১৬ ডিসেম্বর ২০১১ সন্ধ্যায় সিলেটের সদর উপজেলার বাদাঘাটের চেঙ্গেরখাল ডুবন্ত সূর্যের যে আলোয় লাল হয়েছিল তাতে মিশেছিল দুজন তরুণের তাজা রক্ত। বিজয় দিবস উদযাপন করতে আর নয়নাভিরাম প্রকৃতির মাঝে কিছুক্ষনের জন্য হারাতে সেদিন নৌকা ভ্রমণে যায় সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩ ছাত্রী ও ৫ ছাত্র। একসময় নৌকার ইঞ্জিনে গোলমালের কথা বলে মাঝি নৌকাটি এক স্থানে থামালে বখাটেরা শিক্ষার্থীদের উপর হামলা চালিয়ে মারধর করে তিন ছাত্রকে পানিতে ফেলে দেয়। এদের একজন সাঁতার কেটে তীরে উঠলেও মারা যায় কেমিক্যাল সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ছাত্র খায়রুল কবীর ও দীপঙ্কর ঘোষ অনিক। পরদিন সকালে নদী থেকে তাদের লাশ উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার মো. ইশফাকুল হোসেন বাদী হয়ে জালালাবাদ থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করলে পুলিশ প্রথমে নৌকার মাঝি গুলজার মিয়াকে গ্রেফতার করে এবং তারপর যে তথ্য বেরিয়ে আসে তা রীতিমত ন্যাক্কারজনক। ঘটনার দিন পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী নৌকার ঘাটে উপস্থিত থাকা পার্শ্ববর্তী নলকট গ্রামের জামাল, ছইল, শাহীন ও ছাইম মাঝিকে ছাত্রছাত্রীদের বেড়াতে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেয়। এ সময় বখাটেরা তাদের কাজে সহযোগিতা করলে মাঝিকে একটি মোবাইল ফোন দেয়ার প্রলোভন দিলে সে তাতে সম্মতি জানায়। গুলজার মাঝি বখাটেদের কথা অনুযায়ী নৌকাটি চেঙ্গেরখালের পুটিখাটারমুখ ব্রিজের পার্শ্ববর্তী এলাকায় নিয়ে যায় ও ফেরার পথে বখাটেদের নৌকা আসছে দেখে নৌকার ইঞ্জিন বন্ধ করে দেয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রথমে মাঝির হাতে লাঠি দিয়ে একটি আঘাত করা হয়। সঙ্গে সঙ্গে জামাল ও তার অপর সহযোগীরা নৌকায় ওঠে তিন ছাত্রীকে টানাহেঁচড়া করে এবং ছাত্রীদের তাদের নৌকায় তুলে নিতে চায়। এতে সঙ্গে থাকা ছাত্ররা বাধা দিলে জামাল, শাহীন, লাল, ছাইম, রকিব ও সেলিম নৌকায় ওঠে তাদের মারধর করে তিন ছাত্রকে নদীতে ফেলে দেয় ও বখাটেরা ছাত্রছাত্রীদের মোবাইল ফোন, ক্যামেরা, মানিব্যাগ ও ভ্যানিটি ব্যাগ ছিনিয়ে নেয়। গুলজার মাঝি জানায়, তীর থেকে একজন পুলিশ আসছে বলে চিত্কার শুরু করলে বখাটেরা পালিয়ে যায়। এরপর নৌকা নদীর দক্ষিণ পাড়ে ভিড়িয়ে অপর ছাত্রকে মাঝি নৌকায় তুলে নেয় ও পুলিশের ভয়ে সে অন্য দুজকে তোলার কোনো সুযোগ না দিয়েই নৌকা নিয়ে বাদাঘাটে চলে আসে এবং ছাত্রছাত্রীদের নৌকা ছেড়ে চলে যেতে বলে। এরপর নৌকা ঘাটে রেখে সেও চলে যায়। হত্যাকাণ্ডে ঘটনায় জড়িতদেরকে গ্রামবাসীরা পুলিশে