“জীবনে যদি লোকটা একটা কোন কাজ আদৌ শিখে থাকে, সেটা হচ্ছে বইপড়া”-এরকম কিছুই একটা আমার এপিটাফে লেখা যেতে পারে। সৈয়দ মুজতবা আলীর ভাষায় ঠিক ‘পাঁড় পাঠক’ না হলেও মোটামুটি পড়ার অভ্যেসটা আমার যথেষ্ট পুরনো এবং আপন। রজার বেকন বলেছিলেন, লোকেরা পড়ে তিনটে কারণে, ক্ষমতা, অলংকার এবং বিনোদন।

ক্ষমতা বাড়ানোর জন্যে বইপড়া মানে জ্ঞানের বা অন্য কিছুর বৃদ্ধি ঘটানো যাতে অন্যদের ওপর খবরদারি করা যায়। বই পড়ে বলার বা লেখার ভাষা সুকারুমণ্ডিত করার জন্যেও লোকে আগ্রহী হতে পারে। আর পড়ে আনন্দ পাওয়ার জন্যে তো লোকে নিশ্চয়ই পড়ে, সেটা কাশেম বিন আবুবকর বা হুমায়ূনের বইয়ের কাটতি দেখলেই বোঝা যায়।

আমার জ্ঞানজগত সীমিত, ভাষা মনোহারী নয়, যদিও দুটোরই কিছুটা চেষ্টা ছিলো এবং আছে। তবে আমি মূলত আনন্দ বা বিনোদন পাওয়ার জন্যে বইয়ের নেশায় আটক। ‘Reading for pleausre’ পড়েছেন কি কেউ? ঠিকাছে, অন্তত শ্রীহট্টনিবাসী সৈয়দবংশীয় মুজতবা আলী কী বলেছেন শুনুন তাই।

“ভেবে-চিন্তে অগ্র-পশ্চাৎ বিবেচনা করে বই কেনে সংসারী লোক। পাঁড় পাঠক বই কেনে প্রথমটায় দাঁতমুখ খিঁচিয়ে, তারপর চেখে চেখে সুখ করে এবং সর্বশেষে সে কেনে ক্ষ্যাপার মত, এবং চূর হয়ে থাকে তার মধ্যখানে। এই একমাত্র ব্যসন, একমাত্র নেশা যার দরুণ সকাল বেলা চোখের সামনে সারে সারে গোলাপী হাতী দেখতে হয় না, লিভার পচে পটল তুলতে হয় না।”

আমি ভবযন্ত্রণায় আচ্ছন্ন এবং তারপরেও কিছুটা কেনার আর পড়ার চেষ্টা করে যাই এখনো। কী আর করা, ছোটবেলায় বদভ্যেসটার হাত থেকে মুক্তি আর মেলে না কিনা! কাগজের ছেঁড়া টুকরো থেকে আন্তর্জালে লেখালেখি, যা পাই সবই পড়ার চেষ্টা করি, বুঝি বা না বুঝি। ফেসবুকের একটা একাউন্ট আছে, সেখানেও জনসমুদ্রের নানা আবেগের উৎসারণ পাঠ করে যাই অনবরত। এমনি করেই ফেসবুকে এক দিন দেখি আমায় যুক্ত করা হয়েছে ‘বইপড়ুয়া’ নামের একটা দলে। একে নাচুনি বুড়ি, তাতে আবার ঢোলের বাড়ি। বেশ মেতে গেলাম সেখানটায়। বই নিয়ে, বইয়ের ভাষ্য নিয়ে, লেখক নিয়ে, দাম নিয়ে, প্রকাশনা নিয়ে, এমনকি প্রচ্ছদ নিয়েও সেখানে বেশ আলোচনা চলে। বয়েসে ছোট হয়েও অনেকে দারুণ পড়ুয়া, অনেকে সুনির্দিষ্ট বিষয়ে বিশেষজ্ঞ, কেউ কেউ আবার কবিতাও খায়, কেউ নীরব পাঠক বা সরব লেখক। সব মিলিয়ে বেশ একটা স্বাস্থ্যকর হেজেমোনি আর কি।

