আমরা যারা বিবর্তনবাদ, যুক্তিবাদ নির্ভর চিন্তাধারা রাখি, আমাদের জানা যে এই জীবকুল,মানব সমাজ ভগবানের দ্বারা তৈরি নয়। হুট করে মানুষকে ঈশ্বর তৈরি করে নি। মানুষ এসেছে একটা বিবর্তনীয় ধারায় সেই দিক থেকে চিন্তা করলে সব মানুষই সমান, কেউ ঈশ্বর পেরিত সন্তান হতে পারে না। কিন্তু যুগে যুগে বিভিন্ন ধর্মে লক্ষ্য করেছি কিছু ধূর্ত, অতিচালাক, মানব সমাজে প্রভাব সৃষ্টিকারী ব্যক্তি নিজেকে ঈশ্বরের পেরিত সন্তান হিসাবে দাবী করে নানা অলৌকিক কাহিনী সৃষ্টি করে মানব সমাজে নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করে গেছে।

সেই অলৌকিক কাহিনীগুলি যীশু, হজরত মহম্মদ থেকে শুরু করে অনেক ধর্ম পুরুষদের সাথে জড়িয়ে আছে।

তবে আজ আমি যাকে নিয়ে আলোচনা করব তিনি বাংলার হিন্দুদের মধ্যে প্রভাব সৃষ্টিকারী তথাকথিত অলৌকিক শক্তিধর পুরুষ রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব।

উনাদের নিয়ে আমি তেমন আলোচনা করার মতো তেমন প্রয়োজনবোধ করি না। কারণ আমি যখন উনাদের জীবনী পড়তে যাই তখন অলৌকিক ঘটনাগুলি বিন্দুমাত্র বিশ্বাস হওয়া তো দূরে থাক রীতিমত হাস্যকর পাগলামি বলে মনে হয়।
অথচ সাধারণ মানুষ তো বটেই অনেক উচ্চ শিক্ষিত ডক্টরেট ডিগ্রিধারী মানুষও যখন এদের অলৌকিক ক্রিয়াকলাপগুলি বিশ্বাস করে তখন দু:খই হয়।

রামকৃষ্ণ যখন তার ধর্মীয় ভাবধারা প্রচার করতে শুরু করেন, তখন বাংলা তথা ভারতে ধর্ম বিপ্লব চলছে। ধর্মীয় গুড়ামী, কুসংস্কার, অমানবিকতার বিরুদ্ধে এবং যুক্তিবাদী সমাজ গঠনের লক্ষ্যে বাংলা তথা ভারতবর্ষে ব্রাক্ষ সমাজ সহ অনেক সংগঠন সক্রিয় ছিল। রামকৃষ্ণ কিভাবে এই সংগঠনগুলিকে ধ্বংসের পরিকল্পনা করেন তা পরবর্তীতে আলোচনা করব।

যাইহোক, যার কর্মময় জীবনটাই অলৌকিকতায় ভরা তার জন্মকে অলৌকিকতায় ভরে দেওয়া হবে তা তো স্বাভাবিকই।

যেমন যিশুর বেলায় দেখি কুমারী মায়ের গর্ভে জন্ম নেওয়া যীশুকে ঈশ্বরের পুত্র বলে চালানোর চেষ্টা, সেইরকম রামকৃষ্ণের বেলায় ও ব্যতিক্রম নয়
যাইহোক প্রথম জন্ম দিয়ে শুরু করি তারপর না হয় কর্মে যাব।

১৮৩৫ খ্রী: রামকৃষ্ণের বাবা ক্ষুদিরাম তীর্থ ভ্রমণে যান। স্বামীর অবর্তমানে রামকৃষ্ণের মা চন্দ্রাদেবী স্বপ্ন দেখলেন একটি জ্যোতির্ময় মূর্তি তার শয্যায় রয়েছেন! তার ঘুম ভেঙ্গে গেল। কিন্তু তখনও তিনি যেন ঐ জ্যোতির্ময় মূর্তি দেখতে পেলেন। মনে হল কে যেন দরজা ভেঙ্গে তার শয়ন কক্ষে ঢুকছে। তিনি তাড়াতাড়ি উঠে আলো জ্বালেন। কিন্তু দেখলেন, দরজায় খিল দেওয়া আছে, ঘরে কেউ নেই।

