জল…
জলের সাথে আমার এক অদ্ভুত সখ্যতা গড়ে উঠেছে। আমার দৃষ্টির পরিবর্তন না জলেরই ভিন্ন রুপ তা নির্ধারণ করা দায়। এখন আমি জানি জলের ভেতরকার ছোট বড় ঢেউ এর পার্থক্য। আমার মাঝে অন্য রকম স্বতন্ত্র এনে দিয়েছে এ জল। আমায় ইচ্ছেমতন দাপাদাপি করতে দেয়া, আবার গভীর ভালবাসায় নিজের গভীরে টেনে নেয়া। জলকেলী।
আমার আছে শুধুমাত্র একটি ব্রা। চব্বিশ বছর বয়েশি এক তরুনির জন্যে এ কোন কাজের কথা নয়। আমার দক্ষিণ দিকের লজ্জা নিবারণ আর প্রয়োজনে বস্ত্রের সংখ্যা যে এক নয় সেটাই সস্তির। বিশেষ করে আমার মা রেহনুমার জন্নে।
আমি আমার মায়ের একমাত্র সন্তান। সে একমাত্র মেয়ের অন্তর্বাসের সংখ্যা যে একটি হবে তা মায়ের ভাবনার বাহিরে ছিল। আমার অগোছানো ঘরকে মনোহর রুপ দেবার প্রচেষ্টায় মা যখনই এসে শেষের ড্রয়ারটি খুলেন, তখনি সে সনাতন বাক্য- “যত দ্রুত পার স্বাস্থ্যস্মমত কাজটি সারো অনু! এক ব্রা পরে এত জায়গায় যাতায়াত কর, ভাবতেই অবাক লাগে তুমি এ যুগের মেয়ে।”

বাড়ি হতে আমায় প্রায়শই বের হতে হয়। কলেজ যাতায়াত, সাঁতার শেখা, বেশ কিছু পরিচিত বাঙ্গালির বাসায় সপ্তাহে অন্তত দুদিন নিমন্ত্রন; তিন বন্ধুদের সাথে আড্ডা তো আছেই।
“প্রতিদিন নিজ হাতে কেচে তারপর পরি মা, তাও বলবে অস্বাস্থ্যকর?” এমন যুক্তি দেখিয়েও মায়ের কাছ হতে পালাতে পারছিনা।
“তোমায় দূরে কোথাও, ভাল কোথাও অথবা অতি মুল্লের কিছু তো কিনতে বলছিনা। victoria secret- এ যেতে না চাও তো আমাদের এই এলাকায় এবং এলাকার কাছাকাছি একটির চাইতে বেশি walmart আছে। কি করে যে গত ন’টি মাস একই জিনিস ধুয়ে ধুয়ে পরছ বুঝিনা!”
তখন নিজ অজান্তেই আমার ঠোঁটে থাকে হাসি, আর বুকে যেন এক ধরনের তৃপ্তি। গত ন’টি মাস আমি কখন কি করেছি জানিনা, শুধু জানি কার জন্যে করেছি।

হাসির উল্লাস…
আমার বন্ধুদের ধারণা আমি সুস্থ নই। চব্বিশ বছর হবার পরও কারও প্রেমে পড়িনি, সেটা ওরা মানতে রাজি আছে। তবে পাশ্চাত্যে থেকেও কোন ছেলে বন্ধু জোটাতে পারিনি, এতেই তাদের ক্ষোভ।
“কি করব বল, কোন ছেলে নিজ হতে বন্ধুত্ব করতে চায়নি…” এই থাকে আমার জবাব।
“ছেলেরা চায়নি বলে তুই হাত পা গুটিয়ে বসে রইবি?”
আমি শুধু হাসি। জবাব দেবার কিছু থাকে না। এমনিতেই আমি শান্ত প্রকৃতির। জীবন যা নির্ধারণ করে, যা চায় তাই দেই। ততটুকুই দেই। কোন কিছু নিয়ে বেশি ভাবাভাবির মাঝে যাইনা। হয়তো এ জন্যেই আমার তিন বন্ধু আমায় এত পছন্দ করে। ওদের সবকথা আমি চুপচাপ মেনে নেই। ওরা যেদিন বলে “অনু, আজ সবুজ রঙ এর সালোয়ার কামিজ পর,” আমি তাই করি। কোন প্রশ্ন না, কোন তর্ক না।
ওরাই ঠিক করেছে আমার উচিত কম্পিউটার টেকনলজি নিয়ে পড়া। আমি তাই করেছি। ভাল লাগছেনা। আবার খারাপও লাগছেনা। পড়তে হয় পড়েছি। ওদের সাথেই আমার আশপাশের বাঙ্গালিদের বাসায় যাওয়া। ওদের মাধ্যমেই অ্পর্ণা মাসির সাথে পরিচয় আর ঘনিষ্ঠতা। প্রায় মাসেই বাঙ্গালী কিছু শিল্পীরা দেশ হতে আসে, আমার বন্ধুদের বলাতে ওদের কনসার্ট ও বাদ যায়না। ওরা বললে বা টেনে নিলে বৃষ্টিতে ভেজা হয়। আমার এ ঠান্ডা স্বভাবের জন্যে ওরা মজা পায়, আবার বিরক্তি ও বোধ করে।
আমার জীবনের অনেক ভুল সমীকরণের মতন সাঁতার না জানাটাও নাকি একটি ভুল। হ্যাঁ, আমি না হয় এদেশে এসেছি তিন বছর বয়ে্সে, তাই বলে সাঁতার জানবোনা কেন?

