:: নিউইয়র্ক (প্রথমার্ধ) :: নিউইয়র্ক (দ্বিতীয়ার্ধ) :: পোর্টল্যান্ড (ওরিগন) :: সিলিকন ভ্যালি (ক্যালিফোর্নিয়া) :: ওয়াশিংটন ডিসি :: ডেট্রয়েট (মিশিগান) ::

ভার্জিনিয়া স্টেইট, আমেরিকার সবচেয়ে বড় প্রেসিডেন্ট উৎপাদন কারখানা। এখানে সর্বমোট স্টেইট এর সংখ্যা পঞ্চাশ এবং বর্তমানে বারাক ওবামা আমেরিকার ৪৪-তম প্রেসিডেন্ট। গড়ে প্রতি স্টেইট থেকে একজন করে প্রেসিডেন্টও নেই। কিন্তু তাতে কি! চুয়াল্লিশ জনের মধ্যে ভার্জিনিয়ায় জন্মগ্রহণকারী প্রেসিডেন্টের সংখ্যাই আট। যাদের মধ্যে আছেন নামের শেষে ‘সন’-যুক্ত প্রখ্যাত চারজন- উইলসন, জেফারসন, মেডিসন, হ্যারিসন এবং নামের মাঝে ‘শিং’-যুক্ত কয়েক টন খ্যাতিসম্পন্ন ওয়াশিংটন। প্রেসিডেন্ট মানেই নেতা, আর নেতা মানেই আন্দোলন, নেতা মানেই সংগ্রাম। ‘আমেরিকান রেভ্যুলুশান’ এবং ‘আমেরিকান সিভিল ওয়ার’-এই দুই গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলনের তীর্থস্থান ভার্জিনিয়া। এই আন্দোলনগুলোই কখনো জন্ম দিয়েছে স্বাধীন আমেরিকার, কখনো জন্ম দিয়েছে দাসপ্রথাবিহীন আমেরিকার। আর তারই সাথে সাথে এই আন্দোলনগুলোই জন্ম দিয়েছে শত শত নেতৃত্বের আর গণ্ডায় গণ্ডায় প্রেসিডেন্টের।

প্রেসিডেন্টদের কথা যখন বলাই হলো, রাজা-বাদশাদের কথাও একটু না বললেই নয়। ১৬১২ সালে ইংল্যান্ডের রাজা ‘প্রথম জেমস্‌’ ব্যবসা করার প্রস্তাব দিয়ে প্রতিনিধি পাঠান ভারতবর্ষের অদূরদর্শী সম্রাট জাহাঙ্গীরের কাছে। ইতিহাসের ঠিক এই বিন্দুতে, সেদিনই তৈরি হয়ে যায় ভারত বর্ষে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর আগমন এবং পলাশীর আম্রকানন রক্তাক্ত হবার পটভূমি। বাংলা-বিহার উড়িষ্যা-দিল্লির, প্রথম অথবা শেষ, স্বাধীন কিংবা পরাধীন নবাব-বাদশার বহু বীরত্বগাঁথা লেখা হয়ে থাকতে পারে, তবে কতটুকু নির্বোধ হলে একটা কোম্পানির কাছে স্বাধীনতা হারানো সম্ভব হতে পারে সেই হিসেবটা কোথাও লেখা নেই।

