মার্চ মাসের  ২১ তারিখে একটি সংবাদের প্রতি নিশ্চয় অনেকেরই দৃষ্টি গিয়েছে-

ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার অভিযোগ ওঠায় কয়েকটি ফেসবুক পেইজ এবং একটি ওয়েবসাইট বন্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে আদালত। একটি রিট আবেদনে বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার ও বিচারপতি মুহাম্মদ খুরশীদ আলম সরকার বুধবার এই আদেশ দেয়। স্বরাষ্ট্র সচিব, তথ্য সচিব, পুলিশের মহাপরিদর্শক, র‍্যাবের মহাপরিচালক ও টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনকে (বিটিআরসি) এই আদেশ বাস্তবায়ন করতে হবে।

আদালত একইসঙ্গে এই পেইজ ও ওয়েবসাইট সংশ্লিষ্টদের চিহ্নিত করতে তদন্ত শুরুর নির্দেশও দিয়েছে।  আদেশের পর রিট আবেদনকারীর আইনজীবী ব্যারিস্টার মুহাম্মদ নওশাদ জমির বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এই সব ফেসবুক পেইজ এবং ওয়েবসাইটে হযরত মুহাম্মদ (স.) ও ইসলাম সম্পর্কে কটূক্তি করা হয়েছে।

ফেসবুক পেইজ ও ওয়েবসাইটের ঠিকানা প্রকাশ করতে তিনি রাজি হননি। পাঁচটি ফেসবুক পেইজ এবং একটি ওয়েবসাইটের কথা তুলে ধরে বুধবার সকালে হাই কোর্টে রিট আবেদনটি করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক বাতুল সারওয়ার এবং ঢাকা সেন্টার ফর ল অ্যান্ড ইকোনোমিকসের অধ্যক্ষ এম নুরুল ইসলাম।

খবরটা দেখে প্রথমেই মনে হল, ‘চোখ নেই, কান নেই, কোনো বর্ণ নেই  শৃঙ্খলিত নিশ্চল ঈশ্বর’ প্রকৃতির গালিচায় বসে যেন কাঁদছেন। হ্যাঁ, আধুনিক বিশ্বে ঈশ্বর পরিণত হয়েছেন এক নপুংসক সত্ত্বায়; তাই ঈশ্বরের অনুভূতি, ইমেজ এবং  মানসম্মান তিনি নিজে রক্ষা করতে পারেন না, সেই সুমহান দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে তার কিছু পোষা বাহিনীর উপর। নিষ্ফল প্রার্থনা আর ব্যর্থ মোনাজাতে তেমন কাজ হচ্ছিলো না তাই অদৃশ্য ঈশ্বরের ঈশ্বরানুভূতি আর ধর্মানুভূতি আক্রান্ত হওয়ায় তার কিছু প্রিয় বান্দা আদালতের শরণাপন্ন হয়েছেন। রাষ্ট্র-যন্ত্রকে যুক্ত করেছেন।

এটা যে হবেই তা আমরা জানতাম।  রাষ্ট্র-যন্ত্র সবকিছুকেই নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। মিডিয়া, টিভি, পত্রপত্রিকা, বইপত্র সবই। ইন্টারনেট আসার পর তাদের রাশ আলগা হয়ে যাচ্ছিলো ক্রমশ। যুৎ করতে পাচ্ছিলেন না তারা। এখন ধর্মানুভূতি রক্ষায় একাট্টা হয়েছেন। তারা নাকি ফেসবুকের পাঁচটি পেইজ আর একটি ওয়েবসাইট বন্ধ করে দেবেন।  তারা আক্রান্ত বোধ করছেন।  অভিযোগ পুরনো। সেই ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত।  বিষয়টি নিয়ে গভীর আলোচনায় ঢুকার আগে কিছু প্রাসঙ্গিক বিষয় নিয়ে আলাপ সেরে নেয়া দরকার।

গ্যালিলিওর শিক্ষা
১৬৩৩ সাল। মানুষের মনে পৃথিবী নয়, সূর্য তখন পৃথিবীর চারিদিকে ঘুরছে। কিন্তু গ্যালিলিও তাঁর নতুন তৈরি করা টেলিস্কোপটির পর্যবেক্ষণ বর্ণনা করে, যুক্তি-তর্ক দিয়ে আস্ত একটা বই লিখে ফেললেন বাইবেলীয় মতবাদের বিরোধিতা করে। তিনি বললেন, সূর্য নয়, বরং পৃথিবীই ঘুরছে সূর্যকে কেন্দ্র করে। গ্যালিলিও তখন প্রায় অন্ধ, বয়সের ভারে ন্যুব্জ। অসুস্থ ও বৃদ্ধ বিজ্ঞানীকে জোর করে ফ্লোরেন্স থেকে রোমে নিয়ে যাওয়া হলো, হাঁটু ভেঙে সবার সামনে জোড় হাতে ক্ষমা প্রার্থনা করিয়ে বলতে বাধ্য করা হলো, এতদিন গ্যালিলিও যা প্রচার করেছিলেন তা ধর্মবিরোধী, ভুল ও মিথ্যা। বাইবেলে যা বলা হয়েছে সেটিই আসল, সঠিক। পৃথিবী স্থির-অনড়, সৌর জগতের কেন্দ্রে। গ্যালিলিও প্রাণ বাঁচাতে তাই করলেন। স্বীকারোক্তি ও প্রতিজ্ঞাপত্র স্বাক্ষর করে গ্যালিলিও বলেছিলেন-

‘…সূর্য কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত ও নিশ্চল- এরূপ মিথ্যা অভিমত যে কীরূপ শাস্ত্রবিরোধী সেসব বিষয় আমাকে অবহিত করা হয়েছিল; এ মিথ্যা মতবাদ সম্পূর্ণরূপে পরিহার করে এর সমর্থন ও শিক্ষাদান থেকে সর্বপ্রকারে নিবৃত্ত থাকতে আমি এই পবিত্র ধর্মসংস্থা কর্তৃক আদিষ্ট হয়েছিলাম। কিন্তু তৎসত্ত্বেও সে একই নিন্দিত ও পরিত্যক্ত মতবাদ আলোচনা করে ও কোনো সমাধানের চেষ্টার পরিবর্তে সেই মতবাদের সমর্থনে জোরালো যুক্তিতর্কের অবতারণা করে আমি একটি গ্রন্থ রচনা করেছি। এজন্য গভীর সন্দেহ এই যে আমি খ্রিস্ট ধর্মবিরুদ্ধ মত পোষণ করে থাকি। …. অতএব সঙ্গত কারণে আমার প্রতি আরোপিত এই অতি ঘোর সন্দেহ ধর্মাবতারদের ও ক্যাথলিক সম্প্রদায়ভুক্ত প্রত্যেকের মন হতে দূর করার উদ্দেশ্যে সরল অন্তঃকরণে ও অকপট বিশ্বাসে শপথ করে বলছি যে পূর্বোক্ত ভ্রান্ত ও ধর্মবিরুদ্ধ মত আমি ঘৃণা ভরে পরিত্যাগ করি।…’