সোপর্দ করে। এ ঘটনায় উত্তাল হয়ে ওঠে বিশ্ববিদ্যালয়, নিহত খায়রুল ও অনিকের পরিবার এবং সহপাঠীদের বুকফাটা আর্তনাদ ভেসে বেড়াতে থাকে সিলেটের আকাশে-বাতাসে। ভয়াবহ এই ঘটনাটি কিছু বড় প্রশ্ন সামনে এনে দিয়েছে আমাদের। নারীকে এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদেরকেও লাঞ্ছিত করার আকাঙ্ক্ষা ও সুযোগ কি দুর্বৃত্তদের কাছে সবসময়ই সুলভ হবে? এদেশে জীবনের বিশেষত মেধাবী প্রাণের নিরাপত্তা কি সোনার হরিণের চেয়েও দুর্লভ রবে? খেয়াল করে দেখা গেছে যে বখাটেরা এই ঘৃণ্য কাজে অংশ নিয়েছে তাদের প্রত্যেকেরই বয়স ২০-২২ বছরের মধ্যে। তারুণ্যের অবক্ষয়, মূল্যবোধ ও মানবতার অপচয় কিভাবে আমাদের অজান্তে বেড়ে চলেছে সে বিষয়ে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র কি খুব বেশি সচেতন হতে পারছে? পারিবারিক ও সামাজিকভাবে অশিক্ষা ও মূল্যবোধ গঠনে অযত্নের কারণেই এই ছেলেগুলো ছাত্রীদের লাঞ্ছিত করা ও ছিনতাইয়ের মত দুঃসাহসিক ও ভয়ঙ্কর পরিকল্পনা নিতে পেরেছিল, আর মাঝি সামান্য একটা মোবাইল ফোনের বিনিময়ে বিকিয়ে দিতে পেরেছিল মনুষ্যত্ববোধ। সংকীর্ণমনাদের কাছে নারী সর্বদাই লাঞ্ছনার যোগ্য, কিন্তু সেজন্য কি আমরা এই ঘটনার পর থেকে নারী নিজেকে গৃহবন্দী করে রাখবে? আর কোন শিক্ষার্থীর দল কি প্রকৃতির সাথে একাত্ম হতে পা বাড়াবেনা বাইরের পথে? বরাবরের মত আমরা কি ধরে নেব যে নারী ধরার অমিয়ধারায় অপাঙক্তেয়? একটা সাধারণ কথা সবার মনে রাখা দরকার- ফোঁড়া কাটতে হবে, অঙ্গ নয়। যা স্বাভাবিক এবং যাতে কোন অন্যায় নেই সে জীবনধারা আমরা অন্যায়কারীদের জন্য বিসর্জন দেবনা। প্রকৃত অস্বাভাবিকতা হল অন্যায়, তাই অন্যায়কেই বিদায় নিতে হবে আমাদের মধ্য থেকে, নারী-পুরুষ একত্রে বাঁচার ও চলার স্বাভাবিকতাকে নয়। আবারো বন্ধুরা মিলে বেড়াতে যাবে চেঙ্গেরখালে, শুধু হটাতে হবে ওই অমানুষ বখাটে দল ও মাঝির মত প্রাণীগুলোকে। একটা বড় আশার বিষয় হল ইতিমধ্যেই এলাকাবাসী মিলে এমনকি এলাকাবাসীর চাপে পড়ে কোন কোন বখাটের বাবা দুর্বৃত্ত ছেলেকে পুলিশের হাতে সোপর্দ করে প্রমাণ করেছেন যে অপরাধ সর্বদাই শাস্তির দাবি রাখে। এখন পরিবারের ও সমাজের দায়িত্ব হবে নারী-পুরুষের প্রথাগত দূরত্ব দূর করে পারস্পরিক সম্মানের ক্ষেত্র তৈরি করা এবং অপরাধের প্রতি ঘৃণা ও অসহিষ্ণুতা তৈরির মাধ্যমে একযোগে সকলকে প্রতিবাদে মুখর করে তোলা । আর রাষ্ট্রের দায়িত্ব হল কঠোর আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা ও বিচারব্যবস্থা নিশ্চিত করার মধ্য দিয়ে অপরাধের সুযোগ শূণ্যের কোঠায় নিয়ে আসা। অনিক ও খায়রুল আর কখনো ফিরবেনা, তাদের সহপাঠীরা হয়ত সে আগের মত উচ্ছল জীবনে আর ফিরতে পারবেনা, তবু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ও বিচারব্যবস্থার আছে অনেক কিছু করার। তাদের নিশ্চিত করতে হবে যাতে অনিক আর খায়রুলই হয় এমন নির্মমতার শেষ বলি, অপরাধীরা যেন আর কখনোই সাহস না পায় অমানুষ হবার।