আমার সতের বছর বয়স হতে ওরা যে উপায় অবলম্বন করেছিল আমায় সাঁতারে আগ্রহী করতে সেটা হচ্ছে এরকম- কোন এক রৌদ্রাজ্জ্বল দিনে আমি নৌকো ভ্রমনে বের হব। মাঝ নদীতে যাবার পর হঠাৎ নৌকো ডুবি হবার সম্ভাবনা। তক্ষুনি হিন্দি চলচিত্রের মতন কোন একজন মহা আকর্ষণীয় নর আমায় বাঁচাতে আসবে। তারপর প্রথম দৃষ্টিতে প্রেম।
“প্রেম কে তোর এত ভয়, দেখলি তো সাঁতার না জানলে যে প্রেমে নির্ঘাত পড়বি?”
আমি হাসি। “আচ্ছা, আমি একা কেন নৌকো ভ্রমনে যাব তোদের ছাড়া?” অত গভীর ভাবনায় না গিয়ে প্রথম প্রশ্ন মাথায় অই এসেছিল।
“আমাদের কেন জিজ্ঞেস করছিস, যে Director ছবি বানাচ্ছেন, তাকে জিজ্ঞেস কর। তাছাড়া আমরা তোর বন্ধু বলে কোন ধর্ষণ দৃশ্য রাখিনি। Producer সেরকম কিছু খুব খুশি হয়েই রাখবেন।” লাবনী, যার নামের সাথে চরিত্রগত কোন মিল নেই।
“সব সময় সব কিছুতে ছেলেরা কেন পরিত্রাণদাতা হবে বলতে পারিস? আর তোরা নিজেরা নারী হয়ে কেন নিজেদের ছোট করে কথা বলবি?” সুফিয়া, জনাব নারীবাদী।
“কোন নারীই চায়না কেউ ধর্ষণ হোক সুফি। আমরা তো Producer এর কথা বলছি।”
হাসির উল্লাস।
“জীবনের সবকিছুকে ঠাট্টা হিসেবে নিস বলেই আজ নারীদের স্থান…”
সুফিটা অমনই। নারীদের নিয়ে কিছু বলা যাবেনা। ওর আড়ালে রেখা আর লাবনী হাসে। ওকে নাম দিয়েছে বেগম রোকেয়া। আমি সব সময়ের মতন চুপ থাকি। সুফি যখন কথাগুলো বলে, তখন সব সত্য বলে মনে হয়। কিন্তু আবার লাবনী আর রেখাদের মতন জীবন আমাকে বেশি টানে।
লাবনীর হবু বর ওকে দশ মিনিট বাদেই কল দেয়। তাতেও সুফির আপত্তি! ওই ভদ্রলোক নাকি লাবণীকে নজরে রাখছে এখন থেকেই।
সুফি চায়না আমি সাঁতার ক্লাসে যাওয়া শুরু করি। কারণ জানতে চাইলে জবাব মেলে “তুই বুঝবিনা”। সুফি খুব স্পষ্টবাদী আর খুব বেশি সময়ে সঠিক কথা বলে। তাই খানিকটা ভয়ে, খানিকটা অনাগ্রহে আমিও দিব্যি দিন পার করে দিচ্ছি সাঁতার না শিখে।
একদিন জিজ্ঞেস না করতেই সুফি জানালো শুধু আমাদের এলাকায় নয়, বেশিরভাগ সাঁতার শেখার প্রতিষ্ঠান গুলোতে নাকি অনেক দেশি ছেলেদের ভীড় থাকে, যারা দেশি বিদেশি মেয়েদের swimsuit সহ ভেজা শরীর অবলোকনে ওখানে উপস্থিত হয়। সুফি নিশ্চিত যে লাবনী এবং রেখাও তাই চায় আমার জন্যে।
“এতে সমস্যা কোথায় সুফি? আমি তো আর সিরিয়াস বাঙ্গালী নই যে swimsuit আগে কখনো পরিনি।”
সুফি অধৈর্য হয়ে হাত নাড়ে।
“সেটা তো কথা নয় অণু। যেসব ছেলেরা অর্ধনগ্ন মেয়ে দেখতে এক যায়গায় গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, সেসব ছেলেদের কেন প্রশ্রয় দিবি? কেন চাইবি ওদের কেউ একজন তোর জীবনে আসুক?”

সুফির কথা সে মূহুর্তে যৌক্তিক মনে হলেও সে রাতে আমার মনে হল সত্যই সুফির মাথা খারাপ। রেখা আর লাবনী প্রায়ই আমায় মনে করিয়ে দেয় যে আমার ফিগারটা নাকি মডেল দের মতন। পাঁচ ফুট ন’ ইঞ্চি উচ্চতায় গাড় রঙ এর swimsuit এ আমার দিক হতে নাকি দৃষ্টি ফেরানো দায়। সুফি আমাকে অনেক পছন্দ করে সে জানি, তবুও ওতো কখনো এমনতর কিছু বলেনা।
সুফির মতন অত ভাবতে ইচ্ছে করেনা। লাবনীদের মতন আমিও বিশ্বাস করি যে আমার সৌন্দর্য দেখে কেউ যদি আমায় পছন্দ করে এতে সমস্যা কিছু থাকবার কথা নয়।