পোপ এবং ধর্মসংস্থার সামনে গ্যালিলিও যে স্বীকারোক্তি এবং প্রতিজ্ঞাপত্র সাক্ষর করেন, তা বিজ্ঞান সাধনার ইতিহাসে ধর্মীয় মৌলবাদীদের নির্মমতার এবং জ্ঞান সাধকদের কাছে বেদনার এক ঐতিহাসিক দলিল হয়ে আছে।  বিজ্ঞান ও ধর্মের সংঘাতের একটা উদাহরণ দেখাতে গিয়ে প্রাসঙ্গিক ভাবেই আমাদের লেখা অবিশ্বাসের দর্শন (শুদ্ধস্বর, ২০১১) বইটিতে টেনে আনতে হয়েছিলো গ্যালিলিওকে। বিজ্ঞান বা ধর্মের সংঘাত আমাদের আজকের লেখার বিষয়বস্তু না হওয়া সত্ত্বেও এই উদাহরণের অবতারণা করতে হল- কারণ কোপারনিকাস, ব্রুনো কিংবা হাল আমলের ডারউইনের জীবন ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা মানব সমাজের একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্যের দারুণ প্রয়োগ দেখতে পাই। সে বৈশিষ্ট্যটি কী? ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় মুখ বন্ধ করে, হেনস্থা করে কাউকে দাবিয়ে রাখা যায় না। সত্য প্রকাশিত হবেই। কোপার্নিকাস, গ্যালিলিও,  ব্রুনোর উপর অত্যাচারের পরেও ঈশ্বরের পুত্ররা সূর্যের চারিদিকে পৃথিবীর ঘোরা থামাতে পারে নি। পারেনি বিবর্তনকে বিজ্ঞানের মূল ধারা থেকে হটাতে।

তারপরেও কেউ কেউ নিজেদের কান বন্ধ রাখতেই ভালবাসে। তারা ধরে নেয়,  সবাই চুপ করে থাকলে সব আগের মতোই থাকবে, পৃথিবীকে রাণী বানিয়ে চারপাশে ঘুরবে সূর্য, চন্দ্র, গ্রহ, তারা, তারা চায় মিথ্যার মাঝে বসবাস করতে। অথচ পাঠ্য বইয়েই তারা ছোট থেকে সত্য কথা বলার কথা শিখে। তারা দাবী করে ধর্মেই আছে সত্য কথা বলার কিংবা সত্য পথে চলার নির্দেশ। অথচ তারাই কোপারনিকাস, গ্যালিলিওর টুটি চেপে ধরে থামাতে চেয়েছে পৃথিবীর ঘূর্ণন। বিপরীত মত প্রকাশের জন্য তারাই অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদকে করেছিল রক্তাক্ত।

ধর্মের ‘ব্যাশিং’-এ আপত্তি?  অন্য কিছুতে নয় কেন?
অনেকের মনেই এরকম একটা ধারণা জন্মে গেছে যে, ধর্মকে ‘ব্যাশিং’ করা যাবে না, সমালোচনা করা যাবেনা, করলেও করতে হবে বুঝে শুনে, মাথায় ফুল চন্দন দিয়ে।

ব্যাপারটা হাস্যকর। পৃথিবীতে এমন কিছু নেই  যার সমালোচনা হয় না। ছাত্রদের ইতিহাস পড়াতে গিয়ে  কোন ঐতিহাসিক ভয় পান না এই ভেবে যে, চেঙ্গিস খানের সমালোচনা করা যাবে না, পাছে ‘চেঙ্গিসানুভূতি’ আহত হয়! কেউ ইতিহাস চর্চা করতে গিয়ে ভাবেন না দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাৎসিদের অত্যাচারের কথা কিংবা জাপানী বর্বরতার কথা অথবা আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাক বাহিনীর নৃশংসতার কথা বলা যাবে না।  কেউ বলেন না, এতে করে কারো ইতিহাসানুভূতিতে আঘাত লাগছে, মামলা করে দেবে!  প্রথম আলোর মত পত্রিকা যখন বিজ্ঞানের নামে আগডুম বাগডুম পরিবেশন করে, আমরা বলি না আমরা আদালতের শরণাপন্ন হব, আমাদের বিজ্ঞানুভূতি বিপন্ন। অথচ ধর্মের ক্ষেত্রে সব কিছু হয়ে যায় ব্যতিক্রম। ধার্মিকদের ভঙ্গুর অনুভূতি সামান্যতেই আঘাতপ্রাপ্ত হয়। ধর্মযুদ্ধের নামে বিধর্মীদের উপর কি ধরণের অত্যাচার করা হয়েছিলো তা বললে তাদের ধর্মানুভূতি আঘাতপ্রাপ্ত হয়, পয়গম্বর-নবী-রসুল আর ধর্মের দেবদূতদের অমানবিক কার্যকলাপ তুলে ধরলে ধর্মানুভূতি আঘাতপ্রাপ্ত হয়,  নারীদের অন্তরিন করে তাদের অধিকার হরণ করা হয় তা বললে আঘাতপ্রাপ্ত হয়, ধর্মগ্রন্থ গুলোতে বর্ণিত অবৈজ্ঞানিক আয়াত বা শ্লোক তুলে ধরলেও তারা আহত হন।  আর ব্যঙ্গ বিদ্রূপ করা হলে তো কথাই নেই; ঈশ্বর যে ‘খুঁটি ছাড়া আকাশকে ছাদ স্বরূপ ধরে রাখেন’ তা যেন চৌচির হয়ে তাদের মাথায় তৎক্ষণাৎ ভেঙ্গে পড়ে। ধর্ম সব সময়ই কৌতুকের বড় উৎস হলেও ব্যঙ্গ এবং কৌতুকবোধের ব্যাপারটা ধার্মিকদের সাথে সবসময়ই কেন যেন রেসিপ্রোকাল। অথচ, সাহিত্য, রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি চলচ্চিত্র, খেলাধুলা বা অন্যান্য যাবতীয় বিষয়কে সমালোচনা, ব্যঙ্গ বিদ্রূপ করতে তাদের বিন্দুমাত্র আপত্তি নেই।  কেবল ধর্মের বেলাতেই গণেশ উল্টে যায় বরাবরই।

সমালোচনার ব্যাপারটা আরেকটু খোলসা করা যাক। আমাদের চারিদিকের সমাজ ব্যবস্থার দিকে তাকালে দেখব, আওয়ামীলীগ বিএনপির সমালোচনা করছে, বিএনপি আওয়ামীলীগের। আমেরিকায় রিপাবলিকানরা করছে ডেমোক্রেটদের দর্শনের সমালোচনা কিংবা বিরোধিতা, আবার অন্যদিকে ডেমোক্রেটরা রিপাবলিকানদের।  সমাজতান্ত্রিক আর পুঁজিবাদী ঘরনার লোকেরা যে যার দৃষ্টিকোণ থেকে পরস্পরের সমালোচনা করছে। সমাজ, সাহিত্য, ইতিহাস, বিজ্ঞান, ক্রীড়াতত্ত্ব, প্রযুক্তি – কোনটাই সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয়, কিন্তু ধর্মের বেলাতেই ধর্মবাদীরা যেন তালগাছটি বগলে নিয়ে বসে থাকার পণ করেছেন। তারা ধর্মের যে কোন প্রাসঙ্গিক সমালোচনা, ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ কিংবা সংশয়কে চিরতরে নিষিদ্ধ করতে চান, কখনো ধর্মানুভূতির দোহাই দিয়ে, কখনো জনমতের দোহাই দিয়ে, কখনোবা আবার জনশৃংখলা রক্ষার ধোয়া তুলে। তারা চান ধর্মকে ‘মোমের পুতুল’ বানিয়ে হাতের তোলায়  রেখে  কিংবা পোষা বিড়ালের মতো কোলে নিয়ে অবিরত মাথায় হাত বুলিয়ে যেতে। জ্ঞান-বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখার  অপছন্দনীয় বিষয়ের নির্দয় সমালোচনা ধর্মবাদীরা করেন না তা নয়। খুব ভালভাবেই করেন। যেটা পছন্দ না সেটা বলে ফেলেন এক নিমেষেই। তারাও আমাদের মতোই কঠোর সমালোচনা করেন,  ডারউইনের গলার সাথে বাঁদরের  দেহ জুড়ে দিয়ে কার্টুন আঁকেন, মেয়েরা তাদের পছন্দসই কাপড় চোপড় না পড়লে ফতোয়া দেন, একে তাকে মুরতাদ ঘোষণা করে হত্যার হুমকি দেন, এমন কিছু নেই যে তারা বাদ রাখেন, অথচ ধর্মের বেলায় তারা হাস্যকর ভাবে সমস্ত নিয়মের ব্যতিক্রম চান।

