষেপ নেয়, এমন দাবি উত্থাপন করা নিতান্তই ভিত্তিহীন প্রয়াস। কোরানে আল্লাহ মানবজাতির কল্যাণে তাঁর স্বর্গীয় পরিকল্পনার অংশ হিসেবে বারংবার দাসপ্রথার অনুমোদন ব্যক্ত করেছেন। ইসলামের বিধানে বিশ্বে যতদিন মানবজাতির অস্তিত্ব থাকবে ততদিন দাসপ্রথা চলতে থাকবে। শুধু তাই নয়, ইসলাম তার জন্মলগ্নেই দাসপ্রথা চর্চা প্রসারিত করেছিল, যা পরবর্তী শতাব্দীগুলোতে আরো জঘন্য অবস্থায় উপনীত হয়।

নবি মুহাম্মদ বানু কোরাইজা, খাইবার ও বানু মুস্তালিক (বোখারী ৩:৩৬:৭১৭) গোত্রের পুরুষদেরকে নিধন করার পর তাদের নারী ও শিশুদেরকে ক্রীতদাস বানিয়েছিলেন। যতদিন পর্যন্ত না পশ্চিমা’রা দাসপ্রথায় নিজস্ব সম্পৃক্ততা ছিন্ন করে মুসলিমদের রাগ, হতাশা, এমনকি প্রচণ্ড বিরোধিতা সত্ত্বেও মুসলিম বিশ্বে দাসপ্রথা চর্চা নিষিদ্ধ করার জন্য চাপ প্রয়োগ করে, ততদিন যুগের পর যুগ ধরে মুসলিম ধর্মযোদ্ধারা নবির এ দৃষ্টান্তকে আদর্শ কার্যপ্রণালিরূপে অব্যাহত রাখে।

নবি কীভাবে বানু কোরাইজা, মুস্তালিক ও খাইবারের ইহুদিদেরকে হত্যার পর তাদের নারী-শিশুকে ক্রীতদাস বানিয়েছিলেন, সে বিষয়টিও বিবেচনা করতে হবে। মুহাম্মদের জীবনকালে আরব উপদ্বীপে এমন জঘন্য নিষ্ঠুরতম ও বর্বর ঘটনা আর ঘটেনি। ইসলামের ইতিহাস জানায় যে, বারাকাত নামে এক আবিসিনীয় বালিকা ছিল মুহাম্মদের পিতার একমাত্র ক্রীতদাসী; সে যুগে মক্কার বড় বড় নেতাদের ডজন ডজন ক্রীতদাস রাখার তথ্য পাওয়া যায় না। নবির প্রথম স্ত্রী খাদিজার বড় ব্যবসা থাকা সত্ত্বেও জায়েদ ছিল তার একমাত্র ক্রীতদাস, বিয়ের পর যাকে তিনি উপহার স্বরূপ দিয়েছিলেন মুহাম্মদকে। তখনো পৌত্তলিক মুহাম্মদ জায়েদের ক্রীতদাসত্ব মোচন করে দিয়ে তাকে নিজ পুত্ররূপে গ্রহণ করেন।

পৌত্তলিক জীবনের পরবর্তী ১৫ বছর মুহাম্মদের কোনোই ক্রীতদাস ছিল না। অথচ গিয়াসউদ্দিন মোহাম্মদ খোন্দামিরের ‘রাউজাত-উস-সাফা’র তালিকা অনুযায়ী, মুসলিম ও ইসলামের নবিরূপে জীবনের পরবর্তী ২৩ বছরে মুহাম্মদ ৫৯ জন ক্রীতদাস ও ৩৮ জন চাকরের মালিক হন। মুহাম্মদের অন্তরঙ্গ সাহাবা জুবায়ের মৃত্যুর সময় ১,০০০ ক্রীতদাসের মালিক ছিলেন।[২২৪]