এবার ডিসেম্বরে ভাবা হলো একটা বই বের করা যাক ‘বইপড়ুয়া’ দল থেকে। প্রথমে প্রস্তাবটা ছিলো এমন: বইপড়ুয়ার একটা ই-বই বেরিয়েছিলো কিছু দিন আগে ‘আমার প্রিয় বই’ নামে। সেখান থেকে কিছু লেখা নিয়ে আরো কিছু নতুন লেখা লিখিয়ে একটা বই বের করা যাক। পরে সেটা বাতিল হয়ে ঠিক করা হয় একটা অনুবাদের কথা। রুশি কল্পবিজ্ঞান লেখক আলেক্সান্দর বেলিয়ায়েভের নাম হয়তো অনেকেই শুনে থাকবেন। ‘উভচর মানুষ’ নামের বিখ্যাত উপন্যাসটিও হয়তো পড়ে থাকবেন অনেকে। তাঁর আর কোন উপন্যাস বাংলায় অনূদিত হয় নি, কোন বাংলাতেই নয়। আমাদেরই এক সদস্য অদিতি কবির তাঁর একটি উপন্যাস সুদূর ইয়াঙ্কি দেশ থেকে আনিয়েছিলেন, বেলিয়ায়েভের প্রথম উপন্যাস ওটা। নাম ‘প্রফেসর ডয়েলের মস্তক’ (১৯২৫), প্রকাশক: ম্যাকমিলান। অনুবাদের কাজও শুরু করেছিলেন কিছুটা, কিন্তু পরে প্রকাশকের সাথে আর বনিবনা না-হওয়ায় কাজ এগোয় নি। এবার তিনি আমাদের অনুরোধে কাজটা শুরুই করে দিলেন। এই বইপাগল ভদ্রমহিলা চাকরি সুপ্রচুর পরিমাণে ফাঁকি দিয়ে দিনরাত খেটেপিটে অনুবাদখানা নামিয়ে দিলেন জানুয়ারিতেই। এর জন্যে কোন টাকা তো নেনই নি, উলটো বরং নিজের গাঁটের কড়ি খসিয়েছেন বহুল পরিমাণে। অন্যেরাও অনেকে যথাপ্রযুক্ত সঙ্গত করেছেন প্রকাশনাটির বাস্তবায়ন ঘটাতে। শেষমেষ ওটা মেলায় এলো গত ১৮ তারিখ সন্ধ্যেয়, শনিবারে। অভিজিতদা বইয়ের প্রথম ক’জন ক্রেতার এক জন ছিলেন। সুতরাং, মুক্তমনাদেরও বইটা কেনা ফর্জে আইন বটে। প্রসঙ্গত, বইটার অনুবাদ শেষ করার পর মিজ কবির চাকরিটাই দিলেন ছেড়ে।

বইটা নিয়ে দু’চার কথা বলার আগে কিছুটা আলাপ করা যেতে পারে দেশের বইয়ের বাজার, পাঠক ইত্যাদি নিয়ে। অবশ্য আমার অজ্ঞতা এবং তথ্যের সামগ্রিক অপ্রতুলতার কারণে আলাপটা বিশালাকৃতির হবে না সেই ভরসা দিতে পারি। তবে, এটুকু বাদ দিয়ে যেতে পারেন যদি এসব কচকচিতে বিশেষ আগ্রহ না থাকে।