ধর্মবাদীরা অবশ্য তাদের সবকিছুকেই নিয়মের বাইরে রাখতে চান।  তারা মনে করেন  তাদের মহান ঈশ্বর এই বিশ্বজগতসহ সব কিছু পরম মমতাভরে বানিয়েছেন। কিন্তু যদি উল্টে কোন দুর্মুখ প্রশ্ন করে তবে ঈশ্বরকে কে বানালো? তখনই তারা বলবেন, ঈশ্বরকে রাখতে হবে নিয়মের বাইরে। ‘ও সব প্রশ্ন কোরোনা – বোবা কালা হয়ে থাক’।  একই ধারায় তারা চান পৃথিবীর সবকিছুর সমালোচনা, ব্যঙ্গ, বিদ্রূপ চলবে, কেবল ধর্মের বেলায় – নৈবচঃ  নৈবচঃ ।  আসলে ধর্মবাদীদের এই ছেঁদো যুক্তিতে কান দিয়ে শুধু ধার্মিকেরা নন, আমরা মুক্তমনারাও অনেক সময়  নিজেদের অজান্তেই তাদের পাতা ফাঁদে পা দিয়ে ফেলি এবং পরিশেষে আমাদের পতন ডেকে আনি। আসলে এমন কোন যুক্তি কারো থলিতে নেই যা মেনে ধর্মকে সমালোচনার চোখে দেখার থেকে অব্যাহতি দেওয়া যায়। অন্য সব কিছুর সমালোচনা হলেও ধর্মের বেলায় মাথায় হাত বোলাতে হবে – সেটা তো হওয়া উচিত নয়। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, বিশেষ করে বাংলাদেশের মত রাষ্ট্রগুলোতে ধর্ম ব্যাপারটি এতটাই সমাজের হাড়ে-মজ্জায় ঢুকে গেছে যে, ধর্মকে সমালোচনার হাত থেকে বাঁচানোকেই আমরা এখন স্বতঃসিদ্ধ বলে মনে করি।

আমরা, অবিশ্বাসের দর্শন বইয়ের দুই লেখক আমাদের বইয়ের সপ্তম অধ্যায় (ধর্মীয় নৈতিকতা)-এ আমরা বলেছিলাম, কেন ধর্মের সমালোচনাকে ব্যতিক্রম হিসবে দেখার কোন যুক্তি থাকতে পারে না। আমরা বলেছিলাম,

মানবতাবাদীরা আর যুক্তিবাদীরা কেন ধর্মগ্রন্থগুলোর সমালোচনা করেন? সমালোচনা করেন কারণ তা সমালোচনার যোগ্য, তাই। কোন কিছুই তো আসলে সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয়- তা সে অর্থনীতি বা পদার্থবিজ্ঞানের নতুন কোন তত্ত্বই হোক, বা আল্লাহর ‘মহান’ বাণীই হোক। আসলে পুরো ধর্ম বিশ্বাসই তো দাঁড়িয়ে আছে এক জলজ্যান্ত মিথ্যার উপর ভর করে। ধর্ম মানেই আজ কিছু অবৈজ্ঞানিক চিন্তা-চেতনা, কুসংস্কার আর রীতি-নীতির সমাহার, যেগুলো কালের পরিক্রমায় উপযোগিতা হারিয়েছে। ধর্মের সমালোচনার আর একটি বড় কারণ হল, ধর্মগ্রন্থগুলোর মধ্যে বিরাজমান নিষ্ঠুরতা। ধর্মগ্রন্থগুলি তো আর গীতাঞ্জলী বা সঞ্চিতার মত নির্দোষ কাব্যসমগ্র নয় যে অবসর সময়ে শুয়ে শুয়ে কাব্য চর্চা করলাম আর তারপর আলমারির তাকে তুলে রেখে দিলাম ! ধর্মগ্রন্থগুলিতে যা লেখা আছে তা ঈশ্বরের বাণী হিসেবে পালন করা হয় আর উৎসাহের সাথে সমাজে তার প্রয়োগ ঘটান হয়। হিন্দু ধর্মগ্রন্থগুলোতে বর্ণিত সতীদাহর মাহাত্ম্যকে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে শুধুমাত্র ১৮১৫ সাল থেকে ১৮২৬ সালের মধ্যে সতীদাহের স্বীকার হয়েছে ৮১৩৫ জন জন নারী। এই তো সেদিনও – ১৯৮৭ সালে রূপ কানোয়ার নামে একটি মেয়েকে রাজস্থানে পুড়িয়ে মারা হল ‘সতী মাতা কী জয়’ ধ্বনি দিয়ে। সারা গ্রামের মানুষ তাকিয়ে তাকিয়ে দেখল – কেউ টু শব্দটি করল না। আর করবেই বা কেন? ধর্ম রক্ষা করে হবে না? মহাভারতের কথা শুনলে যেমন পুণ্য হয়, সতী পোড়ানো দেখলেও নাকি তেমনি। ধর্ম যে কি কিরকম নেশায় বুদ করে রাখে মানুষকে, তার জলজ্যান্ত প্রমাণ এই সতীদাহ। এ জন্যই বোধ হয় প্যাস্কাল বলেছেন – ‘Men never do evil so completely and cheerfully as when they do it from religious conviction.‘ খুবই সত্যি কথা। চিন্তা করুন ব্যাপারটা – জীবন্ত নারী মাংস জ্বলছে, ছটফট করছে, অনেক সময় বেঁধে রাখতে কষ্ট হচ্ছে, মাঝে মাঝে পালাতে চেষ্টা করছে – আফিম জাতীয় জিনিস গিলিয়ে দিয়ে লাঠি দিয়ে খুঁচিয়ে আবার চিতায় তুলে দেওয়া হচ্ছে – কী চমৎকার মানবিকতা ! প্রায় প্রতিদিনই পত্র-পত্রিকায় পড়ছি যে, ইসলামী বিশ্বে শরিয়া আইনের শিকার হয়ে প্রাণ হারাচ্ছে অসহায় সাফিয়া, আমিনারা। কোরআনের আয়াত উদ্ধৃত করে কাফিরদের বিরুদ্ধে রোজই যুদ্ধের হাঁক পাড়ছে বায়তুল মোকারমের ‘বিখ্যাত’ খতিব (অধুনা মৃত)। তবুও নেশায় বুদ হয়ে ধর্ম আর ধর্মগ্রন্থের মধ্যে ‘শান্তি’, ‘প্রগতি’ আর ‘সহিষ্ণুতা’ খুঁজে চলেছেন মডারেট ধর্মবাদীরা।

