লিখেছেন – স্ট্যানলী অয়ন

প্রতিবার লেখা শুরু করার সময়ই টেবিলের দিকে মাথা নিচু করে বেশ কিছুক্ষণ ধরে ভাবি, কিভাবে শুরু করা যায়। আজও ভেবেছি। শেষ পর্যন্ত আর বিশেষ কিছু খুঁজে পেলাম না। সবসময় খুঁজে পাওয়াটা আবশ্যকও নয়। কারণ কিছু কিছু আনন্দ কে প্রকাশ করার জন্য সহজ, সাবলীল পন্থাই উত্তম।

ছোটবেলায়(বেশি বড় যদিও এখনো হই নাই 😛 ) এদিক-সেদিক থেকে বইমেলার কথা যখন শুনতাম, টেলিভিশনে বাংলা একাডেমী চত্বরে নাম না জানা লেখক-পাঠক দের সাক্ষাৎকার দেখতাম তখন তেমন বিশেষ কিছুই অনুভব করতাম না। ভাবতাম ” ধুরর, বইমেলায় আবার মানুষে কী করে…!!! এর থেইকা বাসায় বইসা টম এন্ড জেরি দেখাই মজা!!” শৈশবের সেই হাস্যকর ভাবনাগুলো এখন অতীত। তবে “টম এন্ড জেরি”র প্রতি ভালবাসা-আকর্ষণ এখনো আছে, চিরকাল থাকবে। সেই সাথে ভালবাসার নতুন জায়গা হিসেবে ধরা দিয়েছে বইমেলা। এ মেলা যেন এখন প্রানের সাথে মিশে গিয়েছে। সেই প্রাণের টানে আবারো ছুটে গিয়েছিলাম মেলা প্রাঙ্গনে।

কিন্তু এবারের বইমেলা ভ্রমনে নিজ প্রাণের উত্তেজনা টা ছিল যেন একটু বেশিই। কারণটা একটু খোলাসা করা যাক। সামাজিক যোগাযোগের বিভিন্ন ওয়েবসাইটের মাধ্যমে এমন কিছু মহৎ মানুষের সাথে পরিচিত হতে পেরেছি যাদের কথা দুই-এক লাইনে বলে শেষ করা হবে অন্যায়। তাদেরকে জেনে বুঝতে পেরেছি দুর্নীতিতে পাঁচ বার চ্যাম্পিয়ন হওয়া এই দেশে এখনো কত মুখোশহীন ভাল মানুষেরা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছেন। অনেকে যখন বলে-” ভাই, এই হারা দুনিয়ায় ভাল মানুষ কই পাবেন? সব গেসে গোল্লায়। ভাই ভাইরে, মা তার সন্তানরে খুন করে। কারে বিশ্বাস করবেন?” তখন তাদের সামনে বেশি কিছু বলতাম না; মনের গহীনে কোথায় যেন একটু আশার আলো দেখতাম কারণ আমার জানা মহৎ মানুষ গুলোর দেখা বাস্তবে না পেলেও তাদের কথা ত শুনেছি। এবারের পহেলা ফাল্গুনে বইমেলা ভ্রমণটা ছিল সেই শোনা গুলোকে বাস্তবে রুপ দেবার দিন।