অন্তত এ নিয়ে নিশ্চয় মুক্তমনাদের কোন দ্বিমত নেই বা থাকা উচিত নয় যে বই পড়ার অভ্যেস আমাদের গড়ে তুলতেই হবে। একটি মাত্তর বই পড়ে সারা জীবন বেশ নিরুপদ্রবেই কাটিয়ে দেওয়া যায়। কিন্তু মুক্তমনা হতে গেলে মনন বিক্ষত এবং ভাবনা বিরক্ত করে এমনি প্রচুর বই পড়তেই হয়, নইলে স্বর্গলোকে গতি নিশ্চিত। বিটিডব্লিউ, কোন ধর্মীয় স্বর্গে কিন্তু বইয়ের প্রতুলতার কোন বিবরণ নেই। কাজেই আমার ওদিকে তেমন আগ্রহ নেই। মোদ্দা কথা, ধ্রুব কোন সত্যে আস্থা না-রাখার কঠিন শিক্ষা এবং নমনীয় মানসিকতাটা অহরহ বজায় রাখার জন্যে জানার আগ্রহ বজায় রাখতে হবেই এবং বই হাতে তুলে নিতে হবেই। নইলে নাস্তিককুলেও ভক্ত প্রহ্লাদের জন্মগ্রহণ অস্বাভাবিক হবে না। কে যেন সেদিন ফেসবুকে বললেন এবং যথার্থই বললেন যে, “বই পড়লে ছাগু হয় না।” মোটের ওপর কথাটা পঁচানব্বই ভাগ সত্যি। বাকি পাঁচ ভাগে ধরুন জাকির নায়েক, হারুন ইয়াহিয়া, ডঃ শমসের আলী-এঁয়াদের নিবাসনিকেতন। এছাড়া, মার-কিষ্ট ছাগু, উজবুক-তাড়িবীর ছাগু, কিংবা অন্য কোন জাতীয় সংখ্যালঘু ছাগু, সবই এই দলে পড়বে। এই লেখাটা পড়ে নিতে পারেন বিশিষ্ট সংখ্যাগুরু ছাগুদের মূল তত্ত্ব জানার জন্যে।

বই পড়তে হবে তো নিশ্চয়, কিন্তু সেরকম বই কি পাচ্ছি? আমাদের বাসের বড় শহর ছেড়ে একটু যদি মফস্বলে যাই, তাহলে বইয়ের দোকানে কী দেখবো? হুমায়ূন-মিলন-জাফর-আনিসুল-কাশেম-মুরাদ-বেহেশতি জেওর-মোকছুদুল মোমেনীন-স্বামী স্ত্রীর গোপন মিলন বা দাম্পত্যজীবন-বেহেশতি কুঞ্জিজাতীয় বইয়ে কি দেশের মুক্তি হবে বা সংকীর্ণতা দূর হবে মানসিকতার বা বিজ্ঞানমনস্কতা বাড়বে বা অর্থনৈতিক অগ্রগমন ঘটাতে উৎসাহিত হবে জনতা? উত্তর দিলে পাবেন এক কোটি টাকা, কে দেবে কে জানে! তাহলে দেখা যাচ্ছে বই পড়তে হবে প্রচুর এবং সেরকম ভালো বইয়ের প্রকাশ বা প্রচার ঘটছে না যা আমূল নাড়া দেবে মানসিকতায়, সাম্প্রদায়িকতা-পরমতঅসহিষ্ণুতা-ধর্মীয় গোঁড়ামির নোংরামি উচ্ছেদ করবে মন থেকে, দেশপ্রেম-মানবপ্রেম-যুক্তিপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করবে সবার অন্তরাত্মা, বা স্রেফ নির্মল বিনোদন দেবে কিংবা উন্মেষ ঘটাবে আরো সব শুভকৃত্যের যা বই সম্পাদন করতে পারে।