দ্বীপ…
আমি সাঁতার ক্লাস নেয়া শুরু করেছি। আমার বন্ধুদের কথা অনু্যায়ী চলচ্চিত্রের কাহিনীর মতন কেউ আমার প্রেমে অথবা আমি কারো প্রেমে পড়ে যাব, এসব আমি মানিনা যতই বলি না কেন, মনে মনে আমি সব সময় চেয়েছি কেউ আমায় পেতে চাক। লাবনী আর রেখারা জন্মদিনে আর ভালবাসা দিবসে ফুল আর কেক পায়, তেমনটি আমায়ও কেউ পাঠাক। কই সুফীর মতন কাট কাট কথা বলিনা কারো সাথে! তাও জীবনে প্রেমপত্র পেয়েছি মাত্র একবার।
তখন আমি ক্লাস নাইনে পড়ি। মা সে সময় আমায় সব সময় উপদেশ দিতেন সব ব্যাপারে।
“অণু, তুমি এখন বড় হচ্ছ। এটা জানবে যে, আমার কাছ হতে কখনো কিছু লুকোবেনা। এটা যেন যে আমি হচ্ছি তোমার সব চাইতে বড় বন্ধু।”
সব সময় বাধ্য মেয়ে ছিলাম বলেই হয়তো প্রথম প্রেম পত্রের জবাবে কি লিখবো জিজ্ঞেস করতে গিয়েছিলাম মাকে। ঝাড়া চল্লিশ মিনিট মা আমায় এত কিছু বোঝালেন আমার উঠতি বয়েশ আর পুরুষ জাত সম্পর্কে, যে এর পরের বছর গুলোতে কারো প্রেমে পড়ার সাহস হয়নি। আসলে সুযোগ ও পাইনি। শান্ত আর লাজুক প্রকৃতির হবার কারনে নিজ হতে কখনো কাউকে কিছু বলতেও পারিনি। তার উপর আমার চারপাশের সবার বিয়ে হয়েছে বা সম্পর্ক আছে যাদের সাথে তারা সবাই বাঙ্গালী। আমার high school আর college হতে যেসব অবাঙ্গালী ছেলে আমায় প্রেমের প্রস্তাব রেখেছে সবাই যেন সত্যি চাইতো কিন্তু আবার এটাও বলেছে যে আমি যদি না করি তো তারা অবাক হবেনা। কেন অবাক হবেনা? কারন ওরা আমার culture সম্পর্কে অনেক জানে। জানে যে আমাদের দেশের মেয়েরা সমদেশীয় কাউকে ছাড়া প্রেম করেনা। আমি আর ভুল ভাঙ্গাতে চেষ্টা করিনি। অত কথা কে বলে?
বাঙ্গালী মহলে নাকি অনেকদিন যাবত আমায় নিয়ে অনেক আলোচনা চলছিলো যে এত সুন্দর মেয়ের কেউ একজন না থেকে যায়না। ওরা সবাই নিশ্চিত আমি “booked”। সেদিন আবার লাবনী বলল অনেক ছেলেরা নাকি আমার সৌন্দর্যকে ভয় পেয়ে এগিয়ে আসতে চায় না। ওফ, এত ব্যাখ্যা আর ভাবনায় কে যায়! তাই সব কিছু ভুলে গিয়ে আমি সাঁতার ক্লাস নেয়া শুরু করেছি।

সাঁতার ক্লাশ আমার জীবন আমূল বদলে দিয়েছে। জলের সাথে এমন সখ্যতা! সপ্তাহে তিন দিন পয়তাল্লিশ মিনিট করে। এ পঁয়তাল্লিশ মিনিটে আমি নিজেকে নুতন করে জানি।
ঢেউ এর হিংস্রভাবে আমার প্রতি লোভ নিয়ে তেড়ে আসা, আবার আমারই বাহুডোরে এসে ভেঙ্গে পড়া। আমায় তার বাহির এবং ভেতর সম্পর্কে আবিস্কার করতে দেয়া। আমি ইচ্ছেমতন জলের উপর দাপাদাপি করি। আবার সে জল এ আমাকেই সম্পূর্ণরূপে তার গভিরে একান্ত আপন করে টেনে নেয়।
আমায় আচ্ছাদন করে পরিপূর্ণ ভাবে, কিন্তু সতর্কতার সাথে। জলের সাথে আমি ভালবাসাবাসি খেলি। জল, জল,…জল নাকি সুদীপ?
আদৌ কি খুবই ভিন্ন জল হতে সুদীপ, সুদীপ হতে জল?

সুদীপের সাথে আমার আলাপ হয় যেদিন প্রথম সাঁতার ক্লাসে রেজিস্টার করতে আসি। সব আনুশাঙ্গিকতা শেষে যখন পার্কিং লট-এ আমার গাড়ির দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলাম, অনূভুত হল দুটি চোখ আমায় দেখছে। ভেজা চুল পিঠে লেপ্টে থাকার মতন সুদীপের চোখ আমায় দেখছিল প্রগাড়ভাবে।
সেই শুরু। কখন, কিভাবে, কোথা থেকে কি হয়ে গেল জানিনা। শুধু জানি আমার জগত জুড়ে এখন শুধুই সুদীপ। আমার চিন্তা চেতনায় এখন ওই একজন মাত্র মানুষ।
আমি সাঁতার শিখি পয়তাল্লিশ মিনিট,- ঘড়ি ধরে। বাকি বিকেলটা কাটাই সুদীপের সাথে। সপ্তাহে তিন দিন। ওই তিনটি দিন ছাড়া সপ্তাহের বাকি দিনগুলো যেন অর্থহীন। ওর সাথে মিলিত হবার আগে যে পঁয়তাল্লিশ মিনিট সাঁতার কেটে যায়, সে সময়টুকু মনে হয় যেন সুদীপের সঙ্গ আর স্পর্শের মতই কাম্য। আমি শুধূই জলের সাথে সুদীপের মিল খুঁজে পাই। আমাকে আমার একান্ত করে যে চিনিয়েছে, সে হচ্ছে এই ব্যক্তি। কামনা, তাড়না, পূর্ণতা এসব শব্দের অর্থ যেন শুধু আমিই বুঝি। জানিনা লাবনী আর রেখাদের একই উপলব্ধি হয়েছিল কিনা। জিজ্ঞেস করতে পারবনা। ওরা সুদীপ কে নিয়ে এমন প্রশ্ন করে বসবে যার জবাব আমার অজানা।
আজ অব্দি সুদীপ আমায় কখনো ফোন-এ কল দেয়নি। সেও আগে হতেই জানিয়েছে যে দেবেনা। সমস্যা নেই জানিয়ে আমি ওকে আশ্বস্ত করেছিলাম আমিই কল দেব। তাতেও শুনলাম আপত্তি।
“সপ্তাহে তিন দিন তো দেখা হয়ই, আবার ফোনএ কথা বলাবলির কি আছে?”
স্বভাবগতভাবেই আমি মেনে নিয়েছি। প্রতিবার আমাদের দৈহিক মিলনটা হোটেলে হয় এবং এভাবেই চলবে সেটাও যেমন মেনে নিয়েছি। সুদীপ শুরু হতে স্পষ্ট বলেছে বাহিরের দুনিয়াকে তার ব্যক্তিগত সম্পর্কের ব্যাপারে জানাতে সে বাধ্য নয়। এখানে ওখানে ঘুরতে গিয়ে সময় অপচয় না করে ও যে শুধু আমাকেই চায় এবং কিভাবে চায় সেটা ওই হোটেলের বন্ধ কক্ষে প্রকাশ করতেই ও বেশি পছন্দ করে।
মাঝে মাঝে আমি চাই ওদের জানাতে। কিন্তু সুদীপের বয়েস আটত্রিশ শুনে ওরা যদি হাসে? আর সুফী যে ধমকাবে সেটা তো অবলীলায় বলা যায়। লাবনীকেও আমি ভয় করি। ওর লাগামহীন মুখ কখন কি প্রশ্ন করে বসে কে জানে! যদি জানতে চায় গত ন’মাসে সুদীপ আমায় কি দিয়েছে, কত প্রতিশ্রুতি করেছে, আমি কি জবাব দেব? কি করে বোঝাব আমার কাছে ও শুধুই আমার দ্বীপ, যাকে ঘিরে আমার হ্রদয়ের সব জলের খেলা।
সুফীটা নির্ঘাত ব্যাপারটাকে বড় করে দেখে নারী অপমানের সাথে মিশিয়ে সুখ পাবে। আটত্রিশ হয়ে সুদীপ কেন এখনও একা?
“পুরুষ জাতটাই এমন, বয়েসে ছোট মেয়েদের দেখলে প্যান্ট কখন ছুঁড়ে ফেলবে সে চিন্তা মাথায় ঘোরে।”
সুফীর মন্তব্য অমন হওয়া অবাস্তব কিছু নয়।
রেখাও তার হতাশা প্রকাশ করবে এটা জানিয়ে যে কেন বিয়ের আগে শারীরিক একত্রতা এত প্রকট ছিল? কেন সময় দিলাম না, এবং নিলাম না?
এত এত প্রশ্ন আর মন্তব্ব্যের তীর আমি কি করে সামাল দেব? সুদীপ আটত্রিশ বছরে যেমন কাউকে পায়নি, আমারও চব্বিশ বছরের জীবনে কেউ আসেনি! আর আমি ওকে মুখ ফুটে কি করে বলি যে তোমার ঘরে নিয়ে চলো। তোমার বাবা মায়ের সাথে আলাপ করিয়ে দাও।
সুদীপ কথা দিয়েছে সময়ে সবই হবে। আমি ওর মুখ হতে উচ্চারিত প্রতিটি শব্দকে আকন্ঠ করে, বিশ্বাস করে সেই সময়ের অপেক্ষায় আছি।
সুদীপ বেশি প্রশ্ন শুনতে পছন্দ করেনা। তাই আমিও বেশি প্রশ্নের মধ্যে যাইনা। শুধু জানি আমার জীবনের কেন্দ্রবিন্দু সুদীপ আর তার জীবনের আমি।