সমালোচনায় যদি ধার্মিকদের এতোই আপত্তি থাকে তাহলে তাদেরকেই বলতে হবে কেন তাদের আরাধ্য ধর্মগ্রন্থগুলোতে এত হিংসা-বিদ্বেষ আর হানাহানির ছড়াছড়ি। অবিশ্বাসীদের যেখানেই পাওয়া যাক তাদের হত্যা করতে, তাদের সাথে সংঘাতে লিপ্ত হতে, কঠোর ব্যবহার করতে, গর্দানে আঘাত করতে – এই ধরণের আক্রমণাত্মক কথা তো পবিত্র ধর্মগ্রন্থতেই লিপিবদ্ধ আছে। বিধর্মীদের কিংবা সমকামীদের ঢালাওভাবে ঘৃণা করার কিংবা হত্যা করার কথাও সেসব বাণীতেই আছে। আছে নারীদের ঘোড়া, গাধা কিংবা শস্যক্ষেত্রের সাথে তুলনা করার মত রুচিহীন ইঙ্গিতসমৃদ্ধ আয়াত কিংবা শ্লোকও। সেইসব রুচিহীন হিংসা বিদ্বেষ ছড়ানো বানীগুলোকে ঈশ্বরের বাণী বানিয়ে কপালে ঠেকিয়ে, চুমু খেয়ে অবিরত ধারায় পাঠ করে যেতে তাদের আপত্তি নেই, আপত্তি কেবল যদি কোন বদমায়েশ নালায়েক কখনো সেগুলো ভুল করে ব্লগে বা সাইটে উল্লেখ করে ফেলে!  শুধু ধর্মে কেন, ধর্মপ্রচারক-নবী-রসুল -পয়গম্বরদের নান পবিত্র কাজ-কর্মেও বহু সহিংসতা আর অমানবিকতার অগুনতি উপাদান ছড়িয়ে আছে। বনি কুয়ানুকা, বনি নাদির আর বনি কুরাইজার ইহুদী গোত্রকে আক্রমণ করে নিরপরাধ নারী, পুরুষ শিশুকে যেভাবে হত্যা করা হয়েছে, সেগুলোকে ক্যারেন আর্মস্ট্রং এর মত ‘ইসলামের প্রতি সহানুভূতিশীল’ লেখিকাও নাৎসি গণহত্যার সাথে তুলনা করতে বাধ্য হয়েছেন।  বেদ পাঠ করার অপরাধে নিরপরাধ শম্বুককে শিরোচ্ছেদ করার কথা কিংবা ধর্ষণের জন্য কুমারী বাদে সব বৃদ্ধ নারী এবং শিশুদেরকে মেরে ফেলার নির্দেশ বিভিন্ন ধর্মের পয়গম্বরদের কাজের মধ্যেই পাওয়া যায়। মক্কা বিজয়ের পর যেভাবে কাবার সমস্ত মূর্তি ধ্বংস  করা হয়েছিলো, অন্য মানুষ আজ সেটা করলে যে কোন আদালতই একে প্রতিপক্ষের ধর্মানুভূতির উপর আঘাত কিংবা জনশৃংখলা ভঙ্গের দায়ে অভিযুক্ত করতেন।  কাজেই ‘ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করা সংবিধানবিরোধী কাজ’ কিংবা ‘রাষ্ট্রদ্রোহী কাজ’ মনে হলে সবার আগে তাদের অভিযুক্ত করা উচিৎ মুখে শান্তির বুলি আওরানো কিন্তু কাজে সর্বদা হানাহানিতে লিপ্ত বিভিন্ন ধর্মের দূত এবং পয়গম্বরদেরই।

স্বর্গীয় দেবদূত আর পয়গম্বরদের কাজের কথা না হয় বাদ থাকুক; দেশের মানুষের কথাই ধরুন। মাননীয় আদালত কি ভুলে গেছেন, বিগত বিএনপি জামাতের আমলে – ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট দেশব্যাপী একযোগে বোমা হামলা চালানোর ঘটনা?  সেদিন সারা বাংলাদেশে ৬৩টি জেলায় একনাগাড়ে বোমার মহড়া চালানো হয়। মহড়ার প্রকোপ এমনই ব্যাপক ছিল যে অনেকেই ১৭ ই আগস্ট দিনটিকে সে সময় ‘বাংলাদেশের ৯/১১’ বলে অভিহিত করেছিলেন। বোমা মহড়ার স্থানগুলোতে পাওয়া তাদের ছাপানো লিফলেটগুলোর কথা কি মনে আছে? সারা লিফলেট জুড়েই তো ছিলো কোরান আর হাদিস থেকে নানা উদ্ধৃতি আর কাফের নাফরমানদের বিরুদ্ধে জিহাদের ডাক। ছিলো না? এগুলো যদি ইসলাম ধর্মকে ভুল বোঝা একদল সন্ত্রাসীর কাজ হয়, তাহলে তো তাদের বিরুদ্ধেও ধর্মানুভূতিতে আঘাতের প্রতিবাদ করা দরকার ছিলো। তারা তো কেবল আঘাত করে ক্ষান্ত থাকেন নি, তারা তো শান্তির ধর্ম ইসলামকে বেদখল করেছেন। রুমানা মঞ্জু্রকে তার স্বামী রীতিমত অন্ধ বানিয়ে দেবার পর তাকে নিয়ে নানা কুৎসা রটনা হয়েছে ফেসবুকে, জাফর ইকবালের মেয়েকে জড়িয়ে, তার নানা ছবি দিয়ে ভরাট করে রাখা হয়েছে ইন্টারনেট। দুঃখ এটাই, আজকে ফেসবুক ভরে গেছে ‘আপা ওড়না গলায় ক্যান, বুকে দেন’ টাইপের অন্তত শ’খানেক পেইজ যেগুলোতে  নারীদের  প্রতিনিয়ত অপমান করা হয়, বিবস্ত্র করা হয়, বিকৃত মজা উপভোগ করা হয়- সেসব নিয়ে কারও কোনো কথা নেই। কথা থাকার অবশ্য কথাও না। তাদের কারো সমস্যা হয় না ফটোশপে ছবি রদবদল করে কুমড়া, জাম্বুরা  কিংবা গাছের ছালে আল্লাপাকের নাম লিখে আর পেইজ বা গ্রুপ খুলে সেই মিথ্যে অলৌকিকতার বিস্তারে। সবগুলোতেই এক শ্রেনীর মানুষকেই বেশি দেখা যায়, প্রতিটিতেই মাঝে মাঝে ধর্ম গুনগানের পোস্ট। সওয়াব আর গুণা কাটাকাটি করার জন্যই বোধহয়।  নির্বুদ্ধিতা আর অপগণ্ডামির নিরন্তর প্রচারে কারো সমস্যা নেই, যত সমস্যা হয় ‘পবিত্র’ ধর্মের নামে চলমান এই সব  কুসংস্কার আর অপবিশ্বাসের বিরোধিতা করলেই।

অথচ ধার্মিকদের ধর্মানুভূতির মতো আমাদেরও ‘নাস্তিকানুভূতি’ আহত হতে পারতো। প্রতিনিয়ত হয়ও।  আমাদের নাস্তিকানাভূতি প্রতিদিনই আহত হয়,  যখন দেখি টিভি খুললেই কিংবা কোন রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান শুরু হলেই কোরান তেলোয়াত আর গীতা, ত্রিপিটক আউরে অদৃশ্য এবং অলীক ঈশ্বরকে খুশি করে অনুষ্ঠান শুরু করতে হয়; আমাদের অবিশ্বাসের দর্শনানুভূতি আহত হয় যখন জোর করে ধর্মশিক্ষার মত রূপকথাকে মাধ্যমিক স্তরে সবার জন্য বাধ্যতামূলক করা হয়, আমাদের বিজ্ঞানুভূতি আহত হয় যখন মেরাজ আর বোরাকের রূপকথাকে আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতত্ত্ব টেনে এনে বৈধতা দেয়ার চেষ্টা করা হয় কিংবা বিবর্তনকে পাঠ্যপুস্তক থেকে অস্পৃশ্য করার উদ্যোগ নেয়া হয়। কিন্তু এর জন্য কারো অনুভূতি ক্ষুন্ন হতে দেখি না, মামলাও হয় না, হয় কেবল এর বিপরীতটি ঘটলেই।

ধর্মানুভূতি – সমাজের এক নতুন ইন্দ্রিয় যেন

অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ ধর্মানুভূতির উপকথা নামে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন কয়েক বছর আগে।  তিনি এই ধর্মানুভূতির উপকথা প্রবন্ধটি লেখার পর নিজেই মুক্তমনায় ইমেল করেছিলেন প্রকাশের জন্য।  লেখাটি মুক্তমনা সাইটে রেখে দেয়া হয়েছিলো পিডিএফ আকারে । পরে অধ্যাপক আজাদ এই প্রবন্ধটিকে নিজের বইয়ে সংকলিত করেন যে বইটির শিরোনামও ছিল ‘ধর্মানুভূতির উপকথা’। ব্যতিক্রমধর্মী এ প্রবন্ধটি পরবর্তীতে মুক্তমনার সংকলন গ্রন্থ ‘স্বতন্ত্র ভাবনা’ (২০০৮) তেও প্রকাশিত হয়।   তিনি লেখাটিতে কিছু তাৎপর্যময় কথা বলেছিলেন যা, আজকের সময়েও অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক –

একটি কথা প্রায়ই শোনা যায় আজকাল, কথাটি হচ্ছে ‘ধর্মানুভূতি’। কথাটি সাধারণত একলা উচ্চারিত হয় না, সাথে জড়িয়ে থাকে ‘আহত’ ও ‘আঘাত’ কথা দুটি; শোনা যায় ‘ধর্মানুভূতি আহত’ হওয়ার বা ‘ধর্মানুভূতিতে আঘাত’ লাগার কথা। আজকাল নিরন্তর আহত আর আঘাতপ্রাপ্ত হচ্ছে মানুষের একটি অসাধারণ অনুভূতি, যার নাম ধর্মানুভূতি। মানুষ খুবই কোমল স্পর্শকাতর জীব, তার রয়েছে ফুলের পাপড়ির মতো অজস্র অনুভূতি; স্বর্গ চ্যুত মানুষেরা বাস করছে নরকের থেকেও নির্মম পৃথিবীতে, যেখানে নিষ্ঠুরতা আর অপবিত্রতা সীমাহীন; তাই তার বিচিত্র ধরনের কোমল অনুভূতি যে প্রতিমুহূর্তে আহত রক্তাক্ত হচ্ছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। যখন সুদিন আসবে, সে আবার স্বর্গে ফিরে যাবে, তখন ওই বিশুদ্ধ জগতে সে পাবে বিশুদ্ধ শান্তি; সেখানে তার কোনো অনুভূতি আহত হবেনা, ফুলের টোকাটিও লাগবে না তার কোনো শুদ্ধ অনুভূতির গায়ে। অনন্ত শান্তির মধ্যে সেখানে সে বিলাস করতে থাকবে। কিন্তু পৃথিবী অশুদ্ধ এলাকা, এখানে আহত হচ্ছে, আঘাত পাচ্ছে, রক্তাক্ত হচ্ছে তার নানা অনুভূতি- এটা খুবই বেদনার কথা; এবং সবচেয়ে আহত হচ্ছে একটি অনুভূতি, যেটি পুরোপুরি পৌরাণিক উপকথার মতো, তার নাম ধর্মানুভূতি।

মানুষ বিশ্বকে অনুভব করে পাঁচটি ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে; ইন্দ্রিয়গুলো মানুষকে দেয় রূপ রস গন্ধ স্পর্শ শ্রুতির অনুভূতি; কিন্তু মানুষ, একমাত্র প্রতিভাবান সৃষ্টিশীল প্রাণী মহাবিশ্বে শুধু এ-পাঁচটি ইন্দ্রিয়েই সীমাবদ্ধ নয়, তার আছে অজস্র ইন্দ্রিয়াতীত ইন্দ্রিয়। তার আছে একটি ইন্দ্রিয়, যার নাম দিতে পারি সৌন্দর্যন্দ্রিয়, যা দিয়ে সে অনুভব করে সৌন্দর্য; আছে একটি ইন্দ্রিয়, নাম দিতে পারি শিল্পেন্দ্রিয়, যা দিয়ে সে উপভোগ করে শিল্পকলা; এমন অনেক ইন্দ্রিয় আছে তার, সেগুলোর মধ্যে এখন সবচেয়ে প্রখর প্রবল প্রচণ্ড হয়েছে হয়ে উঠেছে ধর্মেন্দ্রিয়, যা দিয়ে সে অনুভব করে ধর্ম, তার ভেতর বিকশিত হয় ধর্মানুভূতি, এবং আজকের অধার্মিক বিশ্বে তার স্পর্শকাতর ধর্মানুভূতি আহত হয়, আঘাতপ্রাপ্ত হয় ভোরবেলা থেকে ভোরবেলা। অন্য ইন্দ্রিয়গুলোকে পরাভূত ক’রে এখন এটিই হয়ে উঠেছে মানুষের প্রধান ইন্দ্রিয়; ধর্মেন্দ্রিয় সারাক্ষণ জেগে থাকে, তার চোখে ঘুম নেই; জেগে থেকে সে পাহারা দেয় ধর্মানুভূতিকে, মাঝেমাঝেই আহত হয়ে চিৎকার ক’রে ওঠে, বোধ করে প্রচণ্ড উত্তেজনা। এটি শিল্পানুভূতির মতো অনুভূতি নয় যে আহত হওয়ার যন্ত্রণা কেবল একলাই সহ্য করবে। এটা আহত হ’লে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। ধর্মানুভূতির উত্তেজনা ও ক্ষিপ্ততায় এখন বিশ্ব কাঁপছে।

হুমায়ুন আজাদের কথা একবর্ণ মিথ্যে নয়। ধর্মানুভূতি নামক জুজুর উত্তেজনা ও ক্ষিপ্ততায় এখন সারা বিশ্ব কাঁপছে। পাঠকদের নিশ্চয়ই মনে আছে, ২০০৬ সালে ড্যানিশ একটি পত্রিকায় মোহাম্মদ (সঃ) এর বেশ কয়েকটি কার্টুন প্রকাশের পর ধর্মানুভূতিতে আঘাতের অভিযোগে কিভাবে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিলো সারা মুসলিম বিশ্ব। যদিও ধর্মানুভূতি একটি অসংজ্ঞায়িত এবং নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে একটি অপরিমাপেয় ধারণা বই কিছু নয়। আদালতের উচিৎ পার্থিব বিষয় আশয়ে রুলিং দেয়া, ধর্মানুভূতির মতো অসংজ্ঞায়িত, অপরিমাপযোগ্য, বিমূর্ত বিষয়ে নয়।

ড্যানিশ পত্রিকায় ছাপা হওয়া কার্টুনগুলো পৃথিবীর প্রতিটি প্রান্তে এমনকি বাংলাদেশেও রাজনীতিবিদদের কার্টুন এর মানদণ্ডে মোটামুটি গোবেচারা ধরণের। সর্বমোট বারোটি ছবির মধ্যে, তিনটি কার্টুন ইসলাম এবং সন্ত্রাসের সম্পর্ক উদ্দেশ্য করে। আর এই কার্টুনগুলো ছাপানোর পরে পুরো পৃথিবীতে বিক্ষোভ প্রকাশে ফেটে পড়ে মুসলমানরা। সৌদি আরবের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ডেনমার্ক কর্তৃপক্ষকে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের আহবান জানান, এবং এমন ঘটনা যেনো ভবিষ্যতে কেউ করার সাহস না পায়, তার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের যথাযথ শাস্তি প্রদানের অনুরোধ করেন। এর ঠিক দুইবছর আগে ২০০৪ সালের সেপ্টেম্বরে নেদারল্যান্ডের একটি টেলিভিশন চ্যানেলে প্রথমবারের মতো সম্প্রচারিত হয় চলচ্চিত্র নির্মাতা থিও ভ্যান গগের স্বল্প-দৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘সাবমিশন’- যার মূল বিষয় ছিলো মুসলিম নারীর উপর আরোপিত ইসলামি সমাজের নির্যাতন কথা। থিও ভ্যান গগ আর তার চলচ্চিত্রের মাঝে সময়টা মোটে এক মাস। একই বছরের নভেম্বরের দুই তারিখ, ভ্যান গগ আমস্টার্ডামের রাস্তায় মুহাম্মদ বোয়েরি নামের এক ধর্মান্ধ মুসলমানের গুলিতে নিহত হন। গুলি করে মেরে ফেলেই খুনি ক্ষান্ত হয়নি, ছুরি দিয়ে তার মাথা আলাদা করে ফেলা হয়। ১৯৯২ সালে মিশরের লেখক ফারাজ ফদা ইসলামকে অপমান করার জন্য খুন হন, নোবেল পুরষ্কার পাওয়া মিশরের আরেক উপন্যাসিক নাগিব মাহফুজকে ধর্মানুভূতিতে আঘাতের উছিলায় ছুরিকাঘাত করা হয় ১৯৯৪ সালে, ২০০৪ সালের ২৭শে ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের প্রথাভাঙ্গা লেখক হুমায়ুন আজাদের উপর হামলা চালায় এদেশের একটি ইসলামী মৌলবাদী গোষ্ঠী। চাপাতি দিয়ে ক্ষত বিক্ষত করে ফেলা হয় তার দেহ,যা পরে তাকে প্রলম্বিত মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়।  দেশের সরকার অবশ্য এটাকে সেক্যুলারিস্টদের কাজ বলে পার পেতে চেয়ছিলো, তৎকালীন ইসলামিস্ট মন্ত্রী এও বলেছিলেন, বাংলাভাইরা সব মিডিয়ার সৃষ্টি।