এরপর একদিন তিনি প্রতিবেশী ধ্বনি কামরানী সঙ্গে শিব মন্দিরে শিব বিগ্রহের সম্মুখে দাঁড়িয়েছিলেন। শিব বিগ্রহ থেকে একটি জ্যোতির্ময় শিখা বিচ্ছুরিত হয়ে তীর-বেগে তার দিকে ছুটে আসলো। এ সম্পর্কে ধ্বনীকে তিনি কিছু বলার আগেই তিনি সংজ্ঞা হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন। ধ্বনি তার চোখে মুখে জল দিয়ে তার মূর্ছা ভাঙ্গিয়ে তাকে ঘরে আনলো। সে তার কাছে আনুপূর্বক ঘটনা শুনে ভাবলো চন্দ্রার মাথায় অসুখ হয়েছে। কিন্তু চন্দ্রাদেবী ভাবলেন তিনি সন্তান সম্ভব্য হয়েছেন।
এইভাবে অলৌকিকতার মধ্য দিয়ে ১৮৩৬ খ্রী: ১৮ই ফেব্রুয়ারি তারিখে জন্ম হয় গদাধরের (রামকৃষ্ণের) (ঠাকুর রামকৃষ্ণের জীবন ও বাণী – স্বরূপানন্দ – পৃ: ৮)

এইবার বুঝুন ঠেলা, গর্ভসঞ্চারের কি সুন্দর ব্যাখ্যা! এইভাবে যদি ভগবানের গর্ভসঞ্চারের ক্ষমতা থাকতো তাহলে পৃথিবীতে পুরুষ প্রাণীর কোন প্রয়োজন থাকত না। সব পুরুষ প্রাণীগুলি প্রাকৃতিক নির্বাচনে বিলুপ্তির পথে ধাবিত হত।
আমার মনে হয় এইসব ধর্ম-পুরুষদের পাশে এইসব কাহিনী জুড়ে তাদের অপমানিত করেছে তাদের শিষ্যরা।
উপরিউক্ত ঘটনা হাস্যকর তো বটেই। আর যদি তা বিন্দুমাত্র সত্যি হয় তা হলে নারীর কোকিলা-চরণের একটা আভাস পাওয়া যাচ্ছে।
যীশু বা রামকৃষ্ণের জন্মের অলৌকিকতা দান করতে গিয়ে রীতিমত তাদের অবৈধ সন্তানের পর্যায়ে নিয়ে এসেছেন তাদের শিষ্যরা।

রামকৃষ্ণকে যেভাবে দয়ালু সবধর্মে বিশ্বাসী বলে সর্বস্তরে প্রচার করা হয়। আসলে তিনি কতটুকু দয়ালু ছিলেন যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ রাখে।
উনার জীবনী পড়তে গিয়ে আমার মনে হয়েছে তিনি ছিলেন চরম বর্ণ বিদ্বেষী, ব্রাহ্মণ্যবাদী। দু একটা ঘটনা দিয়ে উদাহরণ দেই –

রামকৃষ্ণ ছিলেন দারিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারের ছেলে। চরম দারিদ্র্যের কারণে তার ভাই রামকুমার দক্ষিণেশ্বর কালী মন্দিরের পৌরহিত্য গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নেন। অথচ সেই মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা রাণী রাসমণি ছিলেন তথাকথিত শূদ্র বংশের। ভাইয়ের শূদ্রের মন্দিরের পৌরহিত্য গ্রহণ করার তীব্র বিরুধী ছিলেন রামকৃষ্ণ। প্রতিবাদ করতে গিয়ে তিনি রামকুমারকে বলেছিলেন – “আমার পিতা ও পূর্বপুরুষরা কেউ শূদ্রের অন্ন গ্রহণ করেনি, এই মন্দিরে পৌরহিত্য গ্রহণ করে তিনি সর্বপ্রথম একাজ করবেন এবং তাতে চাটুজ্জে পরিবারের কলঙ্ক হবে।“