বইয়ের বাজারের একটু খবর নেওয়া যাক। বইমেলাতেই এটা সুস্পষ্টভাবে ধরা পড়ে। এবারের বইমেলায় এখনো অবধি প্রায় ২৫০টা বই বেরিয়েছে। তার মধ্যে গড়ে যদি একেকটা বইয়ের প্রায় ৫ ফর্মা করে আকার হয় এবং ৫০০ কপি করে ছাপা হয় এবং প্রতি ফর্মার উৎপাদন খরচ যদি গড়ে ১৫ টাকাও ধরি (হার্ডকভার ও ৮০ গ্রাম অফসেট কাগজে ছাপা হলে, লেখককে সম্মানী বা রয়েলটি দিতে হলে, বিজ্ঞাপন ও আনুষঙ্গিক খরচ যোগ এটা ১৩-২০ টাকা অবধি যায়), তাহলে প্রতিটা বইয়ের খরচ পড়ছে =(৫x৫০০x১৫)=৩৭,৫০০ টাকা। মানে ২৫০টা বইয়ের উৎপাদন খরচ পড়ছে = (৩৭,৫০০x২৫০) = ৯৩,৭৫,০০০ বা প্রায় এক কোটি টাকা। এই খরচ নেহাতই আনুমানিক এবং আসল খরচ হয়তো আরো বাড়বে। সারা বছরে যদি অন্তত এর তিনগুণ বই বেরোয়, তাহলে আন্দাজ করা যায় মোটামুটি কোটি তিনেক টাকা যায় উৎপাদনে এবং বিক্রয়মূল্য প্রতি ফর্মা ২৫ টাকা ধরলে অন্তত সাড়ে চার থেকে পাঁচ কোটি টাকার ব্যবসা হয়তো হয় সারা দেশ জুড়ে এক একটি বছরে। অবশ্য এখানে ধরে নেওয়া হয়েছে উৎপাদিত সব বইই একই বছরে বিক্রি হয়ে গেছে, যেটা প্রায়ই হয় না। অবশ্য পাঠ্যবইয়ের বাজার এখানে একেবারেই ধরা হয় নি। যদি ধরেও নেই এক বছরে বইয়ের বাজারে নতুন-পুরনো-পাঠ্য-অপাঠ্য-পাইরেটেড পুস্তক মিলিয়ে যদি এমনকি সত্তর-আশি কোটি টাকাও হাতবদল হয়, তারপরও বলতেই হয় ষোল-সতের কোটি জনসংখ্যার দেশে সেটা নিতান্তই নগণ্য। এবং এই বইয়ের বাজারের আরো বিশাল পরিমাণে সম্প্রসারণ প্রয়োজন।

নিজেকেই প্রশ্ন করা যাক, আমরা ‘অপাঠ্য সব পাঠ্য’-এর পেছনে কত খরচ করি?

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রাক্তন গভর্নর এবং প্রখ্যাত ব্যাংকার লুৎফুর রহমানের আরেকটি পরিচয় আছে যেটি হয়তো অনেকেই জানেন না। রম্যরচনায় তিনি সিদ্ধহস্ত ছিলেন। তাঁর সম্ভবত দুটি বই বেরিয়েছিলো মুক্তধারা থেকে। সেরকম একটি বইয়ে অনেক আগে একটি কথা পড়েছিলাম যা এখনো মনে আছে। তিনি জানাচ্ছেন (আমার নিজের ভাষায় বলছি): “আমাদের দেশে ছেলেরা বই পড়ে চাকরি পাওয়ার জন্যে আর মেয়েরা পড়ে বিয়ের জন্যে। ছেলেরা চাকরি পেলে আর মেয়েরা বিয়ে করলেই তাদের পড়ার পালা শেষ হয়ে যায়।” এই প্রসঙ্গে সমরেশ মজুমদারের ‘মেয়েরা যেমন হয়’ বইয়ে দেখি (সত্যি ঘটনা) এক জন সম্ভাব্য সুপাত্র নিয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে মেয়ের বাবা উদ্বেগ প্রকাশ করছেন যে ছেলে বিকেলে অফিস থেকে এসে বই পড়ে! ব্যাপারটা তিনি ঠিক বুঝে উঠতে পারছেন না। চাকরি করে আবার বইপড়ার মানে কী! মানে, বইপড়ার ব্যাপারটা ঠিক স্বাভাবিক অভ্যেস হিসেবে আমাদের দেশে পুরোপুরি দেখা হয় না।
বছরে পাঁচ হাজার টাকা কি আমরা বইয়ের পেছনে খরচ করি একেকটি শিক্ষিত পরিবারে? পাঠ্যবই বাদ দিলে বোধহয় এই সংখ্যা খুব বেশি হবে না। আবার নতুন বইয়ের দামও নেহাৎ কম নয়। মুদ্রাস্ফীতির এই বাজারে বইয়ের মূল্যবৃদ্ধির জন্যে অনেকে হয়তো চাইলেও বই খুব বেশি কিনতে পারছে না। তার মানে বইয়ের দামও প্রকাশক কমাতে পারবে না কারণ উৎপাদন সে বেশি করতে পারছে না। ঘুরেফিরে আমরা আবারো মুজতবা আলীর ‘বই কেনা’ প্রবন্ধের সেই ‘অচ্ছেদ্য চক্র’-এর ফেরে পড়ে যাচ্ছি। বলা বাহুল্য, এই চক্রে বোধহয় অন্তত অন্যপ্রকাশ পড়ে না, কারণ হুমায়ূন আহমেদের প্রায় বই-ই তারা প্রকাশ করে এবং বইমেলার এক মাসে তাঁর প্রতিটি বইয়েরই একাধিক সংস্করণ হয় এবং প্রতিটি সংস্করণ নিশ্চয় কয়েক হাজার কপির। স্টলটির সামনে আগ্রহী ক্রেতার লাইন দেখলেই সেটা মালুম দেয়। আর ‘অবিশ্বাসের দর্শন’ পাঁচশ কপি শেষ হতেই প্রায় ন-দশ মাসের মতো লেগে যায় হয়তো।