অবশ্য জাহাঙ্গীরের কাছে প্রস্তাব পাঠিয়ে উপনিবেশ স্থাপন করার অভিপ্রায় রাজা জেমসের মনে এসেছিলো অন্য এক সফলতায় উদ্বুদ্ধ হয়ে। ভারতবর্ষের মত এত সুবিশাল ভূখণ্ডে উপনিবেশ স্থাপন করা কতটুকু ফলপ্রসূ হবে, সেটা নিয়ে রাজাকে খুব বেশি ভাবতে হয়নি। কারণ, ইতিমধ্যে তারা খুঁটি গেঁড়ে বসেছে আরেক বিশাল ভূখণ্ড, ১৪৯২ সালে আবিস্কৃত নতুন পৃথিবী আমেরিকায়। আরো সুনির্দিষ্ট করে বলতে গেলে আমেরিকার ভার্জিনিয়ায়। ক্যাপ্টেন ক্রিস্টোফার নিউপোর্টের নেতৃত্বে ইংরেজ ব্যবসায়ী গ্রুপ ‘ভার্জিনিয়া কোম্পানী অব লন্ডন’ এর তিনটি জাহাজ ‘সুজান কনস্ট্যান্ট’, ‘ডিসকভারি’ ও ‘গডস্পিড্‌’ ১৬০৭ সালের ২৬শে এপ্রিল এসে নোঙর ফেলে আটলান্টিকের তীরবর্তী অঞ্চল ‘কেইপ হেনরি’তে, যেখানটা অবস্থিত বর্তমানের ভার্জিনিয়া বিচ্‌। উল্লেখ করা যেতে পারে, ঠিক ১১৫ বছর আগে ক্রিস্টোফার নিউপোর্টের মত এরকম তিনটি জাহাজ ‘নিনা’, ‘পিন্টা’ ও ‘সান্তা মারিয়া’ নিয়ে এই একই ভূখণ্ডে আবির্ভুত হয়েছিলো ইতিহাস কাঁপানো নির্ভীক-সাহসী নির্দয়-নাবিক ‘ক্রিস্টোফার কলাম্বাস’

যুগ যুগ ধরে লুটেরার দল সবার আগে যেটা পরিবর্তন করেছে, সেটা হলো অধিকৃত স্থানের নাম। কলাম্বাসরা করেছিলো তাদের রাজা-রাণীর নামে, আর নিউপোর্টরা করেছিলো তাদের রাজা-রাণীর নামে। অতএব লুটতন্ত্রের নিয়মানুযায়ী, রাজা প্রথম জেমস্‌ এর নামে পরিবর্তিত হয়ে গেলো সমস্ত একটা নদীর নাম, সৃষ্টি হয়ে গেলো নতুন নতুন শহর-বন্দর। রাজার নামে ভার্জিনিয়ার ভিতর দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীর নাম হয়ে গেলো জেমস রিভার, শহরের নাম হয়ে গেলো জেমস্‌ টাউন। আজ কেউ আর জানার চেষ্টাও করে না, একদিন এ-ভূমির সত্যিকারের মালিক এবং অধিবাসী নেটিভ আমেরিকানদের ‘পাওহাটান’ নদীই ইতিহাসের পাতায় আজ পরিচিত হয়ে আছে ‘জেমস রিভার’ নামে।

ব্যবসায়ীর জাত ব্রিটিশ যেখানে গেছে সেখানকার মানুষ হারিয়ে ফেলেছে তাদের স্বাধীনতা, হারিয়ে ফেলেছে অধিকার। আমেরিকাতেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। অমানুষিক পরিশ্রম করার জন্য আফ্রিকা মহাদেশ থেকে দলে দলে নিয়ে গেছে দাস, জমজমাট ব্যবসা হয়েছে, প্রচলন হয়েছে আমুষিক পরিশ্রমের দাসপ্রথার। শোষিত-নিপীড়িত, নির্যাতিত-নিষ্পেষিত সাধারণ মানুষের স্বাধীনতা আন্দোলনের সূচনা করতেই লেগে গেছে দেড় শতক। ইংরেজ আগমনের প্রায় ১৫০ বছর পর আঠারোশো শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ব্রিটিশদের তৈরি করা ১৩টি উপনিবেশ মিলে গড়ে তুলতে শুরু করে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন এবং প্রস্তুতি নিতে থাকে সম্মিলিত এক যুক্তরাষ্ট্র গড়ে তুলবার, শুরু হয় স্বাধীনতা অর্জনের লড়াই। ১৭৭৬ সালের ৪ই জুলাই স্বাধীনতা ঘোষণার মধ্য দিয়ে শুরু হয় চূড়ান্ত আন্দোলন। স্বাধীনতা আন্দোলনে খুব কম সংখ্যক দেশের ভাগ্যে থাকে সত্যিকারের নেতৃত্ব দেবার মত যোগ্য মানুষ।