লেখাটা দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত হয়েছিল বেশ কিছুদিন আগে। গতকাল এক ভাইয়ের সাথে আড্ডা দিতে গিয়ে মেয়েদের নিরাপত্তা, যৌন হয়রানি, ইভটিজিং ইত্যাদি বিষয় নিয়ে আলাপ করছিলাম, তখনকার কথাগুলো মাথায় রয়ে গেছে বলেই পুরনো এই লেখার সূত্র ধরে কিছু লিখতে বসলাম। ভাইয়া প্রশ্ন করেছিলেন, সমাজের যে অবস্থা তাতে আমার মেয়ে (যার এখনো জন্মই হয়নি, উনি অবিবাহিত যুবক!) কিভাবে বড় হবে? ভাল থাকবে? তিনি বলছিলেন তিনি সবসময় ভয়ে থাকবেন ইভটিজারদেরকে নিয়ে বা খারাপ মানুষদেরকে নিয়ে যাদের কাছ থেকে আমাদের সমাজে একটা মেয়ের শারীরিক ও মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবার আশঙ্কা রয়েছে। আমি তখন আমার কিছু মত বলেছিলাম যা এখানে তুলে ধরছি। আমি মনে করি আশেপাশের যে মানুষগুলো আছে, যারা একটা মেয়ের দিকে বাকা চোখে তাকায়, কটু মন্তব্য করে, নারীকে শুধুই ভোগ্য বস্তু মনে করে, স্বাধীনচেতা মেয়েদেরকে কটাক্ষ করে, তাকে নিয়ে রসালো গল্প করতে ভালবাসে, একজন নারীকে সফল হতে দেখলে চোখ টাটায় বলে খুব তুচ্ছ ব্যাপার যেমন তার পোশাক পরার ধরণ-হাঁটার ধরণ-ছেলেমেয়ে নির্বিশেষে সকলের সাথে সহজভাবে মেলামেশা ইত্যাদিতে ইজ্জত গেল গেল বলে চেচায় তাদেরকে আমি কখনোই বদলাতে পারবনা। তাই যেটা আমাকে করতে হবে তা হল আমাকে শক্তিশালী হতে হবে। একজন মানুষ যখন আমাকে নিয়ে অকারণ বাজে মন্তব্য, কটাক্ষ বা সমালোচনা করবে তখন সে কিন্তু নিজের নীচু মানসিকতারই প্রমাণ দেবে। আর যেই মানুষটার মানসিকতা নীচু, চিন্তাধারা মধ্যযুগীয় তার কথায় আমি কেন কান দেব? আমি নিজের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে শক্ত হতে শিখেছি। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি, অর্থনৈতিকভাবে পুরোপুরি স্বাবলম্বী, স্বাধীনভাবে চলি, তবু আমার আগের বাসার হুজুররা-আন্টিরা এবং আশেপাশের বাসায় আন্টি আঙ্কেলরা নির্ঘুম রজনী কাটাচ্ছেন বোরকা পরা মায়ের মেয়ে আমি কেন প্যাকেট মুড়িয়ে চলিনা তা নিয়ে এবং প্রতিনিয়ত তাদের বিনিদ্র রজনীযাপনের কথা আমার মাকে বলে আমার জীবনটা রীতিমত নরকের পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছেন। আমার কষ্ট হচ্ছে কারণ আমার মা ছোটবেলা থেকে শিখে এসেছেন, বুঝে এসেছেন, এবং ভয় পেয়ে এসেছেন, “পাছে লোকে কিছু বলে/ মেয়ে হল মেয়ে। মেয়ে মানুষ যাই করুক তাদের