পৃথিবীকে বদলে দেবার প্রেরণায়

আজও যারা অদম্য উৎসাহে পথ হাঁটে

জানে না কতদূর যেতে হবে

এ যাত্রায়,

পাশ দিও তাকে।

পত্র-পত্রিকা এবং ইন্টারনেট মারফতে সবাই হয়তো ইতোমধ্যেই জেনে গেছেন, আদালত ৫টি ফেসবুক পেইজ ও একটি ওয়েবসাইট বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। যে খবরগুলো প্রকাশিত হয়েছে, সেগুলোর চুম্বক অংশে একবার নজর বুলিয়ে নেয়া যাকঃ

১। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগে ফেসবুকের পাঁচটি পেইজ ও একটি ওয়েবসাইট বন্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। আজ বুধবার বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার ও বিচারপতি মুহাম্মদ খুরশীদ আলম সরকারের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ অর্ন্তবর্তীকালীন এ আদেশ দেন।

২। এসব ওয়েবসাইট ও ফেসবুক পেইজে হজরত মুহাম্মদ (স.) ও ইসলাম সম্পর্কে কটূক্তি করা হয়েছে। আবেদনে ছয়টি বিষয়ে বলা হয়েছে। এসব সাইটে যেসব বক্তব্য দেওয়া হচ্ছে, তা ধর্মীয় মূল্যবোধ ও সংবিধান পরিপন্থী। আদালত এসব পেইজ ও সাইট বন্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়ে রুলও জারি করেছেন।

৩। অশালীন বিষয়বস্তু আপলোড করায় এসব সাইট বা ওয়েব পেইজের প্রতিষ্ঠাতাদের বিরুদ্ধে কেন যথাযথ আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে না, তা-ও রুলে জানতে চাওয়া হয়। একই সঙ্গে একই ধরনের অশালীন ও জঘন্য আধেয় প্রদর্শনকারী সাইট বা ওয়েব পেইজ বন্ধের ধারাবাহিকতা কেন নিশ্চিত করা হবে না, তা-ও জানাতে বলা হয়েছে। স্বরাষ্ট্রসচিবসহ পাঁচ বিবাদীকে তিন সপ্তাহের মধ্যে রুলের জবাব দিতে বলা হয়।

৪। আবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে এমন কটূক্তি, বিবৃতি বা অপব্যাখ্যা সংবিধানের ২(এ), ৩১, ৩৯ ও ৪১ অনুচ্ছেদের পরিপন্থী। ইসলাম ধর্মকে কটাক্ষ করে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করা সংবিধানবিরোধী কাজ। ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় বিশ্বাস সংরক্ষণে দেশের সংবিধানেই নিশ্চিত করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন সাইট ধর্মীয় অনুভূতি সংরক্ষণে বাধ্য। অথচ এসব ওয়েবসাইট ও ওয়েব পেজে শুধু মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতিতেই আঘাত দেয়া হয়নি বরং কটাক্ষ করে মন্তব্য, অবসিন, পর্নোগ্রাফী প্রভৃতি দিয়ে গণমানুষের নৈতিক বিশ্বাসের ওপর আঘাত করা হয়েছে। এসব বন্ধে প্রয়োজনীয় ও কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন।

৫। বিটিআরসি চেয়ারম্যান জিয়া আহমেদ বৃহস্পতিবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ফেইসবুক কর্তৃপক্ষকে পেইজগুলো বন্ধ করতে অনুরোধ করা হয়েছে। পাশাপাশি ওয়েবসাইটটিও বন্ধের ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।” এছাড়া ওই ফেইসবুক পেইজ ও ওয়েবসাইট সংশ্লিষ্টদের চিহ্নিত করতে তদন্তে নেমেছে সাইবার ক্রাইম প্রতিরোধে গঠিত বিশেষ দল ‘বাংলাদেশ কম্পিউটার সিকিউরিটি ইনসিডেন্ট রেসপন্স টিম (সিএসআইআরটি)’।

৬। “যে ওয়েবসাইটের বিরুদ্ধে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে, সেটি বন্ধের জন্যও ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। তবে সংশ্লিস্টদের চিহ্নিত করার পরই তা বন্ধ করা হবে।”