আমেরিকা সৌভাগ্যবান দেশ, তাদের ছিলো বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিনের মত নেতৃত্ব; তাদের ছিল জেফারসন, মেডিসন; হ্যামিল্টন,ওয়াশিংটন; তাদের ছিলো জন জেই, জন অ্যাডামস। এই সাতজন নেতাকে স্বাধীন আমেরিকা গঠনের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সে-সময় ভার্জিনিয়া ছিলো সমস্ত উপনিবেশগুলোর কেন্দ্রবিন্দু এবং রাজধানী ছিলো ভার্জিনিয়ায় অবস্থিত উইলিয়ামসবার্গ। যুদ্ধের প্রয়োজনে প্রায় বিরাশি বছরের পুরোনো উইলিয়ামসবার্গ থেকে ১৭৮১ সালে রাজধানীকে সরিয়ে নিয়ে আসা হলো রিচমন্ডে। আর একই বছরের অক্টোবরের ১৯ তারিখ ভার্জিনিয়ার ইয়র্ক টাউনে জর্জ ওয়াশিংটনের কাছে আত্মসমর্পণ করেন ব্রিটশ বাহিনী। যে ব্রিটিশ জেনারেল আত্মসমর্পণের গ্লানি মুখে নিয়ে ইংল্যান্ডে ফিরে যান, তিনি আমাদের ইতিহাসের পাতায় অতি পরিচিত, অতি চেনা মুখ। হাজার মাইল দূরের পরাজয়ের গ্লানি মেখে ঘরে ফিরে আসা সেই ব্যর্থ জেনারেল, পরবর্তীতে আবারো ঘর ছাড়েন ভারতবর্ষের উদ্দেশ্যে। জমিদারদের স্বার্থ সুরক্ষা করে ১৭৯৩ সালে ভারত বর্ষে ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’ প্রথা প্রবর্তনকারী সেই জেনারেলের নাম ‘লর্ড কর্নওয়ালিশ’।

ভার্জিন কুইন হিসেবে পরিচিত ইংল্যান্ডের রাণী প্রথম এলিজাবেথ এর নামে স্টেইটের নামকরণ করা হয়েছিলো ভার্জিনিয়া। ‘ওল্ড ডমিনিয়ন’ ডাক নামে পরিচিত এই স্টেইট বিশ্বের ইন্টারনেটে রাজধানী হিসেবেও পরিচিত। আরো পরিচিত নামকরা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের হেড কোয়ার্টারের জন্য। তার মধ্যে হলিউড মুভির সুবাদে সারা বিশ্বে বিশেষভাবে পরিচিত ‘ল্যাংলি, ভার্জিনিয়া, সিআইএ হেড কোয়ার্টার’। ভার্জিনিয়া রাজধানীতে অবস্থিত রিচমন্ড ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট-এ নেমেই ক্যাব নিতে হলো। মানেটা দাঁড়ালো এয়ারপোর্ট থেকে শহরে যাবার জন্য পাবলিক ট্রান্সপোর্ট পাওয়া যায়নি। জিপিএস-এ গন্তব্য নির্ধারণ করে ড্রাইভার নিয়ে যাচ্ছে শহরে। যতই শহরের কাছ আসছি ততই মনে হচ্ছে শহর কোথায়, শহরতো দেখিনা, যা দেখছি সেটা শহর না, বড়জোর হতে পারে শহরতলী। ড্রাইভার গন্তব্যে নামিয়ে দিয়ে চলে গেলো। মনে হলো নিশ্চয় শহর থেকে অনেক দূরে আছি। আমার অবস্থান ব্রড স্ট্রিট, এটি রিচমন্ড শহরের মাঝ দিয়ে এ-পাশ থেকে ও-পাশে চলে গেছে। ইন্টারনেট খুলে দেখি, নাহ! মূল শহর থেকে খুব বেশি দূরে নেই। অতএব, ব্যাপারখানা কি সেটা বুঝার জন্য শহরের একেবারে মূলবিন্দুতে চলে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই।