অতিপ্রিয় রতন দাদা বরিশালে job করেন। পারিবারিক, পেশাগত নানা ব্যস্ততার মাঝেও চলে এসেছেন কাজের ফাঁকে। আমি যখন সবেমাত্র ফাল্গুনের পড়ন্ত বিকেলে “লাল-কমলা রঙের” অগ্নিময় তরুণ-তরুণীর মধ্যে দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে শাহবাগ যাদুঘরের সামনে তখন তার কল-” হ্যাঁ অয়ন, কোথায়?” ফোনটা পেয়ে ভিতরে ভিতরে সত্যিই আবেগাপ্লুত হয়ে পড়লাম। ছোট জীবন পরিসরে কত বন্ধু এল-গেল, ঘনিষ্ঠতাও হয়েছে কমবেশি কিছু জনের সাথে, কিন্তু রতন দার সাথে ত আমার সেরকম কিছু নেই। মাত্র কিছু দিনের পরিচয়, বয়সেও আমার থেকে অনেকটা বড়, দেখাও হবে ওই প্রথম, এত আপন মনে হল কেন! বুঝতে পারলাম একেই বলে সহমর্মিতা, ভাতৃত্ববোধ, মানুষের প্রতি মানুষের অকৃত্রিম সৌহার্দ্য। মেলার প্রবেশ দ্বারে তাকে পেয়ে গেলাম। সত্যিই খুব ভাল লাগল তখন। মেলায় ঢুকে দুইজন কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করলাম। হঠাৎ কালো ফ্রেমের চশমা পরিহিত, গাদাখানি মেকআপ সজ্জিত, বাঙ্গালিয়ানা শাড়ির ভাঁজে মডেল ও অভিনেত্রী নওশিন কে এক ঝলক দেখলাম। রতন দা’র সাথে কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি শেষে দেখা হয়ে গেল বহুল প্রত্যাশিত মানুষ শ্রদ্ধেয়, সুপ্রিয় লেখক অভিজিৎ রায় দাদার সাথে। ভার্চুয়াল জগতে তাঁর সাথে কথা হলেও সামনাসামনি যে ওই প্রথম। দাদাকে নিয়ে যদিও নতুন করে বলার কিছুই নেই। তারপরও একটু না বললেই নয়।

বিজ্ঞান লেখক হিসেবে ডঃ অভিজিৎ রায়ের নাম আজ প্রথম সারিতে। বাংলাদেশে হাতে গোনা মুষ্টিমেয় যে সমস্ত লেখকেরা আধুনিক বিজ্ঞানের সর্বশেষ জ্ঞান এবং তথ্যের নিরিখে সুসংবদ্ধ বিশ্লেষণ সাধারণ পাঠকদের দুয়ারে নিত্য পৌঁছে দিচ্ছেন, অভিজিৎ রায় নিঃসন্দেহে তাদের শীর্ষস্থানীয় কাণ্ডারি। বিজ্ঞান ও দর্শনের জগতে অবাধ বিচরণ তাঁর গুনমুগ্ধ পাঠকেরা তাঁকে অভিহিত করেছেন “বাংলাদেশের রিচার্ড ডকিন্স” হিসেবে। কেউ বা তাঁকে আখ্যায়িত করেছেন শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞান লেখক হিসেবে। বিজ্ঞানের জটিল অথচ রোমাঞ্চকর বিষয়গুলোকে কথাশিল্পের মনোমুগ্ধকর ভঙ্গিতে প্রকাশ করার কঠিন কাজটি খুব সহজেই নিবিষ্ট মনে করে চলেছেন তিনি। তাঁর দুটি গ্রন্থ পেয়েছে “বিজ্ঞানের ক্লাসিক” হিসেবে মর্যাদা। বিজ্ঞানমনস্কতার পাশাপাশি সমাজ সচেতন, যুক্তবাদী, মানবতাবাদী, সত্য সন্ধানে আপোষহীন, নির্ভীক এই মানুষটির প্রতিষ্ঠিত ব্লগসাইট দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্লগসাইট হিসেবে দেশে-বিদেশে ব্যাপক পরিচিতির পাশাপাশি অর্জন করে নিয়েছে শহীদ জননী জাহানারা ইমাম স্মৃতি পদক। তাঁর পিতা সর্বজন শ্রদ্ধেয় ডঃ অজয় রায় এবার শিক্ষা ক্ষেত্রে অবদানের জন্য রাষ্ট্রীয় সম্মাননা একুশে পদক পেতে যাচ্ছেন।