অভিজিৎ আমার একটি ফেসবুক স্ট্যাটাসে বলেছেন, মহান ঈশ্বর একটি নপুংসক সত্ত্বা, তাই নিজের মান-সম্মান তিনি নিজে রক্ষা করতে পারেন না। ঈশ্বরের মান-সম্মান সেই সুমহান দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে তার কিছু পোষা বাহিনীর উপর। নিষ্ফল প্রার্থনা আর ব্যর্থ মোনাজাতে তেমন কাজ হচ্ছিলো না। তাই অদৃশ্য ঈশ্বরানুভূতি আর ধর্মানুভূতি আক্রান্ত হওয়ায় তার কিছু প্রিয় বান্দা আদালতের শরণাপন্ন হয়েছেন। রাষ্ট্র-যন্ত্রকে যুক্ত করেছেন। রাষ্ট্রযন্ত্র সবকিছুকেই নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। মিডিয়া, টিভি, পত্রপত্রিকা, বইপত্র সবই। ইন্টারনেট আসার পর তাদের রাশ আলগা হয়ে যাচ্ছিলো ক্রমশ। যুৎ করতে পারছিলেন না তারা। এবার তারা ধর্মানুভূতি রক্ষায় একাট্টা হয়েছেন।

বন্যা আহমেদ  বলেছেন, এখানে একটু আনন্দের ব্যাপারও আছে। এক্সেকিউটিভ বিভাগই হোক বা বিচার বিভাগই হোক, রাষ্ট্রযন্ত্র যখন এধরনের কোন নিষেধাজ্ঞার সাথে জড়িত হয়, তখন বুঝতে হবে যে সেটা তাদের জন্য এক বিশাল মাথাব্যাথার কারণ হয়ে উঠেছে। টেলিভিশন, পাঠ্যপুস্তক থেকে শুরু করে প্রিন্ট মিডিয়া, সবই তাদের কথা মেনে চলতে বাধ্য হয়। কারণ তাতে এরকম ব্যাপক হারে সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করার সুযোগ থাকে না। কিন্তু ইন্টারনেট এই পুরো ব্যাপারটাকে ঘাড় ধরে উলটে দিয়েছে।

এখন পৃথিবীর বেশীরভাগ দেশের জন্যই কিন্তু ইন্টারনেট এক ভায়াবহ সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর আমাদের মত দেশগুলোতে, যেখানে মত প্রকাশের কোন স্বাধীনতাই নেই, সেখানে তো কোন কথাই নেই। মত প্রকাশের স্বাধীনতা এখন আর ছোট্ট এক প্রতিক্রিয়াশীল অভিজাত শ্রেণীর হাতে আটকে নেই, বাঁধ ভেঙ্গে পড়ছে সবখানেই। যারই ইন্টারনেটে ঢোকার ক্ষমতা আছে সেই আজ মত প্রকাশ করতে পারে। এটা কিন্তু আমাদের ইতিহাসে আর কোনওদিনও ঘটেনি। এ ধরণের নিষধাজ্ঞাগুলোর তীব্র প্রতিবাদ করা প্রয়োজন, সাম্প্রতিক সময়ে টিউনিশিয়া বা ইজিপ্টের আন্দোলনগুলোর মত করেই।

ধর্মানুভূতিতে আঘাতের অভিযোগটা পুরনো নয়, এই নিয়ে বিতর্কও পুরনো নয়। অন্তর্জালে যারা বিভিন্ন বিষয়ে বিতর্ক করেন, তারা দীর্ঘদিন ধরেই এই বিতর্ক করে আসছেন। এ পর্যন্ত ধর্মানুভূতিতে আঘাতের অভিযোগের উত্তরে যে সকল লেখা এসেছে, তার মধ্যে সম্ভবত শ্রেষ্ঠটি লিখেছেন প্রয়াত হুমায়ুন আজাদ, তার “ধর্মানুভূতির উপকথা” প্রবন্ধে। যারা ধর্মানুভুতিতে আঘাতের অভিযোগ তোলেন, তারা এই প্রবন্ধটি পড়লেই আশা করি তাদের প্রশ্নগুলোর উত্তর পেয়ে যাবেন।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ফেসবুক পেজগুলো আসলেই বন্ধ হবে কি ? উত্তর হচ্ছে, ফেসবুকের সার্ভার বাংলাদেশে না। ফেসবুক বাংলাদেশের আদালতের কথায় উঠবে বসবে না। এমনকি যদি কোনও ওয়েবসাইট বাংলাদেশ থেকে বন্ধ করে দেয়াও হয়, তখনও প্রক্সি দিয়ে সেই ওয়েবসাইটে প্রবেশ করা যাবে।