ছবিঃ আমেরিকার মানচিত্রে ভার্জিনিয়া স্টেইটের অবস্থান (লাল অংশটুকু)

শহরে গিয়ে কিছুটা মিশ্র অনুভূতিই হলো। দেখে অবাক তাকিয়ে থাকার মত শহর রিচ্‌মন্ড নয়। আমেরিকার অন্য আর সব নামকরা শহরের তুলনায় একেবারেই বেমানান। ভার্জিনিয়া স্টেইট এ জন্মগ্রহণকারী আট প্রেসিডেন্টের তাদের নিজেদের রাজধানী রিচমন্ডের জন্য আলাদা করে কিছুই রেখে যাননি। নিতান্তই শ্রীহীন মনে হলো এই শহর। বহুতল বলতে কয়েকটা হাতে গোনা ভবন এবং বাকী দু’একটা হোটেল। আমার নিজ শহর শিকাগোর আর্কিটেকচার এর এত বেশি বৈচিত্রময় যে, সে তুলনায় এখানকার বেশিরভাগ বিল্ডিংয়ের আর্কিটেকচারাল বিউটি নেই বললেই চলে। কিছুটা জানালাওয়ালা কোল্ড স্টোরেজ এর মত। আমেরিকার অন্য শহরগুলোর মতো এখানে বড় বড় শপিং মল বা ফুড চেইনের আধিক্য নেই। বরং গোটা শহর খুঁজে পরিচিত ব্র্যান্ডের যুতসই খাবার দোকান পাওয়াটাই কষ্টকর হয়ে গেলো। ব্র্যান্ড মানে আবার দামী ব্র্যান্ড নয়, ম্যাকডোনাল্ড, কেএফসি’র মত গরীবি ব্র্যান্ড; আমার পকেট যেগুলোর ভার সামলাতে পারে। আলাদাভাবে লক্ষ্যণীয় দিক হচ্ছে, এখানে ভারতীয় লোকজন খুব একটা বেশি দেখতে পাওয়া যায় না। সিটি ট্রান্সপোর্টেশান সিস্টেম অর্গানাইজড্‌ নয়, বাস ভাড়ার কোনো আগা-মাথা নেই, বাস থামাতে দড়ি টানলে ডিস্টার্বিং সাউন্ড হয়। কিন্তু, এতো হবার কথা নয়। ঐতিহাসিকভাবে প্রসিদ্ধ এই শহর নিশ্চয়ই কোথাও সৌন্দর্য লুকিয়ে রেখেছে, আমি খুঁজে বের করতে পারছি না। তবে বলে রাখা ভালো যে, ক্যাপিটাল হলেও ভার্জিনিয়ার সবচেয়ে বড় শহর কিন্তু রিচ্‌মন্ড নয়, সবচেয়ে বড় শহর ভার্জিনিয়া বিচ্‌।

ছবিঃ রিচ্‌মন্ড শহরের স্কাইলাইন

ছবিঃ টাইম ক্যাপসুল

রিচমন্ড ১

ছবিঃ রিচ্‌মন্ড-২

পরবর্তী দিন লোকজনকে জিজ্ঞেস করে, ইন্টারনেট খুঁজে চলে গেলাম ভার্জিনিয়া স্টেইট ক্যাপিটল। নাহ্‌ এ-পর্যায়ে মুগ্ধ না হয়ে উপায় নেই। অপূর্ব রুচিশীল কারুকার্য আর ভাস্কর্যের নজর কাড়া সমাবেশ। এক কথায় চমৎকার। কিছুক্ষণ পরপরই দীপ্ত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছেন পাথরের মহাপুরুষ। হ্যারি পটারের স্কুলে হগওয়ার্টজের মত জাদুকরী একটা ভাব ফুটিয়ে পাশেই আছে বিখ্যাত স্থপতি মায়ার্স এর ডিজাইন করা নিও-গোথিক স্টাইলের ‘ওল্ড সিটি হল’।