পৌত্তলিক অবস্থায় মুহাম্মদ ও সম্ভবত জুবায়ের কোনো ক্রীতদাসের মালিক ছিলেন না। কিন্তু ইসলামে প্রবেশের পর তাঁরা গণ্ডা-গণ্ডা থেকে হাজার সংখ্যক ক্রীতদাসের মালিক হন। এসব উদাহরণ এটা স্পষ্ট করে তোলে যে, দাসপ্রথা বিলুপ্তির পদক্ষেপ গ্রহণের পরিবর্তে ইসলামের নবি ও অন্তরঙ্গ সাথীরা নিজেরাই আরবে পূর্বের তুলনায় অনেক বেশি মাত্রায় দাসপ্রথাকে উন্নীত করেছিলেন। ব্যাপকহারে ক্রীতদাস আটকের জন্য ইসলাম একটা অত্যন্ত নিষ্ঠুর ও বর্বর পন্থারও সূচনা করে, অবশ্য স্বর্গীয় অনুমোদনের ছত্রছায়ায়, যেরূপ ঘটনা ইসলামপূর্ব তৎকালীন আরবে দেখা যায়নি।

[আগামী পর্বে আলোচিত হবেঃ দাসপ্রথা ধর্মীয় ও ঐতিহাসিকভাবে ইসলামের অবিচ্ছেদ্য অংশ]

সূত্রঃ
224. Lal (1994), p. 13

ইসলামি ক্রীতদাসত্ব, খণ্ড ২২

দাসপ্রথা ধর্মীয় ও ঐতিহাসিকভাবে ইসলামের অবিচ্ছেদ্য অংশ

ইসলামে দাসপ্রথা চর্চার ব্যাপক অস্তিত্বের অস্বীকৃতি এবং দাসপ্রথা বিলুপ্তিতে ইসলামের প্রথম পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি সত্ত্বেও, ইসলামে দাসপ্রথা তর্কাতীতভাবে স্বর্গীয় অনুমোদনপ্রাপ্ত একটি প্রথা, যা মানবজাতি অবলুপ্ত না হওয়া পর্যন্ত বৈধ থাকবে। ইসলামি মতবাদ অনুযায়ী, দাসপ্রথা আল্লাহর অনন্তকালীন পরিকল্পনার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত, যা মানবজাতির প্রতি তার স্বর্গীয় অনুকম্পা। ইসলামি আইনের সকল শাখা, শরীয়ত ও গোটা ইতিহাসব্যাপী সকল ইসলামি পণ্ডিত দ্ব্যর্থহীনভাবে গর্বের সঙ্গে দাসপ্রথাকে ইসলামের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশরূপে গ্রহণ ও প্রচার করে গেছেন। মুসলিমরা যখন আফ্রিকাকে ক্রীতদাস শিকার ও প্রজননের খামারে রূপান্তরিত করেছিল, তখন বিখ্যাত ইসলামি চিন্তাবিদ ইবনে খালদুন বিধর্মীদেরকে এরূপে ব্যাপকহারে ক্রীতদাসকরণকে উল্লসিতচিত্তে গ্রহণ করেন। লুইস লিখেছেন: ক্রীতদাস প্রথার চর্চায় ‘মুসলিমরা ধর্মীয় গ্রন্থ, আইন (শরীয়ত) ও ঐতিহ্য (সুন্নত) দ্বারা অনুমোদিত একটা বিধান প্রতিপালন করছিল; এবং এটা তাদের দৃষ্টিতে এমন একটি বিধান ছিল, যা মুসলিম জীবনের সামাজিক অবকাঠামো রক্ষার জন্য প্রয়োজন ছিল।’[২২৫] হিউজেস যথার্থই বলেন: ‘(ইসলামে) বিবাহ আইন, বিক্রয় আইন ও উত্তরাধিকার আইনের সঙ্গে দাসপ্রথা পরস্পর বিজড়িত এবং এর বিলুপ্তি মুহাম্মদী বা ইসলামি বিধানের একেবারে গোড়ায় আঘাত হানবে।’[২২৬]

মুসলিমদের দ্বারা আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গদেরকে ব্যাপকহারে ক্রীতদাসকরণকে ইবনে খালদুন ন্যায়সঙ্গত ভাবতেন, কেননা তার মতে: ‘তাদের প্রকৃতি ছিল অনেকটা বোবা পশুর মতো।’[২২৭] মুসলিম ঐতিহাসিকদের লেখায় ক্রীতদাসকরণ, বিশেষত তথাকথিত বর্বর কৃষ্ণাঙ্গদেরকে, একটা গর্বের বিষয় হয়ে উঠে। তারা এটাকে একটা মহানুভবতার কাজ বলেও মনে করতো, যা সেসব অসভ্য মানুষগুলোকে তাদের বর্বর প্রকৃতি ও পাপপূর্ণ ধর্ম থেকে মুক্ত করে ইসলামের সত্য-ধর্মে ও সুসভ্য জগতে আনয়ন করতো। ধার্মিক ইসলামি চিন্তাবিদদের এরূপ চিন্তা-চেতনা সম্বন্ধে আর্নল্ড লিখেছেন: ‘…ধার্মিক মন ক্রীতদাসকরণকে ঈশ্বর-কর্তৃক তাদেরকে ধর্মের পথে পরিচালনারূপে দেখে।’[২২৮]