তবে, বইয়ের দাম কমলেই যে লোকে হুড়মুড়িয়ে বই কিনবে এমন অনুসিদ্ধান্তে এসে যাওয়াটাও বোধহয় নিতান্ত ছেলেমানুষি হয়ে যাবে। আন্তর্জালে প্রচুর বাংলা বই বিনামূল্যে পড়া বা সংগ্রহ করা যায়, কিন্তু সেখানেও নিশ্চয় ঐ হুমায়ূন-আনিসুল-মামুন-কামাল-ইকবাল গোষ্ঠীরই রাজত্ব বা হয়তো তাও অতোটা নয়। মূল অনুঘটক সেই বই পড়ার এবং তার ফলে কেনার অনভ্যেস।

বইপড়ার অভ্যেস যাদের আছে, তাদের নিয়ে সেরকম বিশাল কোন জরিপ বা ইত্যাদি আমার দৃষ্টিগোচর হয় নি, তবে প্রকাশকদের ভাষ্যমতে সবচে বেশি চলে উপন্যাস, তার পরে ছোটগল্প-কবিতা, এর পরে প্রবন্ধের বই-টই এসব। মানে, মাথা খাটানোর বা মাথা কাজে লাগানোর বইয়ের প্রচার খুবই সীমিত। বিশ্বে বইয়ের বাজারে বাঙালির অবদান কিছুটা ছিলো সাহিত্যে। নীরদ সি চৌধুরীর মতে অবশ্য কবিতা ছাড়া বাঙালির বিশ্বসাহিত্যে সেরকম মানসম্মত কোন ছাপ নেই। না বিজ্ঞানে, না ইতিহাসে, না দর্শনে, না মননশীল কোন কাজে। লেখকের তো এই দশা। আর পাঠকের সেই সাহিত্যপ্রীতিও কোন পর্যায়ে সেটা ওয়াকিফমহল মাত্রই জানেন আর যাঁরা জানেন না, তাঁদের ঢেঁড়া পিটিয়ে জানানোর দায়িত্ব নিতে আমি যথেষ্ট বিব্রতবোধ করবো। শরৎ যে কী ক্ষতি করে গেলেন বাংলা সাহিত্যের!