ছবিঃ ক্যাপিটল-১

ছবিঃ ক্যাপিটল-২

ছবিঃ ক্যাপিটল-৩

ছবিঃ ওল্ড সিটি হল

পরবর্তী দিন চলে গেলাম রিচ্‌মন্ড ক্যানাল ক্রুজ-এ। বোট্‌ এ করে জেমস্‌ রিভার ও কানোহা ক্যানাল ঘুরিয়ে দেখাবে। যথা সময়ে ‘ক্যাপ্টেন মাঝি’ স্টার্ট করলেন, মায়েরা বাচ্চাদের নিয়ে উঠেছে, চমৎকার রৌদ্রজ্জ্বল বিকেল। দাঁড়ি থাকা ঝকঝকে ক্যাপ্টেনের দ্যুতিময় মুখ দেখলে বুঝার উপায় নেই যে তিনি টাইটানিক চালাচ্ছেন, না নৌকা চালাচ্ছেন। মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে শুরু করলেন বর্ণনা। উনি বললেন, আমরা দু’দিকে ভ্রমণ করবো। বামদিকে এবং ডানদিকে। এই বলে প্রথমে ক্যাপ্টেব ডানে যাওয়া শুরু করলেন।

ছবিঃ ক্যানাল ক্রুজ ১

ছবিঃ ক্যানাল ক্রুজ ২

ছবিঃ ক্যানাল ক্রুজ-৩

বিপুল উৎসাহ, উদ্দীপনা এবং ভাব-গাম্ভীর্যহীন ভাবে বাচ্চাদের সাথে সাথে আমিও ব্যাপক উত্তেজনা নিয়ে প্রস্তুত হলাম খাল ভ্রমণের জন্য। দুই মিনিট পার হতে না হতেই যেই না একটু আয়েশ করে বসার খায়েশ হলো ক্যাপ্টেন মাঝি বলে উঠলেন, ওকে! আমাদের ডানদিকের খাল ভ্রমণ এখানেই শেষ, এবার আমরা যাবো বামদিকে। সবার সাথে সাথে আমিও বুঝতে চেষ্টা করলাম, আসলেও ঠিক শুনলামতো। নাহ! ঠিকই শুনলাম। হতাশ হয়ে ভাবলাম বামদিকে গিয়েও আর কি-ই বা পাব। বুঝলাম যতটা আগ্রহ নিয়ে খাল ভ্রমণে এসেছিলাম, ততটা আগ্রহ দেখানোর মত কিছুই নয়। এবার বামদিকে নৌকা চলল। সুন্দর সরু খাল। ক্যাপ্টেন অযথাই বিভিন্ন তথ্য দিয়ে যেতে লাগলেন। দেয়ার মত তথ্য খুব কম। তবু আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন ভ্রমণকারীদের মনোরঞ্জন করার জন্য। এই ‘ক্যাপ্টেন মাঝি’কে দোষ দিয়েও লাভ নেই। এদের দেশেতো মিলিয়ন ডলার মূল্যের “ওরে নীল দরিয়া…” গানটাও নেই যে গেয়ে শোনাবে। খাল ভ্রমণ শেষে যেটা মনে হলো, এই ধরণের একটা ট্যুর এর জন্য বাংলাদেশ হলে আমি সর্বোচ্চ পঞ্চাশ পয়সা দিতে রাজী থাকতাম।

