গত চব্বিশে ফেব্রুয়ারির প্রথম আলোর ভেতরের পাতায় ছোট্ট পরিসরে একটা খবরের প্রতি অনেকের চোখ পড়েছে আশা করি। বাংলাদেশের মত ‘কাজ কম কথা বেশি’র দেশে এরকম খবর খুব একটা সুলভ নয়। সাংবাদিক ফয়েজ আহমদের দান করা দুই চোখের দুই কর্নিয়া দৃষ্টি ফিরিয়ে দিয়েছে দুই অন্ধ যুবককে। ২৯ বছর বয়সী সফ্‌টওয়ার ইঞ্জিনিয়ার তাজহারুল ইসলাম ও ২৫ বছর বয়সী ডাক্তার মোঃ সাইফুল ইসলাম এখন দেখতে পাচ্ছেন। তাঁদের চোখে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে ফয়েজ আহমদের কর্নিয়া। দশ বছর আগে সন্ধানীর আন্তর্জাতিক চক্ষু ব্যাংকে মৃত্যুর পর চোখ দান করার অঙ্গীকার করেছিলেন ফয়েজ আহমদ। নিজের শরীরটাও দান করে গেছেন বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজে শিক্ষার্থীদের কাজে লাগবে বলে। একজন মুক্তচিন্তার মানুষ মৃত্যুর পরেও এভাবেই কাজে লাগে মানুষের। এখানেই সত্যিকারের ‘মানুষ মানুষের জন্য’।

‘মধ্যরাতের অশ্বারোহী’ নামে খ্যাত সাংবাদিক ফয়েজ আহমদ মারা গেছেন ২০শে ফেব্রুয়ারি ভোর বেলা। ১৯২৮ সালের ২রা মে থেকে ২০১২ সালের ২০শে ফেব্রুয়ারি – চুরাশি বছরের নিরলস সংগ্রামী জীবন তাঁর। ছড়াকার, সাহিত্যিক, সংগঠক, রাজনৈতিক কর্মী, মুক্তিযোদ্ধা, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব – সর্বোপরি একজন বিশাল মাপের মানুষ ফয়েজ আহমদ ছিলেন দেশের সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক জগতের ‘বটবৃক্ষ’।

১৯২৮ সালের ২রা মে বিক্রমপুরের বাসাইলডোগ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন ফয়েজ আহমদ। তাঁর বাবা মোস্তফা চৌধুরি ছিলেন ব্রিটিশ সরকারের পুলিশ অফিসার। ছোটবেলা থেকেই সত্যিকারের মানুষ হবার শিক্ষা পেয়েছেন ফয়েজ আহমদ। ষোলঘর উচ্চবিদ্যালয়ের ছাত্র থাকা কালিন শ্রীনগরের রাজা শ্রীনাথ হাসপাতালের প্রখ্যাত ডাক্তার এম এন নন্দীর সংস্পর্শে আসেন তিনি। ডাক্তার নন্দী ছিলেন ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য। তাঁর কাছ থেকে সমাজতন্ত্র ও মানুষের মুক্তির আদর্শে অনুপ্রেরণা পান ফয়েজ আহমদ। মার্কসবাদের প্রতি আকৃষ্ট হন তখন থেকেই।

ব্রিটিশ আমলে তরুণ বয়সেই অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেন তিনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে বাড়ি থেকে পালিয়ে কুর্মিটোলায় এসে ব্রিটিশ এয়ারফোর্সে যোগ দিয়েছিলেন ফয়েজ আহমদ। তারপর ১৯৪৭ থেকে বাংলার মাটিতে যত গণসংগ্রাম ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন হয়েছে – ফয়েজ আহমদ তার সবগুলোর সাথেই যুক্ত ছিলেন মৃত্যুর আগ পর্যন্ত। ১৯৪৮ সালে সাংবাদিকতা শুরু করেন। তারপর একে একে ইত্তেফাক, সংবাদ, আজাদ, পূর্বদেশ ও ইনসাফ-এ কাজ করেন। পাকিস্তান সাহিত্য সংসদের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে ১৯৫০ সালে দিল্লি সাহিত্য সম্মেলনে যোগ দেন। সেই বছর তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় ‘হুল্লোড়’। কমিউনিস্ট পার্টির পূর্ণ সদস্যপদ পাওয়ার আগেই পার্টির নির্দেশে ১৯৫৪ সালে বিনা পাসপোর্টে ভিয়েনায় অনুষ্ঠিত যুব সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন। বামপন্থী আন্দোলনে সক্রিয়তার অপরাধে জেলে যেতে হয় তাঁকে। জেলে বসে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ পান ১৯৬০ সালে। কমিউনিস্ট পার্টির আজীবন সদস্য ছিলেন তিনি।

১৯৬৬ সালে বেইজিং রেডিওতে বাংলা অনুষ্ঠান সম্প্রচার শুরু হয় তাঁর উদ্যোগে। ১৯৬৮-৬৯ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ওপর তাঁর ধারাবাহিক প্রতিবেদন সারাদেশে ঝড় তোলে। ১৯৭০ সালে তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় সাপ্তাহিক স্বরাজ। বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের পাশাপাশি যুদ্ধ করার কৌশলও প্রচার করতো।

মুক্তিযূদ্ধের শুরুতে প্রেসক্লাবে পাকিস্তানিদের গুলিতে আহত হন তিনি। পরে মুজিবনগরে চলে যান তিনি। স্বাধীন বাংলা বেতারে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের রাজনৈতিক যৌক্তিকতা তুলে ধরতেন তিনি তাঁর নিয়মিত প্রতিবেদনে। স্বাধীনতার পর তাঁর নেতৃত্বে গঠিত হয় বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস)। তিনি ছিলেন বাসস’র প্রতিষ্ঠাকালীন প্রধান সম্পাদক।