ইসলামের সাথে সন্ত্রাসের সম্পর্ক আছে কি নেই সেই চায়ের পেয়ালায় ঝড় তোলা বিতর্কে না গিয়েও বলা যায়,  ডেনমার্কের পত্রিকায় প্রকাশিত কার্টুনগুলো কিছু বাস্তবতার দিকে আঙ্গুল প্রদর্শন করে যে বাস্তবতায় আছে বাংলার বাংলা ভাই, বিদেশের ওসামা বিন লাদেন, আইমান আল যাওয়াহ্‌রি, আবু হামজা, মোহাম্মদ আত্তা সহ হাজার হাজার জিহাদি যারা কোরআন এবং হাদিসের বানী দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে হত্যা করছে অসংখ্য নিরপরাধ মানুষকে। শান্তিপ্রিয় মুসলমানরা কার্টুনটি দেখে এই বাস্তবতাটা দেখতে পারতেন, সে বাস্তবতায় সত্যতা পেলে সেটা সমাধানে সচেষ্ট হতে পারতেন, কিন্তু আমরা মানুষেরা- যা দেখতে চাই না, তা দেখিনা, তাই মুসলমানরা ধর্মানুভূতিতে আঘাত লেগেছে বলে চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু করে দিলেন। ডেনমার্কের পত্রিকার ব্যান চাইলেন, সম্পাদক পেলেন মৃত্যুর হুমকি।

তারচেয়েও মজাদার ছিলো ব্রিটেনের ফ্যানাটিক মুসলিমদের কাজকর্ম। ব্রিটেনের মুসলিমরা সন্ত্রাসের সাথে যে ইসলামের কোন সম্পর্ক নেই, কিংবা ইসলাম যে কত শান্তিপূর্ণ ধর্ম, তা ‘প্রমাণ’ করতে রাস্তায় মিছিল করেছিল ব্যানার আর প্ল্যাকার্ড নিয়ে, যেগুলোতে লেখাছিলো – ‘Slay those who insult Islam’, ‘Butcher those who mock islam’,  ‘Behead those who say Islam is a violent religion’

ছবি – ড্যানিশ পত্রিকায় কার্টুন ছাপানোর পরে ব্রিটেনের মুসলিমরা সন্ত্রাসের সাথে যে ইসলামের কোন সম্পর্ক নেই, কিংবা ইসলাম যে কত শান্তিপূর্ণ ধর্ম, তা ‘প্রমাণ’ করতে রাস্তায় মিছিল করেছিল ব্যানার আর প্ল্যাকার্ড নিয়ে, যেগুলোতে লেখা ছিল ‘যারা বলে ইসলাম ভায়োলেন্ট রিলিজিয়ন, তাদের কতল করুন’, কিংবা ‘ইসলামকে ব্যঙ্গ যারা করে তাদের ম্যাসাকার করুন’।

‘যারা বলে ইসলাম ভায়োলেন্ট রিলিজিয়ন, তাদের কতল করুন’ – এর চেয়ে বড় ইসলামিক কার্টুন আর কি হতে পারে!  সাধে কি আমরা বলি ধর্মই সকল বিনোদনের উৎস? তামাসা কেবল ড্যানিশ কার্টুন নিয়েই হয়নি, তামাসা হয়েছিলো  বাংলাদেশে কার্টুনিস্ট আরিফের আঁকা আপাত নিরীহ ‘মুহম্মদ বিড়াল’ কার্টুন নিয়েও। বেচারা আরিফকে জেল খাটতে হয়েছিলো এর জন্য। অথচ সেই কার্টুন বহু আগেই প্রকাশ করেছিলো শিবিরের পত্রিকা কিশোর কণ্ঠ। তখন কারো ধর্মানুভূতি আহত হতে দেখা যায়নি।

কার্টুন কিংবা থিও ভ্যান গগের চলচ্চিত্র- দুটি জিনিসই মুসলমানদের প্রতি আক্রমণাত্মক সন্দেহ নেই। কিন্তু কার্টুন এঁকে কিংবা চলচ্চিত্র তৈরি করে সমাজের একটি বাস্তবতার ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গি তুলে দেওয়া কি মৃত্যু দণ্ডে দণ্ডিত হবার মতো অপরাধ? আমাদের একমাত্র জীবনটা চলে যাবে একটা সামান্য কার্টুনের জন্য- যেটা আঘাত করে একটা গোষ্ঠীর ধর্মানুভূতিতে- যে গোষ্ঠী অন্যের ধর্মানুভূতিতে আঘাত খাওয়ার মতো ব্যাপার দেখলে হাসে, নিজেরটা দেখলে কাঁদে? তারচেয়েও বড় কথা হল, ডারউইনের মাথার সাথে বানরের ছবি জুড়ে দেয়ার কেরিক্যাচার তো ধার্মিকেরাই চালু করেছেন, কই তাতে কোরে তো কারো ‘ডারউইনানুভূতি’ আহত হয়নি, কাউকে এর জন্য মেরে ফেলার হুমকি ধামকিও খেতে হয়নি। ধর্মের ক্ষেত্রে একই যাত্রায় পৃথক ফল হবে কেন?

ছবি – ডারউইনের মাথার সাথে বানরের ছবি জুড়ে দেয়ার কার্টুনীয় রীতি তো ধার্মিকেরাই চালু করেছেন, অথচ মুহম্মদকে নিয়ে একই ধরনের কোন ব্যঙ্গবিদ্রূপ করলে তারা নাঙ্গা তলোয়ার হাতে ঝাঁপিয়ে পড়েন।

ইউনিভার্সাল ডিক্লারেশন অব হিউম্যান রাইটস-এর আর্টিকেল-১৯ এ পরিস্কার বলা আছে –

“Everyone has the right to freedom of opinion and expression; this right includes freedom to hold opinions without interference and to seek, receive and impart information and ideas through any media and regardless of frontiers.”

রাষ্ট্রের কাছে থেকে তাই বাক স্বাধীনতা রক্ষার অধিকার আশা করা যুক্তিসঙ্গত। কিন্তু দুঃখের বিষয় রাষ্ট্র সেটা না দিয়ে বরঞ্চ বাক-স্বাধীনতার অধিকাররোধে বেশি সচেষ্ট থাকে; রাষ্ট্র বেফাঁস কথা বলা পছন্দ করেনা, বিরোধিতা পছন্দ করেনা। বাংলাদেশের মতো দেশগুলোতে রাষ্ট্রযন্ত্র মূলতঃ ক্ষমতার মসনদ ধরে রাখার জন্য সংখ্যাগরিষ্ঠকে ধর্মীয় আফিমে নেশাগ্রস্থ করে রাখতে অনেক আগ্রহী- তাই এ ধরণের রাষ্ট্রযন্ত্রগুলো বাক স্বাধীনতা রক্ষার অধিকার দেবার পরিবর্তে হরণে বেশি আগ্রহী। আর সেইসব রাষ্ট্রের আফিমগ্রস্থ মানুষেরা বিশ্বাস করে, আত্মঘাতী বোমা হামলা করে ত্রিশ জন মারার ঘটনা থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ সে ঘটনায় ইসলামকে জড়িয়ে খারাপ কিছু বলা হয়েছে কিনা- যদি হয়ে থাকে,তাহলে তারা আঘাত পায়। মূল ঘটনা ধামাচাপা পড়ে বড় হয়ে উঠে অন্য ঘটনা- যে ঘটনার খলনায়ক- ‘ব্যাটা তোরে লিখতে কইছে কে’।