যেকোনো শহরে গেলে ‘বেইলী রোড’ খুঁজে বের করাটা আমার অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে। তারুণ্যের বহিঃপ্রকাশ দেখার জন্য। রিচ্‌মন্ড শহরের বেইলী রোড ক্যারি স্ট্রিট। এখানেই আছে ক্যারি টাউন। নাহ্‌! হতাশ হয়ে ফিরতে হয়নি। একেবারেই প্রাণবন্ত রঙিণ একটা এলাকা। অনেক রাতেও চলছে মিউজিক, খেলছে গেম, পার্টি প্লেসগুলো সরগরম। দুইশ মিটার লম্বা লাইন দিয়ে লোকজন ‘সুইট ফ্রগ’ দোকান থেকে ফ্রোজেন ইয়োগার্ট কিনে খাচ্ছে। এখনো পর্যন্ত আমেরিকায় আমার কাছে ‘সুইট ফ্রগ’এর ইয়োগার্ট-ই বেস্ট মনে হয়েছে। ক্যারি স্ট্রিট এ ইন্ডিয়ান একটা দোকানের সন্ধানও পাওয়া গেলো। সেখানে আবার চিকেন বিরিয়ানী পাওয়া যায়। খেতে গিয়ে মনে হলো টাকা দিলেও এত বিস্বাদ চিকেন বিরিয়ানী বানানো সম্ভব নয়। কোন বিশেষ প্রক্রিয়ায় যে তারা চিকেনে এর স্বাদটা পর্যন্ত নষ্ট করে ফেলেছে সেটা জানারও আগ্রহ হলো। ঐ দোকানের একমাত্র টেইস্টি জিনিস হলো ‘আইস’।

শহরের বাইরে গাড়ীতে করে ঘোরার সময় মনে হয়েছে এখানে অনেক সবুজ। প্রচুর পরিমাণে গাছ পালা। বিমানে থেকেও দেখে বুঝা যায় প্রচুর পরিমাণে সবুজের সমারোহ ভার্জিনিয়ায়। কিন্তু শহরের ভিতরের কথা যদি বলতে হয় তাহলে একেবারে আশানুরূপ যে দেখেছি সেটা বলা যাচ্ছে না। এর মধ্যে একদিন সকালে হাঁটতে হাঁটতে আমার নিজের আবাসস্থল ব্রড স্ট্রিট থেকে পাশের স্ট্রিটগুলোতে চলে গেলাম। সেখানে গিয়ে বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে যাবার পালা। এ-যে চানখারপুলের পাশে বারিধারা। রাস্তার নাম মনুমেন্ট অ্যাভিনিউ। রাস্তা যে এত সুন্দর হতে পারে সেটা এখানে না আসলে জানা হতো না। রাস্তার ধারের একেকটা বাড়ী যেন শিল্পী তার তুলি দিয়ে এঁকে রেখেছেন। রিচ্‌মন্ড এর উচ্চবিত্তশ্রেণীর বসবাস এখানে। পার্কও এত সাজানো আর এত সুন্দর হয় না। রাস্তার ওপাশ থেকে ডেকে মানুষজন জিজ্ঞেস করছে, কেমন আছি। বাসার ভিতর থেকে দেখলে হাসি দিয়ে হাই-হ্যালো বলছে। কয়েক মাইল ধরে হাঁটছি আর রাস্তার মোড়ে মোড়ে থেমে দেখছি বিভিন্ন বিখ্যাত ব্যাক্তির মনুমেন্ট। কেউ আছে ঘোড়ায় চড়ে, কেউ আছে দাঁড়িয়ে। আমেরিকার অন্য কোনো শহরের ভিতরে এত সুন্দর, পরিপাটি রাস্তা আমি খুব কমই দেখেছি। এই মনুউমেন্ট অ্যাভিনিউ এসে অবশেষে মনে হলো রিচমন্ড দেখার ষোলোকলা পূর্ণ করলাম।