কিন্তু তারপরেও অনেকেই আতংকে আছেন হাইকোর্টের এই নির্দেশ নিয়ে। কারণ, যেখানে বলা হচ্ছে, জড়িতদের চিহ্নিত করে শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে, সেখানে ধর্মের বিরুদ্ধবাদী ফেসবুক পেইজ ও ওয়েবসাইটগুলোর স্বত্ত্বাধিকারী এবং অ্যাডমিনদের চিন্তিত হওয়ারই কথা।

মনে হতেই পারে, আজকেই যদি পুলিশ আমাকে ধর্মানুভূতিতে আঘাত দেয়ার অভিযোগে ধরে নিয়ে যায় এবং টর্চার করে, তাহলে আমার কীই বা করার থাকতে পারে ? আজকেই যদি আমাকে আদালতের রায়ে দীর্ঘদিনের কারাদণ্ড দেয়া হয়, তাহলে কি নষ্ট হবেনা আমার ভবিষ্যৎ ? যে কোনও সাধারণ মুক্তচিন্তকও এই দুশ্চিন্তার বাইরে নয়। এই মুহুর্তে নিরাপদ নয় কেউই। কোনও মুক্তমনা নিরাপদ নন, নিরাপদ নন “রাষ্ট্রধর্মের অবমাননাকারী” একজন আন্তর্জালিক লেখকও। কারণ, আইনের প্রয়োগের ইতিহাস এই দেশে যে কেমন হয়, তা তো আমাদের দেখা হয়েই গেছে।

আইন এবং এর প্রয়োগ নিয়ে যারা চিন্তিত আছেন, আসুন এবার দেখা যাক এই প্রক্রিয়ার আইনি দিকটি।

ধর্মের ব্যাপারে কী বলা আছে আমাদের সংবিধানে? সংবিধানের ৪১তম অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে,

“আইন, জনশৃঙ্খলা ও নৈতিকতা সাপেক্ষে প্রত্যেক নাগরিকের যেকোনো ধর্ম অবলম্বন, পালন বা প্রচারের অধিকার রহিয়াছে; প্রত্যেক ধর্মীয় সম্প্রদায় ও উপ-সম্প্রদায়ের নিজস্ব ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের স্থাপন, রক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার অধিকার রহিয়াছে।”

এই অনুচ্ছেদের কোথাও বলা নেই যে, ধর্ম বা ধর্মীয় ব্যক্তিদের সমালোচনা করা যাবে না। আলোচ্য ওয়েবসাইটটি ও পেজগুলো ধর্মের অসারতা ও ধর্মের নানাবিধ অসঙ্গতি প্রকটভাবে তুলে ধরছিল। পেজগুলো বা পেজের অ্যাডমিনেরা কারো কোনো ধর্ম ‘অবলম্বনে’ বাধা দিচ্ছিল না, ধর্ম ‘পালনে’ বাধা দিচ্ছিল না, এবং ধর্ম ‘প্রচারে’ও বাধা দিচ্ছিল না।

আবার, ঐ অ্যাডমিনেরা কোনো ‘ধর্মীয় সম্প্রদায়’ বা ‘উপ-সম্প্রদায়ের’ কোনো স্থাপনাও ভেঙে গুঁড়িয়ে দেননি বা দিতে যাননি। তারা কাউকে ধর্মপালন বা ধর্মপ্রচার থেকে বিরত থাকতে হুমকিও দেননি কিংবা কাউকে আহত বা নিহতও করেননি। তাহলে কেন ও কিসের ভিত্তিতে পেজগুলো বন্ধ হবে? কেন অ্যাডমিনদের বিরুদ্ধে ‘ব্যবস্থা’ নেয়া হবে? তারা কীভাবে সংবিধান লঙ্ঘন করছেন বা করেছেন?