তারপরও রামকুমার ঐ মন্দিরের পুরোহিত হয়েছিলেন এবং রামকৃষ্ণকে সেখানে নিয়ে যান। অনিচ্ছা সত্ত্বেও রামকৃষ্ণ ভাইয়ের মনযোগাতে সেখানে যান ঠিকই কিন্তু রীতিমত বেঁকে বসেন। তিনি মন্দিরের প্রসাদ গ্রহণ করতে অস্বীকার করেন এবং স্বহস্তে রান্না করে খেতেন। শেষে অনেকটা বাধ্য হয়ে মন্দিরের পৌরহিত্য গ্রহণ করেন এবং কালী সাধক হয়ে উঠেন।

আরেকটা ঘটনাবলি – একদিন তিনি সম্পূর্ণ উলঙ্গ অবস্থায় একগাছের তলায় বসে সাধনা করতে বসেছেন। সেই সময় উনার ভাগ্নে এই অবস্থায় দেখতে পেয়ে জিজ্ঞেস করল – “মামা তুমি পৈতে খুলে রেখেছে? অথচ ব্রাহ্মণদের পৈতে খুলে রাখা অনুচিত। “

এর উত্তরে রামকৃষ্ণ ভাগ্নেকে বললেন – “আমি ব্রাহ্মণ, সকলের চেয়ে বড়’ – এই অভিমানের চিহ্ন এবং একটা পাশ, মাকে ডাকতে হলে ঐ সব ফেলে রেখে একমনে ডাকতে হয়। তাই পৈতে খুলে রেখেছি। ধ্যান করা শেষ হলে ফিরবার পথে আবার পরব।“
এখানে প্রশ্ন থাকে ব্রাহ্মণ, সকলের চেয়ে বড় এটা যদি অভিমানের চিহ্ন এবং পাশ হয় তবে ধ্যান শেষে পৈতে পরবার প্রয়োজন কি? না কি অদৃশ্য ভগবানের কল্পনা করার সময় আমি ব্রাহ্মণ নই সাধারণ মানুষ আর মানব সমাজে ফিরে আসলে “আমি ব্রাহ্মণ, সকলের চেয়ে বড়” ? তাই মনে হয় আসল কথা।

ছোটবেলা থেকেই রামকৃষ্ণ ছিলেন হিষ্টিরিয়ার রোগী। হঠাৎ হঠাৎ তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়তেন। আর এই রোগকে পল্লবিত করতে গিয়ে তার শিষ্যরা বলেন তিনি নাকি মাঝে মধ্যে ভাব সমাধিতে চলে যেতেন।

তাছাড়া ছিল উনার হরমোনের সমস্যা যার জন্য উনার মধ্যে পুরুষালি ভাবগুলি কম ছিল।
এই কারণই হয়তো উনাকে বিবাহিত জীবন থেকে ব্যর করেছিল।
এই প্রসঙ্গে স্বরূপানন্দ তার ঠাকুর রামকৃষ্ণের জীবন ও বাণী বইতে বলেছেন –
“সাধন-কালে রামকৃষ্ণ মাঝে মাঝে মথুরবাবুর(রাণী রাসমণির জামাতা) বাড়ীতে মেয়েদের সঙ্গে সময় কাটাতেন। মেয়েরা রামকৃষ্ণের সান্নিধ্যে কোনরূপ সংকোচ করত না। রামকৃষ্ণ তাদেরই একজন এই বোধ তাদের মধ্যে সঞ্চারিত হয়েছিল। বাল্যকাল থেকে যখন কলসি কাঁধে জল নিয়ে বাড়ী ফিরতেন তখন কেউ তাকে পুরুষ বলে বুঝতেই পারতো না।“
এখানেও অন্ধবিশ্বাসী শিষ্যরা উনার মহত্ব বাড়াতে এই হরমোনের সমস্যাকে কালীর ভর বলে এখনও চালায়।