ছবিঃ মনুমেন্ট অ্যাভিনিউ-১

ছবিঃ মনুমেন্ট অ্যাভিনিউ-২

ছবিঃ মনুমেন্ট অ্যাভিনিউ-৩

ছবিঃ মনুমেন্ট অ্যাভিনিউ-৪

ছবিঃ মনুমেন্ট অ্যাভিনিউ-৫

ফেরার দিন যখন এয়ারপোর্ট বসে আছি। এয়ারপোর্টে গেলে একেবারে শেষ মূহুর্ত পর্যন্ত আমি প্লেইনের উঠা-নামা দেখি। বিমান কি করে আকশে উড়ে সে বিস্ময়ের ঘোর আমার এখনো কাটেনি। ইউটিউবে শত শত ভিডিও আমি দেখেছি, বিমান উড়া নিয়ে সবগুলোই একই কথা বলছে- লিফট্‌, ওয়েট্‌, থ্রাস্ট্‌, ড্র্যাগ্‌। তারপরও নতুন ভিডিও পেলে আবারো একই জিনিস দেখি। বিমান নিয়ে হওয়া মুভ্যির বেশিরভাগই দেখে শেষ করে ফেলেছি। রিচমন্ড এয়ারপোর্টে কাচের ভিতর দিয়ে আমার নিজের বিমানটাকে দেখছিলাম, একটু পরে ঠিক যে বিমানটাতে করে উড়ে যাব। হঠাৎ দেখলাম, কেউ একজন এসে বিমানের চাকা দেখলো। তারপর দৌঁড়ে চলে গেল। এর মধ্যে সবাই লাইনে দাঁড়িয়ে গেছে বিমানে উঠার জন্য। লাইনে না দাঁড়িয়ে আমি কোনো এক ঘোষণার জন্য অপেক্ষা করছি। অবশেষে ঘোষণা আসলো, বিমানের চাকা পাংঙ্কচার হয়ে গেছে। জীবনে এই প্রথম বিমানের চাকা পাংঙ্কচার হতে শুনলাম। কিন্তু চাকা পাংঙ্কচার হওয়া সমস্যা না, সমস্যা হলো তারা যখন ঘোষণা করলো, ওয়াশিংটন ডিসি থেকে গাড়িতে করে কেউ একজন বিমানের চাকা নিয়ে রওয়ানা করেছে, আসতে চার ঘণ্টা লাগবে। এর মধ্যে ডেস্ক থেকে সবাইকে দুঃখ প্রকাশ করে বললো, মেইন কাউন্টারে গিয়ে দেখতে আগে আগে কোনো প্লেনের টিকিট পাওয়া যায় কি-না, থাকলে টিকেট পরিবর্তন করে নিতে।

আমাদের বিমান ছাড়তে কমপক্ষে আরো পাঁচ-ছয় ঘন্টা লাগবে। সবাই ছুটলো মেইন টিকিট কাউন্টারে। আমি বসে থাকলাম জানালার পাশে। চার-পাঁচ ঘন্টা একটানা বসে বসে প্লেইন দেখাটা আমার জন্য কোনো ব্যাপারই না। লাল প্লেইন, নীল প্লেইন, সাদা প্লেইন, সবুজ প্লেইন। ছোটোবেলায় আকাশে অনেক উপর দিয়ে যখন বিমান যেত তখন ‘কি করে আকাশে বিমান চলে’ সেটা না বুঝেই বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে তাকিয়ে দেখতাম, যে পর্যন্ত দেখা সম্ভব হতো। আজ বড়বেলায় ‘কি করে আকাশে বিমান চলে’ সেটা বুঝেও সে একইভাবে অভিভূত হয়ে দেখি। বিস্ময় কমেনি, বরং বেড়েছে। টিকিট পরিবর্তন করা যায় না-কি সেটা দেখার জন্য সবাই ছুটোছুটি করে চলে গেলে, আমি চুপ করে বসে থাকলাম। ল্যাপটপ খুলে বসে বসে পাঁচ ঘন্টা বিমান দেখার জন্য যখন প্রস্তুতি নিচ্ছি। তখন এয়ারলাইন্সের ডেস্ক থেকে একজন ডেকে বললো, ‘দশ মিনিটের মধ্যে একটা ফ্লাইট ছেড়ে যাচ্ছে, একটা সিট ফাঁকা আছে, তাড়াতাড়ি উঠে পড়’। তার কথা শুনে খুশি হব না দুঃখ পাব, সেটা তৎক্ষণাত বুঝে উঠতে পারলাম না, শুধু অস্ফুট স্বরে মুখ থেকে বেরিয়ে এলো, ‘বাই বাই রিচ্‌মন্ড’।

মইনুল রাজু (ওয়েবসাইট)
[email protected]