এই অসামান্য, অসাধারণ মানুষটির জ্ঞান, প্রজ্ঞা, অভিজ্ঞতাকে যদি হাতির সাথে তুলনা করি তবে আমি বোধহয় সেখানে এক পিঁপড়ার সমতুল্য। তা হওয়া সত্ত্বেও যখন আমি তাঁকে আমার নাম বললাম তিনি ঠিকই আমাকে চিন্তে পেরেছেন। তাঁর হাসিমাখা একটা মুখ নিয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন ভাল আছি কিনা। তাঁর বিনয়ে সত্যি মুগ্ধ হলাম। ঢাবি তে পড়ুয়া আরেক মেধাবি ভাইয়ার সাথেও পরিচিত হলাম। দাদা আমাদের চটপটি আর cold drinks খাওয়ালেন। খানিক্ষন গল্পবাজি করার পর তাঁর সাথে চলে গেলাম অঙ্কুর প্রকাশনীর স্টলে। স্টলের ভিতর বসে কফি খেতে খেতে তিনি ২০০৫ এ তাঁর প্রথম লেখা বই টা আমাকে উপহার দিলেন তাঁর সাক্ষর সহ। সে এক অবর্ণনীয় অনুভূতি। তাঁর সাথে আরও বেশ কিছুক্ষণ ঘুরে ঘুরে তাঁর লেখা আরও ২-৩ টা অসাধারণ বই কিনে ফেললাম। ইতোমধ্যে তাড়া ছিল বলে রতন দা চলে গেলেন। অভিজিৎ দা’র সাথে থাকার প্রতিটা মুহূর্তেই অবাক হতে বাধ্য হয়েছি। বড় মাপের ব্যক্তিত্বদের অনেককেই দেখেছি দাম্ভিক প্রকৃতির হতে। সস্তা জনপ্রিয়তার ভার বইতে বইতে একসময় অনেকেই আর অন্যকে মানুষ মনে করেন না। কিন্তু তিনি যেন এক্ষেত্রে হাতেগোনা কয়েকজনের মত ব্যতিক্রমী একজন। বিনয়ী, প্রাণোচ্ছল, রসিকতায় পরিপূর্ণ এই মানুষটিকে দেখলে শেখা যায় জীবনে বড় হতে হলে ছোট হবার সাধনাটাই করতে হবে সবার আগে।

বিদায়বেলায় সাভাবিকভাবেই খুব খারাপ লাগছিল। কি আর করার! যাবার সময় হাসি মুখে বললেন-” অনেক ভাল লাগল সময়টা” দাদার বিনয়ের পরিচয় যেন আরও একবার স্পষ্ট হয়ে উঠল। এরকম মানুষদেরই সম্মান করতে, ভালবাসতে, স্মৃতিতে ধরে রাখতে পারা যায়। চাইলেও তাদেরকে ভোলা যায় না। ফেরার সময় অন্য লেখক দের আরও কয়েকটা বই কিনে বের হলাম। টিএসসির কোলাহলপূর্ণ পারিপার্শ্বিকতার মাঝে হাঁটতে হাঁটতে জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ দিনটাকে রোমন্থন করেছি বারবার। আর মনে করেছি- একজন অভিজিৎ রায়, একজন আব্দুল্লাহ আবু সাইদ, একজন পলান সরকার, একজন সুলতানা কামাল, একজন জাফর ইকবাল এদেশটার জন্য কত প্রয়োজন, যারা সকল ভেদাভেদ ভুলে মানুষের কথা বলবে, সুন্দরের কথা বলবে, সৃষ্টির কথা বলবে, পুরনো অন্ধকারকে সরিয়ে নতুন আলোয় পৃথিবীটাকে এগিয়ে নিয়ে যাবে; যে স্বপ্ন প্রতিটি সচেতন আধুনিক মানুষ তাঁর অন্তরে লালন করেন।

ইচ্ছে ছিল বড় না করার, তাও লিখতে লিখতে অনেক দূর চলে এলাম। প্রয়াত বিখ্যাত গায়ক ভুপেন হাজারিকার গাওয়া সেই গানটার লাইন দুটো দিয়েই শেষ করি আজ

” মানুষ মানুষের জন্যে
জীবন জীবনের জন্যে”
সত্যিই তো তাই………… :)) 🙂 :))