আনমনা…
“রাহেলের জীবনের প্রতিটি ঘটনা যেমন আমার জানা, তেমনি আমার ভাল লাগা, পছন্দ-অপছন্দ সবই রাহেলের নখদর্পনে।” গর্বিত রেখা।
আমি একটু থমকালাম। ন’মাস হয়ে গেল তাও সুদীপের বাসস্থান আমার অজানা। ওকে জিজ্ঞেস করতে জবাব দিয়েছিল- “আমায় সন্দেহ করোনা অনু। আমি ছোটলোক নই। আমার সম্পর্কে সবই জানবে, শুধু একটু সময় লাগবে।”
খুব লজ্জা পেয়েছিলাম। সুদীপের ধারনা আমি ওকে সন্দেহ করছি? ছি ছি…তাই কি কখনো হয়?
হঠাৎ আমার হাত ধরে কে যেন টান দিল।
“কিরে, শুনেছিস কি বললাম? তোর কি মনে হয়?” লাবনীর প্রশ্ন।
আমি আবারো সুদীপের ভাবনায় হারিয়ে গিয়েছিলাম।
আমরা চার বন্ধু গল্প করলাম প্রায় পাঁচ ঘন্টা যাবত। বিগত হয়ে যাওয়া পাঁচটি ঘন্টায় কে কি বলেছে কিছুই যেন আমার কর্নগোচর হয়নি। অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম ওরা ওদের গল্প করে যাচ্ছিলো আর আমি ছিলাম আমার আর সুদীপের জগতে বিভোর।
রাত অনেক হয়ে এল। সবাই নিজ নিজ ঘরে ফিরে যাবে। লাবনী, রেখা, আর আমি আমার ঘর হতে বেরিয়ে দেখি সুফী মায়ের সাথে আড্ডারত। আমাদের সবাইকে বেরিয়ে আসতে দেখে দুজনেই চুপ হয়ে গেল। এ নূতন কিছু নয়। সুফীটা বরাবরই মায়ের ভক্ত খুব। আর মাও সুফীকে অনেক পছন্দ করেন ওর স্পষ্ট চিন্তা, দৃঢ়বদ্বতা আর সরাসরি কথা বলার গুনাবলীর জন্নে।
“কিরে অমন তিক্ষ্ণ চোখে কি দেখছিস?” আমি জানতে চাইলায় সুফির কাছে। এ প্রশ্ন সুফী জীবনে নিশ্চয়ই বহুবার শুনেছে। ওর দৃষ্টি বা চাহনি মাঝে মাঝে এত তিক্ষ্ণ হতে পারে যে দেখলে মনে হয় হৃদয়ের সব কিছু বুঝি এই পড়ে ফেলল।
“তোর মাঝে একটা কিছু বদলেছে। একটি নূতন কিছুর বীজ তোর মাঝে এসেছে, সেটা মনে হয় দিন দিন ডালপালা ছড়াচ্ছে। তাই দেখছিরে। তোকে অনেক সুখী দেখাচ্ছে।” সুফির জবাব।
“কি ব্যাপার অনু, কবে কোথায় কিভাবে কার বীজ তোর মাঝে চলে এল, আর আমরা জানতেও পারলাম না!” সেই লাগামহীন মুখের লাবনী।
রেখা আমার উদ্ধারে নেমে এল।
“সুফী মোটেই সেরকম কিছু ইঙ্গিত করে বলেনি। অনুটা এমনিতেই sensitive । শুধু শুধু ওকে ভয় পাইয়ে দিস না তো লাবু।”
যাবার আগে তিনজনই সুর মেলালো যে হ্যাঁ, ওরা বেশ অনেকদিন যাবত আমার মাঝে একটি পরিবর্তন লক্ষ্য করছে। অনেক চাপাচাপি করলো। একটা সময় খুব খারাপ লাগা হতে প্রায় বলেই দিচ্ছিলাম সুদীপের কথা। পরক্ষণেই ওর হুকুম দেবার মতন করে বলা-
“ভাল করে শুনো অনু, আমাদের ব্যাপারে যেন কেউ জানতে না পারে। কেউ না। তোমার বন্ধুরা, মামাত চাচাত ভাইবোনেরা অথবা তোমার বাবা-মা।”
প্রথমে একটু অবাক হয়েছিলেম কেন এত সাবধানতা? আমরা দুজনই প্রাপ্তবয়স্ক, দুজনই এমন বয়েসে এসে দাঁড়িয়েছি যে আমাদের ব্যাপারে বাধা দেবার মতন কেউ থাকার কথা নয়। তাও সুদীপ যখন বলছে, নিশ্চয়ই কোন কারন আছে।
আমি ওকে অভয় দিয়েছিলাম কেউ জানবেনা আমাদের ব্যাপারে। প্রসংগ পাল্টেছি দ্রুত। সুদীপ যখন ওই কন্ঠে কথা বলে, তখন কেমন যেন অচেনা লাগে ওকে।
“কেউ জানবেনা, এটা বলে পার পেয়ে যেতে চাইলে তো হবেনা। তোমার যা মেয়েলী স্বভাব, তাতে তো অনুমান করতে কষ্ট হয়না যে কেউ একটু চাপ দিলে বা কোন চাপ ছাড়াই সব কিছু গড় গড় করে সবাইকে বলে দেবে তুমি। আবারো বলছি অনু, কেউ যেন জানতে না পারে।”
একবার ভেবেছিলাম জিজ্ঞেশ করি, মেয়েলি স্বভাবের হওয়াটা কি দোষের কিছু? আমি তো একজন মেয়েই। কে জানে ও কি বুঝে বলেছে। তর্ক করিনি এটা জেনে যে আমার মেয়েলি স্বভাবের জন্নেই ও আমায় বিশেষ মূহুর্তে বেশি করে চায়।
সুদীপকে দেয়া কথা আমি রেখেছি। কাউকে জানতে দেইনি আমার সুখের উৎস কে।
সে রাতে সুফীর ফোন এলো। ইনিয়ে বিনিয়ে কিছু বলে সময় নষ্ট না করে ও সরাসরী আসল প্রসঙ্গে গেল।
“অনু, তোর জীবনে তুই কার সাথে মিশবি সেটা তোর ব্যাপার।কিন্তু তোকে অনেক পছন্দ করি বলেই এটা বলব যে কখনো আত্মমর্যাদা কারো জন্নে হারিয়ে ফেলিস না। কখনো কাউকে এমন সুযোগ দিবি নে যেন তোকে ছো্ট করে কথা বলে, সে যেই হোক না কেন।”
“হঠাৎ এসব কেন বলছিস সুফী?”
“কেন বলছি যদি নাই বুঝে থাকিস তো আমি বুঝে নেব তুই এখনও নিজেকে হারিয়ে ফেলিস নি। এখনও তুই ঠিক আছিস।”
আদৌ কি আমি ঠিক আছি? সুদীপের প্রেমে আমি মনে হয় যেন চোখে আধাঁর দেখছি।
সুদিপ ও কি তাই? নিশ্চয়ই ও আমায় ততটুকু গভীর ভাবেই চায়। নইলে কেন সব সময় আমার ব্যাপারে ওর এত কৌতুহল? এই যে সেদিনও জানতে চাইলো আমার জীবনে সেই প্রথম কিনা। অবাক হয়ে জবাব দিয়েছিলাম যে অবশ্যই হ্যাঁ!