নীল নদের উজানের দেশগুলো থেকে নিগ্রোদেরকে ব্যাপকহারে ক্রীতদাস বানিয়ে ইসলামে ধর্মান্তরিত করা হতো। তাদেরকে গণহারে খোজা করে দূর-দেশে স্থানান্তর করা হতো, এবং সে প্রক্রিয়ায় তাদের অধিকাংশই (৮০-৯০ শতাংশ) প্রাণ হারাতো। আটলান্টিক পার হয়ে যাদেরকে নতুন বিশ্বে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, তাদের ক্ষেত্রে ‘উপকূলের কেন্দ্রগুলোতে নিয়ে যাবার পথে, সমুদ্র পাড়ি দেওয়ার পূর্বে অপেক্ষার সময় ও আমেরিকায় যাওয়ার পথে সমুদ্রে ৩০-৫০ শতাংশ প্রাণ হারায়।’ ইউরোপীয় বণিকদের হাতে পরার পর, নতুন বিশ্বে গমনকারী ক্রীতদাসদের মাঝে মৃত্যুর হার ছিল ১০ শতাংশের মতো।[২২৯]

ইসলামি চিন্তা-চেতনায় বিপুলহারে বন্দিদের এ দুঃখজনক মৃত্যু বা ধ্বংসকেও দেখা হতো মহানুভবতা ও ঈশ্বরের অনুকম্পারূপে, যে বিষয়ে আর্নল্ড লিখেছেন: ‘তাদের আকস্মিক দুর্ঘটনার মাধ্যমে ঈশ্বর তাদেরকে দর্শন দিয়েছেন। তারা বলতে পারে ‘এটা ছিল তাঁর অনুকম্পা’, যেহেতু তারা রক্ষাকারী ধর্মে প্রবেশ করেছে।’[২৩০] আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গদেরকে ব্যাপকহারে ক্রীতদাসকরণের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে অনেক ধর্মীয় মানসিকতার পশ্চিমা ইতিহাসবিদরাও মুসলিম চিন্তা-চেতনার এ সুর প্রতিধ্বনিত করেন। বার্নার্ড লুইস পশ্চিমাদের সে চেতনা তুলে ধরেন এভাবে:

‘দাসপ্রথা মানবজাতির জন্য স্বর্গীয় আশীর্বাদ, যার মাধ্যমে পৌত্তলিক ও বর্বর মানুষরা ইসলামে ও সভ্যতায় আনীত হয়েছিল… প্রাচ্যে দাসপ্রথার চর্চা হাজার হাজার মানুষের উপর (মানবিকভাবে) উন্নতকরণমূলক প্রভাব রেখেছে; এবং এর জন্য লাখ-লাখ মানবাত্মাকে এ পৃথিবীতে জীবনযাপন করতে হবে আদিম বন্যদের মতো, বন্য জানোয়ারের চেয়ে সামান্য ভাল অবস্থায় (অর্থাৎ ক্রীতদাস হিসেবে)। এটা অন্তত তাদেরকে মানুষে পরিণত করেছে, অর্থপূর্ণ মানুষও।[২৩১]