যাইহোক রামকৃষ্ণের লোক দেখানো গরীব দরদ সম্পর্কে একটু দৃষ্টিপাত করি –
তিনি একবার দেওঘরের বৈদ্যনাথ মন্দির দর্শনে গিয়েছিলেন। রামকৃষ্ণ একদিন পার্শ্ববর্তী একটি গ্রাম দিয়ে যাওয়ার সময় এখানকার গ্রামবাসীদের দারিদ্র করুন অবস্থা দেখে কাতর হলেন এবং জমিদার মথুর বাবুকে এই সব দারিদ্র লোকদের অন্ন বস্ত্র দিতে বললেন। মথুর বাবু ইতস্তত করে বললেন।
“এই তীর্থ যাত্রায় অনেক টাকা লাগবে। তাই এদের সাহায্যে করা আমার দ্বারা সম্ভব নয়।“
কিন্তু রামকৃষ্ণ এদের শোচনীয় দু:খ দারিদ্র দেখে কাঁদতে লাগলেন “ছি: ছি:! তুমি কি বলছো? আমি এদের ছেড়ে বারানসিও যেতে চাই না।“ তিনি অবশেষে মথুরবাবুর সঙ্গ ছেড়ে দরিদ্র গ্রামবাসীর সঙ্গে বসলেন। মথুরবাবু শেষে বাধ্য হয়ে কলকাতা থেকে কয়েক গাঁট কাপড় এনে এদের মধ্যে বিতরণ করেন এবং এদের সকলকে খাওয়ানোর ব্যবস্থা করলেন।

ভেবে দেখুন মায়া কান্না আর কাকে বলে? একবেলা খাওয়ালে আর একবার বস্ত্র বিতরণ করলে যে দরিদ্রের দারিদ্র দূর হয় তাই আশ্চর্যের। বরং তিনি পুরো ভারতের প্রয়োজন নেই এই এলাকার স্থায়ী দারিদ্র দূরীকরণে একটা ব্যবস্থা নিতেন তাহলে উনাকে প্রকৃত গরীব দরদী বলতাম।
আর কাপড় ও খাবারের ব্যবস্থা করার জন্য মথুরবাবুর দ্বারস্থ হওয়ার প্রয়োজন কি? মা কালী যেহেতু উনার সব কথা শুনেন। সেহেতু মা কালীর কাছে দরিদ্র গ্রামবাসীর সমস্যা কথা বললেই তো সব সমস্যার সমাধান হয়ে যেত।
অবশ্য মা-কালির প্রতি তিনি কতটুকু আস্থাশীল ছিলেন তাও সন্দেহ হয়। কারণ তিনি নিজেই বলেছেন- “সত্যি কি তুই আছিস মা? না, এসবই মনের কল্পনা? তুই আছিস তবে আমি তোকে দেখতে পাই না কেন? তবে এসব কি আকাশ কুসুম? (ঠাকুর রামকৃষ্ণের জীবন ও বাণী – স্বরূপানন্দ- পৃ: ৮)

এইবার একবার ভাবুন তো পৃথিবীর সব মানুষ যদি তার কাজ কর্ম ছেড়ে ঈশ্বর সাধনায়
মগ্ন হয়ে যায় তবে সমস্ত পৃথিবীর কি অবস্থা হবে? না থাকবে মানব সমাজ, না থাকবে ঈশ্বর কল্পনা করার কেউ।
কিন্তু রামকৃষ্ণ তো এই আদর্শই প্রচার করতে চেয়েছিলেন। শুধু সংসার ত্যাগ নয় মানুষের সেবামূলক পেশার উপর আঘাত করতে দ্বিধা-বোধ করেন নি।
একটা উদাহরণ দেই – একদিন ঠাকুর তাঁর ভক্তদের কাছে বলছিলেন,”ডাক্তার উকিল ও দালাল এদের ঈশ্বর লাভের পথে এগোন কঠিন।“
বিশেষ করে ডাক্তারদের প্রতি বললেন, “মনটা যদি ঔষধের ফোটায় পড়ে থাকে, তবে কি করে সে অসীম অনন্তকে চিন্তা করবে?“
এটা শুনে রামকৃষ্ণের শিষ্য জনৈক নাগ মহাশয় ডাক্তারি ছাড়তে দৃঢ় সংকল্প হলেন এবং ঔষধের বাক্স বই গঙ্গায় ফেলে দিয়েছিলেন।
বাহ! আদর্শের প্রশংসা না করে পারা যায় না। ডাক্তারির মতো একটা বাস্তব মহত সমাজ সেবামূলক কাজ ছেড়ে যার অস্তিত্ব নেই তাকে খোজার মধ্যেই মহত্ব বেশী তাই না?