সংবিধান ধর্ম ‘অবলম্বন’, ‘পালন’ ও ‘প্রচারের’ অধিকার দিয়েছে মাত্র; সংবিধান কারো ‘ধর্মানুভূতি’ পাহারার নিশ্চয়তা দেয়নি। ধর্মানুভূতি অত্যন্ত কাল্পনিক (hypothetical) ও আপেক্ষিক (relative) একটি বিষয়। কাল্পনিক ও অলীক বিষয়ে আদালতের হস্তক্ষেপ প্রত্যাশিত নয়। বিষয়টি ধর্মতর্কে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে নিষ্পত্তি হওয়াই বাঞ্ছনীয়। আদালত কারো ‘অনুভূতি’ রক্ষা বা মান-অভিমান ভাঙার প্রতিষ্ঠানও নয়

কোনো ধর্মসমালোচক কখনোই কারো ধর্ম’পালন’ বা ‘প্রচারে’ বাধা দেয় না, বরং ধার্মিকেরাই ধর্মসমালোচকদেরকে যুগে যুগে হতাহত করে এসেছে। বিজ্ঞ আদালত এই ইতিহাসটা ঘেঁটে দেখলে ভালো হয়।

সংবিধান বা অন্য কোনো আইন যেহেতু ধর্মসমালোচনা নিষিদ্ধ করেনি, সেহেতু ঐ পেজগুলোও নিষিদ্ধ করার আইনি ভিত্তি জন্ম নেয় না।

সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদে শর্তসাপেক্ষে ‘চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা এবং বাক-স্বাধীনতা’ নিশ্চিত করা হয়েছে। শর্তটি হচ্ছে, ঐ চিন্তা ও মত যেন ‘রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশী রাষ্ট্রসমূহের সহিত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা বা নৈতিকতা’র সাথে সাংঘর্ষিক না হয়।

এখন কথা হচ্ছে, ঐ পেজগুলো রাষ্ট্রের নিরাপত্তাও বিঘ্নিত করছে না, বিদেশের সাথেও সম্পর্কেও বিঘ্ন ঘটাচ্ছে না, জনশৃঙ্খলাও বিঘ্নিত করছে না।

‘শালীনতা’ ও ‘নৈতিকতা’ অত্যন্ত তর্কসাপেক্ষ ও আপেক্ষিক দুটো বিষয়। শালীনতা ও নৈতিকতার ব্যাখ্যা ব্যক্তি থেকে ব্যক্তির ওপর নির্ভর করে ও তারতম্য ঘটে। একের কাছে যা অশালীন বা অনৈতিক, তা অন্যের কাছে নাও হতে পারে। আলোচ্য পেজগুলো কতটা শালীন বা অশালীন, সেটা নিয়ে তর্ক হতে পারে এবং আদালত চাইলে পেজগুলোকে এ ব্যাপারে সর্বোচ্চ সাবধান করতে পারে, কিন্তু পেজ বন্ধ করতে নির্দেশ দিতে পারে বলে মনে হয় না। এ ব্যাপারে আদালত আদৌ হস্তক্ষেপ না করলে আরও ভালো হয়।

পেজগুলো বন্ধ হলে ৩৯তম অনুচ্ছেদ লঙ্ঘিত হয় কি না, সেটাও ভেবে দেখার দাবি রাখে। হাই কোর্ট বিভাগ তার নির্দেশ দিয়েছে। বিবাদিপক্ষ আপিলেট বিভাগে আপিল করলে, আশা করা যায়, আপিলেট বিভাগ বিষয়টি নিয়ে আরও গভীরে ভেবে দেখবে।

বাংলাদেশ কোনো ধর্মরাষ্ট্র নয়, ধর্মের ভিত্তিতে এদেশের জন্ম হয়নি, বরং এদেশের জন্ম হয়েছে একটি ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রকে ভেঙে। এদেশে ব্লাসফেমি আইনও নেই। ফলে এদেশে ধর্মসমালোচনা অসাংবিধানিক হতে পারে না। মুক্তমনা নির্ঝর মজুমদার আদালতের নির্দেশের বিরুদ্ধে রিট আবেদন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এবং এই বিষয়ে তিনি কয়েকজন আইনজীবীর সাথেও কথা বলেছেন। দেখা যাক কদ্দূর কী হয়।