এরূপ স্বর্গীয় অনুমোদন, প্রকৃতপক্ষে অনুপ্রেরণা, কৃষ্ণাঙ্গদেরকে ব্যাপকহারে ক্রীতদাসকরণে আফ্রিকার আরব মুসলিমদেরকে এমনভাবে উদ্বুদ্ধ করেছিল যে, ‘তারা নিজেদেরকে পুরোপুরি বাণিজ্যে ও ক্রীতদাস শিকারে উৎসর্গ করেছিল’, এবং এজন্য জনগণ তাদেরকে ক্রীতদাস-ব্যবসায়ীরূপে ঘৃণা ও ভয় করতো, লিখেছেন আর্নল্ড।[২৩২] ইতিমধ্যে উল্লেখ করা হয়েছে যে, মরক্কোতে সুলতান মৌলে ইসমাইলের (মৃত্যু ১৭২৭) ক্রীতদাস উৎপাদনের খামার ছিল। আফ্রিকার সুদান অঞ্চলে কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাস উৎপাদনের খামার বিদ্যমান থাকে উনবিংশ শতাব্দীতেও। কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাস বিক্রির জন্য গরু-ভেড়ার মতো সেসব খামারে কৃষ্ণাঙ্গ শিশুদের জন্ম দেওয়া হতো। গোরী শাসক আবু আল-হারিথ মোহাম্মদ ইবনে আহমদের জন্য ৯৮২ সালে লিখিত পারস্য ভৌগলিক পান্ডুলিপি ‘হুদুদ-আল-আলম’ সুদান সম্পর্কে লিখেছে: ‘এর চেয়ে কোনো অঞ্চল অধিক জনবহুল ছিল না। ব্যবসায়ীরা সেখানে শিশুদের চুরি করে উঠিয়ে নিয়ে যেতো। তারা তাদেরকে খোজা করে মিশরে নিয়ে বিক্রি করতো।’ দাসপ্রথা এমন এক স্তরে পৌঁছে গিয়েছিল যে, উক্ত দলিলে লিখিত আছে, ‘তাদের মধ্যে এমন লোকও ছিল, যারা একে অপরের সন্তানকে চুরি করতো এবং দাসব্যবসায়ীরা এলে তাদের কাছে বিক্রি করে দিতো।’[২৩৩]

মুসলিমরা আফ্রিকার সমাজে দাসপ্রথাকে এমন গভীর ও ব্যাপকভাবে বিজড়িত করে দিয়েছিল যে, ইউরোপীয়রা, বিশেষ করে ইউরোপীয় মিশনারিরা, তাদেরকে মুক্ত করার চেষ্টা করলে ক্রীতদাসরা তাদের ভাগ্য নিজের হাতে তুলে নেয়ার ঝুঁকি বা পরীক্ষা গ্রহণের চেয়ে পূর্বতন মালিকের অধীনে থেকে যাওয়াই শ্রেয় মনে করতো। মধ্য-আফ্রিকায় ব্রিটিশদের প্রথম তিন বছরের শাসনের উপর এক রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়: দাসব্যবসা হয়ে দাঁড়িয়েছে ‘শ্বেতাঙ্গদের কাছে একটা প্রতিদ্বন্দ্বী ধরণের সভ্যতার মতো, যা নিগ্রো মানসিকতায় গ্রহণ করে নেওয়া অনেক সহজ।’[২৩৪] আফ্রিকায় ক্রীতদাসকরণ এমন ব্যাপকতর পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল যে, বি. ডি. ডেভিস দু:খ করে বলেন: ‘আফ্রিকা শব্দটি দাসপ্রথার সমার্থক হয়ে উঠেছিল, যার কারণে বিশ্ব তাতার ও কৃষ্ণসাগর অঞ্চলীয় অন্যান্য মুসলিমদের দ্বারা লক্ষ লক্ষ ইউক্রেনীয়, জর্জীয়, সার্কাসীয়, আর্মেনীয়, বুলগেরীয়, স্লাভ ও তুর্কি জনগণকে বিক্রির বিষয়টি বেমালুম ভুলে যায়।’[২৩৫] দশম শতাব্দীতে ভলগা তীরের বাণিজ্যকেন্দ্র থেকে মুসলিম ব্যবসায়ীরা সবচেয়ে চাহিদার ও মূল্যবান যে পণ্যটি আমদানি করতো তা ছিল শ্বেতাঙ্গ ক্রীতদাস, যাদেরকে কেনা হতো সাধারণত ভাইকিংদের কাছ থেকে।

[আগামী পর্বে আলোচিত হবেঃ

[আগামী পর্বে আলোচিত হবেঃ ইসলামি দাসপ্রথার বিশেষ নিষ্ঠুরতা]

সূত্রঃ
225. Lal (1994), p. 175

226. Hughes, p. 600

227. Lal (1994), p. 80

228. Ibid

229. Curtin, p. 182

230. Arnold TW (1999) The Preaching of Islam, Kitab Bhavan, Delhi, p. 416-17
231 Lal (1994), p. 60

232. Arnold, p. 172-73, 345-46

233. Lal (1994), p. 133

234. Gann, p. 196

235. Lal (1994), p. 61
————–

চলবে—