লিখবোনা? আঁকবোনা? যেখানে সমালোচনা দেখলে সমালোচকের গলা টেপার পরিবর্তে সমালোচনার কারণ খতিয়ে দেখা ‘উচিত’- পৃথিবীর ধার্মিকেরা এতো সহজ ব্যাপারও বোঝেনা? পঞ্চাশোর্ধ বছর বয়সে ছয় বছরের বালিকাকে বিয়ে করে, কিংবা পালকপুত্রের স্ত্রীকে দেখে লালায়িত হয়েও নিজকে ‘প্রেরিত পুরুষ’ বলে দাবী করবেন কোন এক চাঁদু –এগুলো নিয়ে কার্টুন কেউ আঁকবেনা? মুখে শান্তির ধর্ম বলে ফ্যানা তুলে ফেলে সারা বিশ্বে সন্ত্রাসের চাষ করে বেড়ালে সেই দ্বিচারিতা নিয়ে কেউ ব্যঙ্গ করবে না? পৃথিবীর আলো-বাতাস-বিজ্ঞান-প্রযুক্তি সব ব্যবহার করে যারা আজও গুণগান গাইছে মধ্যযুগের হিংসা-বিদ্বেষভরা মতবাদগুলোর প্রতি, সেইসব বালুর মধ্যে মুখ গুঁজে থাকা ব্যক্তিদের নিয়ে কৌতুক করাটা দোষের? পৃথিবীতে লক্ষ লক্ষ আহাম্মক গোষ্ঠীর মধ্যে কতোগুলো গোষ্ঠী আজও বিশ্বাস করে পৃথিবী সমতল, কতোগুলো মনে করে এলভিস প্রিসলি বেঁচে আছেন এখনও- এই আহাম্মকদের নিয়ে উপহাস করা যাবেনা? কারণ তারা আঘাত পাবে?

আমাদের দেশটায় আজ ধর্মের জয়জয়কার। ধর্মান্ধতার জয়জয়কার। জয়জয়কার নির্বুদ্ধিতার। অথচ বিজ্ঞান- যে সত্যিকার অর্থে আমাদের পার করিয়েছে নদী, সেতু তৈরি করে, কোনো নবী বা ধর্মগ্রন্থের জ্ঞান নয়- সে বিজ্ঞানের চেতনা আমরা পরিহার করছি সযতনে- যদিও এইসব চেতনা বুঝতে একটু চোখ-কান খোলা রাখলেই হয়। কিন্তু এতো সহজ একটা কাজও না করে বেঁচে থাকার জন্য প্রাণান্তকর চেষ্টা করি আমরা। ধর্মানুভূতির চাপে পড়ে আজ এদেশে বিবর্তনবিদ্যা পড়ানো হয়না, স্কুল কলেজের জীববিজ্ঞান বই থেকে উঠিয়ে দেওয়া হয় জীববিজ্ঞানের মূল ভিত্তি বিবর্তন সেই বিষয়টাই। আমাদের ধর্মানুভূতির সেপাই আজও আমাদের জন্য নির্ধারণ করে দিতে চাইছেন, আমরা কী দেখবো, কী পড়বো, কী শুনবো আর কী শুনবোনা।

মূলধারায় ধর্মের সমালোচনা বন্ধ হয়ে গেছে অনেকটাই। কিন্তু ইন্টারনেট? সেখানে সমালোচনা বন্ধ করা দরকার না? ধর্মানুভূতির সেপাইরা রাষ্ট্রকে নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েন সে ব্যাপারে-

আমাদের ধর্মানুভূতির সেপাইরা রাত ভর মাইকিং করে অন্য ধর্মের মানুষদের, অন্য দেশের মানুষের আরাম করে গালাগালি করে যেতে পারেন, কিন্তু ফেসবুকে তার ধর্মের বিরুদ্ধে একটা কথা শুনলে মুখ ভার করে ফেলেন। আসলেই কী ফেলেন? না ফেলেন না, কিন্তু সংগঠন ফেলে। সংগঠন তাদের পরিচালনা করে। আর যেহেতু এদেশে তাদের সংগঠন শক্তিশালী তাই রাষ্ট্র তাদের হাত করার জন্য তাদের পক্ষ নেয়, রাষ্ট্র আমাদের বিজ্ঞানানুভূতিতে নিয়ে চিন্তিত নয়, আমাদের সৌন্দার্যানুভূতি নিয়ে চিন্তিত নয়, আমাদের সভ্যতানুভূতি নিয়ে চিন্তিত নয়- হঠাৎ করে রাষ্ট্র চিন্তিত সংখ্যাধিক্য সংগঠনের ধর্মানুভূতি নিয়ে, কারণ সংখ্যালঘুদের বেইল দিয়ে লাভ নেই। মূলধারার পর ইন্টারনেটে তাই এখন ধীরে ধীরে পড়ছে ধর্মানুভূতির রক্ষার্থে কথা সেন্সরশিপের কোপানল।

ইন্টারনেট কী এভাবে দমানো সম্ভব?

ড্যানিশ কার্টুনের ঘটনা, থিও ভ্যান গগের ঘটনার পর সাউথ পার্কও মুসলমানদের একই রোষানলে পড়ে তাদের ২০০ এবং ২০১ তম পর্বটি সেন্সর করতে বাধ্য হয়। ভয় দেখিয়ে বর্তমান সময়ে মত প্রকাশের স্বাধীনতার উপর এই নিরন্তন বাঁধার প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে ইন্টারনেটে এক অভূতপূর্ব আন্দোলনের জন্ম হয়- ‘এভরিবডি ড্র মুহাম্মদ ডে’ নামে। একটি ফেসবুক পাতাকে কেন্দ্র করে লক্ষ লক্ষ ছবি আঁকা হয়, মুহাম্মদের। এখানে একটি বিষয় মুসলমানদের বোঝা দরকার, মুহাম্মদের ছবি আঁকা তাদের জন্য নিষিদ্ধ হলেও যারা তাদের ধর্মভুক্ত নয়- তাদের জন্য কিন্তু এ নিয়ম খাটে না। ২০ মে ২০১০ সালে দিনটি পালনের আগের দিন পাকিস্তানের আদালত ফেসবুক ব্লক করে। কী লাভ হলো তাতে?  এখানে বলে নেয়া উচিত, মন্দিরের ঘণ্টাধ্বনি শুনেও একজন মুসলিমের ধর্মানুভূতি আহত হওয়ার কথা, সেটার বিরুদ্ধেও সোচ্চার হওয়ার কথা। কিন্তু হচ্ছে না, কেন? কারণ হিসেবে বলা যায়, কোন দেশের আইন বা মানুষের নৈতিকতার ভিত্তিটা গড়ে ওঠে পারিপার্শ্বিক অবস্থার সাথে খাপ খাইয়ে। আমাদের সাংস্কৃতিক ইতিহাস বলে, ইসলাম ধর্ম এদেশে প্রবেশ করার পূর্বে আমরা ছিলাম জাতিগতভাবে সনাতন অথবা বৌদ্ধ ধর্মানুসারী- সুতরাং আমাদের যে মিশ্র ধর্মীয় সংস্কৃতি এবং সহনশীলতার ইতিহাস আছে, মূল্যবোধ আছে- সেটা মধ্যপ্রাচ্যের প্রধান ধর্মের মূল্যবোধে নেই। ক্ষেত্র বিশেষে ব্যতিক্রম হলেও, আমাদের দেশে ইসলাম প্রচারে এসেছিলো প্রধানত সূফী সাধকেরা, যাদের প্রেমের বাণী এদেশের মানুষের হৃদয় জয় করে নিয়েছিল। কিন্তু একবিংশ শতাব্দীর প্রেক্ষাপটে আমাদের দেশে মৌলবাদ মাথা চাড়া দিয়ে উঠলেও আমরা কিন্তু সৌদি আরব কিংবা ইরানের মতো ইসলামিক রাষ্ট্র হিসেবে নিজেদের ঘোষণা করি নি হাতে কলমে, আমাদের সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ সেটা বলে না। তাহলে কেন সেই মধ্যযুগীয় অন্ধ মূল্যবোধের দোহাই দিয়ে আমাদের রাষ্ট্র বলপ্রয়োগ করবে? ধর্মানুভূতি বলে কোন সুনির্দিষ্ট অনুভূতি চিহ্নিত করে কী কোন আইন প্রণয়ন করা সম্ভব? কারণ ধর্মানুভূতির ব্যাপারটাই বিমূর্ত এবং প্রত্যেক ধর্মের সাথে একে অপরের সঙ্ঘাতপূর্ণ। কোন সনাতন ধর্মাবলম্বী গিয়ে যদি আদালতে আবেদন করে গরু কোরবানির জন্যে তার ধর্মানুভূতি রক্তাক্ত- তাহলে রাষ্ট্র কী তার ধর্মানুভূতি রক্ষার জন্যে পদক্ষেপ গ্রহণ করবে? যেহেতু রাষ্ট্রের চোখে সবাই সমান- প্রত্যেক ধর্মানুসারীই, না কি তখন আইন প্রণয়ন করা হবে সংখ্যাগুরু মানুষের মূল্যবোধের ওপর ভিত্তি করে? পরোক্ষভাবে কি এখনো সেই ব্যাপারটাই হচ্ছে না? ভয়-ভীতি দেখিয়ে বই, পত্র-পত্রিকা বন্ধ করলেও এখন কী আর আদতে মুখ চেপে ধরা সম্ভব হয়?