হে মহামান্য আদালত,

ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, মুখ বন্ধ করে, হেনস্থা করে কাউকে দাবিয়ে রাখা যায় না। সত্য প্রকাশিত হবেই। কোপার্নিকাস, গ্যালিলিও, ব্রুনোর উপর অত্যাচারের পরেও ঈশ্বরের পুত্ররা সূর্যের চারিদিকে পৃথিবীর ঘোরা থামাতে পারে নি। হুমায়ুন আজাদকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়েও মুক্তবুদ্ধির অগ্রযাত্রা স্তিমিত করা যায়নি; বরং আমরা বেড়েছি। চারা গাছ হিসেবে জন্ম নিয়ে মহীরূহ আকারে ছড়িয়ে পড়েছি এখানে ওখানে সর্বত্র।

ধর্মের বিরুদ্ধাচরণ যদি আমি প্রকাশ করি, সেটা আমার বাকস্বাধীনতা, আমার অধিকার। এই অধিকার আপনি কেড়ে নিতে পারেন না হে মহামান্য আদালত। নির্দোষ কার্টুনিস্ট আরিফ দেশ ছেড়েই চলে গেলেন। যাওয়ার আগে আমারব্লগে দিয়ে গেলেন তার এই পোস্ট, চাইনা হতে আমি হুমায়ুন আজাদ

আপনার খড়্গ তার ওপরে প্রচণ্ডভাবেই নেমে এসেছিলো ৬ মাসের জেল হয়ে। মনে অনেক দুঃখ নিয়ে চলে গেছেন মানুষটি। এই ধর্মানুভূতির অভিযোগ তুলে “সত্যের সেনানীরা” দেশছাড়া করেছে তসলিমা নাসরিন ও কবি দাঊদ হায়দারকে, রক্তাক্ত করেছে হুমায়ুন আজাদ সহ নাম জানা আরও অনেককেই। সেই হিসাবটি কি আপনার কাছে আছে ? সেগুলোর বিচার কি হয়েছে মহামান্য আদালত ?

জানি না শেষ পর্যন্ত আইনজ্ঞরা আপনার সহায়তায় কী সিদ্ধান্তে পৌঁছাবেন। জানি না আমাদের মধ্য থেকে কয়জন রক্তাক্ত হবেন, কয়জনের ভবিষ্যত নষ্ট হবে, কয়জন পচতে থাকবেন জেলখানায়। আপনার উপর সর্বোচ্চ সম্মান ও আস্থা রেখে বিষয়টি গভীরভাবে নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে ভেবে দেখার আবেদন জানাই আমরা আপনার কাছে। শেষ পর্যন্ত রায় যাই হোক, জেনে রাখবেন হে মহামান্য আদালত,তারপরও পৃথিবী কিন্তু ঘুরবে। আমাদের রক্তবীজ জন্ম দেবে সহস্র মুক্তমনার।

আজকে ধর্ম আমাদের গলা বরাবর ছুরি চালিয়েছে। হয় আমাদের গলা কাটা যাবে, নয়তো ধর্মকে নিজের ছুরি সরিয়ে নিতে হবে।

কিন্তু গলা আমরা সরাবো না মহামান্য আদালত, সত্য সত্যের জায়গায় চিরকাল অটুট রয়ে যাবে।

কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ

১। অভিজিৎ রায় ও বন্যা আহমেদকে, ফেসবুকে অভিজিৎ রায়ের ওয়ালে আমার করা একটা পোস্টে তাদের প্রাসঙ্গিক দুটি মন্তব্য লেখার প্রয়োজনে নেয়া হয়েছে।

২। আখতারুজ্জামান আজাদকে, আইনি ব্যাপারগুলো পুরোটাই তার এই নোট থেকে নেয়া।

৩। খবরগুলোর তথ্যসূত্রঃ দৈনিক প্রথম আলো ও বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম, ২২ মার্চ ২০১২।