***************************************************************************************

আজ আমার ছুটির দিন। সকালে ঘুম ভেঙ্গে পর দেখি মা আমার বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে। আমি আদুরে ভঙ্গিতে মায়ের প্রতি হাত বাড়ালাম। মা আমার হাত নিয়ে আমার পাশে বসলেন।
“আমার মেয়ে যে কত সুন্দর সে তথ্য কি তার জানা?”
আমি খুশি হয়ে মায়ের কোমর জড়িয়ে ধরলাম।
“তবুও তোমার মতন সুন্দর কোথায় হতে পারলাম মা?”
“আমি বুঝি লক্ষ্য করিনি সবাই কেমন মুগ্ধ চোখে তাকায় তোমার প্রতি? তোমার বন্ধুরা তোমায় প্রবাসি বাঙালিদের মাঝে অন্যতম সুন্দর ভাবে, সে জান?”
“আমার মা সুন্দর, তাই আমি সুন্দর।” অনেকটুকু খুশি আর অনেকের মাঝে সুন্দর হবার গর্বে আমি শোয়া হতে উঠে বসলাম।
“তোমার বন্ধুরা সত্যি তোমায় অনেক পছন্দ করে অণু। কখনও ওরা যদি কোন কিছুতে ভাল জ্ঞান দেয় তো সেটাকে অবহেলা করনা। বিশেষ করে সুফীটা অনেকের সাথে মিশেছে, জেনেছে মানুষকে। ওর কথাকে ফেলনা মনে করোনা।”
“কেন এসব বলছ মা? আমি তো বরাবরই সবার কথা শুনি।”
“এমনি মনে হল আজ কিছু কথা বলি আমার মেয়ের সাথে। তোমার ভাল মন্দ বোঝার বয়স হয়েছে অনু। যে পথে পা বাড়ালে ব্যাথা পাবার সম্ভাবনা, সে পথে পা যেন দিওনা। জানি তুমি সব সময় সবার কথা শোন খুব। সেটা যেমন ভাল, তেমনি মন্দ দিকও তার আছে। সবার সব কথায় সায় দেবার আগে নিজে নিজে ভেবে নেবে সঠিক কিনা। সায় না দিয়েই একটু ভাবলে ক্ষতি কিছু নেই কিন্তু। এতে জীবনে আঘাত কম পাবে। তুমি একজন নারী। তোমার যথার্থ সম্মান যে ব্যক্তি দেবে…”
মা বলেই যাচ্ছিলেন। কেন যেন রাগ হচ্ছিল। তাহলে গতকাল সুফির সাথে মায়ের এসব নিয়েই কথা হচ্ছিল? আমি কি এতই অবুঝ যে চব্বিশ বছরেও বুঝবনা জীবনে কাকে চাই?
কিন্তু খুব বেশিক্ষন সময় তো মা আর সুফী একা ছিলো না। আড্ডা আমরা সকলে মিলে একসাথেই দিচ্ছিলাম।
“আর বলিস না, ও তো চায় আমায় একেকদিন একেকভাবে দেখতে।” বলছিল রেখা, নকল বিরক্তি কন্ঠে এনে।
“কি বলিস? তাহলে যে তোর বছরে ৩৬৫ টি শাড়ি ব্লাউজ, সালোয়ার এসব লাগবে। শাড়ি ব্লাউজের নিচে যা পরবি সেসবের হিসেব নাইবা ধরলাম।” রেখা লাবনীকে মারতে তেড়ে গেল।
আমি হেসেছিলাম।
ঠিক তক্ষুনি এসব আলোচনায় অংশগ্রহন করতে না চাওয়া সুফী উঠে মায়ের কাছে চলে গিয়েছিলো গল্প করতে।