কাহিনি ঘটানোর পুরাতন টেকনিক আর কাজ করছে না, রাষ্ট্র- আর আমাদের সেন্সরকারীরা ঝাঁপিয়ে পড়ছে নতুন এই ক্ষেত্র ইন্টারনেট আটকে ফেলার উপায় বের করতে। উইকিলিক্স আমেরিকার আফগানিস্তান ও ইরাক যুদ্ধের গোপনীয় বিশাল নথি, গুয়ানতানামু কারাগার এবং আমেরিকার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অসংখ্য নথি সংগ্রহ করে ইন্টারনেটে ছেড়ে দিয়ে সাংবাদিকতার এক নতুন দিগন্ত প্রতিষ্ঠা করে। আমরা দেখলাম, খুব আগ্রহ নিয়েই দেখলাম – পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্র আমেরিকাও তাদের গলা টিপে ধরার প্রচেষ্টায় সফল হতে পারলো না। ২০১০-১১ সাল জুড়ে চলা মধ্যপ্রাচ্যের দেশ গুলোতে ঘনীভূত হয়ে উঠা সংগঠিত চলমান আন্দোলনের পেছনে ইন্টারনেটের এবং সামাজিক যোগাযোগ সাইটগুলোর প্রভাব আমরা সবাই দেখেছি। সিরিয়ার মতো একটি বদ্ধ দেশে থাকা মানুষেরা তাদের কথা, তাদের অবস্থা সারাবিশ্বকে জানাতে পেরেছে ইন্টারনেটের মাধ্যমে। তিউনিসিয়ায় চাকুরিবিহীন বেকার যুবকদের আগুনে আত্মাহুতি দেবার ঘটনাকে কেন্দ্র করে তিউনিসিয়ার সরকারের প্রতি যে বিক্ষোভ দানা বেঁধে উঠেছিলো তাকে ঠেকাতে ইন্টারনেটের সংযোগ বন্ধ করে দিয়েছিলো সরকার। লাভ হয়নি, বরং তিউনিসিয়ার সফল বিপ্লবকে চিহ্নিত করা হয়েছে ‘The Story of the First Successful Internet Revolution’ হিসেবে।  মিশরের বিপ্লবীরাও যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করেছে ইন্টারনেট। মিশরের সরকার গদি বাঁচাতে ফেসবুক ইউটিউব টুইটার বন্ধ করে দিয়েছিলো, লাভ হয়নি সেখানেও। বাংলাদেশে এই আওয়ামীলীগ সরকারের আমলেও কদিন আগে যখন ধর্মানুভূতি এবং রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীর ইমেজানুভূতিতে আঘাত করার জন্য ফেসবুক বন্ধ করার পায়তারা নেয়া হয়েছিলো  তখন জনমানসে কি ভয়ঙ্কর প্রতিক্রিয়া হয়েছিলো, কিভাবে সরকার আবার নিজেদের হাস্যাস্পদ করে অবশেষে ফেসবুককে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলো, রাষ্ট্রের কর্ণধারেরা নিশ্চয় তা ভুলে যায় নি। কিন্তু দুঃখের বিষয়, ভুল থেকে শিক্ষা নিতে তাদের খুব কমই দেখা গেছে।

রাষ্ট্রের কর্নধারেরা এখন তাই আবার নড়ে চড়ে বসেছে, আরেকটি মহাভুল আবারো করার জন্যই বোধ হয়। আবারো ইন্টারনেটের মুখ চেপে ধরতে তারা বদ্ধপরিকর। দিকে দিকে ব্লগ, ফেসবুক, টুইটারের নামে মামলা, কনটেন্ট মোছার আবেদন, ব্লক আরও কতো কি। যখন এগুলোতে ফায়দা হয় না, তখন হয় শারীরিক আক্রমণ। কিন্তু তারা ভুলে যান,  হুমায়ুন আজাদকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়েও মুক্তবুদ্ধির অগ্রযাত্রা স্তিমিত করা যায়নি; বরং আমরা বেড়েছি, চারা গাছ হিসেবে জন্ম নিয়ে মহীরুহ আকারে ছড়িয়ে পড়েছি এখানে ওখানে সর্বত্র। কয়জনকে হেনস্থা করবে, কয়টা সাইট বন্ধ করবে? আজকে যে কোন ব্লগে গেলেই, কিংবা ফেসবুক, টুইটারের যে কোন জায়গাতেই মুক্তবুদ্ধির স্বপক্ষে হাজারো আলোচনা চোখে পড়ে। কেবল পাঁচ ছয়টি সাইট বন্ধ করে দিলেই সব শেষ হয়ে যাবে? আর, ধর্মানুভূতির জিগির তুলে ফেসবুকের পাঁচটি পেজ আর একটি সাইট বন্ধের বিরুদ্ধেও লেখা শুরু হয়েছে বিভিন্ন ব্লগে (দেখুন, এখানে, এখানেএখানে কিংবা এখানে), অজস্র প্রতিবাদ হয়েছে ফেসবুকেও (দেখুন এখানে কিংবা এখানে)।  কাজেই মুখ বন্ধ করার জন্য স্কচ-টেপ নিয়ে ঘুরে বেড়ালেই সবার মুখ বন্ধ হবে তা ভাবা বাতুলদের ‘বাতুলতা’। মুক্তমনারা আজ আর একটি সাইটে নয়, মুক্তমনা একটি সফল আন্দোলনের নাম যা  ছড়িয়ে আছে অসংখ্য সাইটে, ফেসবুক পেইজে, মানুষের মনে, চিন্তা-চেতনায়। প্রতিক্রিয়াশীলদের প্রতিক্রিয়ায় এ আন্দোলন রাতারাতি বন্ধ হয়ে যাবে -সেটা ভাবার কোনো কারণ নেই।

তবে আবহাওয়া খারাপ বলার জন্য রেডিও জকিদের উপর মামলা-হামলা কতোদিন চলবে সেটাই এখন দেখার বিষয়।