আমি প্রথমই বলেছিলাম রামকৃষ্ণ যখন ধর্মীয় ভাবধারা প্রচার শুরু করেন তখন ধর্মবিপ্লব চলছে।
তিনি ব্রাহ্মসমাজের তীব্র বিরুদ্ধি ছিলেন। অথচ ব্রাহ্ম সমাজকে তিনি অতি কৌশলে ঝোপ বুঝে কোপ মারতে দ্বিধা-বোধ করেন নি।
১৮৭৮ খ্রীষ্টাব্দে ব্রাহ্মসমাজের নেতা কেশবচন্দ্র সেন কোচবিহারের মহারাজার সঙ্গে তার শিশু কন্যার বিয়ে দিলে বাল্যবিবাহ বিরুধী ব্রাহ্মসমাজ দ্বিধা বিভক্ত হয়ে পড়ে। কেশব চন্দ্রের অনুরাগী তাকে ত্যাগ করে সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজের প্রতিষ্ঠা করে। এইভাবে ব্রাহ্মসমাজে বিভেদ সৃষ্টি হয়।
ব্রাহ্মসমাজ বিরোধী রামকৃষ্ণ সুযোগ বোঝে কেশবচন্দ্রের কার্যের সমর্থনে বললেন –
“জন্ম,মৃত্যু,বিবাহ ভগবানের ইচ্ছার উপর নির্ভর করে তাই এতে দোষ কি আছে? কেশব গৃহী, সে মেয়ের বিয়ে দিয়ে পিতার কর্তব্য পালন করেছে, এতে ধর্মের কোন হানি হয় নি।“
বাহ! কি সুন্দর কথা। বিবাহ, জন্ম, মৃত্যু সব ভগবানের ইচ্ছা। অথচ উন্নত বিশ্বে আজ বাল্য বিবাহ নাই বলেই চলে, আর জন্ম যদি ভগবানের হাতেই থাকতো তবে আমরা জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি কিভাবে গ্রহণ করছি? নাকি উন্নত বিশ্বের দেশ থেকে ভগবান সব নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে লেজ গুটিয়ে পালাচ্ছেন? যাদের ধর্ম-পুরুষ ভেবে জনসাধারণ পূজা করে এরাই প্রগতি বিরুধী সমাজের বড় শত্রু।
ব্রাহ্ম সমাজের বিরুধীতা করতে গিয়ে নারীকে গরু ছাগলের সাথে তুলনা করতে কার্পণ্য করেননি রামকৃষ্ণ।
শিবনাথ শাস্ত্রী রামকৃষ্ণের কামিনী-কাঞ্চন ত্যাগের আদর্শ সম্পর্কে তিনি রামকৃষ্ণকে বলেছিলেন, “
স্ত্রী লোকেরা ব্রাহ্মসমাজের সদস্যা ব্রাহ্মধর্ম হল একটি সামাজিক ও গাহস্থ্য ধর্ম, ব্রাহ্মসমাজ নারীজাতিকে শিক্ষা ও স্বাধীনতা দিতে চায়। সুতরাং কামিনী ত্যাগের কঠোর আদর্শ আমরা বিশ্বাস করি না।“
এর পরিপ্রেক্ষিতে রামকৃষ্ণ বলেছিলেন – “চারাগাছ নিয়ে মালী কি করে? ছাগল গরু থেকে বাঁচাবার জন্য বেড়া দেই। পরে চারাগাছ যখন বেড়ে ওঠে তখন আর বেড়া দেওয়ার দরকার হয় না। আমাদের আধ্যাত্মিক জীবনেও আমরা তাই করি।“
শিবনাথ তাতে বলেছিলেন – “আমি আপনার মতো নারী জাতির কাজকে গরু ছাগলের মতো ধ্বংসাত্মক মনে করি না। আমাদের সংগ্রাম ও সামাজিক অগ্রগতিতে তারা সহায় হতে পারে।