অন্তর্বাস…
রেখার লাগবে অগনিত। আর আমি গত ন’মাস যাবত একটি ব্রা দিয়ে সমস্ত কাজ সারছি। মায়ের যেমন ভাবতে অবাক লাগে, তেমনি আমারও।
প্রথম যেদিন সুদীপ আমার গোলাপী রঙ এর শার্ট খুলে মেঝেতে ছুড়ে ফেলেছিলো সেদিন সেই শার্ট এর নিচে ছিল আমার অনেকগুলো ব্রাসিয়ারের মাঝে যেটি সবচাইতে আমার বেশি পছন্দের। সাগরনীল অথবা নীলকান্তমণি এ দুটো রঙ এর সংমিশ্রনে যে রঙ তৈরী হয়। আমি জানি আমার ফিগারটা সুন্দর। আমার গায়ের রঙ আর শরীরের গঠন, আর তার উপর এই বিশেষ অন্তর্বাসটির সুন্দর কাট আর ডিজাইন আমায় আরো বেশি আকর্ষনীয় করে তোলে।
সুদীপের সেদিনকার মুগ্ধ দৃষ্টির কথা ভোলার নয়। ও প্রথমে চুমু খেয়েছিল আমার বুকে সেই ব্রা এর উপর। গভীর, নিবিড় একান্ত চুম্বন। সেই একই মাসে যতবার ও আমার পরনে অন্য রঙ এর অন্য ডিজাইনের কিছু দেখেছে, সব শেষে আমাদের ক্লান্ত, বস্ত্রহীন শরীর যখন পাশাপাশি শুয়ে ছিল, ততবারই ওর প্রশ্ন ছিল- তোমার সেই ব্রাটি পরনা কেন?
প্রথম দিন অবাক হয়ে জানতে চেয়েছিলাম- কোনটি?
পরের বার ওই নির্দিষ্ট বক্ষবন্ধনী পরতে ভুল করিনি। আমার শরীরকে সুদীপ যথেষ্ট চায়। আমার যে কোন পোশাকে সব সময় ওর ভীষন মুগ্ধ দৃষ্টি আমায় আলোড়িত করে। কিন্তু ওই একটি রঙ এ সে কি পায় আমি জানি না।
আমাদের তিন মাস একনাগাড়ে মিলনের পর সুদীপ বলেছিল তোমাকে আমি সব সময় এই ব্রাটি পরনে দেখতে চাই। তুমি এখানে আসার আগে যা খুশি পর, কিন্তু আমার জন্নে শুধুই এটি।
সেদিনই বাসায় ফিরে গিয়ে আমি বাদবাকি সব ব্রাসিয়ার ফেলে দেই মায়ের অলক্ষ্যে।
কেন যেন জানতাম বাদবাকি রঙ এর সব অন্তর্বাস আমায় সুদীপের কাছ হতে দূরে সরিয়ে দেবে। ওই একটি বক্ষবন্ধনী আমায় সারাক্ষন এটা মনে করিয়ে দেয় যেন সুদীপ আমার খুব কাছেই আছে। আমার সাথেই আছে। আমায় ছুঁয়ে আছে, আমার বুকের সাথে মিশে আছে।
সুদীপহীন আমার জীবন যেমন ভাবতে পারি না, তেমনি একটিমাত্র ব্রা রেখে বাদবাকি সব ফেলে দিয়ে এখনও নুতন কিছু কেনার কথা ভাবতে পারছিনা। মনে হবে একেকদিন একটি পরছি তো সুদীপকে হারাচ্ছি। ওকে বদলাতে চাচ্ছি।
অন্তর্বাস বদলানোর মতন সঙ্গিকে কি বদলানো যায়? এটা জেনেও আমি এসব হাস্যকর কাজ লুকিয়ে লুকিয়ে করছি। সুফি জানতে পারলে নিশ্চয়ই ধমকে বলবে,- “কিসের সাথে কি তুলনা করছিস?”
যত অদ্ভুতই শোনাক না কেন, আমাদের এক হয়ে যাবার তিন মাস পর ওর যে ইচ্ছে আমায় জানিয়েছে, তা জেনেও আমি কোন ভুল করতে পারবনা।
কত দ্রুত এতটা সময় পার হয়ে গেল! সুদীপের সাথে কথা বলেও কোনমতে ওকে টলানো যাচ্ছেনা। খুব ইচ্ছে করে আমরা একসাথে শপিং এ যাব। ওই বলুক কি কিনব, অথবা ওই কিনে দিক। আমার বিশ্বাস কিছুদিনের মধ্যেই ওকে বুঝিয়ে ওর ভেতর হতে সব জড়তা ঝেড়ে ফেলা যাবে, আমাদের বিষয়ে কাউকে জানানো নিয়ে অথবা একসাথে ঘুরতে যাওয়া নিয়ে।
অবশেষে আমি হোটেলের চার দেয়ালের একটি ঘরের বাহিরের সুদীপকে দেখতে পাব। হোটেল ঘরের নির্জনতা, নিঃশব্দতা আর বিশাল সাজানো গোছান একটি খাটকে দেখিয়ে সুদীপ আমায় সারা সপ্তাহে প্রতিদিন পায় না এমন অজুহাত উপস্থাপন করে এক দিকেই শুধু ইঙ্গিত করবেনা। অবশেষে আমাদের হয়ত একটি বিকেল শুধু হাত ধরে কাটিয়ে দেবার সুযোগ আসবে। অবশেষে আমি সেই সুদীপের সাথে সবার আলাপ করিয়ে দিতে পারব অনেক আনন্দের সাথে, যার বাস শুধুই আমার অন্তরে।