নীচু হয়েই চলতে হবে ” ইত্যাদি। এই হল মোটামুটি একটা উদাহরণ। এভাবে সমাজ প্রতিনিয়তই অন্যের স্ত্রী-কন্যা-বোন-ভাবী নির্বিশেষে নারীদেরকে নিয়ে ভেবে ভেবে নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছেন আর কারণে-অকারণে জাত গেল-জাত গেল বলে চেচাচ্ছেন। আমার মা তাদেরকে গুরুত্ব দেন, আর আমি দিইনা। আর ঠিক এই জিনিসটাই আমি আমার মেয়েকে শেখাব এবং আমি চাই প্রত্যেকটা মেয়ে শিখুক, নীচু মানসিকতার মানুষের কথাকে মূল্য দেবার কোন দরকার নেই। কিন্তু এই কথাটা শুধুমাত্র একজন মেয়েকে ভাবলেই চলবেনা, তার স্বজনদেরও ভাবতে হবে, কারণ সমাজ ও প্রথার রক্ষকদের (যাদের অনেকের দিকেই আঙুল তুলে একশ একটা কথা শোনানো যাবে) একশটা কথা মেয়েটাকে যতটা না ভেঙে দেবে, তার চেয়ে বেশি ভাঙবে যখন আপনি আপনার স্বজন মেয়েটিকে কোমল বা কঠোরভাবে বলবেন ও বোঝাবেন , “পাছে লোকে অনেক কিছু বলছে তো, তাই লোকের মন যুগিয়ে চল”। আমি এর আগে যৌনি হয়রানি নিয়ে একটা লেখায় বলেছিলাম, যৌন হয়রানির স্বীকার একটি মেয়ের আত্মহত্যা বা মনোবল ভেঙে দেয়ার জন্য উত্যক্তকারীর চেয়ে বেশি দায়ী মেয়েটির পরিবার যেখানে কোন সহায়তা না পেয়ে পায় দোষী খেতাব “নিশ্চয় তুই কিছু করেছিস, নইলে ঐ ছেলে তোকে উত্যক্ত করতে সাহস পেল কিভাবে?” ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি নিজেই আমার অনেক বন্ধুদের দেখেছি সচেতনভাবে “মেয়ে” হয়ে অর্থাৎ সংকুচিত হয়ে চলতে, একটা বাজে মন্তব্যে খুব বেশি ভেঙে পড়তে এমনকি কোন এক তুচ্ছ দোকানদারের বা রাস্তার ছেলের মন্তব্যকেও গুরুত্ব দিয়ে মানসিক বিপর্যয়ে পড়তে… কিন্তু কেন? অসুস্থ এবং সংকীর্ণ মানসিকতার একজন মানুষ কেন এত গুরুত্ব পাবে? আমাদের জীবনটা অনেক ছোট এইসব ফালতু মানুষের কথায় কান দিয়ে নিজের জীবনের হাসি-আনন্দ ও স্বাধীনতাকে মাটি করার জন্য। তবে হ্যা সমাজে অমানুষের অভাব নেই, তাই থাকতে হবে সতর্ক কিন্তু বন্দী নয়। নিজেকে গুটিয়ে নেয়া কোন সমাধান নয়। আশা করি প্রতিটি মেয়ে শিখবে কিসে গুরুত্ব দিতে হয় আর কিসে দিতে হয়না আর তারা সকলেই পাবে পরিবারের সহায়তা। এবং তারা নিজেরা যে সহায়তা পরিবার থেকে পায়নি নিজের পারিবারিক জীবনে নিজের অনুজদের বা সন্তানদের সেই সহযোগিতা দেবে। বাবা-মার মত একটা বয়সে এসে গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দিয়ে কনজারভেটিভ হয়ে নিজের অনুজদের সম্ভাবনা ও আনন্দ নষ্ট করবেনা। আমার আশেপাশের কেউই বদলায়নি (এমনকি আমার মাও না) কিন্তু আমি “মানুষ” হয়ে বাঁচতে চাচ্ছি বলেই ফালতু মানুষ বা ফালতু কথা আমার গুরুত্ব পাচ্ছেনা, আর এই চেষ্টায় শত যুদ্ধের মাঝেও আমি উঁচু মাথা আর আত্মসম্মান নিয়ে ভাল আছি।