কাজেই নতুন লেখক উৎসাহ পান না, নতুন বিষয় নিয়ে লেখালেখি হয় না, নতুন ধারণা জন্ম নেয় না বর্ষায় ব্যাঙের ছাতার মতো অনায়াসসুলভ হয়ে। আমরা সাম্প্রদায়িক-ধর্মীয় রাজনীতিকে গালি দেবো প্রাণভরে, রাজনীতির কুৎসিত অবস্থা নিয়ে সবার বিশেষজ্ঞ মতামত জাহির করবো চায়ের কাপে ঝড় তুলে, অর্থনীতির বেহাল দশা সম্পর্কে মার্ক্স-কেইনস-অমর্ত্য সবাইকে ফেল করিয়ে সমাধান দিয়ে ফেলবো আলোর গতিতে, কিন্তু ‘আউটবই’ পড়তে দেখলে সন্তানদের বেদম ঝাড়বো, উপহার হিসেবে বইয়ের কথা মুখে তো দূরে থাক, মনেও আনবো না, বইপাঠকদের বেকুবি ও ‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌পিছিয়ে-পড়াটাই ধরে নেবো স্বতঃসিদ্ধ হিসেবে এবং অবহেলা বা ব্যঙ্গ করবো প্রাণভরে। ব্লগে হয়তো আজ কাল কিছু নতুন বাতাস বইছে, কিন্তু সেখানেও খুব বেশি আশাবাদী আপাতত হতে পারছি না। প্রথমত, আন্তর্জাল সংযোগ আছেই বা কজনার আর ব্লগ পড়েনই বা কজন, বরং ফেসবুকাসক্ত প্রজন্মই চোখে পড়বে বেশি। এছাড়াও, ব্লগ থেকে দুয়েকটা প্রকাশিত সংকলনের প্রচার আর বিক্রয়ের ক্ষেত্রে যা দেখেছি, সেটাও খুব বেশি উচ্ছল করে নি। নিরাশাবাদী নই, তবে প্রভাবটা অন্তত আপাতত বেশ স্বল্পমাত্রার, সেটাই বলছি আর কি।

বলতে চাইছিলাম আসলে ‘প্রফেসর ডয়েলের মস্তক’-এর কথা। কিন্তু, প্রচুর অন্যপ্রসঙ্গ নিয়ে বকবকিয়ে এখন মুখের ভেতর বেশ তেতো স্বাদ পাচ্ছি। যাহোক, যদি সম্ভব হয় বইটা কিনবেন, প্রচার করবেন অন্যদের কাছে, উপহার হিসেবে দেবেন অন্যদের। পাবেন লিটল ম্যাগাজিন চত্বরের ‘সুনৃত’-এর স্টলে। মূল্যমান ২৫০ টাকা, কমিশন বাদে হয়তো ২০০।

প্রফেসর ডয়েলের মস্তক

আপনাদের আনুকূল্যই আমাদের উৎসাহিত করবে হয়তো ভবিষ্যতে এমন কোন বই প্রকাশে যা হয়তো সংকীর্ণতা থেকে মুক্ত করবে এক জনকে, মানবতায় উদ্বুব্ধ করবে দুজনকে, নারীদের সম্মান দিতে শেখাবে তিন জনকে, সাহিত্যের সৌন্দর্যে মুগ্ধ করবে চার জনকে। বিন্দু বিন্দু করেই তো এমনি ভাবে এগিয়ে যায় দেশ, জাতি আর সভ্যতা। ‘ডাস ক্যাপিটাল’ পড়েই তো এক জন বার্নার্ড শ’ তাঁর লোকভয় জয় করেন, রাস্কিন আর তলস্তোয় পড়ে গান্ধী নিজের জীবনের দিশা খুঁজে পান, হোমারের অনুবাদ পড়ে আলোডিত ওডিসি পড়ে কিটস লিখে বসেন এক কালজয়ী কবিতা

আমরা যদি নিজেরাই বই না কিনি, তাহলে কিভাবেই বা আর আশা করি সকালের বা অন্ধকারের ঘোর কাটার?