হোঁচট…
তিন সপ্তাহ হতে চলেছে সুদীপের সাথে আমার দেখা হচ্ছেনা। চিন্তায় আমি অস্থির। কি যে করি বুঝে উঠতে পারছিনা। ওর মোবাইল ফোনের নাম্বার আমার কাছে নেই। মাঝে মাঝে ভেবেছি ওকে লুকিয়ে ওর ফোন হতে আমার ফোনে কল দিয়ে নাম্বার নিয়ে নেই। চেষ্টাও করেছি। কিন্তু পরে বুঝতে পেরেছি আমার সাথে যতবার ও সময় কাটিয়েছে ততবার ওর ফোন বন্ধ ছিল। ওর সব কিছু ভাল লাগার মতন এই ছোট্ট কাজটিও আমার ভীষণ ভাল লেগেছিল। যেন আমাদের মাঝে কোন তৃতীয় ব্যক্তি এসে না যায় সেদিকে ওর কত ভাবনা!
কিন্তু এখন কি করি! তিন সপ্তাহ আগে বলেছিল অনু এখন হতে আর সাঁতার শিখতে এসো না।
“মানে?”
“মানে যথেস্ট তো হল। কিছুদিন সাঁতার শেখা বন্ধ রাখলে খুব একটা ক্ষতি নিশ্চয়ই হবেনা।”
“সাঁতার তো আসল নয় দীপ। ওই একটি সময়ই তো আমি তোমায় কাছে পাই।”
সেদিন কেমন যেন অস্থির দেখলাম তাকে। কেমন যেন বিরক্তি আমার প্রতি। না না, আমার প্রতি নয়, অন্য কিছু হয়ত ওকে ডিস্টার্ব করছিল।

তিনটি সপ্তাহ হতে চললো। কোথায় খুঁজি আমি ওকে?
প্রায় দু মাসের কাছাকাছি আজ আমি সুদীপ বিহীন।
মন শান্ত করার জন্যে টিভিতে হিন্দি সিরিয়াল দেখতে যেই বসেছি তখনি মা আমার পাশে এলেন।
“আমার মেয়ের কি হয়েছে? বেশ কদিন যাবত তাকে উদাস দেখছি?”
জবাব এড়িয়ে গেলাম। মা আমায় বুকে টেনে নিলেন। আমার চুলে বিলি কেটে কেটে বললেন
“ছোটবেলা হতেই তুমি ভীষণ naiive। মানুষকে সহজে বিশ্বাস করে ফেল। এ ধরনের মানুষেরা কষ্ট বেশি পায় মা”।
আমি চুপটি করে মায়ের বুকে মাথা রেখে রইলাম।
“কি হয়েছে আমায় বলো অনু, আমার শান্ত মেয়ে কেন হঠাৎ এত অস্থির?”
তাড়াতাড়ি মায়ের বুক ছেড়ে উঠে পরলাম। মায়ের ছোঁয়া, আদর আর কন্ঠ আমার চোখে জল এনে দেবে। পারবনা, মাকে আমি কিছুতেই দীপের কথা এখন বলতে পারবনা। মা জানতে চাইবেন ও কি করে, এদেশে কদিন হল এসেছে, বাবা মা কোথায়…আমি এসবের কিছুই জানিনা। উঠে বাথরুমে গেলাম মুখ হাত ধুতে। বেরিয়ে এসে দেখি মা অপর্ণা মাসির সাথে ফোনে।
“অনু, তোমার অপর্ণা মাসি আজ যেতে বলছে। চলো ঘুরে আসি বিকেলটা।”
মাকে জানিয়ে দিলাম আমার মন ভাল নেই, যাব না।
একটু পর এল লাবনীর ফোন কল। অপর্ণা মাসির আজ পঁচিশ বছর পূর্তি হলো বিবাহিত জীবনের। ওরা সবাই যাচ্ছে। লাবণী মহা উৎসাহী। আমিও যেন যাই।

লাবনীর ভীষণ পীড়াপিড়ীতে আমি তৈরী হতে বসলাম। খুব করে সাজলাম মন হাল্কা করতে। রক্ত লাল একটি শাড়ির সাথে মিলিয়ে হাত ভর্তি রক্ত লাল চুড়ি পরলাম। কপালে একই রঙের টিপ।
সব শেষে মায়ের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। মা হেসে আমায় জড়িয়ে ধরলেন।

“আমার মেয়েকে আজ কেউ যেন নজর না লাগিয়ে দেয়।“

অপর্ণা মাসির এখানে এসেও মন বসছেনা। মাসি বিদেশীদের কি যেন নকল করে সবাইকে হাসাচ্ছেন।
এ বাড়ির সাজ সজ্জা দেখছি বসে বসে। হঠাৎ মনে হলো সুদীপের সাথে আমার বিয়ের পর আমিও ঠিক এমনি করে আমার ঘর সাজাতে চাই।
আবারো সুদীপ! আমার ভাবনায় কি সহজেই না সে চলে আসে। কিন্তু আমার সামনে বাস্তবে কি করে এল হঠাৎ? সত্যিই সুদীপ এখানে, অপর্ণা মাসির বাসায়! ও জানতো আমি এখানে আসব, তাই সারপ্রাইজ দিতে এসেছে? কতই না ভালোবাসে ও আমায়! আমি কি দৌড়ে গিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরব, নাকি হাত নাড়ব? ওফ, আমার যে কি খুশি লাগছে!
অপর্ণা মাসির চীৎকার।
“সুদীপ তুই এসেছিস? ওমা সাথে আবার টুকটুকে বউটি তোর!”
আমার পৃথিবী দুলতে শুরু করেছে।
অপর্ণা মাসি বলেই যাছেন…
“দু বছর হলো বিয়ে করেছিস, আর এ প্রথম নুতন বউ-এর মুখ দেখাচ্ছিস!” মোটামুটি সুন্দরী দেখতে একটি মেয়ে ঝুঁকে মাসিকে প্রণাম করলো। তার পাশে গর্বিত মুখে দাঁড়ানো তার স্বামী সুদীপ।