স্বৈরাচারী এরশাদের বিরুদ্ধে গণ-আন্দোলন গড়ে তোলার পক্ষে বিরাট ভূমিকা রেখেছেন ফয়েজ আহমদ। ১৯৮৩ সালে হো মো এরশাদ ঘোষণা করলেন শহীদ মিনারে ফুল দেয়া ও আলপনা আঁকা ‘বেদাত কাজ’। প্রতিবাদে ফয়েজ আহমদের নেতৃত্বে গঠিত হলো সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট। দীর্ঘদিন তিনি সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। লেখক শিল্পী সাংবাদিক সংস্কৃতিসেবীদের সম্মিলিত পদক্ষেপের কারণে ক্ষমতায় থাকাকালীন এরশাদ কখনোই শহীদ মিনারে যেতে পারেন নি। জাতীয় প্রেস ক্লাবেও প্রবেশ করতে পারেন নি এরশাদ। এরশাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন জোরদার করার লক্ষ্যে শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার মধ্যে বৈঠক ও যুক্ত ঘোষণা সম্ভব হয়েছিল ফয়েজ আহমদের প্রচেষ্টায়। এর জন্য হুলিয়া জারি হয়েছিল ফয়েজ আহমদের নামে। তাঁকে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠিয়েছিলেন এরশাদ সরকার।

কবি হিসেবে নিজেকে জাহির করার জন্য এরশাদ রাষ্ট্রীয় খরচে কবি সম্মেলন ও বঙ্গভবনে কবিতা পাঠের আসর বসালেন। প্রগতিশীল কবিরা প্রত্যাখ্যান করেন এরশাদের কবি-সম্মেলন। ১৯৮৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে এরশাদের স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে শামসুর রাহমানের নেতৃত্বে গঠিত হলো জাতীয় কবিতা পরিষদ। এরও প্রাণপুরুষ ছিলেন ফয়েজ আহমদ। ১৯৮৭ থেকে ১৯৯১ পর্যন্ত টানা পাঁচ বছর জাতীয় কবিতা উৎসবের আহ্বায়ক ছিলেন ফয়েজ আহমদ।

এরশাদের পতনের পর ১৯৯২ সালে জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিলেন ফয়েজ আহমদ। গোলাম আজমের বিচারের দাবিতে ১৯৯২ সালের ২৬শে মার্চ যে গণ আদালত গঠিত হয়েছিল তার অন্যতম বিচারক ছিলেন ফয়েজ আহমদ। এর জন্য বিএনপি সরকার ফয়েজ আহমদের বিরুদ্ধেও রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা দায়ের করেছিল।

শিশুদের জন্য একটা সুন্দর সমাজ গঠনের লক্ষ্যে শিশুদের উপযোগী বই লিখতে শুরু করেন তিনি। শিশুকিশোরদের জন্য লেখা তাঁর বইয়ের সংখ্যা ৬০। সাংবাদিক জীবনের কাহিনি নিয়ে লেখা তাঁর বিখ্যাত ট্রিলজি ‘মধ্যরাতের অশ্বারোহী’, ‘সত্যবাবু মারা গেছেন’ ও ‘নগরে নন্দিনী’। ছড়া, কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ মিলিয়ে শতাধিক বই লিখেছেন তিনি। জীবদ্দশায় তাঁর কাজের স্বীকৃতিও তিনি পেয়েছেন অনেক। পেয়েছেন একুশে পদক, বাংলা একাডেমী পুরষ্কার, শিশু একাডেমী পুরষ্কার সহ আরো অনেক পুরষ্কার। তাঁর উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ধানমন্ডির শিল্পাঙ্গন গ্যালারি।

চিরকুমার ফয়েজ আহমদ ব্যক্তিগত সুখের কথা ভাবেন নি কখনো। সারাজীবন মানুষের জন্য গঠনমূলক কাজে ব্যস্ত থেকেছেন। জীবনের শেষের দিকে দীর্ঘদিন হৃদরোগ ও চোখের গ্লুকোমায় ভুগছিলেন। চিকিৎসার খরচ চালাতে কষ্ট হয়েছে। ধানমন্ডির যে বাসায় থাকতেন – সেখানে বাড়িওয়ালা তার ভাড়া বাড়ানোর নোটিশ দিয়েছিলেন। ফয়েজ আহমদ কম ভাড়ার বাসা খুঁজতে শুরু করেছিলেন মৃত্যুর কিছুদিন আগে। এই মানুষটির নিজের একটা বাড়িও ছিল না।

তাঁর শেষ ইচ্ছে অনুযায়ী মৃতদেহ ঢেকে রাখা হয়েছিল বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা দিয়ে। পাশে রাখা হয়েছিল মার্ক্স ও এঙ্গেল্‌স এর বই ও কমিউনিস্ট পার্টির মেনিফেস্টো। সবার জন্য সমান সুযোগ তৈরি করার জন্য চিরদিন সংগ্রাম করে গেছেন যিনি – মৃত্যুর পরেও মানুষেরই কাজে লাগিয়েছেন নিজের শরীর। চোখ দিয়ে ফিরিয়ে দিয়েছেন দু’জন মানুষের দৃষ্টি। তাঁর চেয়ে মুক্তমনা মানুষ আমরা আর কোথায় পাবো?

ফয়েজ আহমদের জীবন থেকে আমরা যদি সামান্য শিক্ষাও নিই – তাহলে কিছুটা ভালো কাজ তো হয়। মৃত্যুর পরে আমাদের চোখও তো কাজে লাগতে পারে অন্য কোন মানুষের যারা দেখতে পান না!