রামকৃষ্ণের এক শিষ্য গিরিশচন্দ্র ঘোষ শ্রী রামকৃষ্ণ, শ্রী শ্রী মা ও বিবেকানন্দ বইতে তখনকার ধর্ম বিপ্লবের কথা বলতে গিয়ে বলেছেন –
“পরমহংসদেব যখন জগৎ সমক্ষে উদয় হন, তখন ঘোরতর ধর্মবিপ্লব।“
জড়বাদী মুক্তকণ্ঠে বলিতেছেন – “জড় হইতেই সমস্ত,জড়ের সংযোগেই আত্মা, জড় ব্যতীত আর কিছু নাই।“ ব্রাহ্ম সমাজ বলেন – “বেদ, বাইবেল, কোরান প্রভৃতি কিছুই মানিবার আবশ্যক নাই, কোনটিই অভ্রান্ত নয়, কোনটিই ঈশ্বর বাক্য নয়। এমন সময় পরমহংসদেব প্রচার করলেন “কোন ধর্ম কোন ধর্মের বিরোধী নয়। বাহ্য দৃষ্টিতেই বিরোধ কিন্তু সকল।
ধর্মে ধর্মে বিরোধ আছে কি নেই? তা অন্তর্দৃষ্টি বাহ্য দৃষ্টি দুভাবে দেখলেই বোঝা যায়।
যাক এখন প্রশ্ন উঠতে পারে প্রাচীন ভারত থেকে দেখে আসছি নানা সময় নানা যুক্তিবাদী মতবাদ আন্দোলনের আকার নিলেও তা পুরো সফল হতে পারে না। কোন না কোন ঈশ্বর সন্তান নামধারী ব্যক্তি এসে একে প্রতিহত করে দেয়। যেমন প্রাচীন ভারতে শঙ্কর বেদান্তের ভাব জোয়ারে বস্তুবাদ ধ্বংস হয় আর উনবিংশ শতকে ধর্ম-বিদ্রোহ প্রতিহত করে রামকৃষ্ণের ভাব জোয়ারে।
কিন্তু এর কারণ কি? প্রথমত আমার মনে হয় বিভিন্ন সময়ের যুক্তিবাদী আন্দোলনগুলি একটি নির্দিষ্ট বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর কাছে রয়ে গিয়েছিল সাধারণ মানুষের কাছে এর সারমর্ম সঠিকভাবে পৌঁছায়নি।
দ্বিতীয়ত আদিযুগ থেকে চলে আসা অলৌকিক চিন্তাধারাগুলি বংশ পরম্পরায় আমাদের মস্তিষ্কের কোষে কোষে রয়ে গেছে তাই একটু অলৌকিকতার সুড়সুড়ি পেলেই যুক্তির ধার না ধরেই জনশ্রুত সেই অলৌকিকতার নামধারী ব্যক্তিদের দিকেই ছুটতে থাকে। তবে আজ সময় এসেছে এটা ভেবে দেখার আমরা একটা সুন্দর সমাজ গঠনের লক্ষ্যে নিয়ে নিজের যুক্তি বুদ্ধিকে কাজে লাগিয়ে সামনের দিকে নিয়ে যাব নাকি অলৌকিকতার ধ্বজাধারীদের আদর্শ মেনে অন্ধ থেকে যাব।

(কিছুদিন আগে রামকৃষ্ণ মিশনের পৃষ্ঠপোষক এক ডক্টরেট-ধারী ব্যাক্তির সঙ্গে রামকৃষ্ণের অলৌকিকতার ঘটনাগুলি নিয়ে তর্কে জড়িয়ে যাই। তর্কাতর্কির এক মুহূর্তে তিনি যখন দেখলেন তিনি আর বেশী যুক্তি দেখাতে পারছেন না। তখন তিনি আমাকে গণ্ডমূর্খ, নির্বোধ ইত্যাদি পদবিতে ভূষিত করে আমার উপর ঝাপিয়ে পড়েন। এরপর থেকেই একটা লেখা লেখব বলে ভাবছিলাম কিন্তু সময় সুযোগ হয়ে উঠছিল না। অনেক ব্যস্ততার মধ্যে লেখাটি তৈরি করেছি। কোন ভুল থাকলে ক্ষমা প্রার্থী সঙ্গে সমালোচনাও কাম্য)