নবজন্ম…
আমার সরলতা? বোকামো? সবাইকে বিশ্বাস করার প্রবনতা? আমি সুফীর মতন নই তাই আমার রক্তলাল শাড়ি চুড়ির সাথে মিলিয়ে আমার ভেতরের রক্তক্ষরণ? ক্ষমা আমি করবনা। যতটুকু ভালোবেসেছি ঠিক ততটুকু ঘৃণা করবো। ক্ষমার অযোগ্য ওই শয়তান। এত বড় প্রতারণা! কি দেইনি তাকে? কি অন্যায় করেছিলাম আমি? হ্যাঁ অন্যায় আমার পৃথিবীটাকে না বোঝার, সব কিছু প্রশ্নহীন ভাবে মেনে নেবার। সুফীর কথাই ঠিক। নারী হয়ে জন্মেছি বলেই মাত্রাতিরিক্ত শক্ত হতে হবে, অন্য সবার চাইতে বেশি বুদ্ধি নিয়ে সামনে এগুতে হবে। সুফীটা কত সত্যই না বলতো। এত বোকা কেন ছিলাম আমি? কেন ভেবেছি আর দশটা মেয়ের জীবনে ঘটেছে বলে আমার জ়ীবনেও ঘটবে এমন তো নয়! কেন চোখ কান খোলা রাখিনি? কেন? কেন নিজেকে অনেক কিছু শেখানো হতে বঞ্ছিত করেছি? আমি আমার মতন থাকতে চেয়েছি, এই কি আমার অপরাধ? একজন, শুধুমাত্র একজন মানুষের কুচেষ্টা আর প্রতারনাই যথেষ্ট আমার স্বকীয়তা নষ্ট করার জন্য। এবং সে সফল। আমি এখন আর naïve, innocent নই। দেরিতে হলেও আজ আমি অনেক বুঝি। দেরিতে হলেও আজ আমার নিজস্বতা আছে। অপর্ণা মাসি হতে ফোন নাম্বার নিয়ে যখন কল করি, সে ঠিকই বলেছিল চেঁচিয়ে ফোনে – “তোমার মতন বেহায়া মেয়ে মানুষের কাছে আমি কোন কৈফিয়ত দেবার জন্য বাধ্য নই। একটা সম্পর্ক ছিল, এখন চুকে বুকে গেছে, অন্য কোন কাউকে খুঁজে নাও। তোমার মতন মেয়ে যে এক কথায় হোটেলে থাকতে রাজী হয়ে যায়, তার জন্য কিছুই কঠিন নয়।“
হায়রে হায়া! শুধুমাত্র নারীর জন্যই শব্দটির জন্ম। নারী হবেই বেহায়া আর চরিত্রহীন। আর সব হায়া জমা থাকে পুরুষ দের জন্য।
তবে হ্যাঁ, সব সিদ্ধান্ত থাকা উচিত নারীদের হাতে।

ও ছাড়া জীবন অর্থহীন ভেবে হাত কেটেছি, বিষন্নতার এমন এক পর্যায়ে গেছি যে হেসে মরে যেতে পারি। মাসের পর মাস অন্ধকার বন্ধ ঘরে ডুকরে ডুকরে কেঁদেছি। অনেক, অনেক পর স্বজনদের শুভ কামনায়, চেষ্টায় আর তাগিদে ধীরে ধীরে আবারো মনে হচ্ছিলো অন্ধকার সুড়ঙ্গ হতে বেরিয়ে আসছিলাম।
গত পাঁচ-ছ’ মাস অনেক রক্তক্ষরন, অনেক অশ্রু হারানো হয়েছে, আর নয়। আর নয়। উঠে আমি দাঁড়াবোই। আমার এ বিষন্নতা মাকেও বিষন্ন করে তুলছে। একজন বদলোকের কারনে আমার জীবনের ভালো মানুষ গুলোকে শাস্তি কেন দেব? জীবনের একটি ঘটনা আমার বয়স এক ঝটকায় কতটা বাড়িয়ে দিল তা দেখে ও উপলব্ধি করে নিজেই অবাক হলাম। আগে কেন বুঝিনি আমার শরীরকে সুদীপ যেভাবে ব্যবহার করেছে তাতে ভালবাসা অথবা শ্রদ্ধা কোনটাই ছিলনা। তার নিজেকে আড়ালে রাখার প্রচেষ্টা কেন ছিল এখন বুঝি। দুয়ে দুয়ে চার করতে আমার একটু দেরী হয়ে গেল।

আমার জন্ম হতে গত পঁচিশ বছরের পুরনো আমাকে পালটে ফেলার সংগ্রাম এখন। পারব তো? পারব তো আরেকটি হোঁচট হতে নিজেকে রক্ষা করতে? পারতে আমায় হবেই। যেহেতু আমি নারী। আমার জীবনের সিন্ধান্ত আমারই হাতে থাকবে।

মা লিভিং রুমে ফোনে কথা বলছেন। যতদুর বুঝলাম, অপর্ণা মাসির সাথে আমায় নিয়ে আলাপ হচ্ছে। মাসি বোধ হয় কোন একজন সাইকাইয়াট্রিষ্টের সাথে আমার জন্য এপোয়েণ্টমেন্ট নিতে বলছেন।
আমি রুমে ঢুকতেই মা ফোন রেখে দিলেন।
“অনু এসো, তোমার চুল আঁচড়ে দেই। চুল উস্কোখুস্কো, মুখেও কতদিন কিছু দাওনা সে খেয়াল আছে?”
আমি কিছু না বলে কফি টেবিল হতে আমার গাড়ির চাবি নিয়ে বের হবার জন্য দরজা খুললাম।
“একা একা কোথায় যাচ্ছ?” মায়ের উদ্বিগ্ন প্রশ্ন।
“শপিং মলে মা, নুতন ব্রা কিনতে।“